মন-আমি
- Maharshi MahaManas
- Jun 10, 2018
- 4 min read
Updated: Jun 22, 2018
(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা হতে গৃহীত)

মন-আমি
(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা হতে গৃহীত)
মানব ধর্ম— ‘মহাধর্ম’ এবং মহাধর্মের অনুশীলনীয় পর্ব ‘মহামনন’ —আত্ম- বিকাশ বা মনোবিকাশ কার্যক্রমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমাদের ‘মন’ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক।
‘মন’ হলো— অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো প্রায় বর্ণনাতীত –সাধারণের পক্ষে প্রায় বোধাতীত এক অতি সুক্ষ্ম অস্তিত্ব। মন-সফটওয়ার ও শরীর (হার্ডওয়ার), —এদের মাঝে একটি প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার আছে। এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার-এর মাধ্যমেই শরীর যন্ত্রের যাবতীয় অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপাদি তথা সহজ-প্রবৃত্তিজাত কার্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে।
শরীরকে ভিত্তি করেই এই জৈব সফটওয়ার তৈরী হয়েছে। আর, শরীরসহ এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারের ভিত্তিতেই তৈরী হয়েছে— মন-সফটওয়ার।
প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার, — উভয়েরই স্বতন্ত্র অবয়ব আছে। এই অবয়ব আমাদের বর্তমান চেতন-স্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। উচ্চতর চেতনস্তরের মন এই অবয়ব উপলব্ধি করতে সক্ষম। অন্যান্য সমস্ত অস্তিত্বশীলদের মতই উভয় সফটওয়ারেরই আছে অশরীরী দিব্য অস্তিত্ব (দ্রষ্টব্যঃ Super-existence)। একেই অনেকে আত্মা বলে থাকেন। কিন্তু, সমগ্র মন-অস্তিত্বই হলো— আত্মা। সে দেহযুক্তই হোক আর দেহাতীতই হোক (দ্রষ্টব্যঃ আত্মা)।
প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার— উভয়েরই নিজস্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকলেও, কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। একে অপরের উপর, এবং শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপর উভয় জৈব সফটওয়ারই কম-বেশি নির্ভরশীল। আবার, শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপরেও এরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। মানসিক কার্যকলাপ এবং শারীরীক কার্যকলাপ (যা প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার দ্বারা পরিচালিত অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপ)একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার ক’রে পরস্পর সহযোগী হয়ে কাজ ক’রে থাকে। এর পিছনে রয়েছে— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র কার্য-কারণ স্বরূপ অসংখ্য ঘটনার সম্মিলিত ঘটনাপ্রবাহ। শরীর ও মনের ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়া-কান্ডগুলি হলো— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে প্রসুত ফল, এবং সেই সম্মিলিত ঘটনা প্রবাহেরই অংশ, যা আরো অনেক ঘটনার জন্মদাতা (দ্রষ্টব্যঃ ভাগ্য)।
ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতই, সমগ্র মন— একের পর এক ক্রমোচ্চ স্তরে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। বিকাশের প্রতিটি চেতন-স্তরে মনের এক এক প্রকার রূপ—গঠণ—কার্যকলাপ। অস্ফূট-চেতন-স্তর থেকে পূর্ণ-চেতন-স্তর অভিমুখে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তুচ্ছ লক্ষ্য থেকে উচ্চ লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা (এ’নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘মহাবাদ’ গ্রন্থে)।
তবে, শরীর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অথবা স্বয়ংসম্ভুত হয়ে— মনের সৃষ্টি হয়নি। কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো— মন-সফটওয়ারেরও স্রষ্টা আছে। প্রোগ্রামার— ডেভলপার আছে। প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারসহ মন-সফটওয়ার এবং শরীরযন্ত্র তৈরী হয়েছে— ঈশ্বর দ্বারা, —ঈশ্বরের মন ও শরীর উপাদান থেকে। এই মহা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডরূপ শরীর আর মহা বিশ্ব-মন নিয়েই হলো— ঈশ্বর অস্তিত্ব।
চেতনা হলো— শরীর ও মনের অনুভব—সংবেদন—বোধ করার ক্ষমতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা, কোনো কিছু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার, বিচার-বিবেচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, শরীর ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, কল্পনা—উদ্ভাবন—সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা স্বরূপ।
বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডস্বরূপ ঈশ্বর শরীরের সমস্ত কার্যকলাপ— ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই ঈশ্বর-মন ও ঈশ্বর-চেতনার প্রকাশ। আর, জীব ‘আমি’ হলো— সেই দিব্য-চেতন-মন-সিন্ধুর এক একটি বিন্দু স্বরূপ। ঈশ্বর-শরীরের অসংখ্য কোষের মধ্যে এক একটি কোষ সম। তবে, অন্যান্য কোষের সাথে এর একটু পার্থক্য আছে। জীব হলো— ঈশ্বর উপাদানে— ঈশ্বর সৃষ্ট জৈব কোষ।
