মহা-জীব-সৃষ্টি-রহস্য উন্মোচন
- Maharshi MahaManas
- Jun 30, 2018
- 12 min read
Updated: Jul 1, 2018
মহা-জীব-সৃষ্টি-রহস্য উন্মোচন
মহর্ষি মহামানস

(মহর্ষি মহামানস-এর ‘মহাবাদ’ গ্রন্থ হতে গৃহীত আত্মধ্যান-লব্ধ মহাতত্ত্ব-জ্ঞান কান্ড— বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।)
‘সেই মহাবিস্ফোরণ! —সেই মহাশূন্য জুড়ে আতসবাজীর খেলা, এ’ সবই দূরস্মৃতি আজ। শুধু কাজ আর কাজ— পিছনে তাকানোর মতো একটুও সময় নেই হাতে। তবু তারই মাঝে, ক্ষণেকের জন্যে আনমনা হয়ে যাই, —ডুবে যাই স্মৃতির গহ্বরে।’
আদি জীব —এককোষী অনুজীব এবং আদি-উদ্ভিদ সৃষ্টির মূল নিহিত রয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুলেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই মহা বিস্ফোরণ এবং তৎপরবর্তী অসংখ্য বিস্ফোরণগুলির মধ্যদিয়ে আদি জীবকোষ এবং আদি উদ্ভিদকোষের মূল উপাদানগুলি সৃষ্টি হয়ে— ছড়িয়ে থাকে সমস্ত মহাবিশ্ব জুড়ে। পরে, সেগুলি বিভিন্ন পরিবর্তিত অবস্থার মধ্য দিয়ে— এক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আস্তে আস্তে একত্রিত ও রূপান্তরিত হয়ে, আদি জীব ও আদি উদ্ভিদ কোষের বীজাকার ধারণ করে।
আরও অনেক পরে, মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বর শরী্রের বিভিন্ন স্থানে— জীব বিকাশের অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি পেয়ে, তারা ক্রমে প্রস্ফূটিত হতে থাকে এবং ক্রমশ কোষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে বংশবৃদ্ধি ক’রে চলে—।
অতি শৈশবকাল পেরিয়ে, একটু বয়স হতেই— একটু জ্ঞান হতেই, ঈশ্বর এদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। শিশু-ঈশ্বর অবাক-বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে, তার বিশ্ব-শরীরের নানা অংশে নানা প্রকারের অতি স্বল্প-চেতনা সম্পন্ন বহু সংখ্যক অদ্ভূত অদ্ভূত কি যেন সব সৃষ্টি হয়েছে।
অতি ক্ষুদ্র দেহধারী— অতি নিম্ন-চেতনা সম্পন্ন এই অনুজীবগুলির বিচিত্র আকার, বিচিত্র আচরণ তাকে আকৃষ্ট ক’রে তোলে। সে আরও লক্ষ্য করে, তার বিস্তৃত দেহাঞ্চলের নানা স্থানে নানা প্রকারের অত্যন্ত নিম্ন-চেতনার অজস্র অণু-উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়েছে— আপনা থেকেই।
শিশু-ঈশ্বরের কৌতুহলী মন অত্যন্ত উত্তেজিত এবং আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠে এই সমস্ত আদিজীব ও আদিউদ্ভিদের ব্যাপারে।
প্রথম অবস্থায়, জীব ও উদ্ভিদ— কারো সচেতন ইচ্ছার দ্বারা সৃষ্ট হয়নি। পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে— মহা-সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অনিবার্য ফলস্বরূপ, স্বয়ম্ভূত সৃষ্টি হলো— আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদ।
অন্যভাবে বলা যায়, বীজ বা তদবীজাকারে এ’সবই ছিলো মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বর শরীরের মধ্যেই। পূর্বনির্ধারিতভাবে (‘ভাগ্য’ দ্রষ্টব্য) অনুকূল স্থান-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতি পেয়ে, একসময় অঙ্কুরিত হয়েছে সেই বীজ।
আমাদের শরীরে যেমন নানা প্রকার পরজীবী— অনুজীব, কীট-কীটানু, ছত্রাক প্রভৃতি বিদ্যমান, ঈশ্বর শরীরে আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের স্থান কতকটা তেমনই। জীবাণু ও ছত্রাকের মতো আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদগুলিও ঈশ্বর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শিশু-ঈশ্বরের সবিশেষ পর্যবেক্ষণে ধরা পরে— এদের জীবন-চক্র, এদের কর্মধারা, জন্ম—মৃত্যু, বংশবৃদ্ধি প্রভৃতি। গভীর আগ্রহ এবং মনোযোগের সাথে এদের ক্রিয়া-কলাপ দেখতে দেখতে, শিশু-ঈশ্বরের মাথায় নানারকম চিন্তা-ভাবনা, ধরণা-কল্পনার উদয় হতে থাকে। ক্রমশ শিশুসুলভ খেলার নেশায় মেতে ওঠে সে। গবেষক-শিল্পী-মন জেগে ওঠে সৃষ্টির তাড়নায়।
