top of page

চতুর্থ অধ্যায়

সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন

মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন

(মহর্ষি মহামানস-এর ‘মহাবাদ’ গ্রন্থ হতে গৃহীত আত্মধ্যান-লব্ধ মহাতত্ত্ব-জ্ঞান কান্ড— বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।)

 

পরমশূন্য! আদি-অন্তবিহীন— নিরাকার প্রকৃত শূন্য! আমাদের জানা মহাশূন্য নয়—। মহাবিশ্ব বা ঐশ্বরীয় এলাকা ছাড়িয়ে— আদিসত্তার অঞ্চল (বা ব্রহ্মাঞ্চল) পেরিয়ে বিদ্যমান যে অনন্ত আকাশ— সেই পরম শূন্য। নিস্তব্ধ—নিস্তরঙ্গ—নির্বিকার— অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্ব। শূন্যাস্তিত্ব! অপরিবর্তিত— অবিনাশী—অবিচল সেই শূন্যে— এখানের কোনো সচল বস্তু বা শক্তি প্রবেশ করতে অক্ষম।

 

সেই পরম শূন্যের মাঝে, একটি নির্দিষ্ট সীমা নিয়ে আদিসত্তা— পরমাত্মার অবস্থান। সে এখন* লীলা অবসানে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সেই আদিসত্তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে মহাসৃষ্টি। বহুসংখ্যক মহাবিশ্ব নিয়ে এই মহাসৃষ্টি। তারমধ্যে একটি হলো আমাদের এই মহাবিশ্ব। আদিসত্তা— পরমাত্মা প্রধানত আদিকণা — পরমকণা — আদিশক্তি দিয়ে গঠিত। এছাড়াও তা' আদি বস্তুকণা, অসংখ্য যুগ্মকণা এবং বিকিরণে পরিপূর্ণ। পরমাত্মার অধিক অংশই পরমা্ণু— অতিপরমাণু, আদি শক্তিকণা ও তার বিপরীত কণা দিয়ে গঠিত অসংখ্য যুগ্মকণা এবং নানা বিকিরণে পূর্ণ। এদের সাথে মিলেমিশে রয়েছে আরও অনেক বস্তু— অবস্তু, অন্যবস্তু। যেমন— পরম-পদার্থ, দিব্য-পদার্থ ও চেতনা। আদি চেতনা— পরম চেতনা।

 

সৃষ্টিপূর্বে— একাবারে আদিতে, দুই প্রকারের আদিকণা উপস্থিত ছিল। একটি হলো— পজেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ‘1’ প্রোগ্রামীং কোড এবং '1' ডাইমেনশন সম্পন্ন ‘X’ কণা, আর অপরটি হলো— নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ‘0’ (জিরো) প্রোগ্রামীং কোড সম্পন্ন এবং জিরো ডাইমেনশন বা ডাইমেনশন বিহীন ‘Y’ কণা। বিভিন্ন সংখ্যক 'X' ও 'Y' কণার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মৌলিক কণা। একাধিক মৌলিক কণা— বিশেষ বিশেষ সন্নিবেশে মিলিত হয়ে তৈরী হয়েছে বিভিন্নরূপ মৌলিক পদার্থ কণা।

 

বিভিন্ন মাত্রার ঘুর্ণন— কম্পাঙ্ক এবং চার্জ সম্পন্ন এক একটি মৌলিক কণা— অপরাপর মৌলিক কণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মৌলিক পদার্থ ও শক্তি সৃষ্টি করে থাকে। এই বিভিন্নতার পিছনে নিহিত থাকে ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রামীং কোড— ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক আদিকণার উপস্থিতি।

 

আদিকণা থেকে মৌলিক কণাসহ সমস্ত পদার্থ কণা ও শক্তি কণা এবং তাদের বিশেষ বিশেষ সন্নিবেশে সৃষ্ট বিভিন্ন জাগতিক অস্তিত্বগুলি— সবকিছুর অন্তরেই নিহিত রয়েছে বিভিন্নরূপ 'প্রোগ্রামীং কোড'। কতকটা আমাদের কম্পিউটার প্রোগ্রামীং ল্যাঙ্গুয়েজ— কোড-এর মতোই। আদিকণা থেকে পরবর্তীতে সৃষ্ট বিভিন্ন কম্পাঙ্কের বিভিন্ন প্রকার কণাগুলিসহ সমস্ত প্রকার জাগতিক অস্তিত্ব— ভিন্ন ভিন্নরূপ অব্যক্ত প্রোগ্রামীং কোড-এরই ব্যক্ত বা মূর্ত রূপ।

 

বিভিন্ন প্রকার যোগ-বিয়োগ, আদান-প্রদান, গ্রহণ-বর্জন প্রভৃতি আচরণের ফলে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন বহু প্রকারের কণা ও অস্তিত্ব। যেমন— XY, XYY, XXX, YYY, (XY)+(XYY), (XXY)+(XYY) প্রভৃতি বিভিন্ন ভর বিশিষ্ট এবং ভর বিহীন, চার্জ বিশিষ্ট এবং চার্জ বিহীন, শূন্য ডাইমেনশন থেকে বহু ডাইমেনশনাল অস্তিত্ব।

 

সৃষ্টি হয়— মহাকাশ, পদার্থ, শক্তি, চেতনা প্রভৃতি। মৌলিক কণার মধ্যে পরবর্তীতে রূপান্তরিত হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাই নিহিত বা সুপ্ত থাকে। এই কণাগুলি রূপান্তরধর্মী এবং কখনো কখনো বৈপরীত্য গুণ সম্পন্ন। মৌলিক কণাগুলির মধ্যে বিভিন্নরূপ যোগ-বিয়োগের ফলে সমবিপরীত এবং আংশিক বিপরীত কণাও সৃষ্টি হয়ে থাকে। মৌলিক কণাগুলি এবং তাদের থেকে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্নরূপ কণাগুলির এক বিশেষ বিন্যাসের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আদি-মন ও আদি-চেতনাসহ আদিসত্তা— পরমাত্মা।

 

তা-ই বলে, এই আদিসত্তা— পূর্ণ চেতন-সত্তা বা পূর্ণ চেতনা সম্পন্ন নয়। আর, আদিসত্তা— পরমাত্মা সবদিক থেকেও পুর্ণ নয়। পুর্ণতা হলো একেবারে পূর্ণ অচলাবস্থা। পূর্ণ নিষ্ক্রিয়— নির্গুণ অবস্থা, যা অচেতনতার সমার্থক। যে অবস্থা থেকে কোন সৃষ্টি হতে পারে না। পূর্ণ স্থিতাবস্থা। পূর্ণ চেতন-সত্তার চাওয়ার কিছু থাকে না। পাওয়ারও কিছু নেই। তাই, তার করারও কিছু নেই। স্বয়ং সম্পূর্ণ হলে, সেখানে সৃষ্টি লীলার প্রশ্নই আসেনা। যেখানে লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, চলা নেই— সেখানে সৃষ্টি অসম্ভব।

 

না, আদিসত্তা— পরমাত্মা পূর্ণ নয়, —তবে প্রায় পূর্ণ। আমাদের নিম্ন চেতনা সাপেক্ষে— আপাতঃ দৃষ্টিতে তাকে পূর্ণ মনে হলেও, প্রকৃত অর্থে তাকে শুধু পরম চৈতন্যময় পরমাত্মা** বলা-ই ঠিক হবে। এখানে একমাত্র পরমাত্মা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

তার অন্তরের গভীরে অতি ক্ষীণ মাত্রায় অপূর্ণতা রয়েছে। রয়েছে অতি ধীর এবং সূক্ষ্ম মাত্রায় সক্রিয়তা। তার বহির্ভাগ প্রায় নিস্তরঙ্গ— নিরুত্তেজিত মনে হলেও, রয়েছে চাপা উত্তেজনা। বাস্তবে, পূর্ণতঃ বিরাম এবং পূর্ণ সক্রিয়াবস্থা বলে কিছু নেই। সর্বোচ্চ বিরাম বা নিষ্ক্রিয় অবস্থার মধ্যেও অতি সামান্য হলেও থাকে কিছু সক্রিয়তা। বিপরীত ক্ষেত্রেও তা’ই। বিরাম অবস্থা থেকে পুনরায় কর্মারম্ভ হয়, নিদ্রা-জাগরণের মতো।

 

পরমসত্তা হলো পরমাত্মার দিব্যশরীর সহ দিব্যমন। সামগ্রিকভাবে যা জন্ম-মৃত্যু রহিত— অবিনশ্বর। সাদৃশ্যে মন্ডলাকার। তার কেন্দ্রাভিমুখে ঘনত্ব— তাপ ও চাপ ক্রমশ বেশি।

একসময় পরমাত্মার নিদ্রাকাল শেষ হলো। পরম কালের (মহাকাল নয়) সকাল হলো যেন। নিদ্রাবসানের সাথে সাথে আমাদের যেমন, বিভিন্ন চাহিদা— বিভিন্ন ইচ্ছা জাগ্রত হয়, যেমন— কর্মেচ্ছা, সুখ ও আনন্দ লাভের ইচ্ছা, পূর্ণতা লাভের ইচ্ছা— যা সাধারণ মানুষের অজ্ঞাতে কাজ করে, তার চেতনা সাপেক্ষে— নানা প্রকার হওয়া ও বহু কিছু করা, এবং বহু কিছু পাওয়ার ইচ্ছা রূপে। একাকীত্ব দূর করতে এবং পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে— প্রিয় সঙ্গ লাভের ইচ্ছা জাগে। প্রায় অজ্ঞান মনের অপূর্ণতার চাহিদা মেটাতে এইরূপ ইচ্ছা, —যেন ওকে পেলে বা ঐ বস্তুটা পেলে আমি সুখি হবো— আমি পূর্ণ হবো। আমার একাকীত্ব দূর হবে। এক জীবনে পূর্ণতা লাভ এবং অমরত্ব লাভ সম্ভব নয় বলে, এবং সেইসঙ্গে একাকীত্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্য থেকেই সৃষ্ট হয় সন্তান লাভের ইচ্ছা। জীবন ধারণ এবং রসনার সুখ লাভার্থে আহারের ইচ্ছা বা চাহিদা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে আরেকটু বিকশিত হলে, আত্মজীজ্ঞাসা জাগ্রত হলে, তখন আত্মজ্ঞান লাভের এবং সচেতনভাবে বিকাশলাভের ইচ্ছা প্রভৃতি একে একে জাগ্রত হতে থাকে নিদ্রা অবসানে।

 

পরমাত্মারও— নিদ্রান্তে প্রায় অনুরূপ কিছু চাহিদা ও ইচ্ছার উদ্রেক হলো। আমাদের ইচ্ছাগুলি যেমন মন ও শরীরের নানা চাহিদারই বহিঃপ্রকাশ বা মনঃপ্রকাশ, তেমনই পরমাত্মার ক্ষেত্রেও। ঐ চাহিদার পিছনে রয়েছে তার মন ও শরীরাভ্যন্তরের ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারূপ নানা ঘটনা।

 

নিদ্রান্তে এইসব চিন্তা-ভাবনা থেকে— পরমাত্মার শরীরাভ্যন্তর কেন্দ্রে ক্রমশ তাপ-চাপ —উত্তেজনা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেখানকার যুগ্ম আদি-কণাগুলি মিলে মিশে, ভেঙেচুরে সৃষ্টি হতে থাকে নতুন নতুন কণা— নতুন নতুন পদার্থ। ক্রমশ অন্তরের গভীরে চলতে থাকে মহাসৃষ্টির জন্য সৃষ্টি-বীজ তৈরীর প্রস্তুতি।

 

পরমাত্মা নিজের অবস্থা ভেবে ও বুঝে, আর কোনো গতি না দেখে, অগত্যা, অবশেষে নিজের চাহিদা মেটাতে এক সুন্দর উপায় উদ্ভাবন করে। প্রথমে সে (প্রোগ্রামীং কোড-এর মাধ্যমে)— নিজের অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র মায়া অস্তিত্ব (ভার্চুয়াল এক্সিস্টেন্স) তৈরী কর— নিজের মধ্যে। তারপর, পরমাত্মার নির্দেশ বা ইচ্ছানুসারে তার দ্বারা সৃষ্ট সেই মায়া-সত্তা— স্ব-অভিভাবন বা আত্ম-সম্মোহনমূলক স্ব-অভিভাবন দ্বারা গভীর যোগনিদ্রার (সম্মোহন-নিদ্রার) মধ্য দিয়ে নিজেকে ঘনীভূত— কেন্দ্রীভূত ক’রে বীজাকার প্রাপ্ত হয়। নিজের রূপ-গুণ-চেতনা, জ্ঞান-শক্তি-ক্ষমতা প্রভৃতি সমস্ত কিছুকে বীজ আকারে পরিণত করে সে। নিজেকে অস্ফূট-জ্ঞান বা অজ্ঞান প্রাক-শিশুচেতন— অর্থাৎ ভ্রুণ চেতন স্তরে পর্যবসিত ক’রে, —নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পুনরায় নিজেকে খোঁজার— আবিষ্কারের খেলায় মেতে উঠবে ব’লে।

 

“নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে ফেলে, —আবার তাকে খোঁজা-খুঁজির কানামাছি খেলাই হলো সৃষ্টি রহস্যের মূল কথা।” —মহর্ষি মহামানস

 

===============================================================

*‘এখন’ কিন্তু বর্তমান কাল নয়, সৃষ্টিপূর্ব কোনো এক সময়।

**আদিসত্তার ক্ষেত্রে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি, এবং মহাবিশ্ব অস্তিত্ব বা বিশ্বাত্মার ক্ষেত্রে 'ঈশ্বর' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র বোঝানোর সুবিধার জন্য। প্রচলিত 'ঈশ্বর' ধারণার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।

==============================================================

 

এরপর, পরমাত্মার সেই মায়া-সত্তা (ভার্চুয়াল এক্সিস্টেন্স) নিজেকে ক্রমশ সঙ্কুচিত ক’রে বীজাকারে একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়— পরমাত্মার মধ্যস্থলে। তারপর ক্রমসংকোচনের এক বিশেষ পর্যায়— পরমাত্মার কেন্দ্রস্থলে অকল্পনীয় তাপ—চাপ ও ঘনত্বের ফলে, সেই বহু বিশ্ব-বীজের সমষ্টিরূপ সৃজন-ফলটির মধ্যে ঘটে এক বিস্ফোরণ। আদি বিস্ফোরণ! বিস্ফোরণের মধ্যদিয়ে সেই আদি সৃষ্টি-বীজ ফেটে বহুবিভক্ত হয়ে, সৃষ্টি হয়— বহু বিশ্ব-বীজ।

 

পরমাত্মার কেন্দ্রস্থল থেকে সেই বিশ্ব-বীজগুলি সবদিকে— কেন্দ্র থেকে সবেগে ছিটকে বেড়িয়ে আসে। বিশ্ব-বীজগুলির মধ্যে— সমসংখ্যক বিশ্ব-বীজ এবং সম-বিপরীত গুণ সম্পন্ন বিশ্ব-বীজ রয়েছে। বিপরীত গুণ সম্পন্ন বীজগুলি একে অপরের সাথে মিলিত হলে, লয় প্রাপ্ত হবে উভয়েই। এরা হলো পরস্পর বিপরীত বিশ্ব-বীজ — অর্থাৎ বিপরীত বিশ্বের বীজ। একসম্‌য়, প্রত্যেকটি বিশ্ব-বীজের মধ্যে ঘটলো মহা বিস্ফোরণ, প্রায় একই সময়ে। — অবিলম্বে অঙ্কুরোদ্গম ঘটিয়ে, কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে— ক্রমে মহীরূহ হয়ে উঠতে, তারা শুরু করলো আত্ম-বিকাশের পালা।

 

বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকলো প্রত্যেকে— বহু মহাবিশ্ব রূপে! তাদের অভ্যন্তরেও নিরন্তর ঘটে চলেছে অসংখ্য বিস্ফোরণ—। ভাঙা-জোড়া, পরিবর্তন, রূপান্তর, নব নব সৃষ্টি—ধ্বংস, অজস্র বিচিত্র ঘটনা। সৃষ্টি—স্থিতি—গতি—লয়-এর ঘটনাচক্রে এ’সব কিছু ঘটে চলেছে পরমাত্মার শরীরাভ্যন্তরে সৃষ্ট এই মহাবিশ্বগুলির মধ্যে। সদ্যোজাত বিশ্বগুলি বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, এবং প্রত্যেকটি বিশ্ব নিজ নিজ কেন্দ্র থেকে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। ক্রম-প্রসারমান বিশ্বগুলি নিকটবর্তী বিপরীত বিশ্বের সংস্পর্শে এলেই তখন উভয় বিশ্বসহ সমস্ত সৃষ্টি-ই লয় প্রাপ্ত হবে।

 

আর সে—, সেই আদিসত্তা— পরমাত্মা চুপটি ক’রে উপভোগ করছে— সয়ংক্রিয়ভাবে—পরম্পরাগতভাবে ঘটে চলা— এই সৃষ্টি-লীলা।

 

এদিকে এরা— বেচারা! নিঃস্বপ্রায় অজ্ঞান-অচেতন— অসহায় শৈশব অবস্থা থেকে হাঁটি-হাঁটি পা-পা ক’রে এগিয়ে চলেছে পূর্ণবিকাশ লাভের উদ্দেশ্যে। এই ক্রমবিকাশমান বিশ্বগুলির মধ্যে একটি হলো— আমাদের মহাবিশ্ব! তারমধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ হলো আমাদের এই মানব-গ্রহ— পৃথিবী।

 

এইভাবে চলতে চলতে— অঙ্কুর থেকে কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে একটু একটু ক’রে ক্রমবিকাশের পথ ধরে অবশেষে লাভ করবে তারা পূর্ণ আত্ম-বিকাশ! আদি বীজ-কোষস্থ সফটওয়ারের মাধ্যমে— আদি বীজ-কোষের মধ্যে সাংকেতিক ‘প্রোগ্রাম’ আকারে নথিভূক্ত থাকা ভবিষ্যত কার্যকলাপের পরিকল্পনার ভিত্তিতে— একের পর এক ঘটতে থাকবে বহু বিচিত্র ঘটনাবলী।

 

তবে, এই প্রোগ্রামের মধ্যে মূল উদ্দেশ্য— আত্মানুসন্ধান— আত্মোপলব্ধি— আত্মবিকাশ প্রভৃতি আদি ইচ্ছাগুলি অন্তর্গ্রথিত থাকলেও, কখন কী ঘটবে—, কবে—কোথায়— কার দ্বারা কীভাবে কী ঘটবে, এ’সমস্ত নির্দেশ বিশদভাবে সেখানে উল্লেখ নেই। তাহলে তো খেলার আনন্দই থাকে না! এ’সবই ঘটছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাগ্যক্রমে (ভাগ্য সম্পর্কে বিশদভাবে ‘ভাগ্য আসলে কী’ প্রবন্ধে আলোচনা করেছি)।

 

বিকাশের নানা মাত্রায় একের পর এক ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। নানা পরিবর্তন— রূপান্তর, এবং সেই সাথে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনার ক্রমবিকাশ লাভ।

সৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, —চলছে তার ক্রমবিকাশ। এই অবসরে পরমাত্মার মনের অন্দর-মহলে একটু উঁকি দেওয়া যাক—।

 

পরমাত্মা নিদ্রান্তে— জাগ্রত হয়ে, বিগত সকালগুলির মতোই আবার কর্মজীবন শুরু করেছে। সে জানে, নতুন ক’রে পাওয়ার কিছু নেই —করারও কিছু নেই। সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া— খাড়া বড়ি থোড়’, —একভাবে জীবন চলছে।

 

চাওয়ার যে কিছু নেই, তা’ নয়। কিন্তু চেয়ে কোনো লাভ নেই—। তাই সে তার সমস্ত চাহিদাকে ‘বুকের মাঝে পাষাণ চাপা দিয়ে’ শুইয়ে রেখেছে। কিন্তু তা’তে কি হবে, সেই চাহিদার কীট— ভিতরে ভিতরে তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আনমনা ক’রে তুলছে কখনো কখনো। কখনওবা অস্থির— উত্তেজিত— অসন্তুষ্ট— হতাশাগ্রস্ত— বিষাদ-বিমর্ষ ক’রে তুলছে তাকে।

 

তবে এ’ সমস্তই অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতির হৃদয়াবেগ। মাত্রারিক্ত হয়ে ওঠেনি কখনও। তাই বাইরে থেকে আপাতঃ দৃষ্টিতে সে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ এক পূর্ণ চেতনাময় নির্বিকার সত্তা। যেন, আপনাতে আপনি মগ্ন। শান্ত— সমাহিত— প্রসন্ন, সব পাওয়া— সব হওয়া— সব থাকার এক উজ্জ্বল মহিমামন্ডিত পূর্ণ রূপ!

 

কিন্তু কি সেই অভাব, কী সেই চাহিদা, যা আজও তাকে সক্রিয়—জীবন্ত ক’রে রেখেছে! যার জন্য হতাশা ভুলতে, আনন্দ—উত্তেজনার আগুন পুইয়ে একঘেয়েমীর শীতলতা কাটাতে, আবার কখনও উত্তেজনা দিয়ে উত্তেজনার প্রশমন ঘটাতে, —একা একাই দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে খেলার আয়োজন করতে হয়েছে তাকে বারবার। কেন, কিসের জন্য—?

এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, তার ক্ষমতা— অক্ষমতা, জানা— অজানা, ইচ্ছা— অনিচ্ছার কতটা হদিশ পাওয়া যায়।

 

সে তার ইচ্ছামতো অনেক কিছু করতে পারে। পারে, —তবে তা’ শুধু তার অঞ্চলের বা শরীরের মধ্যেই—। তার শরীর-মন অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণাধীন। শরীর-মনের মধ্যে যা কিছু ঘটছে— যা কিছু আছে, সে সম্পর্কে সে অবগত। কিন্তু সে পরম শূন্যপথে অন্যত্র কোথাও যেতে অক্ষম। নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে অক্ষম। সে নিজেকে নিয়েও যা খুশি করতে পারে না। পারে না নিজের আয়তনকে সঙ্কুচিত বা প্রসারিত করতে, অথবা নিজেকে দ্বিগুণ বা তার বেশি সত্তায় পরিণত করতে। আর পারে না বলেই, সে নিজের উপাদানে এক ক্ষুদ্র মায়া প্রতিরূপ সৃষ্টি ক’রে, তার মধ্য দিয়েই নিজের ইচ্ছাপূর্তি ঘটিয়েছে বারবার।

 

তার এই সমস্ত ইচ্ছা কিন্তু অনেকাংশে তার শরীর ও মন নির্ভর। সে শরীর অন্যরূপ— অন্যবস্তু বা অন্য পদার্থে তৈরী হলেও তা’ শরীর-ই। আমাদের মতোই তার ইচ্ছাগুলিও উৎপন্ন হয় কার্য-কারণের উপর ভিত্তি করে। তার ইচ্ছাও যথেচ্ছভাবে সৃষ্টি হয় না। সে-ও উৎপন্ন হয় তার শারীরিক-মানসিক গঠন-উপাদান, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও কাল সাপেক্ষে, এবং নেপথ্যে থাকা ঐচ্ছিক-অনৈচ্ছিক অজানা শক্তির প্রভাবে।

 

সে তার শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। সে জানে, সে কোথাও যেতে অক্ষম। জানে, তার ক্ষয় নেই, বৃদ্ধিও নেই। কিন্তু সে জানে না, তার জন্ম রহস্য! তার শুরু ও শেষ, জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। যেন, তার শুরু নেই— শেষ নেই, —এভাবেই চলছে—চলবে। প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কী এই পরমশূন্য থেকেই হয়েছে তার সৃষ্টি?! পরম শূন্যের মধ্যেই কী লুকিয়ে আছে আদিসত্তার সৃষ্টিরহস্য?!

 

মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে, কে— সে, কোথা থেকে— কিভাবে এসেছে বা উৎপত্তি হয়েছে, কি উদ্দেশ্যে তার জীবন! কি তার পরিণতি! কোথায় শুরু— কোথায় শেষ এই পরম শূন্যের! কে তার স্রষ্টা! কোথাও তার দোসর আছে— কী নেই, এইসব প্রশ্ন জাগে মনে।

 

পরমশূন্যের মধ্যে অন্যত্র কোথায় কি আছে, কোথায় কি ঘটছে, সে জানে না। সে এটুকু জানে, পরম শূন্যের মধ্য দিয়ে কোনো আলোক, তরঙ্গ, শক্তি, বিকিরণ বা তার জানা কোন কিছুই যেতে বা চলতে সক্ষম নয়। সেখানে দৃষ্টি প্রসারিত হয় না— নিঃসীম অন্ধকার।

 

সে জানে, কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার নেই, —দেওয়ারও নেই কাউকে কিছু। —এত কিছু সত্বেও তার আলস্য নেই, কারণ তার মধ্যে রয়েছে প্রবলতম জীবনীশক্তি— পরম প্রানশক্তি। আছে তীব্র কর্মেচ্ছা— প্রচন্ড উদ্দীপনা। যার জন্য সে চিরকাল এত সক্রিয়— জীবন্ত!

 

আপাততঃ অতীত ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, অজানা নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে— ঘটমান বর্তমানের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পরমানন্দে সে উপভোগ ক’রে চলেছে তার জীবন। সদানন্দ শিশুর মতোই খেলা নিয়ে মেতে আছে সে। প্রতিবারের মতো, খেলা শেষ হলে, দামাল শিশুর মতোই পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রার কোলে নিজেকে সঁপে দেবে সে— আদিসত্তা—পরমাত্মা।

আর বিশ্বাত্মা** — বিশ্বাত্মা বা ইশ্বর বলতে এখানে, আমাদের বিশ্ব-অস্তিত্বকেই বোঝানো হয়েছে। এই বিশ্ব-অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে একটি মন— বিশ্ব-মন। এখানে ‘ঈশ্বর’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে সবার বোঝার সুবিধার্থে। আমরা তাকে ‘বিশ্বাত্মা’-ই বলে থাকি।

আমাদের বিশ্বের নিকটবর্তী বিপরীত বিশ্বের মধ্যেও রয়েছে একটি বিশ্ব-মন। আমাদের বিশ্ব —যে বিশ্বে অবস্থান ক’রে— আমি বলছি, তুমি শুনছো। অথবা আমি লিখছি, তুমি পড়ছো। অপর বিশ্বেও তুমি আছো— আমি আছি। এখানে যা কিছু আছে, যা কিছু ঘটছে— সব কিছু সেখানেও আছে, সেখানেও ঘটছে। সে বিশ্বের সাথে এ’ বিশ্বের প্রত্যক্ষ কোনো যোগ না থাকলেও, আছে এক অদৃশ্য আন্তরীক টান।

 

বিপরীত কণা দিয়ে গঠিত হলেও, সে বিশ্বের সব কিছু এই বিশ্বের মতোই। সেখানকার ‘তুমি’ —‘আমি’ এখানকার তুলনায় বিপরীত গুণ ও চরিত্র বিশিষ্ট নয়। এদের বিপরীত গুণ তখনই বোঝা যাবে, যখন এখানের ‘আমি’ আর ওখানের ‘আমি’ অথবা উভয় বিশ্ব পরস্পর প্রত্যক্ষভাবে মিলিত হবে। মিলিত হবার সাথে সাথেই উভয় ‘আমি’ সহ উভয় বিশ্বই লয় প্রাপ্ত হবে তখুনি। আবার, এরা বিপরীত ধর্মী হলেও, পরস্পরের প্রতি পরস্পর তীব্র আকর্ষণ বোধ করে থাকে।

 

এবার আমাদের বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক—। মহা বিশ্বরূপ শরীর, বিশ্বমন, বিশ্বশক্তি স্বরূপ মহাপ্রাণ-শক্তিসহ সমগ্র বিশ্বসত্তাই— ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা)। তার দেহ আছে, মন আছে, আছে নানারূপ কামনা-বাসনা, নানা কর্মকান্ড। সে অধিকাংশ গুণ, শক্তি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কামনা-বাসনা, জ্ঞান-চেতনা প্রভৃতি লাভ করেছে আদিসত্তা—পরমাত্মা থেকে —জন্মসূত্রে। কিন্তু সে সবই সুপ্তাবস্থায় রয়েছে, —রয়েছে বিকাশের অপেক্ষায়।

 

বিশ্ব-শরীর বলতে এই পৃথিবীই নয়, পৃথিবীর মতো ছোট-বড় অনেক গ্রহ-উপগ্রহ আর অসংখ্য গ্রহাণু এবং এক বা একাধিক নক্ষত্র নিয়ে গঠিত সৌরজগতের মতো এক একটি নক্ষত্র-জগত। এমনই কোটি কোটি নক্ষত্র-জগত নিয়ে এক একটি নক্ষত্রপুঞ্জ। আর ঐরূপ লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে এই বিশাল বিশ্বরূপ ঈশ্বর শরীর। এই শরীরের মধ্যে রয়েছে— অদ্ভূত অদ্ভূত কত কী! আদিকণা— পরামানু—অতিপরমানু থেকে আরম্ভ ক’রে ধূমকেতু, নোভা, সুপার-নোভা, ব্ল্যাক-হোল, ডার্ক-ম্যাটার, ডার্ক-এনার্জী প্রভৃতি কতো কী। আছে বহু বিচিত্র জীব, বিভিন্ন প্রকারের চেতন-সত্তা— উদ্ভীদ আর বিচিত্র বিষয়-বস্তু।

 

মহাকাশ: সমগ্র বিশ্বজুড়ে— একটি বুদবুদ (Bubble)-এর মতো বহুমাত্রিক (Multidimensional), আপাতদৃষ্টিতে অবাধ এবং শূন্যস্থান অস্তিত্বকে মহাকাশ বলা হয়ে থাকে।

 

মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের এই মহাকাশ (Space) অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এবং মহাবিশ্বের সাথে সাথে ক্রমশই এই মহাকাশ প্রসারিত হয়ে চলেছে। এই মহাকাশ আসলে একপ্রকার অদৃশ্য অননুভূত— বিশেষ কম্পাঙ্কের কণা দিয়ে গঠিত এক বিশেষ অস্তিত্ব। কোষবিভাজন প্রক্রিয়ার মতো এই কণাগুলি প্রয়োজনে চক্রবৃদ্ধিহারে নিজেদের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বিজ্ঞান এখনো তাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি।

 

সাধারণভাবে, এই মহাকাশ আমাদের কাছে অদৃশ্য অননুভব‍্য এক অস্তিত্ব। তাই একে মহাশূন্য বলা হয়ে থাকে। তাইবলে, এই মহাকাশ পরমশূন্য নয়। পরমশূন্য রয়েছে মহাবিশ্বের বাইরে যে বহু মহাবিশ্বের সম্মিলিতরূপ মহাসৃষ্টি অবস্থান করছে, তার বাইরে— আদিসত্তারও বাইরে।

আমাদের এই মহাকাশ মোটেও শূন্য নয়। সে তার নিজস্ব অস্তিত্ব ছাড়াও, নানারূপ মহাজাগতিক রশ্মি—শক্তি, কণা এবং বিকিরণে ভরে আছে। সেইসব শক্তি ও কণাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আকর্ষণ-বিকর্ষণ সহ বিভিন্নরূপ কার্যকলাপে সাধারণত সে অংশগ্রহণ করে না। সে নিরপেক্ষ— নিষ্ক্রিয় নির্বিকার।

 

মহাকাশের মধ্যেই যে বিশ্বের সমস্ত কিছু অবস্থান করছে, শুধু তাই নয়, সমস্ত কিছুর মধ্যে বা ভিতরেও মহাকাশ রয়েছে বা বিরাজ করছে। মহাকাশ কোন কিছুকে ধারণ করে না— বর্জনও করে না।