এই মানব-চেতন-স্তরে— দুটি সক্রিয় মন নিয়ে আমাদের মনোজগত। একটি হলো— অবচেতন মন, যে অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। আর অপরটি হলো— সচেতন মন, যে স্বল্পাংশে বিকশিত ও সক্রিয়। এই সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে, তবেই আমরা মানবোত্তর উচ্চ-চেতন-স্তরে উপনিত হবো। অবচেতন মন হলো— যুক্তি বিহীন আবেগপ্রবণ অন্ধ-বিশ্বাসী মন। সারা দিন-রাতের অধিকাংশ চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা ও কর্মের পিছনে আছে এই মন। আর, সচেতন মন হলো— যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষনসহ সত্যপ্রিয় মন। অবচেতন মনের কাজকর্মকে যুক্তি-বিচার-সতর্কতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিচালনা করাই এর কাজ। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এই মনটি খুব সামান্য পরিমানে বিকশিত ও জাগ্রত, এবং অধিকাংশ সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায়, তাদের সচেতন মন যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে অবচেতন মনকে সবসময় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হয়না।
যে নিজেকে ‘আমি’ বলছে, সেতো আসলে ‘মন’-ই! তবে, কখনো অবচেতন-মন নিজেকে ‘আমি’ বলছে, আবার কখনো সচেতন-মন (মানব-চেতন-মন) নিজেকে ‘আমি’ বলছে। একে অপরকে দাবিয়ে রাখার আমিত্বের লড়াই চলছে— প্রায় সর্বক্ষণ। বেশিরভাগ সময়ে সবল অবচেতন-মন-ই জিতছে এই লড়াইয়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বল্প-বিকশিত দুর্বল সচেতন-মন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কখনো কখনো।
অদৃশ্য এই মনদুটিকে যদি মূর্তরূপে দেখতে চান, তাহলে প্রচলিত ধর্মীয় ভাবনার বাইরে গিয়ে— মাকালী্র সেই ছবিটাকে মানসপটে অবলোকন করুন, যার পদতলে শিব শায়িত রয়েছে। এখানে, রণোন্মত্ত কালীই হলো অবচেতন মন। আর, তন্দ্রাচ্ছন্ন শায়িত শিব হলো সচেতন মন।
প্রত্যেক (চেতন স্তরের) মনের নিজস্ব স্মৃতি ভান্ডার আছে।অবচেতন মনের স্মৃতিচারণের সময় যদি সচেতন মন সজাগ থাকে, এবং আগ্রহী থাকে, তবেই সচেতন মন সেই স্মৃতি গ্রহন করতে এবং তার স্মৃতি-ভান্ডারে সঞ্চয় করতে পারবে। অবচেতন মন প্রায় সব সময়েই সজাগ থাকায়-- সে আগ্রহী হলে, সচেতন মনের স্মৃতি গ্রহন করতে সক্ষম।
সচেতন-মনের শাসনাধীনে থাকতে অবচেতন-মনের মোটেই ভালো লাগেনা। তবু নিরুপায় হয়ে থাকতে হয় তাকে। আমাদের নিদ্রাকালে, সচেতন-মন যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিদ্রিত হয়ে পড়ে, তখন বেশকিছু সময়ের জন্য অবচেতন-মন স্বপ্নরূপ কল্পনার পাখা মেলে দিয়ে— সম্পূর্ণতঃ বা অনেকাংশে স্বাধীনতা উপভোগ ক’রে থাকে। আমরা জাগ্রত থাকাকালেও, সচেতন-মনের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঝিমুনো অবস্থায়, অথবা তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অবচেতন-মন নিজের খেয়াল-খুশিমতো কল্পনার জগতে অথবা বাস্তব জগতে অনেক কান্ডই ঘটিয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ আত্মা-মন-পুণর্জন্ম
মন সর্বদাই নিজের ক্রিয়াশীল অস্তিত্ব বজায় রাখতে--- কোনো না কোনো বিষয়কে আঁকড়ে ধরে থাকে।
মানস ক্রিয়াই হলো মন-অস্তিত্বের লক্ষণ বা নিদর্শন।
অস্থির মন--- এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে, এইভাবে সে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ ক'রে থাকে।
মনকে প্রয়োজনমতো এক বিষয়ে ধরে রাখতে চাইলে, বিশেষ কিছু পদ্ধতি অভ্যাস করতে হয়। আর তার সাথে শরীর ও মন সুস্থ ক'রে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
মন--- নিজেকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্থির ও শান্ত হয়ে ওঠে। একেই বলে, আত্ম-ধ্যান। আত্ম-ধ্যানের মধ্য দিয়েই--- আত্মোপলব্ধী--- আত্মজ্ঞান--- আত্মশক্তি লাভ হয়ে থাকে।
কোনো উপায়ে যেকোনো একটা বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়ে--- তার অন্তঃস্থলে কেন্দ্রীভূত হতে পারলে, তখন মন সেই বিষয়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকা তথ্য---তত্ত্ব ও সত্যকে উন্মোচিত ক'রে, তার সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়।
আরেকটি কথা, সচেতন মন--- কোনোকিছুর সঙ্গে মনোযুক্ত হলে, তখন অবচেতন মন আগ্রহের সাথেই হোক আর বাধ্য হয়েই হোক, সেও সেই বিষয়-বস্তুর সাথে যুক্ত হয়।
এবার, সেই বিষয়-বস্তু যদি স্থির বা একঘেয়ে কিছু হয়, অথবা তার আগ্রহের কিছু না হয়, তখন অবচেতন মন চেষ্টা করে--- সেই বিষয়-বস্তু থেকে নিজেকে এবং সচেতন মনকেও বিচ্ছিন্ন করে--- তার নিজের (কল্পনার) জগতে ফিরে আসতে। আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে একাজে সফল হয়ে থাকে।
*মন সম্পর্কে আরো জানতে, নিজের সম্পর্কে জানতে— ‘মহাবাদ’ পড়ুন।
Comments