ঈশ্বর তার যৌবনকাল পর্যন্ত— বিকাশের বিভিন্ন স্তরে, তার মানসিক অবস্থা এবং ক্ষমতার বিভিন্ন মাত্রায়, এই স্বয়ম্ভূত আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের ধারণার ভিত্তিতে, আপন মনের নানা রূপে—রঙে—রসে —নানা কল্পনায়, বিভিন্ন মাত্রার চেতন উপাদানে এবং তার শরীর-উপাদেনে, তার দেহ-আঙিনার ‘ল্যাবরেটরী-কাম-স্টুডিও’-তে একের পর এক সৃষ্টি ক’রে গেছে বিভিন্ন প্রকারের জীব ও উদ্ভিদ।
মনমতো না হলে— ভেঙেছে, আবার গড়েছে। সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে— কাটিয়ে দিয়েছে তার শৈশব— কৈশোর, এবং যৌবনের অনেকটা অংশ পর্যন্ত।
সৃষ্টির প্রথমদিকে— আজকের এই মানুষ ছিলো তার (শিশু ও কিশোর ঈশ্বরের) কল্পনার বাইরে। তবে ছিলো, তা’ চেতনার অনেক গভীরে— সুপ্ত হয়ে ছিলো বীজাকারে। এই এত প্রকারের জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টি তার দ্বারা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি স্বয়ম্ভূত আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের দেখা না পেত সে। কল্পনাতেই আসত না এ’সব। এই অসংখ্য প্রকার বিচিত্র-দর্শন জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টির পিছনে ভিত্তিমূল কিন্তু ওরাই। ‘আইডিয়া’-টা এসেছে ওখান থেকেই।
পরে, সৃষ্টি পরম্পরার মধ্য দিয়ে, —একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা —উন্নয়নের বা ‘ডেভালপমেন্ট’-এর হাত ধরে এগিয়ে গেছে সৃষ্টি-লীলা। তবে, সৃষ্টির সব রূপ ও ধারণা যে ঈশ্বর-মন থেকেই এসেছে— তা’ কিন্তু নয়। গড়তে গিয়ে অনৈচ্ছিক ও আকস্মিকভাবেও অনেককিছু সৃষ্টি হয়ে গেছে অনেক সময়।
আমাদের ক্ষেত্রেও অমন হয়, অনেক সময়— পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে, অনেককিছু গড়তে গিয়ে— অদ্ভুত অদ্ভুত আশ্চর্যজনক কত কি সৃষ্টি হয়ে যায়। —যা ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি নয়।
আমাদের মতো ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও। তখন, ঈশ্বর-মন অনুমোদন করলে— তা’ রয়ে যায়, নইলে ভেঙে ফেলা হয় তাকে আবার। এই ভাঙা-গড়া বেশি ঘটেছে ঈশ্বরের অল্প বয়সে। পরিণত বয়সে এইরূপ ঘটনা তুলনায় অনেক কম।
জীবের এই পরিবর্তন— এই রূপান্তর, সব জায়গায়— সব কালে— সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে ঘটেনা। স্থান-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সেই জীবের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী, বিভিন্ন জীবের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার, বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিভিন্ন প্রকারে পরিবর্তিত— বিভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে সৃষ্ট হওয়া জীবগুলি ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির এবং ভিন্ন ভিন্ন আচরণ সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে।
এইভাবে পরিবর্তন ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেও জীব বৈচিত্র সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানুষ এক স্থানে এবং একই মানব গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে না থাকায়, মানুষের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন হয়েছে সবচাইতে বেশি। বর্তমানে, অধিকাংশ মানুষই পূর্বোক্ত পরিবর্তন ও মিশ্রণের ফলে— এক সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বুকে এত জীব-বৈচিত্র সৃষ্টি হওয়ার পিছনে— ঈশ্বরের ঐচ্ছিক ভূমিকা ছাড়াও, রয়েছে জীবের আভ্যন্তরীক (পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার স্বার্থে) পরিবর্তন, এবং যৌনমিলন ঘটিত মিশ্রন রূপ জাগতিক ব্যবস্থার অনৈচ্ছিক ভূমিকা।
যে কোনো সৃজন কর্মের মতোই, জীবসৃষ্টির বিভিন্ন ধাপে— ঈশ্বরকে নানা প্রকারের বাধা—বিঘ্ন—সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এবং তার সমাধান ক’রে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। তবে সব বাধা— সব সমস্যাই যে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে, তা’ নয়। কখনো বাধা সরিয়ে— কখনো ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, কখনোবা হার মেনে নতি স্বীকার ক’রে, আবার কখনো তার প্রভাব— আধিপত্য মেনে নিয়ে এগিয়ে গেছে সে।