 

মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই— মহাকাশ ছাড়াও আরো দুটি অব‍্যক্ত অননুভবনীয় স্বতন্ত্র ভার্চুয়াল অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছে। তা হলো 'সময়' আর 'ভাগ্য' (সময় বা Time ও ভাগ্য বা Destiny সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। কেউ কেউ মহাকাশ আর সময়-কে মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু সময় ও মহাকাশ দুটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। সময় আর মহাকাশের মধ্যে বড় সম্পর্ক হলো— তারা একইসঙ্গে একই ঘটনা থেকে জন্ম নিয়েছে।

 

জলাশয়ের জলের ভিতরে মাছ যেমন, অনেকটা তেমনই এই মহাকাশের মধ্যে আমাদের অবস্থান। আমাদের সবদিকে— ভেতরে ও বাইরে রয়েছে মহাকাশ। এই অরূপ মহাকাশকে কেউ কেউ তাদের ধারণা বা কল্পনা মতো বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেগুলির কোনটিই এই রহস্যময় মহাকাশের প্রকৃত রূপ বা অবয়ব নয়। মহাকাশ এখনও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে।

 

মহাকাশকে বুঝতে হলে, একেবারে মূল থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। পরম শূন্যের মধ্যে আদিসত্তার অবস্থান। আর তার মধ্যেই বহু মহাবিশ্বরূপ মহাসৃষ্টি সহ বহু মহাকাশ জন্ম নিয়েছে। মহাবিশ্বগুলির অন্তরবর্তী শূণ্যস্থানকে বলাহয়— অতিমহাকাশ। সৃষ্টিতত্ত্বের শুরুতেই পরমশূন‍্য সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। সেই পরমশূন‍্যের মধ্যে আদিসত্তার অবস্থান। আর সেই আদিসত্তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে মহাসৃষ্টি। বহুসংখ্যক মহাবিশ্ব নিয়ে এই মহাসৃষ্টি। তারমধ্যে একটি হলো আমাদের এই মহাবিশ্ব।

 

আদি বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু মহাবিশ্ব-বীজ দিয়ে গঠিত ফল রূপ--- প্রাক মহাসৃষ্টি। আর, একসময় এই ফলটির মধ্যে থাকা বিশ্ববীজগুলির মধ্যে সংঘটিত হয় মহাবিস্ফোরণ। সেই বিশ্ব-বীজগুলি থেকে ক্রমশ অঙ্কুরিত হয়ে— অসংখ্য মহীরুহের মতো বিকশিত হয়ে চলছে মহাবিশ্বগুলি।

 

বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) জন্ম একটু আগেই পর্যবেক্ষণ করেছি—। এখন দেখছি, আমাদের মতো তারও আছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি। আছে পরিণতির দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া। বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর মনও ক্রমবিকাশমান। অস্ফূট জ্ঞান ও চেতনা থেকে পূর্ণ জ্ঞান ও চেতনার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান চেতনালাভের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে— তার জীবন-চলা।

 

অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে শিশুর মতো হাঁটী হাঁটি পা-পা ক’রে তার যাত্রা শূরু। যত চলছে— ততই তার অজ্ঞানতা— মোহ-মায়া-অন্ধত্ব থেকে মুক্তি ঘটছে। ক্রমশ নব নব চেতনার আলোয় আলোকীত হয়ে উঠছে তার জীবন। শৈশব ও কৈশোর চেতন-স্তরে, তার মোহ-মায়া সম্পন্ন, স্বল্প-জ্ঞান ও অন্ধ আবেগ সম্পন্ন অবচেতন অংশ-মনই হলো— মহামায়াত্মা বা মহামায়া মন (‘মন’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

 

অতি-শৈশব কেটেছে ঘোর অজ্ঞানতার মধ্য দিয়ে, দুর্বার—দুরন্ত গতিতে বেড়ে ওঠা—। শৈশবও কেটেছে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ছোটাছুটি— খেলেধুলায় খেয়াল-খুশি মতো কাজ করে, অসচেতনভাবে— ভিতরের তাড়নায়। কৈশোরে কিছুটা সচেতনতা এলেও, মোহ-মায়া, অজ্ঞান-অন্ধত্ব, অন্ধ-আবেগের বশে— খামখেয়ালীপনার সাথে কাম-পীড়িত হয়ে— পেরিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। একই সময়ে দুটি ভিন্ন চেতন-স্তরের ভিন্নধর্মী দুটি সক্রিয় মনের (‘মন’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) উপস্থিতির কারণে, মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে যেমন বৈপরীত্য দেখা যায়, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের মধ্যেও ঠিক তেমনই ঘটে।

 

এইভাবে ক্রমশ এগিয়ে চলতে চলতে— চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে সে একটু একটু ক’রে বুঝতে থাকে নিজেকে। তার শক্তি, ক্ষমতা, কর্ম, লক্ষ্য— উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ। এতদিন অজ্ঞাতসারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে* খেলা চলেছে। এবার আস্তে আস্তে শুরু হয়— সজ্ঞানে সচেতনভাবে চলার পালা। বিভিন্ন সময় চেতনার ক্রমবর্ধিত মাত্রা অনুসারে, তখনকার পরিবির্তিত মনোভাব— কামনা-বাসনা অনুযায়ী নানা উদ্দেশ্যে খেলতে থাকে সে। নিজেকে নিয়ে খেলা— সৃষ্টিলীলা।

 

=========================================================

* আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্যবিহীন মনে হলেও, সে কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই প্রাক সংস্কার বা প্রি-প্রোগ্রামিং মতো লক্ষ্যপানেই এগিয়ে চলেছে।

** বোঝানোর সুবিধার্থে— ‘ঈশ্বর’ বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রচলিত ‘ঈশ্বর’ ধারণার সাথে ‘বিশ্বাত্মা’-র অনেক অমিল আছে।

==============================================================

 

যথেষ্ট চেতনা লাভের সাথেসাথে জাগে আত্ম-জিজ্ঞাসা। —ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার উত্তর সন্ধানে। খেলাধুলা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসে—। শুরু হয়ে যায় তার মহৎ লক্ষ্য পানে— আত্মানুসন্ধানের* লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। ক্রমশ দ্রুত বিকাশের লক্ষ্যে— পূর্ণতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলার নতুন খেলা।

 

ক্রমশ আরো চেতনা বৃদ্ধি পেলে, একটু একটু ক’রে আত্মজ্ঞান লাভ করতে থাকে সে। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসে অনেক কিছু—। পরিণত হয়ে ওঠে সে ক্রমশ।

 

আমি কে—, কেন্—, কোথা থেকে এসেছি—, কোথায় যাব—, কি উদ্দেশ্যে আমি সৃষ্ট হয়েছি—(?) —এ’ প্রশ্ন আজ নতুন নয়। এ’ প্রশ্ন আমার— তোমার সকলের অন্তরে জ্ঞাতে—অজ্ঞাতে অনুক্ষণ অনুরণিত হয়ে চলেছে— সৃষ্টির আদি কাল হতে। এই প্রশ্নই সৃষ্টিলীলার মূল কারণ। আমি যেমন নিজেকে প্রশ্ন করছি, ‘আমি কে—কেন—কোথা থেকে—কোথায়’, বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বরও) তেমনি নিজেকে এই একই প্রশ্ন করছে। আবার, আদিসত্তা— পরমাত্মাও এই একই প্রশ্নবাণে জর্জরিত ক’রে তুলছে নিজেকে!

 

আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে শিকড়ের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়াই হলো— এই মহাজীবন-চলা। একেই অনেকে ‘সৃষ্টিলীলা’ বলে থাকেন। আসলে, এই সৃষ্টি— পরমাত্মার কল্পনা-বিলাস বৈ আর কিছু নয়। এ’সমস্তই তার মানস-সৃজন। সেই হিসাবে, ঈশ্বরকে তার মানস-সন্তান-ও বলা যেতে পারে।

 

পরমাত্মা নিজের জীবনে যে সমস্ত ইচ্ছা পূরণে অক্ষম হয়েছে, কল্পনার মধ্য দিয়ে— সেই সমস্ত ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যেই তার এই লীলা-খেলা বা সৃষ্টিলীলা।

 

বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর)— শুধু আত্মানুসন্ধানেই নয়, সেই সাথে তার স্রষ্টার খোঁজেই শুধু নয়, এছাড়াও আরও একটি খোঁজ চলতে থাকে তার (বিশ্বাত্মার বা ঈশ্বরের) মধ্যে জ্ঞাতে—অজ্ঞাতে, তা’ হলো তার দোসরের খোঁজ। একাকীত্বের পীড়ায় পীড়িত হয়ে, কামনা-বাসনায় জর্জরিত হয়ে, অতঃপর বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর) মনে মনে স্থির করে, ‘হ্যাঁ, আমার প্রধান লক্ষ্য হলো নিজেকে জানা। তবে তার সাথে এ-ও দেখতে হবে, এখানে আমি একা— না আমার কোনো দোসর আছে।’#

 

কিন্তু কি ক’রে তা’ সম্ভব! সে শুধুমাত্র নিজেকে সম্প্রসারিত— বিস্ফোরিত করতে সক্ষম। বহু বিশ্ব নিয়ে গঠিত— মহাসৃষ্টির সম্প্রসারণের ফলে নির্ধারিত পথে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া, পরমাত্মার শরীরের (বা ব্রহ্মাঞ্চলের) অন্য কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা— নতুন উদ্যোমে জলন্ত গ্যাসীও অগ্নিপিন্ডের মতো কোটি কোটি অংশে বিভক্ত হয়ে, দুরন্ত গতিতে দশদিকে (সবদিকে) প্রসারিত হয়ে— দিগবিজয়ে বেড়িয়ে পড়ে সে।** যেন রাজ্য জয়ের মহোৎসবে— মহাশূন্য জুড়ে আতসবাজীর খেলা। কখনো একটা খণ্ড ভেঙে অনেক ছোট ছোট টুকরো হচ্ছে, আবার কখনো অনেক টুকরো মিলিত হয়ে একটা বড় খণ্ড অথবা গ্রহ— নক্ষত্র তৈরী হচ্ছে।

দুর্দম—দুরন্ত গতিতে নিজেকে প্রসারিত ক’রে এগিয়ে চলা—। পিছনে তাকানোর মতো একটুও সময় নেই হাতে। একের পর এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়, চক্রবৃদ্ধিহারে কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে— অবিরাম চলা।

 

ক্রমবিকাশমান চেতনার বিভিন্ন স্তরে, কল্পনার রঙে-রূপে-রসে —নিজেরই উপাদানে নিজেকে গড়ছে—ভাঙছে বারবার। যাত্রাপথের একঘেয়েমী দূর করতে, নিজেকে রসে-বশে আনন্দময় রাখতে, বিভিন্ন উপায়ে বা পথে কাম-তাড়নার প্রশমন ঘটাতে— সদা সক্রিয় সৃজনশীল শিল্পী-মন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

#মহাসৃষ্টিতে আরও অনেক বিশ্ব (দোসর) থাকলেও, প্রথমদিকে বিশ্বাত্মা তাদের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ক্রমবিকাশের পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে এসে, পরবর্তীকালে সে তার দোসরের সন্ধান পায়।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------

 

আদি ইচ্ছাকে সফল ক’রে তুলতে, আনন্দ পেতে— আবিরাম চিন্তা-যজ্ঞ চলছে। দ্রুত সিদ্ধিলাভ চাই, আবার একঘেয়েমী থেকে মুক্তি পেতে চাই বৈচিত্র, চাই সুখস্বাদ। শিল্পীমন মেতে আছে নবনব সৃষ্টির তাড়নায়। প্রকারান্তরে— পূর্ণতা লাভের আকাঙ্খায়।

 

নিরন্তর গবেষণায় নিত্য-নব রূপে— বহুভাবে নিজেকে করছে আবিষ্কার। স্রষ্টা সে— সৃষ্টিও সে-ই। সৃষ্টির আনন্দে মশগুল শিল্পী-গবেষক বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর— অনেক পথ পেরিয়ে এসে, এখন সে অনেকটাই পরিণত।

 

মহাসৃষ্টির আনন্দে মত্তপ্রায়— অপরিসীম সুখাবিষ্ট মোহাচ্ছন্ন বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর)— নতুন আর কী সৃষ্টি করবে, যা কিছু সবই ছিলো বীজ রূপে। জ্ঞান-চেতনা— সমস্ত কিছু। চলতে চলতে সময়ের সাথে সাথে, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে— বিকাশ ঘটছে ধাপে ধাপে। পূর্ব নির্ধারিতভাবে ঘটে চলেছে— যখন যা ঘটার।

 

এরই নাম ভাগ্য! না, প্রত্যক্ষভাবে এর পিছনে সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি বা চেতন সত্তা নেই। কারো অঙ্গুলী হেলনে বা কারো খেয়াল-খুশিমতো এ’সব কিছু ঘটছে না। ঘটছে— মহাজাগতিক ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক দুটি ভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে। ঐচ্ছিক শক্তি কাজ করছে— আদি বীজ-কোষ এবং সমস্ত বিশ্ব-কোষের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত নির্দেশ বা ‘প্রোগ্রাম’ বা ‘প্রি-প্রোগ্রাম’ অনুসারে। আর, অনৈচ্ছিক শক্তি কাজ করছে— ঘটনা প্রবাহের কার্য-কারণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ম মেনে, প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

 

একটা উদাহরণ দিলেই ভাগ্য সম্পর্কে ধারণাটা পরিস্কার হয়ে যাবে। একটা পটকা অথবা খুব ছো্ট একটা বোমার চারিদিকে কতগুলি মারবেল বা পাথরের টুকরো রেখে, —কাগজ দিয়ে মুড়ে নাও, যেন পটকাটির পলতেটা বাইরে বেড়িয়ে থাকে। এবার একটা পরিস্কার ফাঁকা উঠানে নিয়ে গিয়ে— পটকাটি ফাটিয়ে দাও। বিস্ফোরণের পরমূহুর্তে মারবেল বা পাথরের টুকরোগুলি চতুর্দিকে বিভিন্ন গতিতে— বিভিন্ন ঢঙে— ছিটকে বেড়িয়ে পড়েছে—। লক্ষ্য কর, এক একটা টুকরো এক এক পরিবেশে, এক এক ভাবে পাক খেয়ে অথবা গড়িয়ে চলেছে।

কেউ হয়তো আর একটিকে আঘাত ক’রে ভেঙে দুই বা ততোধিক টুকরো হয়েছে। আবার কোনো টুকরো হয়তো আরেকটিকে আঘাত ক’রে তার আচরণে পরিবর্তন এনেছে। আর, কোনো একটা টুকরো হয়তো এক জায়গায় লাট্টুর মতো পাক খেয়ে চলেছে। এইরকম বহু ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে একই সময়ে। কারো আচরণের সাথে কারো পুরোপুরি মিল নেই।

ওখানে এমন একজন দিব্যজ্ঞানী যদি থাকতেন, —পটকাটি, মারবেল বা পাথরের টুকরোগুলির আকার—আয়তন—ওজন, উপাদানাদি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ—আবহাওয়া প্রভৃতি সমস্তকিছু সম্পর্কে যাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টি— প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে, তিনি বলে দিতে পারতেন, কখন কোন টুকরোটির কি দশা হবে, কার কি গতি বা কি পরিণতি ঘটবে। কারণ, ওদের সবার ভাগ্যই নির্ধারিত হয়ে গেছে পটকাটি ফাটার মূহুর্তেই।

 

আরো সহজ ক’রে বোঝাতে, ঘুরণ-চরকী লটারী খেলার সাদামাটা চক্রের মতো যন্ত্রটার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চক্রটি ঘুরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ঠিক হয়ে যায়— তার কাঁটাটি কোন ঘরে বা কত নম্বরে— কখন গিয়ে থামবে। 

 

ঠিক তেমনিভাবে, এখানে যা কিছু ঘটছে, ঘটেছে এবং ঘটবে— সমস্ত কিছুর মূল কারণ নিহিত রয়েছে সেই মহাবিস্ফোরণের মূহুর্তে। একেই বলা হয়— ভাগ্য। ঈশ্বর নিজেও এই ভাগ্যের বাঁধনে বাঁধা। আমরাতো তার অংশমাত্র (‘ভাগ্য আসলে কী’ স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)।

 

বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) ইচ্ছা—অনিচ্ছা এবং আমাদের ইচ্ছা—অনিচ্ছাগুলি সবই, যখন যেটা জাগ্রত হওয়ার— হয়। আমাদের ইচ্ছাও আমাদের নিজস্ব নয়। সে-ও পূর্বনির্ধারিত সময় মতোই জাগ্রত হয়, আবার সময় মতোই তিরোহিত হয়। যখন যেমনটি হবার তেমনটিই হয়। সেই ‘প্রি-প্রোগ্রামড’ ঐচ্ছিক শক্তি আর মহাবিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট ‘ভাগ্য’ রূপ— অনৈচ্ছিক শক্তি, উভয়ে মিলেমিশে কাজ ক’রে চলেছে সর্বক্ষণ।

 

প্রধাণত অনৈচ্ছিক শক্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে— ভাগ্য! আর, ঐচ্ছিক শক্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছে— বিশ্ব-মন বা ঈশ্বর-মন এবং আমাদের মন। এই মন ও তার ইচ্ছা— চিন্তা-ভাবনা, এও সেই অনৈচ্ছিক শক্তির অধিন। ভাগ্যের তালে তাল মিলিয়ে এই মনের বিকাশ ঘটে চলেছে— একটু একটু ক’রে। ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ইচ্ছুক মন— ঈশ্বর মন-এর জন্ম দিয়ে, আদি ঐচ্ছিক শক্তি— আপাতত নিস্ক্রিয় শক্তিরূপে অন্তরাল থেকে কাজ করে চলেছে সঙ্গোপনে।

 

মহাজগত বিভিন্ন সময়ে— কখন কী রূপ ধারণ করবে, এবং সেই সঙ্গে জীব এবং অন্যান্য চেতন-সত্তার অস্তিত্ব আর তাদের বিভিন্ন দশার যাবতীয় পরিকল্পনা বীজাকারে— ‘প্রোগ্রাম’ আকারে আদিসত্তার মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। সেই আদিসত্তা থেকে জন্ম নেওয়া সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু—কণাসহ আমাদের তথা জীবের প্রতিটি (দেহ ও মস্তিষ্ক) কোষের মধ্যে সেই ‘প্রোগ্রাম’ বিদ্যমান রয়েছে।

 

সেই ঐচ্ছিক ক্রিয়া আর ভাগ্যরূপ অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার ঐক্য-বাদনে মহাজাগতিক সুর রচিত হয়ে চলেছে।

 

==========================================================

* এ’এক অদ্ভূত অন্বেষণ। এই খোঁজার প্রথমদিকে একটা বড় অংশ পর্যন্ত—, কে খোঁজে, কিম্বা কাকে খোঁজে, কেন খোঁজে, কোথায় খোঁজে— এ’ সবই থাকে অজানা। তবু নিজের অজ্ঞাতেই খোঁজ চলতে থাকে— অনবরত, চলতেই থাকে।

** এতদিন ধরে এই চলা— এই ছড়িয়ে পড়া ছিলো অনৈচ্ছিকভাবে— অজ্ঞানে। এখন সেই চলাই— সেই ছড়িয়ে পড়াই সতেজ হলো—, নতুন উদ্যোমে— ইচ্ছাকৃতভাবে— সচেতনভাবে।

==========================================================

 

পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের বুকে মানুষ এবং বিভিন্নরূপ চেতন-সত্তার চেতনার এই যে ক্রমবিকাশ, এর পিছনেও কাজ করছে সেই আদি উদ্দেশ্য। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের অংশানুক্রমে কোটি কোটি অনুবৎ আমরাও জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে চলেছি ছুটে সেই আত্মজিজ্ঞাসা— সেই আদি প্রশ্ন নিয়ে।

 

সৃষ্টির শুরুতে— বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের স্বল্প-চেতন-স্তরে, আজকের এই উন্নত জীব— মানুষ এবং অন্যান্য উচ্চ চেতন-সত্তার কল্পনাও তখন অসাধ্য ছিলো তার কাছে। চলতে চলতে নিত্য নতুন চাওয়া-পাওয়া, ভাঙা-গড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নব নব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে— ক্রমশ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি এবং চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই মানুষ এবং অন্যান্য চেতন-সত্তা।

 

আমাদের জীবনযাত্রার সাথে প্রজাপতির জীবন-চক্রের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায়। প্রথমে ডিম, —আমাদের অতীতের সুপ্ত চেতনাবস্থা। তারপর শুককীট, —ক্রোধ, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা-স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা এবং আত্মরক্ষার অজস্র শুঁয়ো নিয়ে শুঁয়োপোকার মতো আমরা ইহলোকে এবং পরলোকে ভোগ সম্পন্ন ক’রে চলেছি। এই ভোগ শেষে— জ্ঞানযোগ সম্পূর্ণ হলে, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ ক’রে দিব্যলোকে— পরলোকোত্তর পরবর্তী জীবনে গভীর ধ্যানমগ্ন বা সমাধিস্থ হওয়া পূর্ণ বিকাশ লাভের উদ্দেশে। —সেই হলো মূককীট অবস্থা। অবশেষে পূর্ণ আত্মবিকাশ— প্রজাপতির মতো।

 

এখানে আমাদের বিকাশ ঘটছে তিনটি স্তরে। প্রথমটি হলো— বংশানুক্রমে। দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ ঘটছে দুই ভাগে, প্রথম পর্ব— ইহলোকে, এই জীবনে। আর দ্বিতীয় পর্বের বিকাশ ঘটছে— পরলোকে। তৃতীয় স্তরের বিকাশ ঘটছে, মহামানব স্তরে— দিব্যলোকে। পরলোকের মধ্যেও রয়েছে ক্রমোচ্চ কয়েকটি ছোট ছোট ক্রমোচ্চ স্তর। পরলোকের সর্বোচ্চ স্তর পার হয়ে পৌঁছাতে হয় মহামানব স্তরে। তার পরেও রয়েছে আরও কয়েকটি ক্রমোচ্চ চেতন স্তর। দেব-চেতন স্তর, মহাদেব-চেতন স্তর, এবং সব শেষে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-চেতন স্তরে উন্নীত হয়ে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের সাথে একাত্ম বোধে বিলীন হয়ে যাওয়া (এ’নিয়ে অন্যত্র বিশদভাবে আলোচনা করেছি)।

 

বংশানুক্রমে যে বিকাশ ঘটছে, তাকেই ডিম্ব অধ্যায় বলা যায়। কারণ, অগণিত পূর্বজদের শরীর-কোষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে জীব সত্তাটি। পূর্বজদের অর্জিত জ্ঞান-চেতনা— যা সংক্রামিত হয় তাদের শরীর-মস্তিষ্ক কোষে, মন সফটওয়ারে এবং তাদের শুক্রকীটে বা ডিম্বকোষে। পূর্বজদের কোষের মধ্যে সুপ্ত থাকা অবস্থাতেই বংশ-পরাম্পরায় ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে ভবিষ্যতের হবু জীবসত্তা।

 

আমরা সবাই চলেছি সেই এক লক্ষ্য পানে—, কেউ জ্ঞানে, কেউ অজ্ঞানে। তাই কেউ জানে, কেউ জানেনা— আসলে একই পথের পথিক আমরা। জড়বৎ অস্ফূট চেতনা হ’তে পূর্ণ চেতনার পথে, কর্ম আর ভোগের মধ্য দিয়ে অবিরাম চলা—। এখানে কেউ থেমে নেই— থেমে থাকে যায়ও না। পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আরও অনেক কারণে গতির বিভিন্নতা। কেউ আছে এগিয়ে, আর কেউ পিছিয়ে।

 

আজ এখানে এসে পৌঁছানোর পিছনে রয়েছে লক্ষ-লক্ষ বছরের অজস্র দুঃখ-কষ্টে ভরা দুঃসহ যন্ত্রনাময় ইতিহাস। যতই এগিয়েছি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতা-যন্ত্রনা রূপান্তরিত হয়ে পেয়েছি চেতনা। আপাতভাবে আমরা এ’ সমস্ত ভুলে গেলেও, সৃষ্টির আদিকাল থেকে— সমস্ত স্মৃতিই সঞ্চিত রয়েছে আমাদের অন্তরের গভীর স্মৃতি-ভান্ডারে। অন্তরের গভীরে ডুবতে পারলেই সব জানা যাবে।

 

অতীতকে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, কীভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে তিলে তিলে দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা, শোক-সমস্যা-হতাশা, ...নিদারুণ যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে প্রায় জড়বৎ মনে একটু একটু ক’রে চেতনার বিকাশ ঘটে চলেছে। পূর্ণ লক্ষ্যে না পৌঁছানো অবধি এর থেকে রেহাই বা মুক্তি নেই। যত বেশি উচ্চাকাঙ্খা, যত বেশি বহির্মুখিতা, যত বেশি উত্তেজনা— অস্থিরিতা, বুঝবে, মুক্তি ততই সন্নিকট। এই মুক্তি— অজ্ঞানতা—অন্ধত্ব—বন্ধন, —পরাধীনতা থেকে মুক্তি। মায়া-মোহপাশ থেকে মুক্তি। অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন মোহ, এবং তার থেকে উৎপন্ন বহু জাগতিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি।

 

আকরিক লৌহ-পিন্ডকে যেমন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-পিটিয়ে, নানাবিধ শোধনের পর, ঘষে-মেজে জাগানো হয় তার ঔজ্বল্য— তার শাশ্বত রূপ, চেতনার বিকাশ-প্রক্রিয়াও তেমনি এক সুসম্বদ্ধ ব্যবস্থা। ভয় পেয়ে, শান্তি বা মুক্তির খোঁজে পালিয়ে গেলেই রেহাই পাবে, তা’ ভেবনা। ভোগ তোমায় সম্পূর্ণ করতেই হবে।

 

তবে দ্রুত হবে কী বিলম্বিত হবে, এবং কিভাবে হবে— সবই পূর্ব নির্ধারিত। আমরা অসহায়। ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক সম। আমাদের নিজস্ব কিছু করার নেই। যা ভাবছি—, যা করছি্‌—, তা’ না ক’রে উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়ে করছি। যা কিছু করছি, তা’ করতে বাধ্য হচ্ছি বলেই করছি। অজ্ঞানতাবশতঃ মনে হচ্ছে— ‘আমি করছি, আমি বলছি, আমার ইচ্ছায় হচ্ছে বা ঘটছে।’

 

আমরা! —কেন এই স্বাতন্ত্র বোধ— এই বহুত্ব?! —শুধু বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর সৃষ্ট জীব-জগতেই নয়, এই বহুত্ব মহাবিশ্বের সর্বত্র। একী তবে বিশ্বাত্মার একাকীত্বের দুঃসহ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবার প্রয়াস?!

 

আসলে, এ-ও তার অদৃষ্ট বা ভাগ্য। মহাবিস্ফোরণের পরক্ষণ থেকে দশদিকে ছিটকে—ছড়িয়ে পড়া ছোট বড় জমাট বাঁধা প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কণা, প্রতিটি অনু-পরমানু সেই চরম আঘাতের ফলে আত্মবিস্মৃত হয়েছে। একত্ব ভুলে স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে ছুটে চলেছে, কর্ম করে চলেছে যে যার অদৃষ্ট মতো। এর পিছনে— সৃষ্টিপূর্বে, আত্মসম্মোহন দ্বারা আত্মবিস্মৃতি সহ অজ্ঞানাবস্থা লাভ-ও এর অন্যতম কারণ।

 

এ’যেন আমাদের শরীরের মতো। বিভিন্ন ধরণের কোটি কোটি কোষ দিয়ে গঠিত এই শরীর। যেন, প্রতিটি কোষ নিজেকে বোধ করছে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে। কর্ম ক’রে যাচ্ছে যে যার মতো। প্রত্যেকেই যেন এক একটা ‘আমি’। আর এই অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘আমি’ নিয়ে আমি— ‘মহা-আমি’। আজকের এই ‘আমি’ মহাজগতের এক আবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ‘আমি’-কে বাদ দিয়ে— এই মহাজগত-অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নয়, সম্ভবও নয়।

 

'আমি'! এই জগতটাই আমি ময়। এই চেতন জগতে 'আমি' থেকে মুক্তি নেই। পরম-আমি থেকে ঈশ্বর-আমি, তারপর, অহম-আমি, অহংকারে মত্ত আমি। অস্ফুট আমি থেকে বিকশিত আমি। অবচেতন-মন সেও নিজেকে বলছে, 'আমি'। মোহাচ্ছন্ন অজ্ঞান আমি। আবার —সচেতন-মন সেও নিজেকে বলছে, 'আমি'। সচেতন আমি। আমি হলো চেতন জগতের প্রথম আত্মোপলব্ধীর প্রকাশ! —আমি নেই তো কিছুই নেই!