এখানে একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, ঈশ্বরকে সৃষ্টির প্রথম থেকেই সর্বজ্ঞ— পূর্ণ চেতনাময় ভেবে বসলে, ভুল হবে। তারও চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে আস্তে আস্তে একটু একটু ক’রে, ধাপে ধাপে— অতি শৈশব থেকে ক্রমবিকাশের পথ ধরে। চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার সৃষ্টিতেও উন্নত মন ও চেতনার ছাপ পড়েছে। ক্রমশ উন্নত হয়েছে তার সৃষ্টি। উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে তার সৃষ্টি-কলার।
পরবর্তীকালে, ঈশ্বর তার গভীর পর্যবেক্ষণে— বিস্ময়ের সঙ্গে একটি জিনিষ লক্ষ্য করে—, এই অনুজীব ও জীবগুলির অনেকেই পরিবর্তীত পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম। এমনকি, নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে, এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদেরকে অল্প-স্বল্প পরিবর্তীত করতেও সক্ষম। যারা সক্ষম নয়, তারা বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।
এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক, প্রচলিত বিবর্তনবাদ— (জীবের ক্ষেত্রে) পূর্বোক্ত পরিবর্তন সক্ষমতার উপর ভিত্তি ক’রে ধারণা করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই— অনেক জীব বহুকাল ধ’রে একটু একটু ক’রে পরিবর্তীত হতে হতে, একসময় তারা নতুন নতুন রূপ ধারণ করেছে বা রুপান্তরীত হয়েছে।
বাস্তবে এমনটা কিন্তু ঘটেনি। এ’ক্ষেত্রে, ঈশ্বরই জীবের এক একটা প্রাথমিক মডেলকে ভিত্তি ক’রে— ক্রমশ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণার মধ্য দিয়ে, একের পর এক উন্নয়ন বা ডেভালপমেন্ট ঘটানোর ফলেই— নতুন নতুন জীবের উদ্ভব হয়েছে। যারফলে, নতুন রূপে সৃষ্ট জীবের সাথে— উন্নয়নের পর্যায়ক্রম অনুসারে তাদের পূর্ববর্তী ধাপের জীবের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য— অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
জীব নিজের থেকে— নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে, তা’ প্রধানতঃ সহনগত— আচরণগত পরিবর্তন। এক্ষেত্রে অল্প-স্বল্প বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটলেও, আভ্যন্তরিন পরিবর্তনটাই এখানে প্রধান। এছাড়া, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলে— চেহারার ও অভিব্যক্তির যেটুকু পরিবর্তন ঘটে থাকে, এক্ষেত্রে সেইটুকুই পরিবর্তন হয়। বড় রকমের আকারগত পরিবর্তন সে ঘটাতে পারেনা। বড় রকমের যে সমস্ত পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য ক’রে থাকি— সে সবই ঈশ্বর কৃত।
জাগতিক বিভিন্ন সৃজন কর্মের মধ্যে— স্রষ্টার বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে। এটা একটু সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে অনুসন্ধান করলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। আর বুদ্ধিমত্তাকে অনুসরণ করলেই পাওয়া যাবে সেই বুদ্ধিমান স্রষ্টাকে। প্রচলিত অনেক ধর্মীয় দৃষ্টিতেই —ঈশ্বর সর্বজ্ঞ! বাস্তবে তা’ নয়, একটু একটু ক’রে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে তারও মনোবিকাশ ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে এখনো।
মনে রাখতে হবে, সেই আদি জীব কোষের উপর ভিত্তি করেই— স্রষ্টা তার শিশু-চেতনাকে সম্বল ক’রে সৃষ্টি-কর্ম শুরু করেছিলো। একটু একটু ক’রে তার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে, অতি ধীর গতিতে তার সৃষ্টি-কর্ম এবং এই সৃষ্টির উন্নয়ন ঘটেছে। সৃষ্টিলীলার চলার পথে ঘটেছে নানা ঘটনা, অনেক ভাঙা-গড়া। অনেক বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে, দীর্ঘকালের গবেষণা এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে, ক্রমশ উন্নত চেতনা সম্পন্ন জীব সৃষ্টির চাহিদার ফলে, এক সময় মানুষ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। আমাদের কম্পিউটার ও রোবট সৃষ্টির মতোই— কতকটা, ঈশ্বরের জীব-সৃষ্টি কান্ড।