 

এই ‘আমি’ যা ভাবছে— যা করছে, তার পিছনে রয়েছে অসংখ্য ঘটনা। কোটি কোটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয়— আরো কোটি কোটি ঘটনা। আবার, সেই সব ঘটনার ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় আরো অজস্র ঘটনা।

 

এইরূপে, ঘটনা-পরম্পরাগতভাবে— বর্তমানে জন্ম নেওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি হলো— এই ‘আমি’-র চিন্তা—ইচ্ছা। আর একটি হলো— এই ‘আমি’-র কর্ম। এদের থেকে আবার জন্ম নেবে অজস্র ঘটনা। এইভাবেই বয়ে চলেছে পরম্পরাগত ঘটনা-প্রবাহ।

 

‘আমি’-র চিন্তা এবং ‘আমি’-র কর্ম হলো— অতীত ও বর্তমানের অসংখ্য ঘটনার সাথে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অজস্র ক্রিয়া-বিক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল। ‘আমি’-র অস্তিত্ব, ‘আমি’-র কর্ম— সব কিছুই এই জাগতিক ব্যবস্থার ফসল।

 

তবে, যা-ই ঘটুক, আদি লক্ষ্য— আত্মান্বেষণ ও পূর্ণতালাভের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি কেউই। তা’ ঠিক গাঁথা আছে প্রত্যেকের অন্তরে। আমাদের সার্বিক বিকাশে— হবে তার পূর্ণতা লাভ। পুণরায় আপাতঃ ‘বহু’ থেকে ‘এক’-এ বিলীন হবার স্বপ্নে, প্রত্যেকে চলেছি এক অজ্ঞাত আকর্ষণে।

 

বিভিন্ন শক্তি—পদার্থ—বস্তু যে উৎস থেকে উৎপন্ন বা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের মনও সৃষ্টি হয়েছে সেই উৎস থেকেই। পরম-চেতনা এবং মহাচেতনা থেকেই আমরা আমাদের চেতনা লাভ করেছি। মহাপ্রাণ থেকেই পেয়েছি আমরা প্রাণশক্তি। মহাবিশ্ব-শরীর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই জীব-শরীর। পরিণতিতে— সমস্ত বস্তু—মন-চেতনা সেই উৎসে গিয়ে মিশে যাবে বা বিলীন হয়ে যাবে একসময়।

 

আদি শক্তি ও শক্তি-ক্ষেত্র থেকেই বিভিন্নরূপ শক্তি এবং বিভিন্ন ধরণের শক্তিক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি শক্তিক্ষেত্রের মধ্যেই আদি শক্তিক্ষেত্রের ছাপ বা সংকেত অন্তর্নিহিত রয়েছে।

এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু সৃষ্টির মূলে রয়েছে মানসক্রিয়া— চিন্তা। চিন্তা থেকেই ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছাক্রমেই সমস্ত সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এই চিন্তারূপ কর্মটির কর্তা হলো— মন। পরমাত্মার চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে বিশ্বরূপ বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়। আর, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-মনের চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হয়েছে— এই উদ্ভিদ ও জীব জগত।

 

তারপর, পৃথিবীর চিন্তাশীল জীব মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে আরও কতকিছু। চিন্তা—কল্পনাকে রূপায়ীত ক’রে তোলার ইচ্ছাতেই শুরু হয় কর্ম। আর, কর্ম থেকেই হয় সৃষ্টি। সৃষ্টিকে কেন্দ্র ক’রে সৃজনশীল মনে আবার একের পর এক চিন্তা—কল্পনা চলতে থাকে। তার থেকে জন্ম নেয় আরও নব নব সৃষ্টি।

 

তবে, অনেকসময়ে, যা কল্পনাতেও ছিলো না, —তা’ও সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে— ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার যৌথ কারবারে। অনেকসময়, চিন্তা ও ইচ্ছানুরূপ কাজ না হওয়া, সৃষ্টি না হওয়া— সফল না হওয়ার জন্য দায়ী হলো এই অনৈচ্ছিক ক্রিয়া— ভাগ্য! অনেকসময়েই, চিন্তাকে প্রভাবিত ক’রে থাকে— পরিচালিত ক’রে থাকে এই ভাগ্য।

 

অজ্ঞানতা জনিত মোহ-মায়াবশতঃ যতই বহুত্ব বোধ করুক সবাই, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর কিন্তু বহু হয়নি কখনোই। ‘এক’-ই রয়েছে সে। একটু ভালো ক’রে নিরীক্ষণ করলেই বুঝতে পারবে, —ঈশ্বর এখন পর্যন্ত পমাত্মার শরীরের বা ব্রহ্মাঞ্চলের যতটা অংশে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, তার মধ্যে এতটুকুও শূন্য নেই। সমস্ত স্থান জুড়ে হয় বস্তু— না হয় কোনো না কোনো শক্তি—কণা, আদিকণা অথবা আমাদের অজানা অন্য বস্তু— অন্য শক্তিতে ভরপুর হয়ে রয়েছে। আর তারই মধ্যে সূক্ষ্মভাবে ছড়িয়ে রয়েছে— দিব্য পদার্থ— পরম পদার্থ (বা ব্রহ্মপদার্থ) ও দিব্য চেতনা প্রভৃতি। স্বাতন্ত্র ও বহুত্ববোধ শুধু মনে। সৃষ্টির আদি থেকে মহাজগৎ ক্রমশ প্রসারিত হয়েই চলেছে, —‘বহু’ হয়নি কখনও।

 

কতকটা যেন, এক গামলা জলের মধ্যে— অনেকগুলি ছোট—বড় বরফের টুকরো। প্রতিটি টুকরো— প্রতিটি জলকণা মোহ-অজ্ঞানতা বশতঃ নিজেদেরকে এক একটি স্বতন্ত্র সত্তা ভাবছে। এইভাবেই মায়াত্মক বহুত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

 

আমাদের মহাকাশকে মহাশূন্য বলা হলেও, তা’ কিন্তু মোটেই শূন্য বা খালি নয়। মহাবিশ্ব অখন্ড। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই এই মহাকাশও সৃষ্টি হয়েছে, এবং সে-ও মহাবিশ্বের মতোই ক্রমশ প্রসারমান।

 

এই প্রসঙ্গে বলি, মহাজাগতিক সময়েরও সৃষ্টি হয়েছে— মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই। মহাজাগতিক সময়— আর পরমাত্মার পারমাত্মিক সময় এক নয়। যেমন এক নয়— আমাদের পার্থিব সময়। মহাজগতের জন্মের পূর্বে, মহাজাগতিক সময় সৃষ্টির পূর্বে— ছিলো শুধু পারমাত্মিক বা পরম সময়। ‘সময়’ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছি অপর একটি অধ্যায়ে।

 

আমরা যেন এক মহা মায়ানদীর স্রোতের টানে ছুটে চলা বিন্দু বিন্দু জলকণারাশি। এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই কারো। ঘটনাচক্রে— বিকাশের মাত্রা অনুসারে, কেউ আছে নীচে, কেউ মাঝে আর কেউ উপরের স্রোতে। যে যেখানে— সেই মতো তার দর্শন। যে আছে একেবারে সবার ওপর তলে, একমাত্র সে-ই দেখতে পারছে— আকাশ, দেখতে পারছে— বাইরের দৃশ্যপট। বুঝতে পারছে তার প্রকৃত অবস্থাটা। বিচার করতে পারছে আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, এই স্রোতকে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই তারও।

আনন্দ পেতে চেয়ে কর্ম-যজ্ঞে নেমে, না চেয়েও জ্ঞান লাভ হয়। তবু যদি আনন্দ না পেতে চায় কেউ, দুঃখ পেতে হবে জেনে, —কেউ যদি এগিয়ে না যায়, তাই— জ্বালাময়ী দুটি ক্ষুধা সর্বদা জ্বলছে এই দেহে। সেই সাথে আর আছে— রোগ-যন্ত্রনা, আত্মরক্ষার তাগিদ, —এদের মেটাতে গিয়ে ছুটতেই হবে। জ্বালা নেভাতে গিয়ে আরো জ্বালা বাড়ে, না চেয়েও জ্ঞান ও চেতনা বেড়ে ওঠে নিজেরই অজ্ঞাতে।

 

ওদের তাড়নায় এইভাবে চলতে চলতে— একটা সময় আসে, যখন জ্ঞান লাভেই আনন্দ অনুভূত হয়। ক্রমশ আত্মজ্ঞান— আত্মচেতনা, অন্তর্নিহিত সুপ্ত আত্মশক্তি বিকশিত হতে থাকে। অতঃপর একসময় যখন দিব্যসত্তাটি বিকশিত হয়ে ‘ঈশ্বর-আমি’-তে পর্যবসিত হয়, তখন (আপাত) পূর্ণতা লাভের** সাথে সাথে আসে অচলাবস্থা। এক আকার ধারণ করতেই, বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব হয় না আর। একাত্মবোধ— অবিলম্বে একীভূত—একাকার হওয়ার ডাক আসে।

 

অবশেষে, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটার সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে— তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত অংশের— এমনকি অজ্ঞান-অন্ধকার অংশেরও পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তার সমস্ত অংশের অজ্ঞানতা-অন্ধত্ব-অন্ধকার দূর হয়ে— আলোকময় হয়ে ওঠে এক নিমেষে।

 

এদিকেও তখন দেখাযায়, নিকটবর্তী দুটি বিপরিত বিশ্ব— ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে একে অপরের অতি নিকটে চলে এসেছে মিলনের আকাঙ্খায়। শুধু আমদের বিশ্ব-ই নয়, অপরাপর বিশ্বগুলির ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা।

 

হঠাৎ এক সুতীব্র আলোর ঝলকানির সাথে সাথে ভোজবাজীর মতো সব নিমেষে উধাও! বিপরীত বিশ্বগুলির মিলনের মধ্য দিয়ে— ঘটে সৃষ্টিলীলার অবসান। এ ঘটনা শুধু আমাদের বিশ্ব এবং তার বিপরীত বিশ্বের ক্ষেত্রেই নয়, একই সময়ে, এই একই ঘটনা ঘটে অন্যান্য সমস্ত বিশ্ব এবং তাদের বিপরিত বিশ্বের ক্ষেত্রেও।

 

অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এক কল্প-নাটক দেখা শেষ ক’রে, পরিশ্রান্ত পরমাত্মা (বা পরমব্রহ্ম) নিজেকে সঁপে দেয় গভীর নিদ্রার কোলে।

 

‘মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন’ অধ্যায় এখানেই শেষ হলো। যাকে জানা দুষ্কর, জানলেও, ব্যক্ত করা কঠিন—, সেই অব্যক্ত পরমাত্মা বা ব্রহ্মের অতি কিঞ্চিৎ মাত্র ব্যক্ত করা সম্ভব হলো— শুধুমাত্র তার ইচ্ছাতেই। এ’টুকু নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে এখন।

 

===============================================================

 

।। সৃষ্টিতত্ত্বের গোপন রহস্য উন্মোচন ।।

 

বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর বা স্রষ্টা) এবং তদকর্তৃক সৃষ্ট এই জীবজগত সহ সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হলো এক ভার্চুয়াল অস্তিত্ব বা মায়া অস্তিত্ব। এ' হলো কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতোই অতি উন্নত মানের প্রোগ্রামীং কোড দ্বারা সৃষ্ট ও চালিত এক বিশাল ভিডিও গেম বা হলোগ্রাম নাটকের মতো পূর্ব পরিকল্পিত নাটক।

 

আমাদের বুদ্ধিমত্তা, যাকে আমরা প্রাকৃতিক বলে জানি, সেও আসলে আমাদের স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

 

আমরা যেমন নিজেরা ভার্চুয়াল অস্তিত্ব হয়েও, কম্পিউটার গেমের মধ্যে অনেক ভার্চুয়াল চরিত্র সহ ভার্চুয়াল জগত সৃষ্টি করছি, তেমনি বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর) নিজে এক মায়া অস্তিত্ব হয়েও, এই জীবজগত সহ আমাদের অনুভব যোগ্য তথাকথিত বাস্তব জগত সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর) সৃষ্ট উন্নত জীব মানুষ কর্তৃক এবং অন্যান্য গ্রহের এবং অন্যান্য বিশ্বের অতি উন্নত জীব অথবা তদ্রুপ সক্রিয় চেতন-সত্তাদের দ্বারাও অনেক জায়গায় ভার্চুয়াল জগত এবং জীব বা জীব সদৃশ এনিমেটেড ভার্চুয়াল ক্যারেকটার বা সত্তা  সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে। 

 

========================================================================

 

 

 

মহাজীবন চলার পথে বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর ও আমরা:

 

ঠিক আমাদের মতোই, সৃজন কালে (শিশু-চেতন ও কিশোর-চেতন স্তরে, এবং যৌবন-চেতন স্তরের প্রথম দিকে)— বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর মনের মধ্যেও ছিলো দুটি মন, দুটি অংশ-মন। একটি হলো— সচেতন মন বা কিশোর মন, আর অপরটি হলো— অবচেতন মন বা শিশুচেতন মন। তার এই অন্ধ-আবেগ সর্বস্ব— যুক্তি-বিচার-কান্ডজ্ঞান বিহিন, মোহ-মায়াময় মনটিই হলো— মহামায়াত্মা ! আর তৎকালে আংশিক বিকশিত— আংশিক জাগ্রত সচেতন মনটিই হলো— মহামন বা মহামানস। আমাদের মধ্যে— যাদের মনরাজ্যে প্রধানতঃ অবচেতন মনের রাজত্ব বা প্রভুত্ব চলছে, সচেতন মন তেমন জাগ্রত না হওয়ায়— সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা, তারা ঈশ্বরের অবচেতন বা শিশুমন— মহামায়াত্মার ভক্ত ও উপাসক।

 

আর যাদের সচেতন মন অনেকাংশে বিকশিত— অনেকটাই সক্রিয় এবং অবচেতন মনের উপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম, —তারা ঈশ্বরের সচেতন বা কিশোর-চেতন মন এবং কেউ কেউ তার যৌবন-চেতন মনের ভক্ত এবং যুক্তি-বিচার ও জ্ঞান-পথের পথিক। মনের মিল হলে তবেই না তাকে ভালোলাগে !

 

ঠিক আমাদের মতোই— ঈশ্বরও চেতনার ক্রমবিকাশের পথ ধরে সর্বদা এগিয়ে চলেছে। ঈশ্বর এখন আর পূর্বের সেই চেতনস্তরে নেই, এখন সে অনেক উচ্চ (প্রৌঢ়) চেতন স্তরে অবস্থান করছে। আমরা তার দ্বারা— তার অংশ হতে সৃষ্ট জীবগণ বর্তমানে মানব-চেতন (বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের ক্ষেত্রে শিশু ও কিশোর চেতন) স্তরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সূক্ষ্ম চেতনস্তরে অবস্থান করছি, এবং ক্রমশ পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে (জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে) এগিয়ে চলেছি, ঠিক ঈশ্বরের মতোই!

 

আমরা বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের অংশ হলেও, —স্বতন্ত্র চেতন সত্তা হওয়ার কারণে এবং আমাদেরকে প্রথম সৃজন কালে, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের তৎকালীন চেতনস্তর থেকে অনেকটাই উচ্চ চেতনস্তরে অবস্থান করার ফলে, পৃথিবী থেকে বহুপূর্বে বিদায় নেওয়া আমাদের অগ্রজ বহু মানুষ— বহু উচ্চ চেতনস্তরে উন্নীত হয়ে— ক্রমে ঈশ্বরের নিকটবর্তী চেতন স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। 

 

ঈশ্বরের (বিশ্বাত্মার) আয়ুষ্কাল অনেক বেশি হওয়ায়, ঈশ্বর-চেতনার বিকাশ ঘটে খুব ধীর গতিতে (দ্রষ্টব্যঃ ‘সময় ও বয়স’ প্রবন্ধ)। এক-একটি চেতন-স্তর অতিক্রম করতে— তার লক্ষ লক্ষ বছর (পৃথিবীর সময়ে) লেগে যায়। সে তুলনায় মানুষ বা মানুষের মতো চেতন-সত্তার ক্ষেত্রে এক-একটি চেতন-স্তর অতিক্রম করতে (পৃথিবীর সময়ে) সময় লাগে হাজার হাজার বছর। এছাড়া, তুমি মধ্যম চেতন-স্তরের পর থেকে, যত উচ্চ চেতন-স্তরে উপনীত হবে, তোমার এগিয়ে চলার গতি ততই মন্থর হয়ে আসবে। এই কারণেই, ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) মানুষের চাইতে চেতনায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও, মানুষের পক্ষে ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) চেতন-স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ঈশ্বর ও মানুষ বা মনুষ্যতুল্য জীব বা সত্তা— উভয়ের ক্ষেত্রেই, মধ্যম চেতন-স্তরগুলিতে— চেতনা যত বৃদ্ধি পাবে, চেতনা বিকাশের গতিও বৃদ্ধি পাবে ততই। নিম্ন ও উচ্চ চেতন-স্তরে বিকাশের গতি মন্থর হয়ে থাকে।

 

বর্তমানে আমরা কিন্তু ঈশ্বরের দ্বারা সরাসরি সৃজিত নই। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর কৃত স্বয়ংক্রিয় সৃজন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে—পরম্পরাগত ভাবে আমাদের জন্ম হচ্ছে এখন। একসময় আমরাও ক্রমবিকাশের পথ ধরে বিশ্বাত্মার (ঈশ্বর) চেতনস্তরে উপনীত হব। এটাই মহা জীবনচলা।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর ও আমরা : কয়েকটি সূত্র:

 

● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর কাউকে আলাদা ভাবে কৃপা করে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকে পূজা ও তোষামোদ কামনা করে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের কাউকেই শত্রু বা মিত্র কোনো দৃষ্টিতেই দেখে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর যা দেওয়ার, যা করার প্রথম সৃজন কালেই করেছে, নতুন করে আর কিছু করার নেই তার। ● আমাদের উপর তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কোনোটাই হয় না সে। ● বিশ্বাত্মা/ঈশ্বর আমাদের ভাগ্য নিয়ন্তা নয়।

 

★ এখন আমাদের ভালো-মন্দ যাকিছু হচ্ছে বা ঘটছে, সে সবই হচ্ছে ভাগ্য ক্রমে বা জাগতিক ব‍্যবস্থাক্রমে। ★ ভাগ্য হলো জাগতিক ব‍্যবস্থার অন্তর্গত অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। এখানে, আমরা ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার মিলিত ফল ভোগ করে থাকি।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মন :

 

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মন নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। যারা নিজের মনটাকেই এখনো ঠিকমতো বুঝতে বা জানতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বর-মনকে বোঝা বা জানা, তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা সত্যিই দুষ্কর।

 

মনকে বুঝতে হয় মন দিয়েই। আর তার জন্য প্রয়োজন হয়--- সজাগ-সচেতন-সত‍্যপ্রিয়, যথেষ্ট বিকশিত মুক্ত-মন।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করার পক্ষে এই নিদর্শনটি অনেকটা সহায়ক হবে আশাকরি---

 

মরণশীল জীবের বংশবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে--- তাদের অস্তিত্ব, বংশধারা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর যে কৌশল রচনা করেছে, তাতেই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আর, বুদ্ধিমত্তাই হলো 'মন'-এর উপস্থিতির নিদর্শন। অর্থাৎ যেখানে বুদ্ধি আছে, সেখানে অবশ্যই মন আছে। যেমন, কোথাও ধোঁয়া থাকলে--- আমরা সেখানে আগুনের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি সহজেই অনুমান করতে পারি।

 

এবার বলি, সেই কৌশলের কথা--- যৌন সুখের ব্যবস্থা করা এবং যৌনসুখের প্রতি জীবকে প্রলুব্ধ ক'রে তুলে, ---তার মধ্যে যৌন মিলনের তাড়নারূপ প্রোগ্রাম-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, জীবকে যৌনমিলনে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য ক'রে তোলার কৌশলটি অবশ্যই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।

স্রষ্টার বুদ্ধিমত্তার আরেকটি নিদর্শন হলো— উন্নতমানের জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষ জীব সৃষ্টি করা এবং তাদের যথোপযুক্ত শরীর-যন্ত্র তৈরি করা। এসবের পিছনে স্পষ্টতই বুদ্ধিমত্তা বা বুদ্ধিমান সচেতন মনের অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়ে থাকে।

এছাড়া, আমরা যাতে নিজেদের শরীর বিনষ্ট ক'রে না ফেলি, আমরা রোগ-ব‍্যাধি, আঘাত-- আক্রমণ থেকে যাতে বাঁচার চেষ্টা করি, সেজন্য স্রষ্টা* আমাদের মধ্যে যন্ত্রণা বোধ দিয়েছে।

যদিও, তার সব কাজই সম্পূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত নয়, আমাদের অনেকের কাছেই যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়, তবুও সৃজনকালে (চেতনার ক্রমবিকাশের একটি বিশেষ স্তরে) তার জ্ঞান ও চেতনা সাপেক্ষে সে অনেক কিছুই করেছে। স্রষ্টা আমাদের দিয়েছে অনেক আত্মরক্ষার ব‍্যবস্থাও।

 

খুঁজলে, এইরকম আরো অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে। আর একটু সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, দেখা যাবে--- আমাদেরকে স্বল্পচেতন মানব থেকে ক্রমশ উচ্চ--- আরও উচ্চ চেতনা ও জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ক'রে তোলার উদ্দেশ্যে , সে নানা প্রকার কৌশল তৈরী করেছে।

 

এছাড়াও, আরো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, সুদীর্ঘকাল ধরে ঈশ্বর-মনও ক্রমশ একটু একটু ক'রে বিকশিত হয়ে চলছে। মনোবিকাশের সাথে সাথে তার সৃজন ক্ষমতারও যে উন্নতি হয়েছে, তা তার ক্রমোন্নত (কীট থেকে আরম্ভ করে উন্নত মানুষ) সৃষ্টির দিকে তাকালেই তা' স্পষ্ট বোঝা যাবে।

 

 

আমাদের কাছে বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর অস্তিত্বের প্রমান--

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হলে, আমাদের প্রমাণ করতে হবে--- ঈশ্বর-মনের অস্তিত্ব। আমাদের 'মহাবাদ' দর্শন অনুসারে --- আমরা মনে করি, সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডই হলো ঈশ্বর-শরীর বা ঈশ্বর।

 

এক্ষেত্রে, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের শরীর-অস্তিত্বের প্রমাণ দাখিল করার প্রয়োজন নেই। শুধু প্রমাণ করতে হবে, এই শরীরের মধ্যে একটি 'মহামন' আছে।

 

আমরা মনে করি, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেনি। সে নিজেই এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড। অর্থাৎ তার পিছনে এক সৃষ্টিকর্তা অথবা সৃষ্টিরহস্য আছে। এ'নিয়ে পূর্বেই আমাদের 'মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন' নামক সৃষ্টিতত্ত্বে যথাসম্ভব বর্ণনা করা হয়েছে। এই দর্শনে আমরা দেখেছি, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর শুধু উদ্ভিদ ও জীব সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে এই জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ, সে আবার সৃষ্টি করেছে অনেক কিছু।

 

বস্তুতঃ এই জীব সৃষ্টির কর্তা হলো ঈশ্বরের মন। আমাদের ক্ষেত্রেও, আমরা যাকিছু সৃষ্টি করছি--- তার প্রকৃত স্রষ্টা হলো আমাদের মন।

 

এখন, এই মনকে বুঝতে হয় মন দিয়ে। মনের অস্তিত্বকে সরাসরি দেখা বা অনুভব করা--- আমাদের অধিকাংশ স্বল্প চেতন মনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। মনের অস্তিত্বকে আমরা অনুভব করি--- মনের কার্যকলাপের মাধ্যমে।

 

মন হলো অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়্যার-এর মতো একটি অতি উচ্চমানের সফটওয়্যার বিশেষ। এই সফটওয়ারের পিছনেও থাকে ডেভলপার---প্রোগ্রামার। এমনি এমনি কিছুই সৃষ্টি হয়ে যায় না।

 

 

 

মন সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে, ‘মন-আমি’ এবং ‘নিজের মনকে জানো’ পড়ুন।

 

=========================================================

 

**এই পূর্ণতা লাভ হলো— স্বতন্ত্র সত্তার পূর্ণ বিকাশ লাভ। ইশ্বরের পক্ষে পূর্ণতা লাভ বা পূর্ণ বিকাশলাভ সম্ভব। কিন্তু তা-ই ব’লে, পরমব্রহ্ম— পরমাত্মার পক্ষে তা’ সম্ভব নয়। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের পূর্ণ বিকাশ লাভ হলো— পুনরায় সৃষ্টিপূর্বের অবস্থায়, পরমাত্মার অবস্থানে ফিরে আসা।

ভাগ্য আসলে কী

 

 

ভাগ্য হলো~ মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব-সৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই স্বয়ংসৃষ্ট--- স্বয়ংক্রিয় এক জাগতিক ব‍্যবস্থা। এই ব‍্যবস্থায়, ঐ বিস্ফোরণের মূহুর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়--- পরম্পরাগত ঘটনাক্রমে কখন--- কোথায়--- কী ঘটবে। এরই নাম ভাগ্য। 

 

এখানে যাকিছু ঘটছে, সব কিছুর মূলে রয়েছে ভাগ্য, ভাগ্যই সব কিছুর জন্য দায়ী। আর এই ভাগ্য পূর্ব নির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। তবে, ভাগ্যকে কার্যকর ফলবৎ হতে, বিভিন্ন কার্য-কারণের ভিত্তিতে, পরিবেশ-পরিস্থিতি সাপেক্ষে, যুক্তি-বিজ্ঞানের পথ ধরেই অগ্রসর হতে হয়। ভাগ্যের জন্যেই আমরা কেউ সুখী -কেউ দুঃখী, কেউ সফল –কেউ অসফল৷ ভাগ্যের জন্যেই আমাদের এত দুঃখকষ্ট-যন্ত্রনা। তাই, ভাগ্যকে খুব ভালোভাবে জানা প্রয়োজন৷

জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে ভাগ্য এবং তার গতিবিধি সহ সমস্ত কার্য-কারণ যুক্তি-বিজ্ঞান আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না। আবার কখনো কিছু অংশে দৃষ্টিগোচর হলেও তার প্রতিকার দৃষ্টিগোচর বা ধারণাগত হয়না, অথবা প্রতিকার সম্ভব হয়ে ওঠেনা৷ ফলে, আমরা অসহায়ের মতো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে থাকি, অসফল ব্যর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হই৷ মনে রাখতে হবে, আমরা এবং আমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ, সবই ভাগ্যের দান৷ আমরা কেউই ভাগ্য প্রসুত ঘটনা প্রবাহের বাইরে নই। তাই, আমাদের কর্তব্য ভাগ্যকে তার স্বরূপে জানা। 

 

আসলে ভাগ্য হলো, কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বতঃসম্ভুত একপ্রকার ব‍্যবস্থা, যা স্থান-কাল-পাত্র, পরিবেশ-পরিস্থিতি সাপেক্ষে, পরম্পরাগত ঘটনাবলীর কার্য-কারণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়ে, অবশ্যম্ভাবি ভাবী ঘটনা বা ঘটনাবলীর অমোঘ নির্ধারক ও নিয়ামক। *

 

জাগতিক বা মহাজাগতিক ক্ষেত্রে: ভাগ্য হলো- আদি মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জগৎ সৃজন শুরু হওয়ার মুহূর্তে উৎপন্ন হওয়া– অবশ্যম্ভাবি ভাবী ঘটনাবলীর নির্ধারক ও নিয়ামক রূপ একপ্রকার অনৈচ্ছিক শক্তি অথবা স্বতঃসৃষ্ট প্রোগ্রাম রূপ ব্যবস্থা। প্রোগ্রাম৷ এছাড়াও, ব্যবহারীক অর্থে— পূর্বনির্ধারিত ঘটনা অথবা পূর্বনির্ধারিত পরম্পরাগত অবশ্যম্ভাবি ঘটনা বা ঘটনাবলীকেও ভাগ্য বলা হয়। প্রতিটি ঘটনা— সৃষ্টিরূপ প্রতিটি উৎপাদন, তার সাথে সম্পর্কযুক্ত পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা বা সৃষ্টির আপাত কারণ। যা সৃষ্টির শুরুতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে। 

সৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথেসাথেই এই ভাগ্য— অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে। তখনই ঠিক হয়ে যায় কখন কোথায় কেমন ভাবে কি ঘটবে। জগতের সর্বত্র বিস্তৃত প্রম্পরাগত অবশ্যম্ভাবী ঘটনা প্রবাহ। ঈশ্বর অর্থাৎ এই মহাবিশ্ব রূপ অস্তিত্বও ভাগ্যের অধীন। ঈশ্বরের সমস্ত কার্যকলাপও ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বলাযায়, ভাগ্য ঈশ্বরের থেকেও বলবান৷


বস্থুর গঠন-উপাদান, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং প্রযুক্ত বল প্রভৃতি যাই হোকনা কেন, ঘটনা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।* কোনো দুটি ক্ষেত্রে, বস্তুর গঠন-উপাদান, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং প্রযুক্ত বল প্রভৃতি যদি ভিন্ন হয়, সেক্ষেত্রে তাদের ভাগ্যও ভিন্ন হবে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ঘটনা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।*  

 

বোঝাবার সুবিধার্থে, একটি সহজ নিদর্শন দিয়ে বলি, একটি তীরের ফলক যুক্ত ঘূর্ণমান চক্রের ঘুর্ণনক্রিয়া শুরু হওয়ার সাথেসাথেই স্বতঃই নির্ধারিত হয়ে যায়, তীরের ফলকের তীক্ষ্ণ কোণটি কখন এবং ঠিক কোথায় গিয়ে স্থির হবে৷* এ-ই হলো ভাগ্য এবং পূর্বনির্ধারিত ঘটনা। মহাসৃষ্টি বা জাগতিক ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রায় অনুরূপ। সৃষ্টির শুরুতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। 

একটা ঘটনা থেকে জন্ম নেয় একাধিক ঘটনা। সেইসব ঘটনাগুলি থেকে একের পর এক জন্ম নিতে থাকে আরো অনেক ঘটনা। এইভাবে 'সাকসেসিভ স্ত্রিম অফ ইভেন্টস' চলতে থাকে।

 

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ঘটনা হতে উদ্ভূত বিভিন্ন ঘটনাবলী শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কোন নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারবে না। বহিরাগত অথবা এর বাইরে সৃষ্ট অন্যান্য ঘটনা, বিষয়-বস্তু, শক্তি প্রভৃতি তার বা তাদের চলাকে বিঘ্নিত করে বা প্রভাবিত করে অথবা যুক্ত হয়ে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

 

তাই, এখানে উল্লেখিত উদাহরণ শুধুনাত্র উদাহরণই। আমার আলোচ্য মূল ঘটনার সঙ্গে এই উদাহরণের খুব বেশি সাদৃশ্য থাকবে না। আলোচ্য মূল ঘটনাটি হলো— মহাবিশ্ব-সৃষ্টি শুরুর মূহুর্তে ঘটা মহাবিস্ফোরণ! যা বিগ-ব্যাঙ নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে, মূল ঘটনা এবং তা’ থেকে সৃষ্ট অসংখ্য ঘটনাবলীকে প্রভাবিত করার মতো বাইরের কোনো বিষয়-বস্তু, শক্তি বা ঘটনা অনুপস্থিত। এখানে ঘটনাক্রম এগিয়ে চলেছে সুশৃঙ্খলভাবে স্বয়ং-নির্ধারিত পথ ধরে।


ভাগ্য আমাদের ভিতরে বাইরে, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ক্রিয়াশীল। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা সহ আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তা জাগতিক কর্মকান্ডেরই অংশ। আমরাও এই জগতেরই একটা অংশ৷ এখানে, ভাগ্যক্রমে বা ঘটনাক্রমে কেউ ধনী ---কেউ দরিদ্র, কেউ মহৎ আবার কেউ অসৎ। তা-ই বলে এর পিছনে কোনো নিয়ন্তা বা নির্ধারক ও নিয়ামক চেতন সত্তা নেই, আছে স্বতঃসৃষ্ট এক যান্ত্রিক ব‍্যবস্থা।

আমাদের অসহায়তার মুলে ভাগ্য দায়ী হলেও, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতাই তার অন্যতম কারণ। তাই জাগতিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা প্রভৃতি থেকে মুক্তি পেতে জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা সহ জ্ঞানী ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহন আশু কর্তব্য। 

কিন্তু, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণেই আমরা বুঝে উঠতে পারিনা কে প্রকৃত জ্ঞানী আর কে ভন্ড-প্রতারক। কোনটা জ্ঞান আর কোনটা নয়, কিসে আমাদের প্রকৃত মঙ্গল হবে বুঝতে পারিনা। ফলে, আমরা অসহায়ের মতো দিগবিদিগ জ্ঞানশূণ্য হয়ে ছোটাছুটি করি এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভন্ড গুরু, জ্যোতিষী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের করতলগত হয়ে আরো বেশী দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করি। 

যদিও এই ভাবেই জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তিলেতিলে আমাদের চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে। অনেক সময়েই জ্ঞানীর সদুপদেশের পরিবর্তে ভন্ড-প্রতারকের কু-পরামর্শই আমাদের কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হয়৷ জ্ঞানীর সুপরামর্শ আমাদের মনঃপুত হয়না।


ভাগ্য, ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা শুধু আমাদের ভালোই চায়, -এই রকম ভুল ধারণা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। ভাগ্যকে অনেকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা ম্ননে করে থাকে, বলে থাকে— 'ঈশ্বর যা করেন আমাদের ভালোর জন্যেই করেন।' ঈশ্বরের ইচ্ছা- সেও আসলে ভাগ্যেরই সৃষ্টি। ভাগ্যেরই প্রকাশ। কিন্তু তাই বলে- ঈশ্বরই ভাগ্য-বিধাতা নয়৷ এই মহাজগৎ বা মহাবিশ্বরূপ সত্তাই হলো – ঈশ্বর।

এ' হলো এক বিচিত্র বৈপরীত্যে ভরা অদ্ভূত জগত। যে ব্যক্তি অন্যায়-অপরাধ -কুকর্ম করছে, ভাগ্যই তাকে দিয়ে তা' করাচ্ছে। যে অপরাধী- সে অপরাধ করতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ ভাগ্য তাকে বাধ্য করাচ্ছে অপরাধ করতে। অপরাধ না করে তার উপায় নেই। আবার যে ভালো কাজ করছে, সেও বাধ্য হচ্ছে তা করতে। যে অপরাধীকে ধরছে এবং যে অপরাধীকে শাস্তি দিচ্ছে, ভাগ্যই তাদের দিয়ে তা করাছে। কুকর্ম করেও অনেকে শাস্তি ভোগ করছে না, আবার সুকর্ম করেও শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে অনেককে।  

এই পক্ষপাতিত্বের সঠিক কারণ খুঁজে না পেয়ে, অনেকেই পূর্বজন্মের কর্মফলের কাল্পনিক তত্ত্ব হাজির করে থাকে। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তাহলে অতি নিম্ন-চেতন স্তরের যে জীবটিকে হত্যা করে আমরা তার মাংস খাচ্ছি, -তার সুকর্ম-কুকর্ম, দোষ-গুণ–অপরাধ ও কর্মফলের হিসেবটা কিরকম হবে? আর তার এই করুণ পরিণতিতে সেই জীবটির কি ভালো হতে পারে?!  

ঈশ্বর, ভাগ্য এবং এই জাগতিক ব্যবস্থা কারোই— জীবের জন্য কিছুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। ঈশ্বর তার শৈশব ও কৈশোরের ছেলেখেলায়- যখন জীব সৃষ্টির শখ হয়েছিল, সেইসময় জীবের প্রতি তার কিছুটা নজর থাকলেও, জীবের উপর সুবিচার করেনি সে কখনোই৷ জীবকে জীবের খাদ্যে পরিণত করাটাই তার বড় প্রমাণ। ঈশ্বরের বয়স বৃদ্ধির সাথেসাথে— জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে, আস্তে আস্তে খেলা-ধুলার পাট চুকে যাওয়ার পর, পুতুল খেলার শখ মিটে গেলে- জীব তখন শৈশবের খেলাঘরে অনাদরে পড়ে থাকা আবর্জনার স্তুপ বৈ আর কিছু নয়।  

ঈশ্বরকে যতই ডাকো— যতই তার কাছে কাতর প্রার্থনা জানাও, তাতে সে বিরক্তই হবে, ভক্তের উপর সদয় হবেনা সে কখনোই৷ বর্তমানে আমাদের মাথার উপরে কোনো শাসক নেই কোনো সহায়কও নেই। আছে আমাদের চারিপাশে বিস্তার করে থাকা অধিকাংশে অদৃশ্য —ভাগ্যের জাল। অজ্ঞান-অন্ধত্ব -চেতনাভাবের কারণে আমরা সম্পূর্ণ ভাগ্যের অধীনস্ত হয়ে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে চলেছি। আমাদের জ্ঞান ও চেতনার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলেই আমরা ভাগ্যের হাত থেকে বহুলাংশে মুক্ত হতে পারবো।  

তাহলে জীবজগৎ টিকে আছে কি করে? দুঃসহ সব কঠিণ অবস্থার মধ্য দিয়ে— ঈশ্বর প্রদত্ত শরীর-মন এবং তার মধ্যে অন্তগ্রথিত নির্দেশ বা ‘প্রোগ্রাম’ সম্বল করে, অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা সয়ে— প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে জীব টিকে আছে এই জগতে। ঘটনাচক্রে -ভাগ্যক্রমেই সে টিকে আছে। যে সমস্ত জীব পরিবর্তীত প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে অক্ষম হয়েছে, তারা হারিয়ে গেছে এই কঠিণ নিষ্ঠুর জগৎ থেকে।  

এই জগতে যা কিছু ঘটছে- সবই ঘটনাক্রমে বা ভাগ্যক্রমে ঘটে চলেছে। এখানে এর ব্যতীক্রম ঘটানোর সাধ্য নেই কারো। একমাত্র, উচ্চ চেতনা সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তার পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনার দ্বারা নিজেকে ভাগ্যের বন্ধন থেকে অনেকাংশে মুক্ত করতে সক্ষম৷ তাই, ‘ভাগ্য জীবের ভালোই চায়, ভাগ্যকে মেনে নিলে আমরা অনেক ভালো থাকতে পারবো, কিম্বা ভাগ্য যাকে যেদিকে নিয়ে যেতে চায় সে দিকে গেলেই তার ভালো হবে।' —সব সময়েই এই সাধারণ সরল হিসেব সমান কার্যকর হয়না। ঘটানাক্রমে কখনো ভালো হতেও পারে, কখনো নাও হতে পারে।  


এইসব দেখে-শুনে, স্বভাবতঃই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে- তাহলে, প্রকৃতই ভাগ্য কী চায়? -ভাগ্যকে বুঝতে, - তার কার্যকলাপকে বুঝতে, তার জন্ম লগ্নের দিকে ফিরে তাকাতে হবে আমাদের।  

 

মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই সৃষ্টির শুরু, আর সেই বিস্ফোরণের ক্ষণটিতেই জন্ম নেয় ভাগ্য নামক এক স্বয়ংসৃস্ট ব্যবস্থা। যেমন, একটি বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে একের পর এক নানা ঘটনা। বিস্ফোরণের মূহুর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়, তারপরে কি ঘটবে, এবং তারও পরে পরম্পরাগতভাবে একের পর এক কি-কি ঘটতে থাকবে।* এই জগতে যা কিছু ঘটছে এবং যা কিছু ঘটবে সে সমস্ত কিছুই নির্ধারিত হয়ে গেছে ---মহা বিস্ফোরণের মুহুর্তে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এখানে 'প্রায়' কথাটি বলছি এই জন্যে যে বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে এর পিছনে ছিলো— ইচ্ছাশক্তি ও স্থান-কাল এবং পাত্র হলো বিস্ফোরক বস্তুটির গঠণ-উপাদান প্রভৃতি।  বিস্ফোরণ পরবর্তী পরম্পরাগত ঘটনাগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক ঘটতে থাকলেও, এদের মধ্যে পূর্বোক্ত সেই ইচ্ছাশক্তি— যে ইচ্ছাবলে বিস্ফোরণটি ঘটেছিলো, সেই ইচ্ছা প্রচ্ছন্নভাবে সক্রিয় আছে।  

আমরা জানি, মহাজগৎ সৃষ্টির পিছনে রয়েছে আদি ইচ্ছা— আদি উদ্দেশ্য, এবং তাকে সফল করে তোলার পরিকল্পনা (‘মহাবিশ্ব-সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন’ দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও, আমরা এই মহাজাগতিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে পুনরায় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটতে দেখেছি৷ প্রথমে তার প্রকাশ ঘটেছে- ঈশ্বর মনের মধ্য দিয়ে, এবং তার পরবর্তীতে জীব প্রভৃতি ঈশ্বরের অংশ থেকে সৃষ্ট হওয়া ঐচ্ছিক সত্তার মধ্য দিয়ে। সেই আদি ইচ্ছা- আদি উদ্দেশ্য হলো - আত্মবিকাশ লাভ!   

 

সমস্ত সৃষ্টি এবং তার জাগতিক ঘটনাবলীর মধ্যে- ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় প্রকার শক্তিই ক্রিয়াশীল রয়েছে। ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক শক্তি সম্মিলিতভাবে সমস্ত জাগতিক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ভালো করে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে— কখনো ঐচ্ছিক শক্তি থেকে অনৈচ্ছিক শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে, আবার কখনো অনৈচ্ছিক শক্তি থেকে ঐচ্ছিক সত্তা বা শক্তি জন্ম নিচ্ছে। তবে, এ জগতে কোনো শক্তিই পুরোপুরি ঐচ্ছিক অথবা পুরোপুরি অনৈচ্ছিক নয়। অনৈচ্ছিক শক্তির মধ্যে অল্প হলেও ঐচ্ছিক শক্তি নিহিত আছে। আবার ঐচ্ছিক শক্তির মধ্যেও অল্প-স্বল্প অনৈচ্ছিক শক্তি নিহিত রয়েছে। এখানে কোনো ঘটনাই— ঐচ্ছিক শক্তির দ্বারা অথবা অনৈচ্ছিক শক্তির দ্বারা সর্বাংশে নিয়ন্ত্রিত ও সৃষ্ট নয়। আর এটাই হলো আমাদের ক্ষেত্রে জাগতিক সমস্যার অন্যতম একটি কারণ।  

সবসময়, সর্বক্ষেত্রে— ঈশ্বর বা জীবের ইচ্ছামতো সবকিছু ঘটা সম্ভব নয় এখানে। তারপর, ঈশ্বর এবং আমাদের ইচ্ছাও অনেকাংশে অনৈচ্ছিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তবে যা কিছু ঘটছে, সবই পূর্বনির্ধারিত ভাবে ঘটে চলেছে, এবং এর পিছনে প্রচ্ছন্নভাবে আদি-ইচ্ছা কাজ করছে। ঈশ্বর এবং আমাদের ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছামতো আমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ —সবই ভাগ্যক্রমে পূর্বনির্ধারিত মতো ঘটে চলেছে।  ​

ঈশ্বর— জীবের স্বার্থে জীবের মঙ্গলের জন্যে বিশেষ কিছু করেনা। সে যা কিছু করে, সবই নিজের স্বার্থে—নিজের প্রয়োজনের তাগিদে৷ সেই প্রয়োজন মেটাতে গিয়েই কখনো জীবের মঙ্গল হয়, আবার কখনো ক্ষতি হয়। কখনো কারো ভালো হয় তো কখনো কারো মন্দ হয়৷ অংশানুক্রমে ঈশ্বর সৃষ্ট জীবও তাই এত স্বার্থপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, জীবও নিজের যৌন চাহিদা মেটাতে গিয়েই ঘটনাক্রমে সন্তানের জন্ম দেয়। জাগতিক ব্যবস্থা কারো স্বার্থ দেখেনা৷ সে হলো- নিরপেক্ষ এক অনৈচ্ছিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা৷ যে এই যান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিফহাল, সে ততটাই স্বাধীন।  

ঈশ্বর তার প্রয়োজনানুগ কর্মও কিন্তু সবসময় পুরোপুরি নিজের ইচ্ছামতো করতে পারেনি— পারেনা৷ কখনো শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরী হয়েছে, আবার, কখনো বাঁদর তৈরী করতে গিয়ে শিব তৈরী হয়ে গিয়েছে। তাই জীবের দুঃখ-কষ্টযন্ত্রনার জন্য সবসময় ঈশ্বরকেও পুরোপুরি দায়ী করা যায়না। আমরা যেমন অসহায়, তেমনি ঈশ্বরও তার সেই নিম্ন-চেতন স্তরে ছিলো অসহায়। তারও সহায় নেই কেউ। তাই এই মহাসৃষ্টিকে এক মহা অনাসৃষ্টিও বলা যেতে পারে৷  

তবে, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অভাবই হলো এই অসহায়তার অন্যতম কারণ। ঈশ্বর যখন জীব সৃষ্টি করেছিলো তখন তার জ্ঞান ও চেতনা ছিল এখনকার তুলনায় খুবই কম। আবার, এখন সে যে উচ্চ-চেতন স্তরে পৌচেছে, - সেখান থেকে সেই শৈশব ও কৈশোরের ছেলেখেলায় সে আর আগ্রহী নয়। সে এখন মোহ-মায়া থেকে অনেকটাই মুক্ত।  


পূর্বনির্ধারিত অবশ্যম্ভাবি ঘটনার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হলে— সমগ্র ঘটনা প্রবাহের বাইরের থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য থেকে কোনোরূপ শক্তি প্রয়োগের দ্বারা সেই ঘটনা প্রবাহের অন্তর্গত কোনো ঘটনার পরিবর্তন সাধিত হলে, তা পূর্বনির্ধারিত ঘটনাক্রমেই সংঘটিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।  

জাগতিক বা মহাজাগতিক প্রতিটি ঘটনাই- মহাজগৎ ব্যাপী বিস্তৃত ঘটনাপ্রবাহের অন্তর্গত। মহাজগতের আভ্যন্তরীণ সমস্ত ঘটনাই মহাজাগতিক ভাগ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই, জাগতিক কোনো ঘটনার পরিবর্তন ঘটাতে হলে, তার জন্য এই মহাজগতের বাইরের থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, যা মোটেই সম্ভব নয়।  

ভাগ্য নামে— ভাবী ঘটনাবলীর নির্ধারক ও নিয়ামক শক্তি বা প্রোগ্রাম’-টি উৎপন্ন হওয়ার সময়, অর্থাৎ মূল ঘটনা ঘটার সময়— সেই ঘটনার সাথে বা পিছনে যদি কোনো উদ্দেশ্যমূলক ঐচ্ছিক শক্তি থাকে, অথবা কাজ করে, সেক্ষেত্রে, ভাগ্য রূপ অনৈচ্ছিক শক্তি বা প্রোগ্রাম’-টির সাথে সেই ইচ্ছাশক্তি অথবা ইচ্ছা রূপ প্রোগ্রাম'-টি যুক্ত হয়ে, ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় শক্তি বা প্রোগ্রামের সমন্বয়ে ভাগ্য রূপ ‘প্রোগ্রাম'-টি গঠিত হয়ে থাকে। তারফলে শুধু অনৈচ্ছিক প্রোগ্রাম বা নির্দেশের দ্বারা যেরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কথা – ঠিক সেইরূপ না হয়ে, উভয়ের বলাবল সাপেক্ষে, অনৈচ্ছিক ও ঐচ্ছিক প্রোগ্রামের মিলিত ক্রিয়ায় ভাবী ঘটনাবলী ভিন্নরূপ হয়ে থাকে।  

মহাজগতের ভিতর থেকে মহাজাগতিক ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। ভাগ্য রূপ প্রোগ্রাম'-টি অপরিবর্তনীয় হলেও, -এই ভাগ্যের দ্বারা সংঘটিত মহাজগৎ ব্যাপী বিস্তৃত অসংখ্য ঘটনাবলী কিন্তু সততই পরিবর্তনশীল। তবে, এই সতঃসৃষ্ট অনৈচ্ছিক শক্তি সম্পন্ন ভাগ্য বা ‘প্রোগ্রাম’-এর সাথে যদি কোনো ইচ্ছাশক্তি অথবা ঐচ্ছিক প্রোগ্রাম যুক্ত থাকে, তার জন্মের সময় থেকেই যুক্ত হয়ে থাকে, সেই ইচ্ছাশক্তি রূপ প্রোগ্রাম বা ঐচ্ছিক প্রোগ্রাম অনুসারে নির্দিষ্ট বিশেষ কো্নো সময়ে বা সময়গুলিতে এই ভাগ্যের পরিবর্তন সাধিত হতে পারে।


যেমন, সেই ঐচ্ছিক প্রোগ্রামের মধ্যে যদি এইরূপ কো্নো নির্দেশ থাকে, যে ঈশ্বর এবং ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন জীব বা কো্নো সত্তা কালক্রমে উচ্চ-চেতনা সহ প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন হয়ে উঠলে, তখন তারা তাদের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে। অথবা ভাগ্যের বন্ধন থেকে অনেকাংশে মুক্ত হতে পারবে, —সেক্ষেত্রে, সেই নির্দেশ কার্যকর হবে।  

শেষ করার আগে, আমি আমার অনুগামীদের উদ্দেশে বলব, তাৎক্ষণিক লাভের আশায় ভাগ্য বা ঈশ্বর অথবা কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য সত্তার দয়া বা কৃপা লাভের পিছনে না ছুটে, নিজের আত্মবিকাশ বা মনোবিকাশের জন্য তৎপর হও, সর্বাঙ্গীন সুস্থতা লাভের জন্য উদ্যোগী হও। তাহলেই ক্রমশ তোমরা দুর্ভাগ্য থেকে অনেকাংশে মুক্তিলাভ করতে পারবে, সেই সাথে অজ্ঞানতার বন্ধন থেকেও মুক্তিলাভ ঘটবে তোমাদের।

একদিক থেকে দেখলে, দুর্ভাগ্য আর কিছুই নয়, তোমাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ঘষে-মেজে খাঁটি সোনায় পরিণত করার এক নিষ্ঠুর জাগতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু তোমরা যদি নিজের থেকেই খাঁটি সোনা হয়ে ওঠার উদ্যোগ নাও, আত্মবিকাশের উদ্যোগ নাও, তাহলে দুর্ভাগ্য তোমাদের কী করবে! দুর্ভাগ্যের জন্য মূলতঃ দায়ী করো নিজেকে, এবং দুর্ভাগ্যের অসাফল্যের কারণ গুলি অনুসন্ধান করো নিজের মধ্যে। দোষ-ত্রুটি –ঘাটতি, অজ্ঞানতা অসুস্থতা —ঋণাত্মকতা প্রভৃতি কারণ গুলিকে একে একে চিহ্নিত করে তারপর সেই কারণ গুলির অপসারণ ঘটাতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নাও। নিজের মধ্যে শুভ পরিবর্তন ঘটাতে পারলে, তোমাদের ভাগ্যেরও শুভ পরিবর্তন ঘটবে। তবে এগুলি করতে পারলে, বুঝতে হবে তা’ ভাগ্যক্রমেই করেছো, এবং সেক্ষেত্রে তুমি সৌভাগ্যবান।   

যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অভাবেই আমরা এত অসহায়। সমস্যা কোথায়— বিপদ কোন দিক থেকে আসছে এবং তার মোকাবিলা করতে অথবা তার থেকে নিস্তার পেতে কি করা কর্তব্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা' আমাদের ধারণা ও জ্ঞানের অতীত হওয়ায় আমরা এত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে থাকি। যা করলে দুঃখ-কষ্ট পাবো যাতে আমাদের ক্ষতি হবে, অনেক সময়ে আমরা তা-ই করে থাকি। তাই এর থেকে রেহাই পেতে আমাদের একমাত্র কর্তব্য জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া। একমাত্র, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনাই আমাদের মুক্তি দিতে সক্ষম। অথচ আমরা অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে তা’ না করে, অজ্ঞানের সাধনা করে চলেছি, যাতে আরো বেশী করে মোহ-মায়ার জালে জড়িয়ে পড়ি সেই চেষ্টাই করে চলেছি আমরা।  

এই বৈপরীত্যের জগতে— জ্ঞান ও চেতনা লাভের ডাক, —আত্মবিকাশ লাভের আহ্বান যেমন ভাগ্যের ঐচ্ছিক শক্তির দান, তেমনি আবার জ্ঞান ও সত্য লাভে অনিহা —আত্মবিকাশ লাভে অনিচ্ছাও দেখা দেয় দুর্ভাগ্যক্রমে। যে ইচ্ছাক্রমে এই মহাজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল, যে ইচ্ছাক্রমে ঈশ্বর এবং তার সৃষ্ট জীব— আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে চলেছি, সেই আদি-ইচ্ছা —আত্মবিকাশ বা মনোবিকাশের ইচ্ছা অন্তর্গ্রথিত হয়ে আছে আমাদের সবার অন্তরের গভীরে। যে সেই অন্তরের ডাক শুনতে পায়, সেই ভাগ্যবান।   

 


-------------------------------------------------------------------------------------------

* যদি মূল ঘটনা ঘটার পরবর্তী সময়ে— বাইরের কোনো বস্তু বা শক্তি বা ঘটনা— সেই ঘটনা থেকে সৃষ্ট ঘটনাক্রম বা ঘটনাবলীর সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত না হয়। 

ঈশ্বর / বিশ্বাত্মা প্রসঙ্গে মহর্ষি মহামানস

 

আমরা সবাই একই চেতন-স্তরে অবস্থান না করার ফলে, ঈশ্বর (আমরা বলি, 'বিশ্বাত্মা') সম্পর্কে আমাদের ধারণাও সবার ক্ষেত্রে একরূপ নয়। আবার আধ্যাত্মিক (দৃষ্টিকোণ থেকে) ঈশ্বর, আর প্রচলিত ধর্মীও ঈশ্বর একরূপ নয়। যখন তুমি নিজেকে নিজের স্বরূপে জানতে পারবে, একমাত্র তখনই তুমি ঈশ্বরকে তার প্রকৃত রূপে বা স্বরূপে জানতে সক্ষম হবে— অনেকাংশে।

 

এই মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বরকে— মহাসাগররূপে কল্পনা করলে, তুমি হলে তার একবিন্দু জল বা পাণি স্বরূপ। এই মহাসাগরকে জানতে, সর্বাগ্রে— তার কয়েক বিন্দু জল বা পাণি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে তোমাকে। তুমি নিজেকে এবং নিজের চারিপাশকে সঠিকভাবে যত বেশি জানতে পারবে, ঈশ্বরকেও জানতে পারবে তত বেশি।

আমরা 'মহাবাদ' ও 'মহাধর্ম'-এর অনুসরণকারীগণ আমাদের স্রষ্টাকে বলি, 'বিশ্বাত্মা'। আমাদের 'বিশ্বাত্মা' আর প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন নামে 'ঈশ্বর' একরূপ নয়। আমরা (মহাবাদ ও মহাধর্ম-এর অনুগামীগণ) মনে করি, এই মহাবিশ্ব হলো ঈশ্বরের শরীর, এবং এই শরীরের মধ্যে রয়েছে একটি মন, তা-ই হলো ঈশ্বর-মন। এই মহাবিশ্বরূপ ‘শরীর’ আর এই মহাজাগতিক ‘মন’ মিলে একত্রে ঈশ্বর অস্তিত্ব। বিশ্ব-প্রকৃতি আর আমাদের ঈশ্বর আসলে একই।

 

এই মহাবিশ্ব— ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট নয়, সে নিজেই ঈশ্বর। এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর অতিরিক্ত আর কিছুর অস্তিত্ব নেই (একমাত্র সুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন আদিসত্ত্বা ছাড়া)। শুধুমাত্র এর কিছু অংশ— যেমন জীব— উদ্ভিদ প্রভৃতি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। যদিও ঈশ্বর এদের সৃষ্টি করেছে তার শরীর উপাদান থেকেই। আমাদের মনও সৃষ্টি হয়েছে— বিশ্ব-মন বা ঈশ্বর-মন থেকে। শুন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হয়নি। আমরা সবাই ঈশ্বরের অর্থাৎ এই মহাবিশ্বেরই অংশ।

 

এই বিশ্ব-অস্তিত্বই হলো ঈশ্বর। যা সৃষ্ট হয়েছে আদিসত্ত্বা বা পরমাত্মা (সংস্কৃততে ব্রহ্ম) থেকে। এই আদিসত্ত্বা ঈশ্বর নয়, এবং এই জাগতিক কর্মকান্ডে তার বিশেষ ভূমিকা নেই। এই বিশ্ব-লীলায় আদিসত্ত্বা হলো নিরব ও প্রচ্ছন্ন দর্শকের মতো। আদিসত্ত্বা— পরমাত্মা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ বা পরিপূর্ণ নয়। পূর্ণতা হলো— পূর্ণ স্থির নিশ্চল— নিষ্ক্রিয় অবস্থা। পূর্ণতা থেকে কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। সেই অবস্থায় চাওয়ার কিছু থাকে না— পাওয়ারও কিছু নেই। সেই কারণে করারও কিছু নেই। সৃষ্টির প্রশ্নই আসেনা সেখানে।

 

আদিসত্ত্বাও পূর্ণ নয়। তারও আছে কিছু চাহিদা— কিছু অভাব। সে জানেনা, সে— কে, কেনই বা সে, আর কোথা থেকেই বা সে এসেছে বা তার উৎপত্তি হয়েছে। জানেনা তার পরিণতি কী। এই নিজেকে জানার ইচ্ছাই হলো— সৃষ্টির আদি কারণ। অগত্যা, স্ব-ইচ্ছায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পুণরায় তাকে খোঁজা বা আত্মানুসন্ধান করাই হল— সৃষ্টির গোপন রহস্য।

 

একসময় এই মহাবিশ্ব— অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়েছে বা জন্ম নিয়েছে, এবং একসময় এর মৃত্যু বা ধ্বংসও হবে। এই মহাবিশ্ব— মহাসৃষ্টি হলো আদিসত্ত্বার ইচ্ছার ফল। ঈশ্বরের জন্ম হয়েছে ঠিক একটি সদ্যজাত শিশুর মতো— শিশু-বিশ্ব রূপে। প্রায় অজ্ঞান-অচেতন একটি শিশুর জীবনযাত্রা শুরু হয়েছে— পূর্ণ বিকাশলাভের উদ্দেশে। প্রায় অজ্ঞান-অচেতন অবস্থা থেকে পূর্ণ চেতনার লক্ষ্যে, কর্মতৎপরতা সহ দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দলাভের মধ্য দিয়ে— জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য অবিরাম চলাই তার নিয়তি। আর এটাই হলো জীবন।

 

পিতা-মাতার অপূর্ণ ইচ্ছাকে সন্তানের মধ্য দিয়ে পূর্ণ ক’রে তোলার সাথে— এই মহাসৃষ্টির উদ্দেশ্য-র অনেকটাই সাদৃশ্য আছে। ঈশ্বর বা মহাবিশ্ব-জীবনে অনেকগুলি ক্রমিক ধাপ রয়েছে, যথা— শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি, —অনেকটা আমাদের জীবনের মতোই।

 

শুধু ঈশ্বর নয়, আমরা সবাই চলেছি সেই এক লক্ষ্য পানে—। ইশ্বর বা মহাবিশ্বের অংশানুক্রমে আমরা প্রকৃতি—পরিস্থিতি এবং ঘটনা অনুসারে কেউ এগিয়ে আর কেউ পিছিয়ে আছি।

সৃষ্টির ক্রমিক পর্বগুলি নিম্নরূপ—

১) আদিসত্ত্বা বা পরমাত্মা তার নিজ উপাদানে— প্রায় তার অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র মায়া সত্ত্বা তৈরী করেছে প্রথমে।

২) আদিসত্ত্বার প্রতিরূপ সত্ত্বাটি— স্ব-অভিভাবন বা আত্ম-সম্মোহন দ্বারা অর্থাৎ যোগনিদ্রা বলে, নিজ জ্ঞান-গুণ-ক্ষমতা বিস্মৃত হয়ে— অস্ফুট চেতন-স্তরে উপনীত হয়।

৩) তারপর সে, প্রথম বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে— বহু বিভক্ত হয়ে, দশ দিকে ছড়িয়ে পড়ে, এবং বহু বিশ্ব ও বিপরীত বিশ্বের বীজে পরিণত হয়।

৪) সমস্ত বিশ্ব-বীজগুলি (এই বিশ্ব ছাড়াও মহাসৃষ্টিতে আছে বহু বিশ্ব ও বিপরীত বিশ্ব-অস্তিত্ব)  একই সময়ে সবাই ঘটায় মহা-বিস্ফোরণ। তারপর, বীজ থেকে ক্রমশ মহীরূহের মতো— প্রত্যেকে মহাবিশ্বে পরিণত হতে থাকে— অসংখ্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।

৫) পরবর্তীকালে, কিছুটা পরিণত হওয়ার পর— আমাদের বিশ্বরূপ ঈশ্বর বা বিশ্বাত্না একসময় উদ্ভিদ ও জীব সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠে...।

 

এই হলো, অতিসংক্ষেপে মহাজীবন-চলার কথা (বিশদভাবে জানতে হলে, ‘মহাবাদ’ গ্রন্থটি পড়তে হবে)। এই জীবন-চলার মধ্যে বহু পর্ব আছে। আছে বহু কর্মকান্ড। এই বিশ্বরূপ ঈশ্বর বা বিশ্বাত্মাসহ আমরা যতই এগিয়ে চলেছি, ততই অজ্ঞানতা— অচেতনতা ও মোহ থেকে মুক্ত হচ্ছি ক্রমশ। প্রকৃতপক্ষে, যথেষ্ট জ্ঞান-চেতনা লাভই এই জীবনের মূল লক্ষ্য।

ঈশ্বর সম্পর্কে সাধারণের ধারণা, ঈশ্বর শুধুই কল্যাণময়— শুভাকাঙ্খী— প্রেমময়, সৎ চিৎ আনন্দময়, জীবের বন্ধু। কিন্তু ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ বা স্বরূপ তা’ নয়। ঈশ্বরের মধ্যে তার বিভিন্ন চেতন-স্তর ও অবস্থা অনুযায়ী শুভ-অশুভ, সৎ-অসৎ উভয় গুণ ও শক্তিই বিদ্যমান। এখানে উল্লেখযোগ্য— ঈশ্বর যদি সত্যই জীবের বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী হতো, তাহলে জীবের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক তৈরী করতো না।

 

ঈশ্বর-মনের মধ্যে শুভাত্মক সৎ মন-অস্তিত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি তার মধ্যে অশুভ— অজ্ঞান-অসৎ মন-অস্তিত্বও রয়েছে। এই অসৎ অস্তিত্ব আসলে ঈশ্বরেরই আর এক দিক বা রূপ বা অস্তিত্ব।

 

ঈশ্বরের সন্তান ও অংশরূপে তার সাথে আমাদের বহু সাদৃশ্য বর্তমান। ক্রমবিকাশমান চেতনার পথে— ঈশ্বর যখন আমাদের অনুরূপ চেতন-স্তরে অবস্থান করেছে, তখন তার মানসিক অবস্থাও অনেকাংশে আমাদের মতই ছিলো। আমাদের মতোই ঈশ্বরের মন ও চেতনাও ক্রমশ বিকাশমান। বিকাশমান মনের কয়েকটি বিশেষ বিশেষ নিম্ন-চেতন-মন অস্তিত্ব হলো— কয়েক প্রকারের অজ্ঞান-অসৎ বা ঋণাত্মক মন।

 

ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে এই ঋণাত্মক বা অসৎ মনের বিকাশ ঘটে, নিম্ন-চেতন-স্তরগুলির বিশেষ বিশেষ স্তরে— অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত অবস্থায়। ক্রমশ চেতনা বিকাশের সাথে সাথে, এইসব নিম্ন-চেতন-স্তরের অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত মনগুলি সচেতন বা আরও উচ্চ-চেতন মনের প্রদীপের নীচে— অন্ধকারে আশ্রয় নেয়, অর্থাৎ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে অন্তরালে চলে যায় তারা। 

 

তাই বলে, একেবারে হারিয়ে যায় না কিছুই— সবই থাকে ফাইলের নীচে চাপা পড়া অবস্থায়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, ঈশ্বররূপ এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর অতিরিক্ত কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে ভালো-মন্দ যা কিছু আছে, সবই ইশ্বর বা ঈশ্বরের অংশ। মনের ক্রমবিকাশের স্তরগুলি সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করেছি ('মন-আমি' দ্রষ্টব্য)।

 

তাইবলে, ঈশ্বরকে ভয় পাবার কিছু নেই। ঈশ্বর সৃষ্ট জীব কখনোই ঈশ্বরের শত্রু হতে পারে না। আবার, ঈশ্বরও কখনোই জীবকে শত্রু ভাবতে পারে না। ঈশ্বরের শত্রু হতে গেলে, যে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তা’ কখনোই জীবের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। জীবোত্তর জীবনে উচ্চতর চেতন-স্তরে— সে যতই উন্নীত হবে, ঈশ্বরের সাথে তার একাত্মতা বৃদ্ধি পাবে ততই।

 

জীবের প্রতি রুষ্ট বা অসন্তুস্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, জীব যা কিছু করে, —সবই সে জাগতিক ব্যবস্থার দ্বারা চালিত হয়েই ক’রে থাকে। স্বতন্ত্রভাবে তার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। তাই, তার কর্মের জন্য সে দায়ী নয়।

আমাদের ক্ষেত্রে যেমন— আমরাই আমাদের বড় শত্রু। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই নিজের বড় শত্রু (অজ্ঞানতার কারণে)। তেমনি ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও। ঈশ্বরের মধ্যেও (নিম্ন চেতন-স্তরগুলিতে) চলে অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে নিজেই তার নিজের শত্রু। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে, ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে— মহাবিশ্ব জুড়ে। অবশ্য তার কুফল ভুগতে হয় জীবকেও। কিন্তু জীব এখানে অসহায়, তার পক্ষে ঈশ্বরকে শান্ত করা— প্রশমিত করা সম্ভব নয়। পূজা-পাঠ, প্রার্থনা—উপাসনা কোনো কিছুই ঈশ্বরকে টলাতে সক্ষম নয়।

 

তবে সান্তনা এই যে, ঈশ্বর এখন ক্রমবিকাশের পথ ধরে— অনেক উচ্চ চেতন-স্তরে উপনীত হয়েছে। তার ঋণাত্মক বা অশুভ-অসৎ মন এখন অতীতের অন্ধকারে প্রায় সুপ্ত অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্বাত্মা এখন আর সৃষ্টির ব্যপারে— কিশোর-যৌবনের লীলা-খেলার ব্যপারে অনেকটাই উদাসীন।

 

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যেমন— যা কিছু করছি— ভাবছি, সবই বাধ্য হয়ে করছি। জগতের অংশরূপে পূর্ব-নির্ধারিত জাগতিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে সবাইকে। ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও তেমনি। ঈশ্বর নিজেই এই জগত স্বরূপ। তার মধ্যে যাকিছু ঘটছে, প্রকৃতপক্ষে তার উপর ঈশ্বরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার ভাবনা-চিন্তা-কর্ম সবই পূর্ব-নির্ধারিতভাবে যখন যেটা ঘটার ঘটে চলেছে। এরই নাম ভাগ্য। সে যেটা নিয়ন্ত্রণ করছে সেটাও পূর্ব-নির্ধারিতভাবে করতে বাধ্য হচ্ছে সে। অপ্রিয় সত্যটা হলো— ভাগ্য ঈশ্বরের থেকেও বলবান।

 

এই পূর্ব-নির্ধারণ ঘটেছে সৃষ্টির শুরুতেই। সৃষ্টির শুরুতেই সমস্ত চিত্রনাট্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। কখন কোথায় কী ঘটবে, সবকিছুই স্থির হয়ে গেছে— সৃষ্টি শুরু হবার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। যেমন একটি বিস্ফোরণ ঘটার সাথে সাথেই স্থির হয়ে যায়— তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কখন— কোথায় কী ঘটবে। সৃষ্টির শুরুও তো আসলে একটা বিস্ফোরণ বা মহা-বিস্ফোরণ!