সৃষ্টির পিছনে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছে যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি, তাদের মধ্যে প্রধান হলো— খেলার মজা, সৃষ্টির আনন্দ, নিজেকে— নিজের খেলার ঘরকে নব নব রূপে সাজিয়ে তোলা, এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের বিস্ময়ানন্দ লাভ, একাকীত্ব দূরীকরণ, জীবনের একঘেয়েমী কাটিয়ে জীবনে বৈচিত্র আনা, এবং বিভিন্ন পথে কামেচ্ছার পরিতৃপ্তি ঘটানো। আর, তার পাশাপাশি— পরমাত্মা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেছিলো, —সে’ তো আছেই।
প্রথমদিকে সৃষ্ট জীব এবং তাদের জীবনযাত্রার পিছনে ঈশ্বরের অনেকাংশে প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও, পরবর্তীকালে তা’ ক্রমশই কমতে থাকে। ঈশ্বর তার প্রৌঢত্বে পৌঁছে, শেষদিকে তার আর কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি দর্শকের ভূমিকাও নয়। একবার শুরু ক’রে দেবার পর, জাগতিক ব্যবস্থাক্রমে পূর্বনির্দিষ্ট মতো, সৃষ্টি চলছে— চলতেই থাকছে। সৃষ্টি-স্থিতি-গতি-লয়ের চক্রে— যখন যা ঘটার ঘটে চলেছে।
উচ্চ চেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ সৃষ্টির পর, ঈশ্বর তার যৌবনের দ্বিতীয়ার্ধে ক্রমশ উচ্চতর চেতনা লাভের সাথে সাথে, আস্তে আস্তে এইসব পুতুলখেলা ছেড়ে দিয়ে— আত্মজিজ্ঞাসাক্রমে আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আত্মপরিচয় জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। সেই সঙ্গে তার দোসরের খোঁজে— মিলনের আর্তিতে কাতর হয়ে ওঠে। সৃষ্টি তার নিজের মতো চলতে থাকে। সেদিকে তাকানোর মতো সময়— ইচ্ছা— মানসিক অবস্থা তার আর নেই।
ঈশ্বর তার সৃষ্টির শেষদিকে, উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ সৃষ্টি করেছে, তার উচ্চ চেতনা এবং পূর্বলব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে। এই মানুষ অনেকাংশে তার সন্তানের মতো। এই মানুষ ক্রমশ বিকশিত হয়ে, বিভিন্ন স্তরে— ক্রমোন্নতির মধ্য দিয়ে, বহু পথ পেরিয়ে— একসময় তার চেতন স্তরে এসে মিলিত হবে তার সাথে। মানুষ সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের অন্যতম ইচ্ছা এই—। মানুষের মনকে সে সেই ভাবেই তৈরী এবং ‘প্রোগ্রামিং’ করে রেখেছে।
প্রথমদিকে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক ছিলো— খেলনা পুতুল এবং তার খেলুড়ের মতো। পরে, কতকটা যেন— প্রভু আর তার পোষ্য-র মতো। সেখানে সৃষ্ট জীব— তার স্রষ্টাকে ঠিকমতো জানেনা, ভালোভাবে চেনেনা। চেনা ও জানার মতো অত জ্ঞান ও চেতনা নেই তার। শেষ পর্যায়ে সৃষ্ট জীব— মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা সন্তান ও জন্মদাতা পিতা/মাতার মতো। এই মানুষ এক সময় স্রষ্টাকে জানতে পারবে। ক্রমশ স্রষ্টার মানসিক স্তরে উন্নীত হতে পারবে, —এই কামনারই ফসল হলো— মানুষ।
ঈশ্বর প্রথমদিকে কম চেতনার কারণে— মোহের বশবর্তী হয়ে, তার সৃষ্ট সন্তানতুল্য মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি, পূজাদি কামনা করেছে এক সময়। সাধারণ মানুষ যেমন কামনা ক’রে থাকে। পরবর্তীকালে তার চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে— তার এই চাহিদা ক্রমশই অন্তর্হিত হয়েছে।
মানুষ কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরের সন্তান নয়। তবে সন্তান তুল্য। জীব ঈশ্বরের দেহজ ও মনোজ হওয়া সত্বেও, সে ঈশ্বরের সন্তান নয়। সন্তান হতে হলে তাকে— সর্বতোভাবে ঈশ্বরের সমস্ত দেহ-মনের অনুরূপ হতে হবে। যা নির্দিষ্ট প্রণালীর মধ্য দিয়ে বীজাকার থেকে ক্রমশ বিকশিত হয়ে, এক সময়— ঈশ্বরের মতো রূপ-গুণ-ক্ষমতা লাভ করবে। ঈশ্বর সৃষ্ট সমস্ত জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের খন্ড মন ও খন্ড শরীর থেকে। ঈশ্বরের পূর্ণাবয়ব তাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায়— সংকেতাকারে বিদ্যমান থকলেও, নির্মান পদ্ধতির কারণে কোনোদিনই তা’ উজ্জীবিত হবেনা, বিকশিত হবার সুযোগ পাবেনা কোনোদিন।