 

ঈশ্বর প্রসঙ্গে –খুব স্বাভাবিকভাবেই দেব-দেবীদের কথা এসে যায়। বহু মানুষই ঈশ্বর ও দেব-দেবী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে, বিভিন্ন দেব-দেবীকেই ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা—উপাসনা করে থাকে। ‘মহাবাদ’-এ উক্ত দেব-চেতন-স্তরের বাসিন্দারাই প্রকৃত অর্থে দেবতা। এখানে দেব-দেবী বলে কিছু নেই। কারণ, এই উচ্চ চেতন-স্তরে কোনো লিঙ্গ ভেদ নেই। নেই বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা।

 

সারা পৃথিবীতে প্রচলিত বা কাল্পনিক দেব-দেবী বা দেবতাগণ আর মহাবাদোক্ত দেবতাগণ এক নয়। এরা অনেক বেশি উচ্চ চেতন-স্তরের সত্ত্বা। পৃথিবীতে অবতরণ ক’রে মানুষের সাথে নানারূপ লীলা-খেলায় অংশ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

সংস্কৃতভাষায় দেবতার অর্থ জ্ঞানী-বিদ্বজন, যাঁরা তৎকালীন সাধারণ মানুষ থেকে বেশ কিছুটা উচ্চশ্রেণীর মানুষ।* ভগবান বলতেও সংস্কৃতভাষায় শুধু ঈশ্বরকেই বোঝায় না। দেবতুল্য ব্যক্তি, শৌর্য-বীর্যবান, ঐশ্বর্যশালি, জ্ঞানী, যশবান ও সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকেও ভগবান বলা হয়। আর, এর ফলেই, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ঈশ্বর ও দেবতা সম্পর্কে গুলিয়ে ফেলে।

 

আর, একটা গুহ্য কথা, পরোলোকের কিছু কিছু নিম্ন-চেতন-স্তরের বিদেহী আত্মা (বা দুরাত্মা)-দেরকে অনেক সময়েই বিভিন্ন পূজিত দেব-দেবীর ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। বিশেষতঃ যে সব মন্দির ও তীর্থস্থানে অনাচার—কদাচার—দুরাচারে পূর্ণ, সেইসব স্থানেই ভূত-প্রেত-পিশাচাদি নিম্ন-চেতন-স্তরের প্রেত-আত্মাদের ভীড়। এদের মধ্যে কিছু কিছু চতুর প্রতারক মনের প্রেত-আত্মা অনেক সময়েই অজ্ঞান-অন্ধ-অসহায় মানুষ বা দেব-ভক্তদের প্রতারণা ক’রে আনন্দ পায়, এবং তাদের পূজা-অর্ঘাদি আত্মসাৎ ক’রে তৃপ্ত হয়।

 

এদের কেরামতিতেই অনেক দেবস্থান এবং অনেক দেব-দেবী হয়ে ওঠে জাগ্রত। দেবতা সম্পর্কে সঠীক ধারণা না থাকায়, অনেক মানুষই প্রতারিত হয়ে আসছে এইভাবে। অনেকেই ঈশ্বর আর দেবতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে মায়ার গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছে।

 

*বিদ্বাংসোদেবা (সূত্রঃ তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২/৩ সুক্ত)

ঈশ্বর-মন (বিশ্বাত্মা) অস্তিত্ব প্রসঙ্গে মহর্ষি মহামানস
 


ঈশ্বর-মন ( আমরা বলি, 'বিশ্বাত্মা' ) নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। যারা নিজের মনটাকেই এখনো ঠিকমতো বুঝতে বা জানতে পারেনি, উপলব্ধি করতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বর-মন বা বিশ্ব-মনকে বোঝা বা জানা, তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা সত্যিই দুষ্কর। মনকে বুঝতে হয় মন দিয়েই। আর তার জন্য প্রয়োজন হয়--- সজাগ-সচেতন-সত‍্যপ্রিয়, বিকশিত মুক্ত-মন। 

ঈশ্বর-মনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করার পক্ষে এই নিদর্শনটি অনেকটা সহায়ক হবে আশাকরি--- 
মরণশীল জীবের বংশবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে--- তাদের অস্তিত্ব, বংশধারা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর যে কৌশল রচনা করেছে, তাতেই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আর, বুদ্ধিমত্তাই হলো 'মন'-এর উপস্থিতির নিদর্শন। অর্থাৎ যেখানে বুদ্ধি আছে, সেখানে অবশ্যই মন আছে। 

 

স্রষ্টার বুদ্ধিমত্তার আরেকটি নিদর্শন হলো— উন্নতমানের জীব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষ জীব সৃষ্টি করা এবং তাদের যথোপযুক্ত শরীর-যন্ত্র তৈরি করা। এসবের পিছনে স্পষ্টতই বুদ্ধিমান সচেতন মনের অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়ে থাকে।

এছাড়া, আমরা যাতে নিজেদের শরীর বিনষ্ট ক'রে না ফেলি, আমরা রোগ-ব‍্যাধি, আঘাত-- আক্রমণ থেকে যাতে বাঁচার চেষ্টা করি, সেজন্য স্রষ্টা আমাদের মধ্যে যন্ত্রণা বোধ দিয়েছে।

যদিও, তার সব কাজই সম্পূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত নয়, আমাদের অনেকের কাছেই যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়, তবুও সৃজনকালে (চেতনার ক্রমবিকাশের একটি বিশেষ স্তরে) তার জ্ঞান ও চেতনা সাপেক্ষে সে অনেক কিছুই করেছে। স্রষ্টা আমাদের দিয়েছে অনেক আত্মরক্ষার ব‍্যবস্থাও।

যৌনসুখের প্রতি জীবকে প্রলুব্ধ ক'রে তুলে, ---তার মধ্যে যৌন মিলনের তাড়নারূপ প্রোগ্রাম-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, জীবকে যৌনমিলনে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য ক'রে তোলার কৌশলটি অবশ্যই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। খুঁজলে, এইরকম আরো অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে। 

আর একটু সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, দেখা যাবে--- আমাদেরকে স্বল্পচেতন মানব থেকে ক্রমশ উচ্চ--- আরও উচ্চ চেতনা ও জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ক'রে তোলার উদ্দেশ্যে , সে নানা প্রকার কৌশল তৈরী করেছে। 

এছাড়াও, আরো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, সুদীর্ঘকাল ধরে ঈশ্বর-মনও ক্রমশ একটু একটু ক'রে বিকশিত হয়ে চলছে। মনোবিকাশের সাথে সাথে তার সৃজন ক্ষমতারও যে উন্নতি হয়েছে, তা তার ক্রমোন্নত (কীট থেকে আরম্ভ করে উন্নত মানুষ)  সৃষ্টির দিকে তাকালেই তা' স্পষ্ট বোঝা যাবে। 

বিশ্বাসের চশমাটাকে খুলে রেখে দেখো


প্রচলিত ধর্ম--- দ‍র্শন---মতবাদ -এর কথা আমি বলতে পারবো না। আমাদের ধর্ম-দর্শন-মতবাদে এই মহাবিশ্ব অস্তিত্বই হলো ঈশ্বর। এই বিশ্ব-অস্তিত্বকে কি তুমি অস্বীকার করতে পারো !?


বিশ্বাসের চশমাটাকে খুলে রেখে দেখো।​ 'মহাধর্ম' ও 'মহাবাদ'-এর মধ্যে তুমি তোমার বিশ্বাসের ঈশ্বরকে খুঁজতে যেওনা। —পাবেনা। তথাকথিত স্বর্গলাভ– ঈশ্বরলাভ অথবা ব্রহ্মলাভের কোন পথ বা পদ্ধতির সন্ধান নেই এখানে। আছে মানবত্ব লাভের উপায়।

বিশ্বাসের চশমাটাকে খুলে রেখে, যথাসম্ভব প্রভাবমুক্ত হয়ে— খোলা মন নিয়ে, সত্যানুসন্ধিৎসুর দৃষ্টি নিয়ে-– এর গভীরে প্রবেশ করলে, তবেই বিস্ময়কর সত্য তোমার কাছে প্রকাশলাভ করবে।

'মহাধর্ম' ও 'মহাবাদ' হলো— যথাক্রমে এক স্বতন্ত্র ধর্ম এবং স্বতন্ত্র মতবাদ। বিভিন্ন শাস্ত্র —বিভিন্ন মতবাদ অথবা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সাথে এর তুলনামূলক বিচার করতে গেলে, ধন্দে পড়ে যাবে। দেখবে, কোথাও হয়তো মিলছে, কোথাও মিলছে না। তারফলে, তোমরা অনেকেই মানসিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে— হতবুদ্ধি হয়ে যেতে পারো।

তাই, 'মহাধর্ম' ও 'মহাবাদ'-এর দ্বারা লাভবান হতে চাইলে, একে এর দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যুক্তিবাদী সচেতন মুক্ত মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

ঠিকমতো উপলব্ধি হলে, তখন বুঝতে পারবে, কোনটা লভ্য ---কোনটা লাভ করা সম্ভব, আর কোনটা আকাশ-কুসুম কল্পনা! বুঝতে পারবে, এতদিন কিভাবে মরিচিকার পিছনে ছুটে ছুটে মরেছো তুমি। বুঝতে পারবে মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য কী।

তুমি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে, তোমার জীবনের অধিকাংশ অসাফল্য— পরাজয়, হানি, অধিকাংশ দুঃখ– কষ্ট —যন্ত্রনার পিছনে প্রধানত দায়ী—তোমার অজ্ঞানতা, তোমার অন্ধ-বিশ্বাস। সঠিকভাবে নিজেকে না জানার ফলে, তোমার সামনের মানুষকে ঠিকমতো চিনতে না পারার ফলে, তুমি বহুবার ঠকেছ— প্রতারিত হয়েছো। এর পুণরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে, যতদিন না তুমি আলস্যতা কাটিয়ে সজাগ–সচেতন থেকে— সত্য– মিথ্যা, বাস্তব– অবাস্তব-কে চেনার ক্ষমতা লাভ করছো।

নিজেকে সজাগ–সচেতন রেখে— প্রভাবমুক্ত হয়ে, যুক্তি-বিচার প্রয়োগ করে, সত্যানুসন্ধান করতে, গভীরভাবে চিন্তা করতে, অনেকটাই মানসিক পরশ্রম করতে হয়। তার চাইতে বিশ্বাস করা অনেক সহজ কাজ। বিশ্বাস করতে তেমন পরিশ্রমের দরকার হয় না। তাই, মানসিক শ্রমবিমুখ মানুষ— বিশ্বাসের পথটাই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু তার ফলে যে কী ক্ষতি হয়, তা’ বোঝার জন্যেও মানসিক পরিশ্রম করতে সে নারাজ বা অপারক।

বিশ্বাসের পথে আত্মোপলব্ধি— সত্যোপলব্ধি, ঈশ্বরলাভ অথবা ঈশ্বরত্ব লাভ কিছুই সম্ভব হয় না। তবু, মানুষ বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধ’রে ছুটে–ছুটে মরে। তাই, মানুষকে সজাগ-সচেতন —যুক্তিবাদী —সত্যানুসন্ধিত্সু ক’রে তুলতে, মানুষের জীবনে একের পর এক দুর্ভাগ্য নেমে আসে। মানুষ যথেষ্ট সজাগ-সচেতন না হওয়াবধি বারবার আঘাত আসতে থাকে, এবং আসতেই থাকে।

বিশ্বাসের দ্বারা পৃথিবীতে যতটুকু ভালো হয়েছে, মন্দ হয়েছে তার চাইতে অনেক গুণ বেশি। সারা পৃথিবী জুড়ে যত অমানবিক কর্ম সংঘটিত হয়েছে, যত রক্তপাত হয়েছে  ও হচ্ছে, তার অধিক অংশের মূলেই আছে বিশ্বাস। অন্ধ বিশ্বাস।

আর, যদি মনে কর, তোমার বিশ্বাসের পথই শ্রেষ্ঠ পথ, ওটাই শেষ কথা, তাহলে বুঝতে হবে, মহাধর্ম ও মহাবাদ তোমার জন্য নয়।

এই মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা নিম্নচেতন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, শঠতা ও প্রবঞ্চনাপূর্ণ প্রচলিত ধর্ম তাকে দিয়েছে সহজবোধ্য কাল্পনিক ঈশ্বর, যাতে সে তা-ই নিয়েই নির্বোধের স্বর্গে অলীক সুখে মশগুল হয়ে থাকে।

মানুষ যাতে ক্রমশ চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে— কোনো দিনই আসল ঈশ্বরকে জানার এবং উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারে, তারজন্য সমস্ত আয়োজনই পাকা করে রেখেছে এই ধর্ম নাম্নী অধর্ম।

একমাত্র প্রবল চেষ্টার দ্বারাই, ধর্মের এই কঠিন মায়াজালের ফাঁদ থেকে বেড়িয়ে এসে মুক্তি লাভ সম্ভব। চেষ্টা করো, নিশ্চয়ই পারবে। অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিপ্রিয় সত‍্যপ্রেমী হয়ে ওঠো। আমার শুভকামনা তোমার সঙ্গে থাকবে।

দীর্ঘকাল অন্ধকারে থাকতে অভ‍্যস্ত হয়ে গেলে, যেমন আলোতে আসতে ভয় হয়, দীর্ঘ বন্দী-জীবন কাটানোর পর, মুক্ত জীবনে ফিরে আসতে যেমন ভয় হয়, তেমনই আজন্ম ধর্মের ঘেরাটোপে বন্দী থেকে অভ‍্যস্ত মানুষ--- ধর্মের মোহজাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে এসে মুক্তজীবন লাভের কথা ভাবতেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

এই ভয়কে জয় ক'রে মুক্তিলাভে সক্ষম হয় যে (যুক্তিপ্রিয় সত‍্যপ্রেমী মুক্তমনের) জন , সে-ই হলো প্রকৃত আলোকপ্রাপ্ত মানুষ।। 

জীবাত্মা —দিব‍্যাত্মা ​

বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষের কাছ থেকেই প্রশ্ন এসেছে— আত্মা সম্পর্কে। 'আত্মা' আছে কি— নেই, থাকলে তা' কি রূপ। তার অশরীরী অস্তিত্ব আছে কি না, পুনর্জন্ম হয় কি না, এমনই বিবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে বহুবার।

 

এতদিন এড়িয়ে গেছি, বলেছি, যা বোঝানো সহজ নয়, যার প্রমাণ দেওয়া যায় না, ---তা নিয়ে কথা বলে কি হবে। বলেছি, এ' সম্পর্কে জানার সময় হয়নি এখনো। কিন্তু অনেকেই নাছোড়বান্দা। অগত্যা অতি সংক্ষেপে আজ কিছু বলব, ঠিক করেছি।

 

পরমাত্মা— বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরাত্মা, জীবাত্মা নিয়ে মানুষের যত না আগ্রহ, তার থেকে বেশি আগ্রহ প্রেতাত্মা বা দিব‍্যাত্মা নিয়ে। তবে নতুন প্রজন্মের অনেক মানুষেরই চেতনা এখন অনেক উন্নত। প্রধানত তাদের কথা ভেবেই আজকের এই 'আত্মা' সম্পর্কে আলোচনা। পরমাত্মা ও বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর সম্পর্কে সৃষ্টিতত্ত্ব অধ্যায় বলেছি। এখন, জীবাত্মা এবং প্রেতাত্মা বা দিব‍্যাত্মা সম্পর্কে বলব।

 

জীবাত্মাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, প্রথমে বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে —এর বাস্তব দিকটাকে ভালভাবে দেখা দরকার। সর্বাগ্রে জানতে হবে জীবাত্মা কি বা কাকে বলবো।

 

জীবের দেহময় অস্তিত্ব ছাড়াও রয়েছে আরও দুটি প্রধান অস্তিত্ব, —প্রাণময় অস্তিত্ব এবং মনোময় বা চৈতন্যময় অস্তিত্ব। জীবাত্মা বলতে বাস্তব দৃষ্টিতে বোঝায়, যথাযথ দেহ-প্রাণ সম্পন্ন সক্রিয় সচেতন জীবের মনোময় সত্তাটি—। মানুষের ক্ষেত্রে, এই আমিত্ব স্বরূপ কর্তা ও ভোক্তারূপ মনোময় সত্তাই হলো জীবাত্মা। যা জীবদেহকে ভিত্তি ক'রে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ ক'রে চলেছে—। যার সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের সঙ্গে। অলক্ষ্যে সেখানে উপস্থিত রয়েছে আরো একজন উপভোক্তা, সে হলো সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিব‍্যপ্ত হয়ে থাকা— পরমাত্মা।

 

মনোময় সত্তা বা জীবাত্মা সপ্রাণ সক্রিয় দেহের উপর নির্ভরশীল। বাস্তবে, দেহময় এবং প্রাণময় অস্তিত্ব লোপ পেলেই মনময় অস্তিত্বও লোপ পায়। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ব‍্যতীত মনের কোনো অস্তিত্ব নেই। মন থাকলে, সেখানে মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র থাকতে হবে। মন— সে যত শক্তিশালী-ই হোক না কেন, মস্তিষ্ক রূপ যন্ত্র নির্ভর।

 

তাহলে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরেরও কি মস্তিষ্ক আছে! হ‍্যাঁ আছে, তোমার মস্তিষ্কটাকে কল্পনায় বহুগুণ বর্ধিত করো, আরো বড়--- আরও বড় করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মত বিশাল আকার ভাবার চেষ্টা কর। দেখো, সেটা একটা মহাবিশ্বের মতই দেখাচ্ছে। বাস্তবে, এই মহাবিশ্বের একটা বড় অংশই হলো ঈশ্বরের মস্তিষ্ক। তবে ঈশ্বর মস্তিষ্ক--- আমাদের এই জৈব মস্তিষ্কের মত নয়। তার গঠন উপাদান কার্য প্রক্রিয়া ভিন্ন (যেমন ট্র‍্যানজিস্টার যুক্ত যন্ত্র এবং ডিজিটাল যন্ত্র)।  

 

প্রাণময় অস্তিত্ব সম্পর্কে এই প্রসঙ্গে কিছু বলা প্রয়োজন। প্রাণ হলো প্রধানত তাপ, জৈব বিদ্যুৎশক্তি ও স্নায়বিক শক্তি। শরীরস্থ বিভিন্ন যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে— তা' থেকে গতি, বল প্রভৃতি আরও কয়েক প্রকার শক্তি বা কার্যক্ষমতার সৃষ্টি হয়, —শরীর ও মনের বিভিন্ন প্রকার কার্যকর জীবনীশক্তি হিসাবে। মানস প্রক্রিয়ার পিছনেও রয়েছে— প্রাণশক্তি থেকে বিভিন্ন যান্ত্রিক ব‍্যবস্থাক্রমে উদ্ভূত কয়েক প্রকার কার্যকর শক্তি।

 

প্রাণশক্তির অভাবে দেহ-মন-চেতনা সবই স্তব্ধ। প্রাণের অভাবে দেহ স্তব্ধ বা ক্রিয়া রহিত হলেও— সঙ্গে সঙ্গে তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়না। কিন্তু প্রাণশক্তির অভাবে মনের ক্রিয়া রহিত হওয়ায়, তার বাস্তব অস্তিত্ব লোপ পায়। কারণ ক্রিয়াতেই তার অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়ে থাকে।

 

প্রাণশক্তি দেহযন্ত্রের মধ্যে— বাইরের খাদ্য, আলো, জল, বাতাস প্রভৃতির যোগান সাপেক্ষে সৃষ্ট হয়ে, দেহযন্ত্রকে সচল সক্রিয় রাখার কার্যকরী শক্তি স্বরূপ। ব্যাপক দৃষ্টিতে যেকোনো ক্রিয়া শক্তিই প্রাণশক্তি। প্রাণশক্তি ছাড়া কোন ক্রিয়া হতে পারে না। জাগতিক সমস্ত ক্রিয়াই বিশ্বসত্তার এবং জীবের প্রাণশক্তির খেলা।

মন বা জীবাত্মাকে বুঝতে— কম্পিউটার বা কম্পিউটারযুক্ত উন্নত মানের 'রোবট' হলো সবচাইতে ভালো নিদর্শন। কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার হলো জীবের দেহময় অস্তিত্ব। আর সফটওয়ার হলো মনময় অস্তিত্ব। শরীরের মধ্যে একটি বহুমুখী কার্যকর 'বেসিক সফটওয়্যার' আছে। মন সফটওয়্যার তার উপরে ভিত্তি করেই সৃষ্ট হয়েছে এবং কর্ম করে চলেছে। যদিও কম্পিউটারের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের তুলনায় আমাদের জৈব দেহ ও মন অনেক বেশি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জটিল যন্ত্র। মনরূপ সফটওয়্যার এবং তার প্রোগ্রামও অনেক বেশি উন্নত।

 

সফটওয়্যার মূলত দুই প্রকারের, এক— অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার, আর দুই--- বিভিন্ন কাজের উপযোগী এপ্লিকেশন সফটওয়্যার। মূল অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার-এর উপর ভিত্তি করেই এপ্লিকেশন সফটওয়্যার গুলি কাজ করে থাকে। আধুনিক কালের উন্নত অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যারের মধ্যেই নানা প্রকার কাজের উপযোগী অনেক এপ্লিকেশন সফটওয়্যার অন্তর্গত থাকে।

জীবের ক্ষেত্রে, বিশেষত মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রকারের অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার হলো মন বা মনোময় সত্তা। সে জন্মসূত্রে হার্ডওয়ার রূপ শরীর যন্ত্রের সঙ্গে কপি হয়ে আসে এবং কর্ম আর ভোগের মধ্য দিয়ে ডেভলপড এবং আপগ্রেডেড হতে থাকে নিজে নিজেই। জীবের দেহরূপ হার্ডওয়ারের গঠন- উপাদান, গুণাগুণের উপর তার মনের প্রকৃতি, চরিত্র, গুণমান অনেকাংশে নির্ভরশীল। মনুষ্য সৃষ্ট কম্পিউটার সফটওয়্যার-এর মতো সাধারণত তা' স্থানান্তর যোগ্য নয়।

 

মনোময় সত্তা বংশগতির মাধ্যমে দেহরূপ হার্ডওয়্যার-এর মধ্যে সৃষ্ট নবজাতক হার্ডওয়্যার-এর সাথেই প্রতিলিপি বা কপি হয়ে বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই প্রতিলিপির সংকেত মজুত থাকে দেহরূপ হার্ডওয়্যারের বিশেষ কোষের মধ্যে।

 

জীবের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রকারের এপ্লিকেশন সফটওয়্যার গুলি, মূল মন-সফটওয়্যারের বিকাশ —গঠন এবং প্রবণতার ভিত্তিতে, বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাইরের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-শিক্ষার যোগান নিয়ে বিভিন্ন কাজের উপযোগী এপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরি হয়ে ওঠে, ও.এস. সফটওয়্যার এর ভিতরেই। যেমন--- সংগীত, নাটক, কারিগরি চেতনা ও কার্যক্ষমতা সম্পন্ন বিভিন্ন প্রকার উপমন বা অংশমন, —যারা প্রধান মনের সাহায্যে, তার একটা অংশ হিসেবে কাজ করে। আসলে, এই সব এপ্লিকেশন সফটওয়ারগুলি 'মন' সফটওয়ারের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বাইরের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তারা জাগ্রত হয়ে ওঠে।

 

মৌলিক শ্রেণীর প্রাণী— কীটপতঙ্গ, পশুপাখির ক্ষেত্রে, বংশানুক্রমে প্রাপ্ত প্রতিলিপি বা কপি— মন সফটওয়্যার ও দেহ হার্ডওয়ার, অর্থাৎ মন ও শরীর তাদের মা-বাবার প্রায় অনুরূপ হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা হয় না। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই সংকর জাতির জীব হওয়ায়, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত তাদের দেহ-মনের প্রতিলিপি বা কপিগুলি কোনটির সাথে কোনটি সমরূপ হয় না। সুদীর্ঘকাল ধরে একের পর এক— অতি মিশ্র হওয়ার ফলে, এক একজনের চেহারা এবং মানসিক গঠন এক এক প্রকার।

 

কম্পিউটারের চালিকাশক্তি— বিদ্যুৎ-শক্তির মতোই, জীবের জৈব-বিদ্যুৎ শক্তিই হলো প্রাণময় অস্তিত্ব। কম্পিউটারের ক্ষেত্রে প্রাণশক্তি বা বিদ্যুৎ সরাসরি বাইরের থেকে যোগান দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রাণশক্তির অভাবে সমস্ত কিছু অচল— স্তব্ধ হলেও, জীবদেহরূপ হার্ডওয়ারের মতো প্রাণ বা বিদ্যুৎ শক্তির অভাবে তা' পুনর্জীবন লাভে অক্ষম হয়না। প্রাণ শক্তির পুনঃ যোগান পেয়ে কম্পিউটার—হার্ডওয়্যার সক্রিয় হলে, তার সফটওয়্যার আবার জাগ্রত সক্রিয় হতে পারে।

 

জীবদেহের ক্ষেত্রে প্রাণ শক্তি— জৈব বিদ্যুৎশক্তি দেহের মধ্যেই উৎপন্ন হয়। আর কোনো কারনে প্রাণশক্তির উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ হলেই শরীরযন্ত্র বিনষ্ট হয়ে চিরতরে কার্যক্ষমতা এবং পুনর্জাগরণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে (সাধারণত)। বাস্তবে মনময় অস্তিত্ব যেহেতু প্রাণময় এবং এবং দেহময় অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল, তাই এ' অবস্থায় জীবের মনোময় বাস্তব অস্তিত্বেরও বিনাশ ঘটে চিরতরে। 

 

এবার, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা 'আত্মা'-কে দেখবো। এখন, জন্মান্তর প্রশ্নে— দেখা যাক, পরলোকগত দিব্য মনোময় সত্তা বা প্রেতাত্মার (এখন থেকে বলার সুবিধার্থে এই ক্ষেত্রে শুধু 'আত্মা'-ই বলব) পুণরায় জীবদেহ ধারণ ক'রে পুনর্জন্ম লাভের আদৌ কোন বাস্তবতা আছে কিনা।

 

আমরা পূর্বেই দেখেছি, জীব মাত্রই জন্মসূত্রে— বংশানুক্রমে তার জন্মদাতার বা জন্মদাতাদের কাছ থেকে প্রাণময় সত্তাসহ মনোময় এবং দেহময় সত্তার প্রতিলিপি (কপি) প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই বংশবৃদ্ধির এই প্রক্রিয়ায়— নবজাতককে 'আত্মা' বা 'মন' বা 'চেতনা' লাভ করতে, তার শরীরের মধ্যে পরলোকের কোন আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটার কোনো প্রয়োজন নেই। আর সেই কারণেই, পরলোকের আত্মার পক্ষে জীবদেহ ধারণ ক'রে পুনর্জন্ম লাভের কোন সম্ভাবনা নেই।

 

অনেকেই বিদেহী মনময় সত্তাকে 'আত্মা' বলে মেনে নেয় না। তারা 'আত্মা' বলতে দেহ-মন অতিরিক্ত কোন সত্তায় বিশ্বাসী। কিন্তু সেটা যে প্রকৃতপক্ষে কী সে সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। কেউ কেউ শুধু দিব‍্য মনময় সত্তাকেই আত্মা বলে মনে করে। এটা ঠিক, পরলোক এবং তদুর্ধ লোকে দিব্য মনোময় সত্তাই আত্মা। কিন্তু দিব‍্য মনময় সত্তা তো আসলে 'মন'-ই। যার চিন্তা করার ক্ষমতা আছে— সে মন বৈ আর কিছু নয়। সে -ই অতীতে পৃথিবীতে— দেহ অস্তিত্ব সম্পন্ন থাকাকালীন, বাস্তব মনোময় সত্তার সঙ্গে মিলেমিশে একসাথে জীবাত্মা রূপে তার ভূমিকা পালন করে গেছে একসময়। আচ্ছা, এ' কথায় পরে আসছি।

প্রেতাত্মা বা আত্মার ধারণা অতি প্রাচীনকাল থেকে আজও আমাদের মধ্যে রহস্যাবৃত হয়ে রয়েছে। প্রেতাত্মা বা অশরীরী আত্মাকে জানার চেষ্টাও হয়েছে বহু, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞান-মনস্ক মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি তার অস্তিত্বের। মানুষের ভয়, বিশ্বাস, অজ্ঞানতা ও অসুস্থতা প্রসূত কুসংস্কারকে আশ্রয় ক'রে সে টিকে আছে আমাদের কাছে।

 

মনোবিকারজাত দৃষ্টি ভ্রম, ভ্রান্ত দর্শন এবং হিস্টিরিয়া রোগীর নানা অদ্ভুত কান্ড কারখানা, দুষ্ট লোকের কারসাজি, আর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা এবং অদ্ভুত অজানা রোগের আকস্মিক প্রাদুর্ভাব, —সাধারণের কাছে যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায়, সাধারণ মানুষ সরল মনে সেগুলিকেই প্রেতাত্মার প্রমাণ হিসেবে মেনে নিয়েছে।

 