একমাত্র, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। মানুষ হলো ঈশ্বরের যৌবনের ফল, সৃষ্টিলীলার শেষদিকের সৃষ্টি। —ততদিনে ঈশ্বর অনেকটাই পরিণত হয়েছে, সেই সঙ্গে তার সৃষ্টিও হয়েছে অনেক উন্নত। কালক্রমে ঈশ্বরের মধ্যে বাৎসল্য রসের ক্রিয়া শুরু হওয়া সত্বেও— সন্তান সৃষ্টির সুযোগ না থাকায়, তাকে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে— মানুষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।* সেই অর্থে মানুষ— ঈশ্বরের তৈরী নেহাত খেলনা পুতুল অথবা নিছক শিল্পকলা নয়। অনেকাংশে সন্তান বা সন্তানবৎ সে।
ঈশ্বর মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছে, যাতে সে ধাপে ধাপে ক্রমোন্নত ও ক্রমোবিকশিত হয়ে, এক সময় তার নাগাল পেতে পারে। সেখানে সন্তানের মতো স্বতন্ত্র বিশ্বরূপ— ঈশ্বর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা না থাকলেও, আছে একসময় ঈশ্বর-চেতন স্তরে উপনীত হওয়ার— ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা।
বহু পূর্বের কথা। যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগে থেকেই— বেশ কয়েক পর্যায়ে জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়ে গেছে। ঈশ্বরের জীবসৃষ্টি লীলার প্রায় মধ্য পর্বের কোনো এক সময়—
পৃথিবী তখন পূর্ণ যুবতী। কামাসক্তা ঋতুমতী নারীর মতোই— তখন তার চেহারা ছিলো অপরূপা মনোমোহিনী অতিব রমনীয়া। নানা রঙের বিচিত্র ভূষণে সজ্জিতা সে তখন। পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত জলাশয়— জলাভূমি এবং তার সংলগ্ন স্যাঁতসেঁতে ঊষ্ণ-আদ্র তৃণভূমি, আর ঘন বনাঞ্চল—। বিচিত্র— পরিবর্তনশীল তখন তার প্রেমাস্পদ আকাশের রঙ।
মাঝে মাঝেই— পৃথিবী গরম হয়ে উঠছে, আর তারপরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে প্রেমরস-ধারা বর্ষণ। কখনো মুষলধারায়, কখনো ঝিরঝির ক’রে অবিশ্রান্তভাবে ঝরে পড়ছে জীবন-রসের ধারা। যেন অবিরাম রমনক্রিয়া চলছে আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যে। আর সেই বারিধারার সাথে অঝোরে নেমে আসছে নানাপ্রকার জৈব-রাসায়নিক পদার্থ। ঝরে পড়ছে— অসংখ্য শুক্রকীটসম জীব-বীজ কণা। আর তার সাথে, জীব উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা জৈব উপাদান।
তৃণভূমি— ঝোপ-ঝাড়, বন-বাদাড়ের মাঝে মাঝে, পাথরের খাঁজে— ফাঁক-ফোঁকরে, চারিদিকে অদ্ভূত সব আঠালো লালাময় পদার্থ জমে আছে। স্বচ্ছ— জেলির মতো লালচে, সবজেটে নানা রঙের পদার্থ।
তারই মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও ফোস্কার মতো— একটু একটু ক’রে খুব ধীর গতিতে ফুলে উঠছে— গর্ভাশয়ের মতো জীব-সৃষ্টির আধার। কিছুদিনের মধ্যেই সেই ঈষৎ স্বচ্ছ অসংখ্য বেলুনের মতো প্রকৃতির গর্ভাশয়ের মধ্যে— একটু একটু ক’রে দৃশ্যমান হতে থাকে, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে জীবদেহের অস্তিত্ব।
সাধারণত, এক একটি গর্ভাশয়ের মধ্যে একটি ক’রে জীব। এইভাবে, এক এক সময়ে— এক এক স্থানে একই রকমের বহু জীবের উৎপত্তি হতে থাকে। ক্রমশ ভ্রুণটি পূর্ণতা প্রাপ্ত হলে, সেই গর্ভাশয় ছিন্ন ক’রে বেরিয়ে আসে সদ্যজাত শিশু প্রানীটি।
এ’দৃশ্য এখন আর দেখা যাবে না। পৃথিবী তার যৌবন পেরিয়ে এসেছে। এখন তার রজঃনিবৃত্তিকাল। এখন টিকে থাকা প্রাণীরা, নিজেরাই বংশ বৃদ্ধি ক’রে— চরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বুকে। শুধু তা’ই নয়, আকাশ থেকে আর বর্ষিত হয়না সেই কাম-রস-ধারাসহ আদি জীব-বীজ-কণা। এখন বর্ষিত হয় প্রাণরূপী জল, যা পৃথিবীর জীব ও উদ্ভিদ জগতকে সজীব করে রেখেছে।
স্বল্পায়ু— ক্ষুদ্রাকার জীবগণ সৃষ্টির কিছু সময় পরেই, তারা খাদ্য সংগ্রহে সক্ষম হয়ে ওঠে। দীর্ঘায়ু— বৃহদাকার জীবদের খাদ্য সংগ্রহে সক্ষম হয়ে উঠতে— বড় হয়ে উঠতে বেশ সময় লাগে। তাই তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা—, প্রকৃতির গর্ভাশয়টির গায়ে অনেকগুলি ছোট ছোট থলি বা বেলুনের মতো দুগ্ধবৎ একপ্রকার পানীয় ভর্তি আধার থাকে তাদের জন্য। সদ্যজাত জীব এই পানীয় পান ক’রে বড় হয়ে ওঠে। পরে সেই পানীয় শেষ হয়ে গেলে, নরম থলথলে বেলুনটাকেই কয়েকদিন ধরে আস্তে আস্তে খেয়ে— আরো বড় হয়। তারপরে তারা নিজেরাই (ঈশ্বর কর্তৃক তাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত পূর্ব-নির্দেশরূপ ‘প্রোগ্রাম’ অনুসারে) খাদ্য সংগ্রহে সক্ষম হয়ে ওঠে।
এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র প্রথম সৃজনকালের জন্যে। তারপর থেকে, জীব মস্তিষ্কে ঈশ্বরের ‘প্রি-প্রোগ্রামিং’ করা পূর্বব্যবস্থা মতো, জীব তার বংশবৃদ্ধি, আত্মরক্ষা, বংশরক্ষা, খাদ্য সংগ্রহ প্রভৃতি কর্ম ক’রে চলে আপনা থেকেই।
ঈশ্বরের পিছনদিকের বিভিন্ন চেতন-স্তরে, বিভিন্ন সময়কার ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান ও বিভিন্ন মাত্রার চেতনানুসারে, তার মনোভাব এবং বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে, বিভিন্ন সময়ে— বিভিন্ন প্রকার জীব সৃষ্টি করেছে সে।
প্রথম স্তর বাদে* পরবর্তী প্রতিটি চেতন স্তরেই** ঈশ্বর যেমন একাধিক মন*** এবং কয়েকটি নিষ্ক্রিয় বা সুপ্ত মনের অধিকারী, ঠিক তেমনই ঈশ্বরের বিভিন্ন চেতন-স্তরে সৃষ্ট বিভিন্ন জীবও একাধিক মনের অধিকারী। যদিও তাদের চেতন-স্তর জীব সৃষ্টিকালীন ঈশ্বর-চেতন-স্তর থেকে অনেক নিম্ন স্তরের। তবু তারা ঈশ্বরের দেহ-মন-প্রাণ ও চেতন উপাদানে নির্মিত হওয়ায়, তাদের মানসিক গঠন কিছুটা ঈশ্বরের নিম্ন-চেতন-স্তরের অনুরূপ।
আদিম মানবেতর জীব সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের মনরূপ ‘সফটওয়ার’-এর অতি সীমিত কার্যক্ষমতা সম্পন্ন সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বা ‘লিমিটেড-ভার্সান’-এর ‘কপি’ দ্বারা। আদিম-মানব সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের মন-সফটওয়ারের সীমিত ক্ষমতা সম্পন্ন ‘আপগ্রেডেড ভার্সান’-এর কপি থেকে। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে— পরবর্তী আরো ‘আপগ্রেডেড ভার্সান’ মন-সফটওয়ার -এর ‘কপি’ থেকে। মানবেতর জীবদের ক্ষেত্রে চেতনা বিকাশের বিশেষ সুযোগ নেই, যেমন আছে মানুষের ক্ষেত্রে।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, জীবের চেতন-স্তর ঈশ্বরের (জীব সৃষ্টিকালের) পূর্বাবস্থার কোনো এক চেতন-স্তরের অনুরূপ অথবা অংশত অনুরূপ হলেও, জীবের দেহাকৃতি ঈশ্বরের তুলনায় অতিব ক্ষুদ্র হওয়ায়, ঈশ্বর-শরীরের মধ্যেই তার অবস্থান হওয়ায় এবং বহুকিছুর উপর তার সক্রিয়তা ও টিকে থাকা নির্ভর করায়, আর সেখানে তার যথেষ্ট স্বাধীনতা না থাকার ফলে, জীবের শক্তি-সামর্থ হয় অতি সামান্যই।
সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, জীব— ঈশ্বর সৃষ্ট হলেও, সামগ্রিকভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে তার দেহগত (জৈব— অজৈব প্রভৃতি) পার্থক্যের কারণ ঘটেছে— জীব সৃষ্টির ভিত্তিমূল এককোষী আদি জীব— অনুজীব হওয়ায়, জীব-চেতনাকে ঈশ্বর-চেতনার নিম্নস্তরের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে।
ক্ষুদ্র হলেও, জীবের মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের মতো ঐরূপ নানা মনোস্তর। কিছু সুপ্ত, আর কিছু জাগ্রত ও সক্রিয়— আংশিকভাবে। ঈশ্বরের বিকাশের প্রতিটি স্তরেই একাধিক মনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাই জীবের মধ্যেও রয়েছে একাধিক মনের অস্তিত্ব— ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র রূপে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
*মনোপদ্মের ‘ডায়াগ্রাম’ দেখুন, এটি ঈশ্বর মনোবিকাশের একটি প্রতীকী তালিকা।