প্রেতাত্মা বিশ্বাসের সবচাইতে বড় কারণ হলো, আমাদের মধ্যে সংস্কারাবদ্ধ বা প্রি-প্রোগ্রামড (মন-আমি- চেতনা দ্রষ্টব্য) ধারণা বা অন্তর্গ্রথিত নির্দেশ, যা বেঁচে থাকার চাহিদা, মৃত্যুভয় বা অস্তিত্ব বিলোপের ভয় এবং আত্মরক্ষার ইচ্ছা বা চাহিদা রূপে কাজ করে। যার জন্য— 'আমার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আমি এই জগত থেকে হারিয়ে যাবো চিরতরে— আমি কোথাও থাকবো না।' এটা আমাদের মন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বিশেষত পরলোক সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকায়, একপ্রকার যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রেতাত্মা—পুনর্জন্মের ধারণা গড়ে উঠেছে আমাদের মনে।

 

আমিত্ব! —এই আমিত্ব গুণই হলো মানবাত্মার বিশেষ লক্ষণ। মন যখন নিজেকে কর্তা এবং ভোক্তা রূপে অনুভব করতে থাকে, আমিত্বের সৃষ্টি হয় তখন থেকেই। ক্রমশ যথেষ্ট জ্ঞান এবং উচ্চ চেতনা লাভের সঙ্গে সঙ্গে— এই বোধ জন্মাতে থাকে, যে সে আসলে নিমিত্ত মাত্র। তখন থেকে ক্রমশ আমিত্ব লোপ পেতে থাকে তার। পরবর্তী সর্বোচ্চ চেতনায় ঈশ্বরের সাথে মিশে গিয়ে সে ঈশ্বরামিত্ব লাভ করে।

মানুষের মৃত্যুর পর কি আমিত্ব লোপ পায়, না তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বর্তমান থাকে, না —কি ঈশ্বরের সাথে মিশে যায় এ প্রশ্ন অনেকেরই।

 

বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে— যখন একজন মানুষ অজ্ঞান-অচেতন হয়ে পড়ে, তখন জগত-সংসার তার মতো চলতে থাকে। কিন্তু সে —আমিত্ব স্বরূপ সেই মন-অস্তিত্ব তখন অনুপস্থিত— অস্তিত্ববিহীন। শরীর যন্ত্র স্বাভাবিক-সক্রিয় হলে, সে আবার অস্তিত্ব ফিরে পায়। কম্পিউটারের সুইচ অফ-অন করলে যেমনটি হয়। কিন্তু শরীর যখন একেবারে চিরতরে নিষ্ক্রিয় বা বিনষ্ট হয়ে যায়, পুনরায় স্বাভাবিক সক্রিয় হওয়ার আর কোন উপায় থাকে না, তখন সেই আমিত্ব স্বরূপ মনের আর অস্তিত্ব ফিরে পাবার উপায় থাকে না। দেহ তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে মিশে যায় বিশ্ব-শরীর বা ঈশ্বর দেহের সাথে। প্রচলিত কথায়, পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায় সে তখন।

 

আর মন—? ঈশ্বর মনের সাথে যুক্ত হতে গেলেও তার দেহ থাকতে হবে। বাস্তব দৃষ্টিতে— দেহ ছাড়া মন হয় না। জীবন্ত সত্তার দেহ-মন আছে। আমরা ঈশ্বরের সাথে এবং ঈশ্বর মনের সাথে —সরাসরি না হলেও, সূক্ষ্ম ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছি। দেহ নষ্ট হলে মনের অস্তিত্ব নেই, তাই ঈশ্বরের মনের সাথে জীব মনের মিশে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

 

ঈশ্বরের সাথে মিশে যাওয়া বলতে, নিজের স্বাতন্ত্র্যবোধ মুছে গিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। বাস্তবে, আমরা ঈশ্বরের সঙ্গেই আছি, কিন্তু স্বাতন্ত্র্যবোধ —যথেষ্ট চেতনার অভাব আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। স্বাতন্ত্র্যবোধ সম্পন্ন একটি জীবের আত্মা, —মৃত্যু পরবর্তী স্তরে তার অস্তিত্ব থাকলেও, —সে তার স্বাতন্ত্র্যের কারণে —চেতনার স্বল্পতার কারণে, ঈশ্বর মনের সাথে মিশে যেতে বা একাত্ম হতে পারবে না। ঈশ্বর চেতনার সমান চেতনা লাভ হলে, তবেই ঈশ্বর মনের সাথে মিশে যাওয়া সম্ভব।

 

স্বল্প চেতন— আমিত্ববোধ বিহীন,  সম্পূর্ন দেহগত জীবের মন, তার শরীরের মৃত্যু হলে, শরীরের রূপান্তর ঘটার সাথে সাথে, সে-ও রূপান্তরিত হয়ে বিশ্ব-শরীর বা ঈশ্বর শরীরের সঙ্গে মিশে যায়।

 

এতক্ষণ, বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে জীবাত্মা— আত্মা এবং আত্মা সম্পর্কিত কিছু কিছু বিষয় বস্তু পর্যবেক্ষণ করলাম। এবার বলবো, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে— ধ‍্যানালোকে অতিরিক্ত যা পাওয়া গেছে।

 

'আত্মা' সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে, তার আগে 'দিব‍্য-অস্তিত্ব' বা 'এস-এক্সিসটেন্স' সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা প্রয়োজন। আদিকণা থেকে আরম্ভ ক'রে প্রতিটি পদার্থ, বস্তু এবং শক্তির রয়েছে দুটি ভিন্ন রূপ অস্তিত্ব। একটি হলো তার বাস্তব অস্তিত্ব, আর অপরটি— দিব্য অস্তিত্ব। বস্তু বা পদার্থের গঠন, উপাদান, রূপ- গুণ, শক্তি প্রভৃতি সমস্ত কিছুই তার দিব‍্য-অস্তিত্বের মধ্যে বর্তমান। সাধারণভাবে, এই দিব‍্য-অস্তিত্ব— বাস্তব অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোত হয়ে মিশে থাকে।

 

জীবদেহের ক্ষেত্রেও অনুরূপ, তারও আছে একটি দিব্য-অস্তিত্ব, দিব্য-শরীর। জীব দেহের মধ্যে উপস্থিত মন, প্রাণ, চেতনা প্রভৃতির দিব‍্য-অস্তিত্বও এই দিব‍্য-শরীরের মধ্যে বিদ্যমান। বস্তু ও শক্তির সাথে তাদের দিব্য অস্তিত্ব জড়িয়ে থাকে ওতপ্রোতভাবে। বাস্তব শরীর বা বস্তুকে অবলম্বন ক'রে, তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিলেমিশে— তাকে ঘিরেই তার দিব‍্য অস্তিত্ব বর্তমান থাকে। দিব‍্য অস্তিত্ব বিহীন কোনো বস্তু— কোনো কিছু হতেই পারে না। বস্তু বা শরীরের আকার এবং গুণগত পরিবর্তন ঘটলে, তার দিব‍্য-অস্তিত্বেরও বা দিব্য সত্তারও অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে থাকে। দিব্য শরীর বা অস্তিত্ব, বাস্তব অস্তিত্ব বা শরীরের একটি সামগ্রিক প্রতিলিপি বা কপি। যা আমাদের পরিচিত বস্তু নয়, এক প্রকার অন্য বস্তু— অপার্থিব বস্তু দিয়ে তৈরি।

 

একটি বস্তুর সাথে অপর একটি বস্তুর মধ্যে যখন ক্রিয়া ও বিক্রিয়া হয়, তখন তাদের দিব‍্যসত্তাদের মধ্যেও অনুরূপ ক্রিয়া ও বিক্রিয়া এবং পরিবর্তন ঘটে।

 

বিপরীত বিশ্বের (সৃষ্টি রহস্য দ্রষ্টব্য) সমস্ত বস্তু ও শক্তিরও রয়েছে অনুরূপ দিব্য সত্তা। কোন একটি বস্তু তার বিপরীত বস্তুর সংস্পর্শে এলেই— দুটি বস্তু এবং তাদের দিব‍্য সত্তার মিলনের সাথে সাথে তারা উভয়ই তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। এই মিলনের ফলে শক্তির বিকিরণ ঘটে, আর মিলনের রকমফেরে (মিলনের গতি এবং অবস্থার উপর নির্ভর ক'রে) সৃষ্টি হতে পারে আদি কণা, সৃষ্টি হতে পারে নতুন পদার্থ বা বস্তু অথবা শক্তি।

 

কোনো বস্তু বা বস্তু কণার সাথে অপর কোন বস্তু বা বস্তুর মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ বা সংঘাত ঘটলে, একে অপরের উপর তাদের দিব্য-সত্তার বিপরীত ছাপ ফেলবে। প্রত‍্যেকের দিব‍্যসত্তা অপরের দিব‍্য সত্তার ঐ বিপরীত ছাপ বহন করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই বহনকারী বস্তু বা পদার্থ বা পদার্থ কণার এবং তাদের দিব্য সত্তার বিকার বা রূপান্তর ঘটছে। 

 

বস্তুর দিব্য সত্তার উপর ভর ক'রে থাকা ঐ বিপরীত দিব্য ছাপ থেকে আরও অনেক ছাপ বা ঐ ছাপের কপি তৈরি হতে পারে, যদি ওই ছাপ বহনকারী বস্তু বা পদার্থ কণার সাথে কিছু পরিমাণ ঐরূপ বস্তু অথবা অপর কোন বস্তু বা পদার্থ কণার নিয়মিত পুনঃ পুনঃ সংঘাত বা সংঘর্ষ ঘটে তাহলেই—। তবে এক্ষেত্রে ঐ ছাপ-এর বিপরীত ছাপ তৈরি হবে না। অপর একটি দিব‍্যসত্তার উপর ভর করে থাকা এই বিপরীত দিব্য ছাপ—নেহাতই একটি অশরীরী ছাপ বিশেষ। তার নিজস্ব শরীর না থাকায়, সে অপরের উপর বিপরীত ছাপ ফেলতে অক্ষম। সংঘর্ষের ফলে তা' থেকে অনেক অনুরূপ কপি তৈরী হতে পারে, তবে সেই ছাপ ক্রমশ সূক্ষতা প্রাপ্ত হবে। একটি কণা থেকে অপর কণাতে, তার থেকে আরেকটি কণাতে— এইভাবে যদি ক্রমান্বয়ে ঐ ছাপের কপি হতে থাকে, তাহলে ক্রমশই সেই দিব্য ছাপ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকবে।

সাধারণভাবে এই দিব্য ছাপ নিষ্ক্রিয় —নির্গুণ। কিন্তু কোনো প্রকারে যদি তা' জীব শরীরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, তখন সে প্রাণশক্তি— জৈব বিদ্যুৎ-শক্তিসহ জীব যন্ত্রের সফটওয়ারের সাহায্যে দিব‍্যরূপ শরীর ধারণে সক্ষম হতে পারে।

 

বিপরীত দিব্য ছাপ— জীব শরীরের মধ্যে প্রবেশ করার পর, তা' স্নায়ুতন্ত্রের মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কের বিশেষ কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। সেখানে জীব-যন্ত্রের সফটওয়্যারের এক বিশেষ ক্ষমতা বলে, ঐ ছাপ তার অনুরূপ দিব‍্য শরীর লাভ ক'রে থাকে। অর্থাৎ মূল পদার্থের বিপরীত দিব‍্যছাপ তখন বিপরীত দিব‍্য শরীরে পরিণত হয়। তখন সে আর নিষ্ক্রিয় ছাপ মাত্র নয়, গুণ ও ধর্ম সম্পন্ন সক্রিয় দিব্য শরীর। যে বস্তু বা পদার্থের বিপরীত ছাপ রূপে তার জন্ম হয়েছিল, সেই বস্তু বা পদার্থের বিপরীত দিব‍্যসত্তা হয়ে ওঠে সে তখন।

 

এরপর, সেই বিপরীত সত্তা— শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে জীবের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক যেন আরক্ষাবাহিনীর মতো, শত্রু ও অপরাধীর সন্ধানে সারা শরীরে চিরুনি তল্লাশি ক'রে যদি কোথাও তার বিপরীত অস্তিত্বের সাক্ষাৎ পায়, তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। ফলতঃ লোপ পায় উভয়ের অস্তিত্ব।

তোমাদের কাছে বিষয়টি একেবারেই নতুন, তাই আরেকবার বলি—, বিপরীত ছাপ গুলি শরীরের স্নায়ুমন্ডলীর জৈব বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসতেই— তড়িৎ গতিতে তা' পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের এক বিশেষ কেন্দ্রে। সেখানে জীব যন্ত্রের সফটওয়ারের মাধ্যমে— ছাপগুলি তাদের রূপ-গুণ চরিত্র মতো প্রত্যেকে এক একটি দিব্য শরীর লাভ করে। সেখান থেকে তারা জীব শরীরের প্রতিরক্ষাতন্ত্রের ব্যবস্থামতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে—- শরীরের মধ্যে বিষক্রিয়াকারি অনিষ্টকর সম-বিপরীত বস্তু বা পদার্থের সন্ধানে।

স্নায়ুতন্ত্রের দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা বা অক্ষমতা থাকলে, ওই দিব্য ছাপগুলির দিব্যশরীর লাভ এবং কার্যকর ভূমিকা পালন সম্ভব নাও হতে পারে।

 

বস্তু হলো তাঁর দিব‍্য অস্তিত্বের বাস্তব রূপ। দিব‍্য অস্তিত্ব বিহীন কোন বস্তু হতে পারে না। শক্তিও তাই। কিন্তু দিব‍্যসত্তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বাস্তব রূপ অর্থাৎ বস্তু শরীর ছাড়াই— কিছু শক্তি এবং অলৌকিক পদার্থের উপর নির্ভর ক'রে বিদ্যমান থাকতে পারে।

 

কোন দিব‍্য-অস্তিত্ব তার সম-বিপরীত দিব‍্য-অস্তিত্বের সাথে মিলিত হলে, উভয়ের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়। সেই সঙ্গে তাদের বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে, তা- ও বিনাশ প্রাপ্ত হয়।

এই দিব‍্য-অস্তিত্ব তার বস্তু শরীরের মতই গুণসম্পন্ন অপার্থিব কণার সমন্বয়ে গঠিত। পরমাণু এবং তার অন্তঃস্থ শক্তি, আদি কণা এবং অন্যান্য সমস্ত কণারই দিব্য অস্তিত্ব বিদ্যমান। প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই তার সদৃশ দিব‍্য- অস্তিত্ব উপস্থিত।

 

আমাদের হাতের কাছে— দিব‍্য-সত্তার উপলব্ধি যোগ্য নিদর্শন হলো— হোমিওপ্যাথিক ওষুধ। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ হলো— সুগার বা অ্যালকোহলের দিব্য সত্তার উপর ভর ক'রে থাকা —ওষুধরূপ কোন বস্তু বা পদার্থ কণার বিপরীত দিব‍্য-ছাপ। যে ছাপ দেহের অভ্যন্তরের গিয়ে— সদৃশ দিব‍্যসত্তা লাভ ক'রে, দেহস্থ অনিষ্টকর বিপরীত সত্তার সাথে মিলিত হয়ে, উভয়ই লয় প্রাপ্ত হয়। এই হলো হোমিওপ্যাথিক এবং 'মহাপ‍্যাথিক' ওষুধের আরোগ্য প্রক্রিয়া মূল তত্ত্ব।

ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে—, প্রত্যেকের যেমন যেমন শরীর মন, ঠিক সমানুরূপ এক একটি দিব্য-শরীর ও দিব‍্য- মন রয়েছে আমাদের। কিন্তু আমরা আমাদের দিব‍্য শরীর-মনের অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবগত নই অধিকাংশ মানুষ। অবগত হলেও এদের আমরা পৃথক করতে অক্ষম। উচ্চ চেতনা সম্পন্ন এবং কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী কোন কোন মানুষের পক্ষে বিশেষ ইচ্ছাশক্তি এবং বিশেষ ক্ষমতা বলে— দিব‍্যসত্তার একটি কপিকে সাময়িকভাবে দূরে অন্যত্র প্রেরণ করা সম্ভব।

 

স্বাতন্ত্র‍্য‍ ও আমিত্ব-বোধসহ উচ্চ চেতনাসম্পন্ন জীব— মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার মনোময়-সত্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললেও, তার দিব‍্য-অস্তিত্ব বিলীন হয় না। মৃত্যুর পর মুহূর্তে— দিব্য মনোময় সত্তা বা আত্মা বা দিব্যাত্মা* স্থির-নিশ্চলভাবে মৃত্যুপূর্ব চেতন স্তরে বিরাজ করে। এর পরেই মৃতের শরীরে ধ্বংস বা রূপান্তর ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ক্রমশ শরীরের গঠন-উপাদান পরিবর্তিত হতে থাকে।

আত্মা বা দিব্যাত্মা* দেহের মায়া (উচ্চ চেতনা সম্পন্ন ব্যক্তি, যারা প্রায় মায়া মুক্ত, তাদের কথা স্বতন্ত্র) ত্যাগ করতে না পেরে, যতক্ষণ সম্ভব সে দেহের অস্তিত্বের মধ্যে— পূর্বের মতোই বিদ্যমান থাকে। আস্তে আস্তে দেহ তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে পূর্ব রূপ হারিয়ে একটু একটু করে রূপান্তরিত হতে থাকে। শরীরের দিব্য সত্তাও ক্রমশ রূপান্তরিত হতে থাকে শরীরের সাথে সাথে।

 

একসময় পরিবর্তিত দিব্য শরীরের সাথে আর কোনো মতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে—, সেখানে টিকে থাকতে না পেরে, নিষ্প্রাণ ক্ষীয়মান দিব্য শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় সেই প্রাণময়—চৈতন্যময় দিব্যসত্তার সম্মিলিত দিব‍্যরূপ— আত্মা বা দিব্যাত্মা। 

 

অতঃপর সে পরম-পদার্থ বা আদি-পদার্থ ( বোঝার সুবিধার্থে-- ব্রহ্ম-পদার্থ)-এর দিব্যরথে আরোহন ক'রে অর্থাৎ ব্রহ্ম-পদার্থকে অবলম্বন করে রওনা হয় নির্দিষ্ট বিশ্রামাগারের উদ্দেশ্যে।

মানুষের মৃত্যুর পরে মনোময় সত্তার অস্তিত্ব— মৃত শরীর থেকে বেরিয়ে এসে, অশরীরী আত্মা রূপে ব্রহ্ম- পদার্থ অবলম্বন করে, প্রথমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে, এবং আস্তে আস্তে গভীর সুষুপ্তির মধ্যে ডুবে যায়। এই অবস্থার মধ্যেই সে তার চেতন স্তর, রূপ-গুণ- শক্তি সামর্থ্য ও মানসিক গঠন অনুসারে দিব‍্য-শরীর লাভ করে।

 

যে যত উচ্চ চেতনা সম্পন্ন— সে তত ঊর্ধ্বমুখী। তার কর্মজগৎ পৃথিবী থেকে তত উর্ধ্বে। এই পৃথিবীর আকর্ষ মণ্ডলের মধ্যেই, চেতনস্তর ভেদে— বিভিন্ন উচ্চতায় পার্থিব জগতের সমান্তরালে রয়েছে কয়েকটি জীবোত্তর জগৎ। এখন সে সেই জগতের বাসিন্দা।

 

আত্মার এই স্থানান্তরে গমন এবং দিব‍্য-শরীর লাভ প্রভৃতি ঘটনাগুলি— ঈশ্বর-শরীর-অভ‍্যন্তরস্থ (পূর্ব নির্ধারিত) যান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে আত্মার নিজস্ব কোনো ভূমিকা নেই। আমাদের দেহাভ্যন্তরে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের যেমন দশা হয়— কতকাংশে তেমনই।

নিম্ন-চেতন মনুষ‍্যেতর জীবের ক্ষেত্রে, যাদের জীবাত্মার স্বাতন্ত্র্যবোধ— স্ববোধ বা আমিত্ব বোধ নেই, দেহবোধের সাথেই যাদের আত্মা একাত্ম হয়ে আছে, এবং যাদের দেহবোধ বা শরীর সচেতনতাও তেমন পুষ্ট হয়নি, মৃত্যুর পরে তাদের মনোময় সত্তা (আত্মা) দেহের সাথে সাথেই লয় প্রাপ্ত হয় অথবা দেহের সাথেই রূপান্তরিত হয়ে তার স্বতন্ত্র‍্য‍ হারায়।

 

স্বাতন্ত্র‍্য‍ বোধ সম্পন্ন— অহংবোধ সম্পন্ন উচ্চচেতন মনেরই কেবল তদনুরূপ স্বতন্ত্র দিব‍্য মনোময় অস্তিত্ব থাকে। অন্যদের তেমন থাকে না। তাদের দিব‍্য মনোময় সত্তা শরীরের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রায় মিশে থাকে, আলাদা হতে পারে না।

 

আমাদের অবস্থা কতকটা উন্নত প্রণালির মাছ চাষের মতো। প্রথমে একটা জলাশয়ে ডিম তৈরি হয়, পরে সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয় আরেকটি জলাশয়ে। সেখানে ধানী মাছ বা বাচ্চা ক্রমশ বড় হতে থাকে। এরপর, আবার আরেকটি জলাশয়ে সেই বড় বাচ্চাগুলি থেকে চারাপোনা তৈরি হয়। সেখান থেকে বাছাই ক'রে আবার আরেকটি জলাশয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। যেখানে ক্রমশ আরো বড় হয়ে ওঠে মাছ।

আমাদের ক্রমবিকাশমান সমগ্র জীবনও সেইরূপ স্তরে স্তরে— এক জগত থেকে আর এক জগতে, একের পর এক জগত পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। এক জগতের পাট চুকলে— সে পরবর্তী জগতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। একই জগতে বারবার পুনর্জন্ম ঘটছে না।

 

এখ্‌ন, আমরা যে জগতে অবস্থান করছি, প্রচলিত ভাষায় তাকে বলা হচ্ছে— ইহলোক। আর মৃত্যু পরবর্তী জগতকে পরলোক বলা হয়। এই পরলোক বা জীবোত্তর লোকের মধ্যেও রয়েছে কয়েকটি স্তর— কয়েকটি জগত। আত্মার চেতনস্তর অনুসারে এই স্তর গুলি গঠিত। যে— যে চেতন স্তরের, সাধারণত সে সেই চেতন স্তরে বিচরণ বা অবস্থান করে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনে উচ্চস্তরের আত্মা তদপেক্ষা কিছুটা নিম্নস্তরে আসতে পারে সাময়িকভাবে। কিন্তু নিম্নস্তরের আত্মা উচ্চস্তরে যেতে সক্ষম নয়।

 

পরলোকে নিম্ন চেতনস্তরের বাসিন্দারা ছাড়া অন্যান্য উচ্চস্তরের মহাত্মাগণ সাধারণত ইহজগতের ব্যাপারে উদাসীন। নিম্ন চেতন-স্তরের আত্মাও প্রথম প্রথম কিছুদিন —পৃথিবী এবং তার আত্মীয় পরিজনদের আকর্ষণ ত্যাগ করতে না পেরে, পরিচিত স্থান, পরিচিতজনদের আশেপাশে ঘোরাঘুরি ক'রে থাকে। ক্রমশ ইহলোকের মানুষের মনোভাব এবং তাদের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে— আস্তে আস্তে জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে, তাদের উপর থেকে মায়া কেটে যায়। তখন তারা ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হয়ে ক্রমোচ্চ জগতে প্রবেশ করে।

 

এখানেও আত্মার চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে। এবং ক্রমে ক্রমে তারা পরলোকের ঊর্ধ্ব থেকে তদোর্ধ্ব স্তরে উন্নীত হয়। অবশেষে পরলোকের পাট শেষ করে— পৃথিবীর আকর্ষ মণ্ডলের বাইরে— অনেক দূরে অন্য লোকে পাড়ি দেয় তারা। ( গ্রন্থের শেষে Diagram দেখো)

অজ্ঞানতার কারণে পরলোকেও আত্মাকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। বিশেষত যারা ইহলোকে সুখে—বিলাসে নিমজ্জিত হয়ে জীবন কাটায়, এবং তার ফলে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটে খুবই কম, পরলোকে তাদের অবস্থা হয় খুবই খারাপ।

 

যারা ইহলোকে দুঃখ-কষ্ট দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে জ্ঞান অভিজ্ঞতা লাভ করে চলেছে, এবং যারা সচেতনভাবে চেতনা লাভের পথে এগিয়ে চলেছে, তারা তাদের চেতনার ভিত্তিতে— পরলোকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম দুঃখ ভোগ করে থাকে। আর ইহলোকেই যারা যথেষ্ট চেতনা সম্পন্ন—  মোহ-মায়া থেকে অনেকটাই মুক্ত, পরলোক তাদের কাছে স্বর্গসম হয়ে ওঠে।

 

অশরীরি আত্মার বা দিব‍্যসত্তার বাস্তব শরীর না থাকায়, সাধারণত সে এই বাস্তব জগতের সব মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনে অক্ষম। সব মানুষকে দেখা দেওয়া, উপকার বা অপকার করা, এর কোনটাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। —নিম্নস্তরের আত্মাদের পক্ষে তো নয়ই। তবে কিছু শক্তিশালী দুরাত্মাও আছে, তাদের কথা স্বতন্ত্র।

 

অতি উচ্চস্তরের আত্মার কিছু ক্ষমতা থাকলেও, —তা' সে করে না। কারণ যথেষ্ট চেতনা বলে ইতিমধ্যে সে জেনে গেছে, এখানে যা কিছু ঘটছে, সব ঠিক ঠিক ঘটছে। যখন যেখানে যেমনটি ঘটার তা-ই ঘটছে। —এখানে তার কোনো ভূমিকা নেই। পৃথিবীর প্রতি মিথ্যে মায়া নেই তাদের।

তবে ইহলোকের কোন কোন মানুষ— বিশেষ সাধনাক্রমে সিদ্ধ হয়ে, বিশেষ ক্ষমতা লাভ করার ফলে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত ইচ্ছাশক্তি এবং কিছুটা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা বলে, পরলোকের নিম্ন-চেতন-স্তরের আত্মাকে দিয়ে বিশেষ কাজ, কিছু উদ্দেশ্য সাধন করিয়ে নিতে সক্ষম।

 

এছাড়া, কিছু কিছু মানসিক গঠন এবং ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ— আত্মাকে অনুভব বা মনোদর্শন করতে সক্ষম এবং আত্মার সাথে যোগ ঘটাতে সক্ষম।

 

কিছু হিস্টেরিক এবং বিশেষ মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অনেক সময় এরূপ ঘটনা বা অতীন্দ্রিয় অনুভুতি ঘটে থাকে। এইসব ব্যক্তিদের ওষুধ —চিকিৎসা দ্বারা তাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে, তখন তারা ঐ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে— ভয়, দৃঢ়মূল ভ্রান্ত ধারণা এবং মানসিক দুর্বলতা থেকেই কাল্পনিক প্রেতাত্মার দর্শন ঘটে থাকে। যা প্রকৃত দর্শন নয়, —ইমাজিনারি মেন্টাল প্রোজেকশন মাত্র।

 

মানুষ বা জীবের অনেক মানসিক গুণাগুণই তার শরীর এবং বংশনির্ভর। আর কিছুটা অর্জিত হয় তার জীবন চলার মধ্য দিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি সাপেক্ষে। একজন মানুষ জন্মসূত্রে যে বিশেষ একটি শরীর-মন লাভ করেছে, তা' তার বংশানুক্রমে বা বংশপরম্পরায় বিভিন্ন কালের পরিবেশ-পরিস্থিতি সাপেক্ষে প্রাপ্তি। সেখানে অন্য একটি চরিত্রের— অন্য গুণাগুণ সম্পন্ন একটি আত্মার অনুপ্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই।

 

কোন কোন ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশিত বিশেষ কিছু প্রতিভা —বিশেষ কিছু গুণাগুণ বা অস্বাভাবিক লক্ষণ, তার কয়েকজন পূর্বপুরুষ এর মধ্যে পরিলক্ষিত নাও হতে পারে। কিন্তু তাতেই অন্য আত্মার অনুপ্রবেশ ভেবে নিওনা। এই বিশেষ গুণাগুণ অতি মিশ্র সংকরজাতির মানুষের মধ্যে যেকোন সময়েই সৃষ্টি বা প্রকাশ পেতে পারে। আর তা' হওয়াই স্বাভাবিক।

 

নানাবিধ রাসায়নিক পদার্থের নানা ভাগে, নানা রূপে— একের পর এক, বারবার মিশ্রণ ঘটাতে থাকলে, তা' থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা বিচিত্র জিনিসের উদ্ভব হতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটে। মানুষের প্রজনন ভান্ডারে যে অসংখ্য ডিম্ব বা বীজ রয়েছে, তারা বীজ হিসেবে দেখতে এক রূপ হলেও, তাদের কেউই সম-রূপ-গুণ সম্পন্ন শরীর-মনের বীজ নয়।

 

কোন মৌলিক (অমিশ্র) জাতির পশু-পাখির ক্ষেত্রে কিন্তু তা' হবে না। সেক্ষেত্রে বংশানুক্রমে সবকটি জীবই প্রায় একরূপ শরীর ও মনের হবে। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কিছু হেরফের ঘটতে পারে মাত্র।

মানুষের ক্ষেত্রে, যে আত্মা তার স্বাতন্ত্র‍্য‍ ও আমিত্ববোধ এর জন্য ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হতে পারে না, সে কি করে একটি অন্য জীব-আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে, এবং মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করবে! একই দেহের মালিক রূপে— একই মন হিসেবে কাজ করবে! যদি প্রত্যেক জীবাত্মার উপরে একটি অশরীরী আত্মা এসে ভর করতো, তাহলে প্রতিটি মানুষের অবস্থা হতো তথাকথিত ভুতে পাওয়া মানুষের মতো।

তথাকথিত ভূতে পাওয়া মানুষের অধিকাংশই একপ্রকার মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। সঠিক চিকিৎসায় এরা আরোগ্য হয়। মনোপথে এবং ওষুধের সাহায্যে এদের আরোগ্য করা সম্ভব। প্রকৃতই ভূতাবিষ্ট কিনা তা' পরীক্ষা করতে, এদের এমন প্রশ্ন করবে, যার উত্তর সাধারণ মানুষের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। যেমন ছাদের উপরে এখন কে আছে, অথবা আমার পকেটের মধ্যে এখন কি আছে, —এই ধরনের প্রশ্ন। ওই ব্যক্তি যদি সঠিক উত্তর দিতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে— সে প্রকৃতই ভুতগ্রস্ত অথবা সাময়িকভাবে সে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা সম্পন্ন হয়েছে। তবে প্রকৃত ভূতগ্রস্ত ব্যক্তিকেও মনোপথে এবং ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা ক'রে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।

*'মন' অস্তিত্বের দিব্য সত্তাই হলো 'দিব্যাত্মা'। 

সময় আসলে কী
 

 

মন যেমন মস্তিষ্কের ক্রিয়া হতে উৎপন্ন একটি অস্তিত্ব, কতকটা তেমনই, সময়ও— যে কোন রূপ ক্রিয়া হতে উৎপন্ন এক বিশেষ অস্তিত্ব। দৃশ‍্যতঃ অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্ব। এই নিদর্শনটি শুধুমাত্র বোঝানোর সুবিধার জন্য।

 

ক্রিয়া থাকলেই তা' থেকে সময় সৃষ্টি হবে, —সেই ক্রিয়ার নিজস্ব সময়। আর ক্রিয়া যদি নিয়ম-শৃংখলার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট গতিতে এবং নির্দিষ্ট পথে চক্রাকারে— অবিরামভাবে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়ে চলে,  তখনই সৃষ্টি হয় বোধযোগ্য এবং পরিমাপযোগ্য সময়। এই রূপ সময়ের ভিত্তিতে অপরাপর বস্তু— ব্যক্তি প্রভৃতির ক্রিয়াকাল এবং জীবৎকাল পরিমাপ করা যায়।

 

সংক্ষেপে, পৃথিবীর ঘূর্ণন ক্রিয়া অথবা ঐরূপ চক্রাকারে (লুপ আকারে) ঘটে চলা কোনো ক্রিয়ার বিভিন্ন ভাগ বা অংশ বা পর্ব গুলিকে অথবা সমগ্র অংশকে বোঝার ও বোঝানোর সুবিধার্থে ক্রিয়াকাল রূপে একটি অস্তিত্বের কল্পনা করে, তাকে 'সময়' নামে অভিহিত করা হয়েছে।

 

কোন কিছুর জীবৎকাল বা আয়ুষ্কাল অথবা বয়স বলতে, সাধারণভাবে— তার জন্ম থেকে মৃত্যু বা সৃষ্টি থেকে লয়, অথবা আয়ুষ্কালের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত, পৃথিবীর (নিয়মিত গতিরূপ ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত—পরিমাপযোগ্য) সময়ের হিসাবে —তার স্থায়িত্বকাল টুকু বোঝায়। প্রত্যেকটি বস্তু, পদার্থ ও জীবের নিজস্ব ক্রিয়া আছে এবং (পৃথিবী বা অন্য কারো সময়ের হিসাবের মধ্যে থাকলেও) আছে তার নিজস্ব সময়।

 

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা যখন 'সকাল —সন্ধ্যা' বলি,  তখন শুধু সময়কেই বোঝাই না, —সেই নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিতভাবে চক্রাকারে ঘটে চলা বিশেষ কোনো এক বা একগুচ্ছ প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং তৎসম্পর্কিত অন্যান্য ক্রিয়া বা ঘটনা, পরিবেশ ও পরিস্থিতিকেও আমরা সময় বা সময়ের দ‍্যোতক রূপে গণ্য করে থাকি।

 

সময়কে তার এক এক পর্বে, এক একটি বিশেষ রূপে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। ওই রূপটাই আমাদের কাছে সময় রূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু প্রকৃতই সময়ের কোন রূপ নেই। ঘটনাক্রমে— সময়ান্তরে প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপ থেকেই আমাদের সময়ের ধারণা জন্মায়।

 

বলা হয়—, সময়ের ছাপ, সময়ের ক্ষমতা, সময়ের দান প্রভৃতি। যেন, সময়ের নিজস্ব কোন শক্তি বা ক্ষমতা আছে, যার দ্বারা সে অনেক কিছু করতে পারে। বাস্তবে সময়ের স্বাধীন কোন রূপ-গুণ-ক্ষমতা নেই। অবিরাম কার্যক্রমের বা ঘটনাক্রমের ধারায়, একের পর এক নানা ক্রিয়া বা নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের— এক একটি পর্বে এক একটি বিশেষ রূপ, বিশেষ ক্ষতি বা প্রাপ্তি ঘটে থাকে। সেগুলিকে আমরা সময়ের পরিমাপে ফেলে, ঘটনা পরম্পরাকে আমাদের ধারণার মধ্যে এনে থাকি। বলে থাকি, 'যে সময়ে যা ঘটার তাই ঘটবে,  সময় হলেই ঘটবে'....ইত্যাদি। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে, সময়ই এই ঘটনা গুলি ঘটাচ্ছে। সময় যে একটা শক্তিশালী অস্তিত্ব তা' বাস্তবে এখনো প্রমাণিত হয়নি।

 

এই প্রসঙ্গে বলি, সময়ের মত ভাগ্যও ক্রিয়া হতে উদ্ভূত— আপাতদৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন এক বিশেষ অস্তিত্ব। সৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এরা অর্থাৎ জাগতিক সময় ও ভাগ্য— উভয়েই অস্তিত্ত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে (ভাগ্য সম্পর্কে প্রবন্ধ দেখুন)।

 

আমরা কতটা গতিসম্পন্ন? আমাদের সক্রিয়তা— গতিশীলতা ছাড়াও, আমরা পৃথিবীর গতির অধীনে আছি। শুধু পৃথিবী নয় সৌরজগতের গতির সাথে আমরা যুক্ত আছি। আবার, আমাদের নীহারিকাসহ সমগ্র মহাজাগতিক গতির মধ্য দিয়ে আমরা অভাবনীয় গতিতে গতিময়।

 

উচ্চ সক্রিয়তা বা দ্রুতগতিসম্পন্ন কোন বস্তু বা জীব— নিম্ন সক্রিয়তা বা মন্থর গতিসম্পন্ন সম-জাতীয় বস্তু বা জীবের তুলনায়  (কোনো অনিয়ম বা অঘটন না ঘটলে) অনেক পূর্বেই তার নির্দিষ্ট কার্য সম্পন্ন করবে, লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, পরিণতি লাভ করবে, ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, বুড়িয়ে যাবে এবং ফুরিয়ে যাবে বা লয় প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ তার জীবনকাল হবে অপরটির তুলনায় অনেক কম, তার নিজস্ব সময়ের ভিত্তিতে দ্রুত বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে।

 

তবে, অধিক আয়ুষ্কালের কোন জীব বা মানুষ যদি উচ্চ সক্রিয়তা সম্পন্ন হয়, সেক্ষেত্রে সে দ্রুত বুড়িয়ে যাবে না, যদিনা সে কোন রোগ-ব্যধির দ্বারা আক্রান্ত হয়, যদিনা প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় প্রভৃতির অভাব ঘটে, এবং অঘটন কিছু না ঘটে।

 

তবে, আইনস্টাইনের থিওরী অনুযায়ী বস্তু বা ব্যক্তির সক্রিয়তা বা গতি যদি দ্রুততম হয়ে— আলোর গতির নিকটবর্তী হয়, তখন তার সময় চলতে থাকবে খুব ধীরগতিতে। ফলতঃ তার বয়সও অতি ধীর গতিতে বাড়তে থাকবে। যদি না কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তার জীবনকাল বা আয়ুষ্কাল হবে সাধারণ গতি সম্পন্ন অনুরূপ বস্তু বা ব‍্যক্তির তুলনায় অনেকগুণ বেশি। যদিও, কোন বস্তু আলোর গতির সমান গতি লাভ করলে, তখন তার আর বস্তুরূপ অস্তিত্ব থাকবে না। পরবর্তীতে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো, এই থিওরী কতটা সঠিক।

 

আধ‍্যাত্মিক দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে:

উচ্চতর চেতন স্তর থেকে উচ্চতম চেতন স্তরে— সময় ক্রমশ খুব বেশি ধীর গতিশীল। পরমাত্মার নিদ্রাভঙ্গ কালের পর থেকে নিদ্রারম্ভ কালের পূর্ব পর্যন্ত, অর্থাৎ তার একটি দিন (মহাবিশ্বের সৃষ্টি— স্থিতি— গতি লয়) আমাদের পৃথিবীর কাল অনুসারে তা' কোটি কোটি বছরের সমান। ( মহাসৃষ্টিতত্ত্ব দ্রষ্টব্য)

 

মহা-সৃষ্টিতত্ত্বে আমরা দেখেছি, শুরুতেই সব নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। কোথায় কি ঘটবে, কখন কি ঘটবে। সৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে ঈশ্বর (মহাবিশ্ব অস্তিত্ব) বা মহাবিশ্বের কালচক্রের চলা শুরু হয়ে গেছে।

 

তোমার জন্মের সাথে সাথে, তোমার নিজস্ব কালের ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করে দিয়েছে। একটি যন্ত্র তৈরি হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায়, (পরিবেশ পরিস্থিতি ও তার উপাদান সাপেক্ষে) কতকাল সে সার্ভিস দেবে এবং কতকাল সে তার স্বাতন্ত্র‍্য‍ নিয়ে টিকে থাকবে। আমাদের শরীর যন্ত্রের ক্ষেত্রেও তেমনই।

 * পূর্বোক্ত রচনাটির রচনাকাল~ 1988

 

 

 

 

প্রসঙ্গ: সময় (২য় পর্ব)

 

কোনকিছুর গতি বা সক্রিয়তা থেকেই 'সময়' নামে একটি ভার্চুয়াল অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়। মহাজাগতিক সময়ের জন্ম হয়েছে, মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই।

 

প্রত‍্যেকটি গতিশীল বা সক্রিয় বস্তুর নিজস্ব সময় আছে। আমরা পৃথিবীর সময়ের অধীনে হলেও, আমাদের প্রত‍্যেকেরই আছে নিজস্ব সময়। একজনের সক্রিয়তা বা কার্যকলাপের ধরণ বা প্রকৃতির উপরেই তার নিজস্ব সময়ের ধরণ নির্ভর করে।

 

ব‍্যবহারীক ক্ষেত্রে, সময় হলো— কোনো দুটি ঘটনার (অথবা কোনো ধারাবাহিক ঘটনার মধ্যে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার) মধ্যবর্তী দূরত্ব বা ব্যবধান বা মেয়াদ। যা আমরা নির্দিষ্ট গতিতে নিয়মিতভাবে অবিরাম সংঘটিত  ঘটনা হতে উদ্ভূত পরিমাপবোধক সময় নামক এক ভার্চুয়াল অস্তিত্বের ভিত্তিতে উপলব্ধি করে থাকি। যেমন, পৃথিবীর নিয়মিত আবর্তন থেকে উৎপন্ন হওয়া সময়ের ভিত্তিতে আমরা কোনো ঘটনার সময় নির্ধারণ করে থাকি।

 

সময় কি শুধুই মানুষের মনোগত বা ধারণাগত একটা অস্তিত্ব, নাকি তার বাস্তবতা-ও আছে! কেউ উপলব্ধি করুক আর নাই করুক, সময় তার নিজস্ব অস্তিত্বে বিরাজমান। বরং কখনো কখনো সময় সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভ্রান্ত হতে পারে। কখনো অল্প সময়কে কারোকাছে অনেক সময় বলে মনে হতে পারে। আবার তার বিপরীতও হতে পারে। যেমন কোনো চক্র খুব দ্রুত বেগে ঘুরতে থাকলে, কোনো দর্শকের মনে হতে পারে, চক্রটি ধীরগতিতে ঘুরছে, এবং/অথবা বিপরীত দিকে ঘুরছে। এটা হলো দর্শকের দৃষ্টি বিভ্রম বা তার ভ্রান্ত ধারণা। বাস্তব তা নয়।

 

কোন বস্তু বা কোনকিছু মন্থর অথবা দ্রুতগতিসম্পন্ন হলে, তার কোন একটি (ঘটনার) অবস্থান থেকে অপর একটি (ঘটনার) অবস্থানে পৌঁছাতে (নিয়মিত গতিশীল অপর একটি ঘটনা থেকে উৎপন্ন পরিমাপযোগ্য সময়ের ভিত্তিতে, দীর্ঘ সময় অথবা অল্প সময় ব্যয় হতে পারে।

 

ওই গতিশীল বস্তুটির নিজস্ব সময় কিন্তু তার ঐ গতির উপরেই নির্ভরশীল। সেখানে, তার গতি মন্থর হলে, তার সময়ও মন্থর হবে। তার গতি দ্রুত হলে, তার সময়ও দ্রুত হবে। এর ব্যতিক্রম বা বিপরীত হবে না। অর্থাৎ তার গতি দ্রুত হলে, তার সময় মন্থর হয়ে যাবেনা।

 

আপেক্ষিকতা দুই প্রকারের। প্রথমটি হলো, একাধিক বিষয়বস্তুর মধ্যে তুলনামূলক বিচার। আর দ্বিতীয়টি হলো, কোনকিছুর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়, তার নিজের সঙ্গে নিজের তুলনামূলক বিচার।

 

আমি এখানে যে আপেক্ষিকতার উল্লেখ করছি, তা হলো কোনকিছুর নিজের সঙ্গে নিজের আপেক্ষিকতা। এখানে উচ্চ গতিশীল কোনকিছুর সঙ্গে তারই অপেক্ষাকৃত নিম্ন গতিসম্পন্ন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

 

কোনকিছুর সময় মন্থর হওয়ার অর্থ তার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া। সাধারণত, কারও গতি যদি আগের চেয়ে বেশি বা দ্রুত হয়, তবে তার সময়ের গতিও আগের চাইতে আরও দ্রুত হবে। এবং ফলস্বরূপ, তার আয়ু হ্রাস পাবে। বস্তুর গতি বা সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে, বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার কারণে তার আয়ুষ্কাল কমে যাবে।

 

তবে আইনস্টাইনের মতে, কোনও কিছু যদি আগের চাইতে খুব দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়, তবে তার সময় হ্রাস পাবে এবং তার আয়ু বৃদ্ধি পাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তার নিজের গতি হ্রাস না হলে, কী করে তার (নিজস্ব) সময় মন্থর হয়ে যায়!

 

কোন বস্তু বা কোনকিছু মন্থর অথবা দ্রুতগতিসম্পন্ন হলে, তার কোন একটি (ঘটনার) অবস্থা থেকে অপর একটি (ঘটনার) অবস্থায় পৌঁছাতে (নিয়মিত গতিশীল অপর একটি ঘটনা থেকে উৎপন্ন পরিমাপযোগ্য সময়ের ভিত্তিতে) দীর্ঘ সময় অথবা অল্প সময় ব্যয় হতে পারে।

 

ওই গতিশীল বস্তুটির নিজস্ব সময় কিন্তু তার ঐ গতির উপরেই নির্ভরশীল। সেখানে, তার গতি মন্থর হলে, তার সময়ও মন্থর হবে। তার গতি দ্রুত হলে, তার সময়ও দ্রুত হবে। এর ব্যতিক্রম বা বিপরীত হবে না। অর্থাৎ তার গতি দ্রুত হলে, তার সময় মন্থর হয়ে যাবেনা।

 

কোন গতিশীল বস্তুর উপর বাইরের কোনোরূপ বল বা শক্তি প্রযুক্ত না হলে, বস্তুর গতি হতে উৎপন্ন 'সময়' স্বাভাবিকই থাকবে। তার সময় মন্থর হয়ে যাবে না।

 

কোন বস্তু যদি মহাশূন্য পথে (যদিও মহাশুন্য— প্রকৃতপক্ষে শূন্য নয়) গতিশীল থাকে, সেক্ষেত্রে তার ক্ষয়ক্ষতি কম হবে অথবা হবেনা। তার আয়ু প্রায় একই থাকবে, অথবা তার আয়ু তেমন কমবে না। এটাই সাধারণ ধারণা।

 

কিন্তু ঐ বস্তুটী খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন হলে, তার আকর্ষণ ক্ষমতা বেশি হবে, তার 'গ্র‍্যাভিটি' বেশি হবে। তারফলে, প্রচুর মহাজাগতিক কণা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তাতে তার গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। 

 

সেই উচ্চগতি সম্পন্ন বস্তুটি ক্রমশই মহাজাগতিক কণায় ভরে উঠতে থাকবে। অর্থাৎ তার মধ্যে মহাজাগতিক কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এবং বস্তুটির স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকবে ক্রমশই।

 

এর ফলে ক্রমশই সেই বস্তুটীর আয়ুষ্কাল কমতে থাকবে। আর আয়ুষ্কাল যত কমতে থাকবে, তার সময় ততই দ্রুততর হবে। দ্রুত ফুরিয়ে আসবে তার সময়।

 

প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনকিছুর গ্র‍্যাভিটি যত বেশি হবে, তার সময় ততই মন্থর হতে থাকবে। কিন্তু সেই বস্তুটির মধ্যে যদি আত্মরক্ষার ব‍্যবস্থা না থাকে, যদি সে মহাজাগতিক এনার্জি বা কণা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, সেক্ষেত্রে তার আয়ুষ্কাল কমে যাবে। আর আয়ুষ্কাল কমে যাওয়ার অর্থই হলো, তার (নিজস্ব) 'সময়' দ্রুতগতি সম্পন্ন হওয়া।

 

এই প্রসঙ্গে বলি, উচ্চতম গতিশীল আলোর ক্ষেত্রেও তার 'সময়' সৃষ্টি হয়ে থাকে। বহু দূরের গ‍্যালাক্সী থেকে পৃথিবীতে আসতে, আলোর অনেক সময় লাগে। তাই বলে, উচ্চতম গতির কারণে তার 'সময়' মন্থর হয়েছে, এমন কথা বলা যায়না।

 

মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার মূহূর্তেই 'টাইম', 'স্পেস' এবং 'ডেসটিনি' একইসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এই ভার্চুয়াল অস্তিত্ব গুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হলেও এবং একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।

 

এই 'সময়' নামে ভার্চুয়াল সত্তাটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়েছে। মহাবিশ্ব লয় প্রাপ্ত হলেই, 'সময়' অস্তিত্বেরও বিনাশ ঘটবে তখন।

 

 

এবার আসুন, আমরা অবগুণ্ঠিত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য 'সময়'-কে আরও গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ-তদন্ত করে দেখি:

 

প্রত‍্যেকটি গতিশীল বা সক্রিয় অস্তিত্বের রয়েছে তার নিজস্ব সময়। আর যেহেতু এই জগতে কোন কিছুই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় নয়, ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ও রূপে সক্রিয়। তাই অস্তিত্বশীল সবকিছুরই আছে নিজের নিজের মতো সময়। 

 

সময় কোনো একটি মাত্র অস্তিত্ব নয়। মহাজাগতিক সময় এবং পৃথিবীর সময়ের মতোই বিভিন্ন প্রকারের সক্রিয়তা সম্পন্ন অসংখ্য অস্তিত্বের প্রত‍্যেকেরই রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার বা প্রকারের সময়।

 

কোনকিছু অস্তিত্ব সম্পন্ন হওয়া অথবা জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই তার সময়ও অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়ে ওঠে বা জন্ম নেয়। কোনোকিছুর অস্তিত্ব বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সময়ও অস্তিত্বশীল থাকে। সে যদি আপাতদৃষ্টিতে স্থির কিছু হয়, অর্থাৎ উল্লেখযোগ্য সক্রিয় বা গতিশীল কিছু না হয়, তবুও তার সময় চলতে থাকে তার সক্রিয়তার অনুরূপ খুব ধীর গতিতে। কারণ এই জগতে কোনকিছুই সম্পূর্ণ স্থির বা নিষ্ক্রিয় নয়। তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই তার সময়েরও বিলোপ ঘটে তখন। তাই বলে, সময়ের নিজস্ব কোনো গতি বা সক্রিয়তা নেই। সময় হলো (বোঝানোর সুবিধার্থে) অস্তিত্বশীল কোনকিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা, তার আত্মার মতো এক অস্তিত্ব ।

 

একেরপর এক ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা ঘটনা, অথবা পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্বগুলোকে আমরা সময়ের বিভিন্ন মাপ রূপে নির্ধারণ করে থাকি। এবং তাদের অন্তর্বর্তী ডিউরেশনকে সময় বলে থাকি। সময়ের বাস্তব অস্তিত্ব আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা। তাই আমাদের কাছে বাস্তবে সময় বলে কিছু নেই।

 

কোনো ঘটনার বা পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করা, এবং সেই অপেক্ষার মেয়াদ (duration of waiting) থেকে সময় সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায় আমাদের। কোনকিছুর ক্রমবিকাশ অথবা ক্রমবর্ধমান কোনকিছুকে লক্ষ্য করলেও সময় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়াও, ক্রমাগত একই গতিতে পুনঃপুনঃ আবর্তিত কোনকিছু (যেমন পৃথিবী ও ঘড়ি) থেকে উৎপন্ন পরিমাপযোগ‍্য সময়ের ধারণা লাভ করে থাকি আমরা।

 

এখানে বলা আবশ্যক যে কোনকিছুর জন্য অথবা কোনো ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা হলো একপ্রকার মানসিক ও শারীরিক প্রক্রিয়া (বা প্রসেস) যা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায়। যা শরীর-মনের বহু সূক্ষ্ম ঘটনার উপর ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠা এক বিশেষ কার্যক্রম। আমাদের শরীরের মধ্যে চলতে থাকা বায়ো-ক্লকের অনেকগুলো পালস্ অতিবাহিত করা বা অতিক্রম করার এক প্রক্রিয়া বিশেষ। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের মনে সময়ের ধারণা মিশে থাকলেও,  এখানে সময়ের কোনরূপ কার্যকর ভূমিকা (role) থাকেনা।

 

যে ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা হয়, সেও বহুকিছু সাপেক্ষে একেরপর এক ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা বহু ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কার্য-কারণ এবং মিশ্রণে  উৎপন্ন হওয়া এক ঘটনা-ফল বিশেষ। এক্ষেত্রেও সময়ের কোনো ভূমিকা (role) নেই।

 

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর ঘুর্ণন জনিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে জীব ও উদ্ভিদের মধ্যে তাল ও সময় বোধ জন্মেছে, এবং প্রত‍্যেকের মধ্যে একটা বায়ো-ক্লক তৈরী হয়েছে।

 

এই পার্থিব জগতে, সময় হলো— নিরাকার নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষ নিরাসক্ত নির্বিকার এক অব‍্যক্ত অননুভবযোগ‍্য ভার্চুয়াল অস্তিত্ব। বিমূর্ত সময়কে একমাত্র ম‍্যাথামেটিক‍্যাল মডেলের মাধ্যমেই কিছুটা মূর্ত করে তোলা যায়। তাই ইন্দ্রিয়াতীত জগতে তার একটা ডাইমেনশন থাকলেও, এই বস্তু জগতে যে তার একটা ডাইমেনশন আছে, এই ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে নেহাতই একটা কল্পনা বলেই মনে হয়।

 

প্রতিটি সক্রিয় অস্তিত্বই সময়ের জন্ম দিয়ে থাকে। কিন্তু সময় কোনো বাস্তব অস্তিত্ব বা ঘটনার জন্ম দেয় বলে আমাদের জানা নেই। আমরা দেখেছি, কোনকিছুর অস্তিত্ব এবং তার গতি বা সক্রিয়তার উপরে সময় অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে, সময়ের উপর কি কোনকিছু নির্ভরশীল? এর উত্তর হলো— না, বাস্তব জগতে সময়ের নিজস্ব কোনো কার্যকলাপ দেখা যায় না। তাই কোনকিছু সময়ের উপর নির্ভরশীল একথা বলা যায় না।

 

পরম্পরাগতভাবে একটা ঘটনা থেকে জন্ম নেয় এক বা একাধিক ঘটনা। এইভাবে 'সাকসেসিভ স্ট্রিম অফ ইভেন্টস' চলতে থাকে। তাই, কোনো ঘটনা ঘটার পিছনে অন‍্য কারো হাত নেই বলেই আমরা মনে করি।

 

কোনকিছুর নিয়মিত গতি হতে উৎপন্ন পরিমাপ যোগ্য সময়ের সাপেক্ষে, অপর সক্রিয় বা গতিশীল কোনকিছুর সময় আমাদের ধারণায় স্লো বা ফাস্ট মনে হতে পারে। এবার, কোনকিছুর গতি বা সক্রিয়তা যদি তার নিজেরই পূর্বাবস্থার তুলনায় মন্থর বা দ্রুত হয়, সেক্ষেত্রে তার নিজস্ব সময়ও স্লো বা ফাস্ট হবে।

 

এখানে 'সময়ের স্লো বা ফাস্ট হয়ে যাওয়া' বিষয়টি বাস্তবে সময় সংক্রান্ত নয়, বিষয়টি হলো কোনকিছুর গতি সংক্রান্ত। তার গতি স্লো বা ফাস্ট হয়ে যাওয়া। তবে, যেহেতু কোনকিছুর গতি বা সক্রিয়তা থেকেই সময়ের সৃষ্টি হয়েছে, তাই, কোনকিছুর গতি স্লো বা ফাস্ট হলে, তার সময়ও তার সাথে সাথেই স্লো বা ফাস্ট হবে। তবে বাস্তব জগতে সময়ের সেই গতি আমরা অনুভব করতে পারবো না।

 

 

আমি আমার 'ভাগ্য আসলে কী' ('এগজ‍্যাক্টলি হোয়াট ডেস্টিনি ইজ') প্রবন্ধে বলেছি, মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম মূহুর্তেই তিনটি অননুভবযোগ‍্য ভার্চুয়াল অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারা হলো— মহাকাশ, সময় ও ভাগ্য বা ডেস্টিনি। মহাবিশ্বের জন্ম মূহুর্তেই ঠিক হয়ে যায়— পরবর্তীতে কখন~ কোথায়~ কি কি ঘটবে এবং কিভাবে ঘটবে।

 

সবশেষে, এবার আসছি আসল কথায়, যা জানলে সময় সম্পর্কে সব ধারণাই বদলে যাবে এবং সময় সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সময়ের প্রকৃত অস্তিত্ব হলো~ 'S-existence' । এই অধরা অননুভবযোগ‍্য অস্তিত্বটিকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমার 'S-existence and its contrary existence' প্রবন্ধটি পড়তে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

 

এই লিঙ্ক ফলো করুন: https://sumeruscience.blogspot.com/2019/10/s-existence-and-its-contrary-existence.html?m=1

 

'সময়' অস্তিত্বটি আর কিছু নয়, আসলে 'সময়' হলো~ একটি দিব‍্য অস্তিত্ব বা S-existence! 

 এই রচমাটির রচনাকাল-- ১৯৯০

 

 

 

 সময় ও বয়স  (৩য় পর্ব)

 

 

একটি জীব বা মানুষের ক্ষেত্রে, তার বয়স পৃথিবীর সময়ের মাপকাঠিতে মাপা হলেও, তার নিজস্ব সক্রিয়তার ভিত্তিতে— নিজস্ব সময়ের গণ্ডিতে সে বাঁঁধা। যারা আয়ুষ্কাল একশো বছর (পৃথিবীর সময়ের পরিমাপে) সে দশ বছর বয়সে অল্পবয়স্ক কিশোর। আর যারা আয়ুষ্কাল পনের বছর সে দশ বছর বয়সে প্রৌঢ়।

 

অধিক আয়ুষ্কালের জীবদের ক্ষেত্রে অন্যান্য পর্বের মতো শৈশবও দীর্ঘ হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হতেই লেগে যায় অনেক সময়। স্বল্প আয়ুষ্কালের জীবরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই খাদ্য সংগ্রহ এবং বংশ বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়ে ওঠে তারা। অতীতে মানুষের আয়ুষ্কাল বেশি, সক্রিয়তা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক কম। এখন আয়ুষ্কাল কমে গেছে সক্রিয়তা বেড়েছে।

 

মূলতঃ সক্রিয়তার উপরেই— বয়স, পরিপক্কতা, জ্ঞান-চেতনা ও বিকাশাদি নির্ভরশীল। পৃথিবীর সময় দিয়ে তার সঠিক পরিমাপ করা যাবে না। জীবের এই সক্রিয়তা শুধু আপাত জীবনের সক্রিয়তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। অতীতের অসংখ্য জীবনের সক্রিয়তা রয়েছে এর পিছনে।

 

বংশানুক্রমে অর্জিত পরিপক্কতা— চেতনাদি আসলে, পূর্বপুরুষদের ঐসব জীবনে প্রাপ্ত শারীরিক অবস্থা, পরিবেশ- পরিস্থিতি এবং ঘটনাচক্র সাপেক্ষে সক্রিয়তা হতে উৎপন্ন পরম্পরাগত ফসল।

 

একটি জীবের সক্রিয়তা থেকে লব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা বংশানুক্রমে উত্তর-পুরুষদের মধ্যে সমানভাবে সঞ্চারিত হলে কোন কথাই ছিল না। সে ক্ষেত্রে সবারই বয়স, চেতনা, সক্রিয়তা হতো প্রায় সমান। কিন্তু তা ঘটেনি। যতদিন পর্যন্ত বিশুদ্ধ— মৌলিক প্রকৃতির বা জাতির জীব ও উদ্ভিদ —একই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে নিজেদের স্ত্রী-পুরুষের মধ্যেই মিলন সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে, ততদিন কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। প্রত্যেকের নবজাতক বংশধরদের মধ্যে প্রায় সমান ভাবে সঞ্চারিত হয়েছে তাদের রূপ-গুণ-চেতনা, প্রকৃতি ইত্যাদি।

 

বিভিন্ন চেতন স্তরের ভিন্ন ভিন্ন মানব জাতি বা প্রকৃতির মধ্যে মিলন ঘটার পর থেকেই দেখা যায়, প্রতিটি নবজাতকের মধ্যে—  রূপ-গুণ-চেতনা-প্রকৃতি আর সমান ভাবে বিস্তার লাভ করছে না। দিনের পর দিন—যত বেশি মিশ্রণ ঘটছে, ততই বৈচিত্র্যে ভরে উঠছে ধরিত্রী।

 

মৌলিক জাতির সক্রিয়তা একটি নির্দিষ্ট গতিতে— নির্দিষ্ট বাঁধাধরা পথে, নির্দিষ্ট চরিত্রগত বা আচরণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে, সেখানে চেতনার বিকাশও অতি সীমিত। ক্রমাগত মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন প্রকৃতি, আকৃতি, আচরণ, বৈশিষ্ট্য, গতি, চাহিদা ও চেতনা প্রভৃতির বিভিন্ন ভাগের সমন্বয়ে বহু বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ চেতনাসম্পন্ন অতি সক্রিয় সংকর জাতির সৃষ্টি হয়ে চলেছে। ফলতঃ মানুষের মনের বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত হারে।

 

আপাতদৃষ্টিতে অনেকের মনে হতে পারে, উন্নতির চাইতে অবনতি-ই বেশি হচ্ছে। মানুষ এগিয়ে না গিয়ে— যেন দিন দিন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে— অবনতির দিকে। আসলে কিন্তু তা নয়, এখানে শুধু এগিয়ে চলাই আছে, পিছনো নেই। নেই থেমে থাকাও।

 

 

* 'সময়'-এর সঙ্গে 'ভাগ্য'-এর খুব নিকট সম্পর্ক রয়েছে। তাই, 'ভাগ্য'-এর উপর লেখাটি পড়তে অনুরোধ করছি।

 এই রচমাটির রচনাকাল-- ২০১২

মহাবাদ ও বিবর্তনবাদ

মহাবাদ-উক্ত সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বরই উদ্ভিদ ও জীব সৃষ্টি করেছে। হ‍্যাঁ, ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই এই সৃষ্টি হয়েছে। তবে, তার খেয়াল-খুশি মতো, যখন যা ইচ্ছা হয়েছে--- ইচ্ছা করার সাথে সাথেই একেরপর এক নতুন নতুন উদ্ভিদ ও জীব তৈরী হয়ে গেছে, এমন নয়।​ একের পর এক নব নব সৃষ্টির পিছনে রয়েছে ---সুদীর্ঘকাল ধরে নিরলস গবেষণা আর শৈল্পিক চিন্তা-ভাবনা।

এখানে (মহাবাদ-এ), ঈশ্বর-মন— ক্রমবিকাশমান । এগিয়ে চলার সাথে সাথে ঈশ্বরের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। সেই সঙ্গে তার সৃষ্টিও হয়েছে ক্রমোন্নত।

ক্রমশই একটু একটু করে সে তার সৃষ্টিকে ক্রমোন্নত করে তুলেছে। ফলে, গতকালের সৃষ্টি— আর আজকের সৃষ্টির মধ্যে— ক্রমোন্নতির স্বাক্ষর বা প্রমাণ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

সৃষ্টি নিজের থেকেই অল্প-বিস্তর ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই। যেটুকু হয়েছে, সেও ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই। ঈশ্বর তার মধ্যে সেই রূপ প্রয়োজনীয় নির্দেশ (প্রোগ্রাম) অন্তর্গ্রথিত করে দেওয়ার ফলে।

আসলে, বিবর্তনবাদ হলো— অন্ধের হস্তী দর্শন। সে সমস্ত হাতীটাকে দেখতে পায়নি এখনো।

জীব-সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন

(মহর্ষি মহামানস-এর ‘মহাবাদ’ গ্রন্থ হতে গৃহীত আত্মধ্যান-লব্ধ মহাতত্ত্ব-জ্ঞান কান্ড— বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।)