**ডায়াগ্রামে দেখানো মনোবিকাশের স্তরগুলির মধ্যে রয়েছে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্তর। আবার প্রত্যেকটি স্তরের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিভাগ— কর্মবিভাগ।
***প্রতিটি মনোস্তরে একটি মন বেশি সক্রিয়, —যে সবচাইতে বেশি বিকশিত। আর, পরবর্তী মনোস্তরের বিকাশযোগ্য মনটি— পূর্বের মনটির তুলনায় কম বিকশিত এবং কম সক্রিয়। প্রধান ভূমিকায় যে সক্রিয় মনটি রয়েছে, তার পূর্বস্তরের (তৎপূর্বেই) পূর্ণবিকশিত মনটি বিকাশের স্তর ভেদে, হয় সে সবে সুপ্তাবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে, আর নয়তো পুরোপুরি সুপ্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
মানুষের মধ্যে দুটি মন এখন সক্রিয়। ঈশ্বরের দিক থেকে দেখলে, একটি হলো— শিশু-মন, অপরটি হলো— কিশোর-মন। আর, জীবের দিক থেকে দেখলে— একটি হলো— আদিম-মানব-চেতন-মন, এবং অপরটি হলো— মানব-চেতন-মন। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের যুবক মনোস্তরে। যুবক মনোস্তরের মধ্যেও রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক স্তর। আর সেই সব স্তরে উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন চেতন-স্তরের মানুষ, —পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। পরবর্তীকালে তাদের মিশ্রন এবং চেতনার ক্রমবিকাশের ফলে আরো উন্নত মানুষের সৃষ্টি হয়েছে।
জীব-চেতনার সঙ্গে ঈশ্বর-চেতনার সম্পর্ক মোটামুটি নিম্নরূপ—
আদি জীবের চেতনা— ঈশ্বরের ভ্রুণ অবস্থার প্রথমার্ধের চেতন-স্তরের মতো।
ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্ট জীবের চেতনা— ঈশ্বরের ভ্রুণ চেতনার দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সদ্যজাত শিশু-ঈশ্বর-চেতনার মধ্যে। ঈশ্বর নিজে সেই সময়— পরিণত শিশু-চেতন স্তরে।
পরবর্তী জীবের চেতনা— ঈশ্বর তার পরিণত শিশু-চেতন স্তর থেকে কিশোর-চেতন স্তরের মধ্যবর্তী সময়ে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বহু স্তরে, বহু প্রকারের সূক্ষ্ম চেতন পার্থক্য সম্পন্ন বহু জীব সৃষ্টি করেছে। এইসব জীবের চেতনাবস্থা ঈশ্বরের অতি শিশু-চেতন স্তরের মধ্যে।
মানব পূর্ব জীব— বানর ও নর-বানর স্রেণীর জীব, এবং আদিম মানুষের চেতনা— ঈশ্বর তার কৈশোর শেষে, সদ্য যৌবন থেকে যৌবনের প্রথমার্ধের প্রথম পর্বের মধ্যে এদের সৃষ্টি করেছে। এদের চেতনাবস্থা ঈশ্বরের অতি শিশু-চেতন স্তরের শেষ পর্ব থেকে শিশু-চেতন স্তরের প্রথমার্ধের মধ্যে।
মানব চেতনা— বিভিন্ন পর্যায়ে মানব সৃষ্টিকালে ঈশ্বর তার যৌবনের দ্বিতীয়পর্ব থেকে দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম পর্বের মধ্যে অবস্থান করেছে। সৃষ্টিকালে বিভিন্ন পর্যায়ের মানব-চেতনাবস্থা, —ঈশ্বরের শিশু-চেতনার দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কিশোর-চেতন স্তরের প্রথমার্ধের মধ্যে। পরে ক্রমশ চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে মানব-চেতনার বিকাশ ঘটে চলেছে।
মানুষের বিকাশ প্রক্রিয়া— বহু সময় নিয়ে, অতি ধীর গতিতে অগ্রসর হইয়ে চলেছে। সাধারণভাবে একটি মানুষের জীবদ্দশায় তার মনের বিকাশ ঘটে অতি সামান্যই। বংশানুক্রমে বহু পুরুষ পরেও, মানুষের বিশেষ উন্নতি হতে দেখা যায় না। বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং বহুল ঘটনাবলী সাপেক্ষে, এবং জাতি মিশ্রণের ফলে, তৎকালীন কিছু বিশেষ উন্নতি ঘটলেও— তা’ একটা সীমায় পৌঁছে আর তেমনভাবে এগোয় না। কখনো কখনো খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কিছু বেশি বিকাশ ঘটতে দেখা যায়।
ঈশ্বরের চেতনাও খুব ধীর গতিতে বিকাশমান। জীব সৃষ্টির পরে— ঈশ্বর তার চেতনা-বিকাশের পথে সচেতনভাবে এগিয়ে যায়। ক্রমশ তার পরবর্তী ক্রমোচ্চ চেতন-মন জাগ্রত হতে থাকে। মানবেতর জীব পিছনেই পড়ে থাকে। আর উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ, ঈশ্বরের পিছনে পিছনে অগ্রসর হতে থাকে।
সাধারণভবে মানবেতর জীব ক্রমবিবর্তীত এবং ক্রমবিকশিত হয়ে পরবর্তী উচ্চ-চেতনা সম্পন্ন জীবে পরিণত বা পরিবর্তীত হয় না। তবে ব্যতীক্রমী ঘটনাও ঘটে, একাধিক ভিন্ন ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন ভিন্ন চেতন-স্তরের জীবের মধ্যে মিশ্রন বা মিলনের ফলে, নতুন রূপ বা চেহারার কিছু উচ্চ চেতনার জীব সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে। তবে সেটাই মূল স্রোত নয়।
ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরীসৃপ থেকে পশু, পশু থেকে আদিম মানব, এবং আদিম মানব থেকে ক্রমোন্নত হয়ে সচেতন মানবের সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি জীবের মধ্যে ২/৩টি মন বা চেতন-স্তরের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায়, এবং পাশাপাশি দুটি নিকট স্তরের জীবের মধ্যে দেহ ও মন লক্ষণে অনেক সাদৃশ্য থাকায়, এবং পরবর্তী স্তরে সৃষ্ট জীবের মধ্যে পূর্ববর্তী স্তরের জীব থেকে কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হওয়ায়, স্বভাবতই মনে হতে পারে, বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বুঝি এদের উৎপত্তি হয়েছে।
কিন্তু তা’ নয়। একটি জীব বিবর্তিত হয়ে পরবর্তী ক্রমোচ্চ চেতনা সম্পন্ন জীবে পরিণত বা রুপান্তরিত হয়নি। প্রতিটি বিশেষ শ্রেণীর জীবের উৎপত্তি হয়েছে— ঈশ্বর সৃষ্ট সেই শ্রেণীর জীব-বীজকোষ বা ডিম্বকোষ থেকে (পূর্বোক্ত প্রক্রিয়ায়) প্রস্ফূটিত হয়ে।
ঈশ্বর অনেক সময়েই— তৎকর্তৃক পূর্বে সৃষ্ট কোনো বিশেষ প্রকৃতির জীবের ছাঁচ বা মডেলের উপর কিছু পরিবর্তন —পরিবর্ধন ঘটিয়ে, পরবর্তী আরেক প্রকারের জীব সৃষ্টি করেছে।
যদিও আপাত দৃষ্টিতে, ঈশ্বর তা’ সৃষ্টি করলেও, আসলে, আগের থেকেই— মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরু থেকেই, সমস্ত কার্যক্রম প্রস্তুত এবং নির্ধারিত হয়ে আছে। আমাদের সমস্ত কাজ-কর্ম এবং আমাদের সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে— আমরা যেমন নিমিত্ত মাত্র, ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও তা’ই। ঈশ্বর তথা এই জগতের সমস্ত কিছুই অনিত্য। উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষের ক্ষেত্রে, তার চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটলেও, সংকর জাতির মানুষের মধ্যে বিকাশের ধারাবাহিকতা সবার ক্ষেত্রে সবসময় একভাবে ক্রম-ঊর্ধমুখী হয় না। তবে অসুস্থতা ব্যতীত, বিকাশের গতি কারো ক্ষেত্রেই কখনো নিম্নাভিমুখী নয়।
মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের অবনতি, অথবা উচ্চ চেতনা সম্পন্ন কোনো পিতা/মাতার —তদপেক্ষা নিম্ন চেতনা সম্পন্ন সন্তান হলে— তা’ বিকাশের অধঃগতি বোঝায় না। প্রথম ক্ষেত্রে, বিকাশ হলো— মোটের উপর সুস্থ মনের এক স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব-ক্রিয়া। বিকাশ-পথ থেকে সরে আসা বিশেষ অসুস্থ মন বা মস্তিষ্কের অবনতিকে বিকাশের পশ্চাৎগতি ধরা হয় না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সংকর জাতির পিতা/মাতার মধ্যে বহু সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্পন্ন চেতন-স্তরের বংশবীজ উপস্থিত থাকায়, আপাতদৃষ্টিতে বিকাশের এই উত্থান—পতন পরিলক্ষিত হলেও, সার্বিক দৃষ্টিতে বিকাশ ক্রমশই ঊর্ধমুখীই থাকে।
এমনকি কোনো সদাচারী নিরীহ ভদ্রলোককে যদি বিশেষ অসুস্থতার কারণ ছাড়াই, পরবর্তীকালে উশৃঙ্খল— অনাচারী— কদাচারী হতে দেখা যায়, সেক্ষেত্রেও বিকাশ অধঃগামী বলা যায় না। মনে রেখো, একটি নিরীহ তৃণভোজী পশুর থেকে একটি ভয়ানক হিংস্র-ফন্দিবাজ শিকারী পশুর চেতনা অনেক বেশি হতে পারে।
একজন একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছিল, প্রশ্নটি হলো— ‘হাজার হাজার বছর আগেও বেশ কিছু উচ্চ চেতনার মানুষ ছিল, কিন্তু তাদের বংশধররা গেল কোথায়? —এতো দিনে ক্রমবিকশিত হয়ে তাদের তো আরো অনেক বেশি উচ্চ চেতনার মানুষ হয়ে ওঠার কথা! কিন্তু কই, তেমন মানুষের তো দেখা মেলা না।
তাদের অনুপস্থিতির কারণ, বংশধারার গতিশীল বহু শাখা-প্রশাখার কোনো একটির অগ্রবর্তী ব্যক্তি যথেষ্ট উচ্চচেতনা সম্পন্ন হলে, সাধারণত তার আর বংশবৃদ্ধির চাহিদা থাকে না। এইরূপ মানুষের— পৃথিবীর ভোগ শেষ হয়ে যাওয়ায়, বংশধারার সেই উচ্চ শাখাটির বংশগতি বা বংশবৃদ্ধি স্থগিত বা রুদ্ধ হয়ে যায়।
আরেকটি ঘটনা হলো, সেই উচ্চচেতন ধারাটি ঘটনাচক্রে নিম্নচেতনার মানুষের সাথে মিলিত হয়ে— হারিয়ে যেতে পারে আপাতদৃষ্টিতে। বহুকাল পরে, মাঝে-মধ্যে এখানে ওখানে দু-একজন মহাপুরুষের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে তারই ফলস্বরূপ। তাছাড়া, সেই ব্যক্তি উচ্চ-চেতনা সম্পন্ন হলেও, তার সমস্ত বীজগুলি তো আর উচ্চমানের নয়। সংকর জাতির মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
Comments