 

‘সেই মহাবিস্ফোরণ! —সেই মহাশূন্য জুড়ে আতসবাজীর খেলা, এ’ সবই দূরস্মৃতি আজ। শুধু কাজ আর কাজ— পিছনে তাকানোর মতো একটুও সময় নেই হাতে। তবু তারই মাঝে, ক্ষণেকের জন্যে আনমনা হয়ে যাই, —ডুবে যাই স্মৃতির গহ্বরে।’

আদি জীব —এককোষী অনুজীব এবং আদি-উদ্ভিদ সৃষ্টির মূল নিহিত রয়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুলেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই মহা বিস্ফোরণ এবং তৎপরবর্তী অসংখ্য বিস্ফোরণগুলির মধ্যদিয়ে আদি জীবকোষ এবং আদি উদ্ভিদকোষের মূল উপাদানগুলি সৃষ্টি হয়ে— ছড়িয়ে থাকে সমস্ত মহাবিশ্ব জুড়ে। পরে, সেগুলি বিভিন্ন পরিবর্তিত অবস্থার মধ্য দিয়ে— এক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আস্তে আস্তে একত্রিত ও রূপান্তরিত হয়ে, আদি জীব ও আদি উদ্ভিদ কোষের বীজাকার ধারণ করে।

আরও অনেক পরে, মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বর শরী্রের বিভিন্ন স্থানে— জীব বিকাশের অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি পেয়ে, তারা ক্রমে প্রস্ফূটিত হতে থাকে এবং ক্রমশ কোষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে বংশবৃদ্ধি ক’রে চলে—।

অতি শৈশবকাল পেরিয়ে, একটু বয়স হতেই— একটু জ্ঞান হতেই, ঈশ্বর এদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। শিশু-ঈশ্বর অবাক-বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে, তার বিশ্ব-শরীরের নানা অংশে নানা প্রকারের অতি স্বল্প-চেতনা সম্পন্ন বহু সংখ্যক অদ্ভূত অদ্ভূত কি যেন সব সৃষ্টি হয়েছে।

অতি ক্ষুদ্র দেহধারী— অতি নিম্ন-চেতনা সম্পন্ন এই অনুজীবগুলির অদ্ভুত আকার, বিচিত্র আচরণ তাকে আকৃষ্ট ক’রে তোলে। সে আরও লক্ষ্য করে, তার বিস্তৃত দেহাঞ্চলের নানা স্থানে নানা প্রকারের অত্যন্ত নিম্ন-চেতনার অজস্র অণু-উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়েছে— আপনা থেকেই।

শিশু-ঈশ্বরের কৌতুহলী মন অত্যন্ত উত্তেজিত এবং আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠে এই সমস্ত আদিজীব ও আদিউদ্ভিদের ব্যাপারে।

প্রথম অবস্থায়, জীব ও উদ্ভিদ— কারো সচেতন ইচ্ছার দ্বারা সৃষ্ট হয়নি। পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে— মহা-সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অনিবার্য ফলস্বরূপ, স্বয়ম্ভূত সৃষ্টি হলো— আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদ।

অন্যভাবে বলা যায়, বীজ বা তদবীজাকারে এ’সবই ছিলো মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বর শরীরের মধ্যেই। পূর্বনির্ধারিতভাবে (‘ভাগ্য’ দ্রষ্টব্য) অনুকূল স্থান-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতি পেয়ে, একসময় অঙ্কুরিত হয়েছে সেই বীজ।

আমাদের শরীরে যেমন নানা প্রকার পরজীবী— অনুজীব, কীট-কীটানু, ছত্রাক প্রভৃতি বিদ্যমান, ঈশ্বর শরীরে আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের স্থান কতকটা তেমনই। জীবাণু ও ছত্রাকের মতো আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদগুলিও ঈশ্বর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

শিশু-ঈশ্বরের সবিশেষ পর্যবেক্ষণে ধরা পরে— এদের জীবন-চক্র, এদের কর্মধারা, জন্ম—মৃত্যু, বংশবৃদ্ধি প্রভৃতি। গভীর আগ্রহ এবং মনোযোগের সাথে এদের ক্রিয়া-কলাপ দেখতে দেখতে, শিশু-ঈশ্বরের মাথায় নানারকম চিন্তা-ভাবনা, ধরণা-কল্পনার উদয় হতে থাকে। ক্রমশ শিশুসুলভ খেলার নেশায় মেতে ওঠে সে। গবেষক-শিল্পী-মন জেগে ওঠে সৃষ্টির তাড়নায়।

ঈশ্বর তার যৌবনকাল পর্যন্ত— বিকাশের বিভিন্ন স্তরে, তার মানসিক অবস্থা এবং ক্ষমতার বিভিন্ন মাত্রায়, এই স্বয়ম্ভূত আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের ধারণার ভিত্তিতে, আপন মনের নানা রূপে—রঙে—রসে —নানা কল্পনায়, বিভিন্ন মাত্রার চেতন উপাদানে এবং তার শরীর-উপাদানে, তার দেহ-আঙিনার ‘ল্যাবরেটরী-কাম-স্টুডিও’-তে একের পর এক সৃষ্টি ক’রে গেছে বিভিন্ন প্রকারের জীব ও উদ্ভিদ। মনমতো না হলে— ভেঙেছে, আবার গড়েছে। সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে— কাটিয়ে দিয়েছে তার শৈশব— কৈশোর, এবং যৌবনের অনেকটা অংশ পর্যন্ত।

স্রষ্টা (বিশ্বাত্মা/ঈশ্বর) বিশদভাবে অনুসন্ধানের করে জানতে পারে— আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের বাস্তব রূপের অন্তরালে রয়েছে তাদের দিব্য-অস্তিত্ব (S-Existence)। তারপর আরও গভীরভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের ফলে, একসময় সে আবিষ্কার করে— সেই ‘প্রোগ্রামীং কোড ল্যাঙ্গুয়েজ’, যার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে এই দিব্য-অস্তিত্ব। বিভিন্নরূপ দিব্য-অস্তিত্বের ব্যক্ত রূপই হলো— জীব ও উদ্ভিদসহ সমগ্র বিশ্বজগত।

পরবর্তীকালে— সেই ‘প্রোগ্রামীং কোড ল্যাঙ্গুয়েজ’ নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে ক্রমশ সে সৃষ্টি করতে থাকে একের পর এক নতুন নতুন জীব ও উদ্ভিদ।  বিশ্বাত্মা (বোঝার সুবিধার জন্য অনেক ক্ষেত্রে তাকে ‘ঈশ্বর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে) শুধুমাত্র জীব ও উদ্ভিদের অন্তরালে থাকা সফটওয়্যার প্রোগ্রামীং কোড-ই আবিষ্কার করেনি, সে একসময় তার নিজ মন-সফটওয়ার এবং তার প্রোগ্রামীং কোড-ও আবিষ্কার করেছে। পরবর্তীতে ক্রমোন্নত জীব সৃষ্টি করতে গিয়ে, সে প্রয়োজনমতো তার নিজ মন-সফটওয়ারের এবং তার প্রোগ্রামীং কোড-এর কিছু কিছু অংশও ব্যবহার করেছে অনেক সময়।       

সৃষ্টির প্রথমদিকে— আজকের এই মানুষ ছিলো তার (শিশু ও কিশোর ঈশ্বর-মন-এর) কল্পনার বাইরে। তবে ছিলো, তা’ চেতনার অনেক গভীরে— সুপ্ত হয়ে ছিলো বীজাকারে। এই এত প্রকারের জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টি তার দ্বারা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি স্বয়ম্ভূত আদি-জীব ও আদি-উদ্ভিদের দেখা না পেত সে। কল্পনাতেই আসতো না এ’সব। এই অসংখ্য প্রকার বিচিত্র-দর্শন জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টির পিছনে ভিত্তিমূল কিন্তু ওরাই। ‘আইডিয়া’-টা এসেছে ওখান থেকেই। 

পরে, সৃষ্টি পরম্পরার মধ্য দিয়ে, —একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা —উন্নয়নের বা ‘ডেভালপমেন্ট’-এর হাত ধরে এগিয়ে গেছে সৃষ্টি-লীলা। তবে, সৃষ্টির সব রূপ ও ধারণা যে ঈশ্বর-মন থেকেই এসেছে— তা’ কিন্তু নয়। গড়তে গিয়ে অনৈচ্ছিক ও আকস্মিকভাবেও অনেককিছু সৃষ্টি হয়ে গেছে অনেক সময়।

আমাদের ক্ষেত্রেও এমন হয়, অনেক সময়— পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে, অনেককিছু গড়তে গিয়ে— অদ্ভুত অদ্ভুত আশ্চর্যজনক কত কি সৃষ্টি হয়ে যায়। —যা ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি নয়।

আমাদের মতো ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও। তখন, ঈশ্বর-মন অনুমোদন করলে— তা’ রয়ে যায়, নইলে ভেঙে ফেলা হয় তাকে আবার। এই ভাঙা-গড়া বেশি ঘটেছে ঈশ্বরের অল্প বয়সে। পরিণত বয়সে এইরূপ ঘটনা তুলনায় অনেক কম।

জীবের এই পরিবর্তন— এই রূপান্তর, সব জায়গায়— সব কালে— সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে ঘটেনা। স্থান-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সেই জীবের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী, বিভিন্ন জীবের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার, বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মাত্রায় এবং‌ বিভিন্ন প্রকারে পরিবর্তিত— বিভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে সৃষ্ট হওয়া জীবগুলি ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির এবং ভিন্ন ভিন্ন আচরণ সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে।

এইভাবে পরিবর্তন ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেও জীব বৈচিত্র সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানুষ এক স্থানে এবং একই মানব গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে না থাকায়, মানুষের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন হয়েছে সবচাইতে বেশি। বর্তমানে, অধিকাংশ মানুষই পূর্বোক্ত পরিবর্তন ও মিশ্রণের ফলে— এক অতি সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর বুকে এত জীব-বৈচিত্র সৃষ্টি হওয়ার পিছনে— ঈশ্বরের ঐচ্ছিক ভূমিকা ছাড়াও, রয়েছে জীবের আভ্যন্তরীক (পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার স্বার্থে) পরিবর্তন, এবং যৌনমিলন ঘটিত মিশ্রন রূপ জাগতিক ব্যবস্থার অনৈচ্ছিক ভূমিকা। 

যে কোনো সৃজন কর্মের মতোই, জীবসৃষ্টির বিভিন্ন ধাপে— ঈশ্বরকে নানা প্রকারের বাধা—বিঘ্ন—সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এবং তার সমাধান ক’রে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। তবে সব বাধা— সব সমস্যাই যে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে, তা’ নয়। কখনো বাধা সরিয়ে— কখনো ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, কখনোবা হার মেনে নতি স্বীকার ক’রে, আবার কখনো তার প্রভাব— আধিপত্য মেনে নিয়ে এগিয়ে গেছে সে।

এখানে একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, ঈশ্বরকে সৃষ্টির প্রথম থেকেই সর্বজ্ঞ— পূর্ণ চেতনাময় ভেবে বসলে, ভুল হবে। তারও চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে আস্তে আস্তে একটু একটু ক’রে, ধাপে ধাপে— অতি শৈশব থেকে ক্রমবিকাশের পথ ধরে। চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার সৃষ্টিতেও উন্নত মন ও চেতনার ছাপ পড়েছে। ক্রমশ উন্নত হয়েছে তার সৃষ্টি। উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে তার সৃষ্টি-কলার।

পরবর্তীকালে, ঈশ্বর তার গভীর পর্যবেক্ষণে— বিস্ময়ের সঙ্গে একটি জিনিষ লক্ষ্য করে—, এই অনুজীব ও জীবগুলির অনেকেই পরিবর্তীত পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম। এমনকি, নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে, এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেদেরকে অল্প-স্বল্প পরিবর্তীত করতেও সক্ষম। যারা সক্ষম নয়, তারা বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।

এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক, প্রচলিত বিবর্তনবাদ— (জীবের ক্ষেত্রে) পূর্বোক্ত পরিবর্তন সক্ষমতার উপর ভিত্তি ক’রে ধারণা করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই— অনেক জীব বহুকাল ধ’রে একটু একটু ক’রে পরিবর্তীত হতে হতে, একসময় তারা নতুন নতুন রূপ ধারণ করেছে বা রুপান্তরীত হয়েছে।

বাস্তবে এমনটা কিন্তু ঘটেনি। এ’ক্ষেত্রে, ঈশ্বরই জীবের এক একটা প্রাথমিক মডেলকে ভিত্তি ক’রে— ক্রমশ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণার মধ্য দিয়ে, একের পর এক উন্নয়ন বা ডেভালপমেন্ট ঘটানোর ফলেই— নতুন নতুন জীবের উদ্ভব হয়েছে। যারফলে, নতুন রূপে সৃষ্ট জীবের সাথে— উন্নয়নের পর্যায়ক্রম অনুসারে তাদের পূর্ববর্তী ধাপের জীবের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য— অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

জীব নিজের থেকে— নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে, তা’ প্রধানতঃ সহনগত— আচরণগত পরিবর্তন। এক্ষেত্রে অল্প-স্বল্প বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটলেও, আভ্যন্তরিন পরিবর্তনটাই এখানে প্রধান। এছাড়া, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলে— চেহারার ও অভিব্যক্তির যেটুকু পরিবর্তন ঘটে থাকে, এক্ষেত্রে সেইটুকুই পরিবর্তন হয়। বড় রকমের আকারগত পরিবর্তন সে ঘটাতে পারেনা। বড় রকমের যে সমস্ত পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য ক’রে থাকি— সে সবই ঈশ্বর কৃত।

জাগতিক বিভিন্ন সৃজন কর্মের মধ্যে— স্রষ্টার বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে। এটা একটু সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে অনুসন্ধান করলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। আর বুদ্ধিমত্তাকে অনুসরণ করলেই পাওয়া যাবে সেই বুদ্ধিমান স্রষ্টাকে। প্রচলিত অনেক ধর্মীয় দৃষ্টিতেই —ঈশ্বর সর্বজ্ঞ! বাস্তবে তা’ নয়, একটু একটু ক’রে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে তারও মনোবিকাশ ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে এখনো।

মনে রাখতে হবে, সেই আদি জীব কোষের উপর ভিত্তি করেই— স্রষ্টা তার শিশু-চেতনাকে সম্বল ক’রে সৃষ্টি-কর্ম শুরু করেছিলো। একটু একটু ক’রে তার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে, অতি ধীর গতিতে তার সৃষ্টি-কর্ম এবং এই সৃষ্টির উন্নয়ন ঘটেছে। সৃষ্টিলীলার চলার পথে ঘটেছে নানা ঘটনা, অনেক ভাঙা-গড়া। অনেক বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে, দীর্ঘকালের গবেষণা এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে, ক্রমশ উন্নত চেতনা সম্পন্ন জীব সৃষ্টির চাহিদার ফলে, এক সময় মানুষ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। আমাদের কম্পিউটারে এনিমেশন ক্যারেকটার, ভিডিও গেম, হলোগ্রাম এবং রোবট সৃষ্টির মতোই— কতকটা, ঈশ্বরের জীব-সৃষ্টি কান্ড।

সৃষ্টির পিছনে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছে যে সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি, তাদের মধ্যে প্রধান হলো— খেলার মজা, সৃষ্টির আনন্দ, নিজেকে— নিজের খেলার ঘরকে নব নব রূপে সাজিয়ে তোলা, এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের বিস্ময়ানন্দ লাভ, একাকীত্ব দূরীকরণ, জীবনের একঘেয়েমী কাটিয়ে জীবনে বৈচিত্র আনা, এবং বিভিন্ন পথে কামেচ্ছার পরিতৃপ্তি ঘটানো। আর, তার পাশাপাশি— পরমাত্মা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেছিলো, —সে’ তো আছেই।

প্রথমদিকে সৃষ্ট জীব এবং তাদের জীবনযাত্রার পিছনে ঈশ্বরের অনেকাংশে প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও, পরবর্তীকালে তা’ ক্রমশই কমতে থাকে। ঈশ্বর তার প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে, শেষদিকে তার আর কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি দর্শকের ভূমিকাও নয়। একবার শুরু ক’রে দেবার পর, জাগতিক ব্যবস্থাক্রমে পূর্বনির্দিষ্ট ব্যবস্থা মতো, সৃষ্টি চলছে— চলতেই থাকছে। সৃষ্টি-স্থিতি-গতি-লয়ের চক্রে— যখন যা ঘটার ঘটে চলেছে।

উচ্চ চেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ সৃষ্টির পর, ঈশ্বর তার যৌবনের দ্বিতীয়ার্ধে ক্রমশ উচ্চতর চেতনা লাভের সাথে সাথে, আস্তে আস্তে এইসব পুতুলখেলা ছেড়ে দিয়ে, আত্মজিজ্ঞাসাক্রমে আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আত্মপরিচয় জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। সেই সঙ্গে তার দোসরের খোঁজে— মিলনের আর্তিতে কাতর হয়ে ওঠে সে। সৃষ্টি তার নিজের মতো চলতে থাকে। সেদিকে তাকানোর মতো সময়— ইচ্ছা— মানসিক অবস্থা তার আর নেই। 

ঈশ্বর/ বিশ্বাত্মা উচ্চ চেতন স্তরে পৌঁছে যাবার পর, সে একমাত্র খুব উচ্চ চেতন মনুষ্যোতর চেতন-সত্তাদের ব্যাপারে মাঝে মাঝে আগ্রহী হয়ে থাকলেও, নিম্ন চেতন-সত্ত অথবা নিম্ন চেতনা সম্পন্ন জীবদের ব্যাপারে সে আর আগ্রহী নয়।

ঈশ্বর তার সৃষ্টির শেষদিকে, উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ এবং অন্যত্র বিভিন্নরূপ চেতন-অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে, তার উচ্চ চেতনা এবং পূর্বলব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে। পৃথিবীতে, এই মানুষ অনেকাংশে তার সন্তানের মতো। এই মানুষ ক্রমশ বিকশিত হয়ে, বিভিন্ন স্তরে— ক্রমোন্নতির মধ্য দিয়ে, বহু পথ পেরিয়ে— একসময় তার চেতন স্তরে এসে মিলিত হবে— তার সাথে। মানুষ সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের অন্যতম ইচ্ছা এই—। মানুষের মনকে সে সেই ভাবেই তৈরী এবং ‘প্রোগ্রামিং’ করে রেখেছে। 

প্রথমদিকে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক ছিলো— খেলনা পুতুল এবং তার খেলুড়ের মতো। পরে, কতকটা যেন— প্রভু আর তার পোষ্য-র মতো। সেখানে সৃষ্ট জীব— তার স্রষ্টাকে ঠিকমতো জানেনা, ভালোভাবে চেনেনা। চেনা ও জানার মতো অত জ্ঞান ও চেতনা নেই তার। শেষ পর্যায়ে সৃষ্ট জীব— মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা সন্তান ও জন্মদাতা পিতা/মাতার মতো। এই মানুষ এক সময় স্রষ্টাকে জানতে পারবে। ক্রমশ স্রষ্টার মানসিক স্তরে উন্নীত হতে পারবে, —এই কামনারই ফসল হলো— মানুষ।

ঈশ্বর প্রথমদিকে কম চেতনার কারণে— মোহের বশবর্তী হয়ে, তার সৃষ্ট সন্তানতুল্য মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি, পূজাদি কামনা করেছে এক সময়। সাধারণ মানুষ যেমন কামনা ক’রে থাকে। পরবর্তীকালে তার চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে— তার এই চাহিদা ক্রমশই অন্তর্হিত হয়েছে।

মানুষ কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের সন্তান নয়। তবে সন্তান তুল্য। জীব— ঈশ্বরের দেহজ ও মনোজ হওয়া সত্বেও, সে বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) সন্তান নয়। সন্তান হতে হলে তাকে— সর্বতোভাবে ঈশ্বরের সমস্ত দেহ-মনের অনুরূপ হতে হবে। যা নির্দিষ্ট প্রণালীর মধ্য দিয়ে বীজাকার থেকে ক্রমশ বিকশিত হয়ে, এক সময়— ঈশ্বরের মতো রূপ-গুণ-ক্ষমতা লাভ করবে। ঈশ্বর সৃষ্ট সমস্ত জীব ও উদ্ভিদ সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের খন্ড মন ও খন্ড শরীর থেকে। ঈশ্বরের পূর্ণাবয়ব তাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায়— সংকেতাকারে বিদ্যমান থকলেও, নির্মান পদ্ধতির কারণে কোনোদিনই তা’ উজ্জীবিত হবেনা, বিকশিত হবার সুযোগ পাবেনা কোনোদিন।

পৃথিবীতে, একমাত্র ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। মানুষ হলো ঈশ্বরের যৌবনের ফল, সৃষ্টিলীলার শেষদিকের সৃষ্টি। —ততদিনে ঈশ্বর অনেকটাই পরিণত হয়েছে, সেই সঙ্গে তার সৃষ্টিও হয়েছে অনেক উন্নত। কালক্রমে ঈশ্বরের মধ্যে বাৎসল্য রসের ক্রিয়া শুরু হওয়া সত্বেও— সন্তান সৃষ্টির সুযোগ না থাকায়, তাকে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে— মানুষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।* সেই অর্থে মানুষ— ঈশ্বরের তৈরী নেহাত খেলনা পুতুল অথবা নিছক শিল্পকলা নয়। অনেকাংশে সন্তান বা সন্তানবৎ সে।

ঈশ্বর মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছে, যাতে সে ধাপে ধাপে ক্রমোন্নত ও ক্রমোবিকশিত হয়ে, এক সময় তার নাগাল পেতে পারে। সেখানে সন্তানের মতো স্বতন্ত্র বিশ্বরূপ— ঈশ্বর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা না থাকলেও, আছে একসময় ঈশ্বর-চেতন স্তরে উপনীত হওয়ার— ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা। উচ্চ চেতন স্তর গুলিতে পৌঁছে, মানুষ আর মানুষ বা জীব থাকেনা, তখন সে দেব, মহাদেব প্রভৃতি পদবাচ্য হয়ে যায়।

সৃষ্টির প্রথম স্তর বাদে* পরবর্তী প্রতিটি চেতন স্তরেই** ঈশ্বর যেমন একাধিক মন*** এবং কয়েকটি নিষ্ক্রিয় বা সুপ্ত মনের অধিকারী, ঠিক তেমনই ঈশ্বরের বিভিন্ন চেতন-স্তরে সৃষ্ট বিভিন্ন জীবও একাধিক মনের অধিকারী। যদিও তাদের চেতন-স্তর জীব সৃষ্টিকালীন ঈশ্বর-চেতন-স্তর থেকে অনেক নিম্ন স্তরের। তবু তারা ঈশ্বরের দেহ-মন-প্রাণ ও চেতন উপাদানে নির্মিত হওয়ায়, তাদের মানসিক গঠন কিছুটা ঈশ্বরের নিম্ন-চেতন-স্তরের অনুরূপ।

আদিম মানবেতর জীব সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের মনরূপ ‘সফটওয়ার’-এর অতি সীমিত কার্যক্ষমতা সম্পন্ন সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বা ‘লিমিটেড-ভার্সান’-এর ‘কপি’ দ্বারা। আদিম-মানব সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের মন-সফটওয়ারের সীমিত ক্ষমতা সম্পন্ন ‘আপগ্রেডেড ভার্সান’-এর কপি থেকে। মানুষ সৃষ্টি হয়েছে— পরবর্তী আরো ‘আপগ্রেডেড ভার্সান’ মন-সফটওয়ার -এর ‘কপি’ থেকে। মানবেতর জীবদের ক্ষেত্রে চেতনা বিকাশের বিশেষ সুযোগ নেই, যেমন আছে মানুষের ক্ষেত্রে (ডায়াগ্রাম দ্রষ্টব্য)

এখানে আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, জীবের চেতন-স্তর ঈশ্বরের (জীব সৃষ্টিকালের) পূর্বাবস্থার কোনো এক চেতন-স্তরের অনুরূপ অথবা অংশত অনুরূপ হলেও, জীবের দেহাকৃতি ঈশ্বরের তুলনায় অতিব ক্ষুদ্র হওয়ায়, ঈশ্বর-শরীরের মধ্যেই তার অবস্থান হওয়ায় এবং বহুকিছুর উপর তার সক্রিয়তা ও টিকে থাকা নির্ভর করায়, আর সেখানে তার যথেষ্ট স্বাধীনতা না থাকার ফলে, জীবের শক্তি-সামর্থ হয় অতি সামান্যই।

সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, জীব— ঈশ্বর সৃষ্ট হলেও, সামগ্রিকভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে তার দেহগত (জৈব— অজৈব প্রভৃতি) পার্থক্যের কারণ ঘটেছে— জীব সৃষ্টির ভিত্তিমূল এককোষী আদি জীব— অনুজীব হওয়ায়, জীব-চেতনাকে ঈশ্বর-চেতনার নিম্নস্তরের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে।

ক্ষুদ্র হলেও, জীবের মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের মতো ঐরূপ নানা মনোস্তর। কিছু সুপ্ত, আর কিছু জাগ্রত ও সক্রিয়— আংশিকভাবে। ঈশ্বরের বিকাশের প্রতিটি স্তরেই একাধিক মনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাই জীবের মধ্যেও রয়েছে একাধিক মনের অস্তিত্ব— ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র রূপে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------

*মনোপদ্মের ‘ডায়াগ্রাম’ দেখো, এটি ঈশ্বর মনোবিকাশের একটি প্রতীকী তালিকা।

**ডায়াগ্রামে দেখানো মনোবিকাশের স্তরগুলির মধ্যে রয়েছে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্তর। আবার প্রত্যেকটি স্তরের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিভাগ— কর্মবিভাগ।

***প্রতিটি মনোস্তরে একটি মন বেশি সক্রিয়, —যে সবচাইতে বেশি বিকশিত। আর, পরবর্তী মনোস্তরের বিকাশযোগ্য মনটি— পূর্বের মনটির তুলনায় কম বিকশিত এবং কম সক্রিয়। প্রধান ভূমিকায় যে সক্রিয় মনটি রয়েছে, তার পূর্বস্তরের (তৎপূর্বেই) পূর্ণবিকশিত মনটি বিকাশের স্তর ভেদে, হয় সে সবে সুপ্তাবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে, আর নয়তো পুরোপুরি সুপ্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।

-------------------------------------------------------------------------------------------------------

মানুষের মধ্যে দুটি মন এখন সক্রিয়। ঈশ্বরের দিক থেকে দেখলে, একটি হলো— শিশু-মন, অপরটি হলো— কিশোর-মন। আর, জীবের দিক থেকে দেখলে— একটি হলো— আদিম-মানব-চেতন-মন, এবং অপরটি হলো— মানব-চেতন-মন। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে— ঈশ্বরের যুবক মনোস্তরে। যুবক মনোস্তরের মধ্যেও রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক স্তর। আর সেই সব স্তরে উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন চেতন-স্তরের মানুষ। পরবর্তীকালে তাদের মিশ্রন এবং চেতনার ক্রমবিকাশের ফলে আরো উন্নত মানুষের সৃষ্টি হয়েছে।

জীব-চেতনার সঙ্গে ঈশ্বর-চেতনার সম্পর্ক মোটামুটি নিম্নরূপ—

আদি জীবের চেতনা— ঈশ্বরের ভ্রুণ অবস্থার প্রথমার্ধের চেতন-স্তরের মতো। ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্ট জীবের চেতনা— ঈশ্বরের ভ্রুণ চেতনার দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সদ্যজাত শিশু-ঈশ্বর-চেতনার মধ্যে। ঈশ্বর নিজে সেই সময়— পরিণত শিশু-চেতন স্তরে।

পরবর্তী জীবের চেতনা— ঈশ্বর তার পরিণত শিশু-চেতন স্তর থেকে কিশোর-চেতন স্তরের মধ্যবর্তী সময়ে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বহু স্তরে, বহু প্রকারের সূক্ষ্ম চেতন পার্থক্য সম্পন্ন বহু জীব সৃষ্টি করেছে। এইসব জীবের চেতনাবস্থা ঈশ্বরের অতি শিশু-চেতন স্তরের মধ্যে।

মানব পূর্ব জীব— বানর ও নর-বানর স্রেণীর জীব, এবং আদিম মানুষের চেতনা— ঈশ্বর তার কৈশোর শেষে, সদ্য যৌবন থেকে যৌবনের প্রথমার্ধের প্রথম পর্বের মধ্যে এদের সৃষ্টি করেছে। এদের চেতনাবস্থা ঈশ্বরের অতি শিশু-চেতন স্তরের শেষ পর্ব থেকে শিশু-চেতন স্তরের প্রথমার্ধের মধ্যে।

মানব চেতনা— বিভিন্ন পর্যায়ে মানব সৃষ্টিকালে ঈশ্বর তার যৌবনের দ্বিতীয়পর্ব থেকে দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম পর্বের মধ্যে অবস্থান করেছে। সৃষ্টিকালে বিভিন্ন পর্যায়ের মানব-চেতনাবস্থা, —ঈশ্বরের শিশু-চেতনার দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কিশোর-চেতন স্তরের প্রথমার্ধের মধ্যে। পরে ক্রমশ চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে মানব-চেতনার বিকাশ ঘটে চলেছে।

মানুষের বিকাশ প্রক্রিয়া— বহু সময় নিয়ে, অতি ধীর গতিতে অগ্রসর হয়ে চলেছে। সাধারণভাবে একটি মানুষের জীবদ্দশায় তার মনের বিকাশ ঘটে অতি সামান্যই। বংশানুক্রমে বহু পুরুষ পরেও, মানুষের বিশেষ উন্নতি হতে দেখা যায় না। বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং বহুল ঘটনাবলী সাপেক্ষে, এবং জাতি মিশ্রণের ফলে, তৎকালীন কিছু বিশেষ উন্নতি ঘটলেও— তা’ একটা সীমায় পৌঁছে আর তেমনভাবে এগোয় না। কখনো কখনো খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কিছু বেশি বিকাশ ঘটতে দেখা যায়।

ঈশ্বরের চেতনাও খুব ধীর গতিতে বিকাশমান। জীব সৃষ্টির পরে— ঈশ্বর তার চেতনা-বিকাশের পথে সচেতনভাবে এগিয়ে যায়। ক্রমশ তার পরবর্তী ক্রমোচ্চ চেতন-মন জাগ্রত হতে থাকে। মানবেতর জীব পিছনেই পড়ে থাকে। আর উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষ, ঈশ্বরের পিছনে পিছনে অগ্রসর হতে থাকে।

সাধারণভবে মানবেতর জীব ক্রমবিবর্তীত এবং ক্রমবিকশিত হয়ে পরবর্তী উচ্চ-চেতনা সম্পন্ন জীবে পরিণত বা পরিবর্তীত হয় না। তবে ব্যতীক্রমী ঘটনাও ঘটে, একাধিক ভিন্ন ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন ভিন্ন চেতন-স্তরের জীবের মধ্যে মিশ্রন বা মিলনের ফলে, নতুন রূপ বা চেহারার কিছু উচ্চ চেতনার জীব সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে। তবে সেটাই মূল স্রোত নয়।

ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরীসৃপ থেকে পশু, পশু থেকে আদিম মানব, এবং আদিম মানব থেকে ক্রমোন্নত হয়ে সচেতন মানবের সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি জীবের মধ্যে ২/৩টি মন বা চেতন-স্তরের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায়, এবং পাশাপাশি দুটি নিকট স্তরের জীবের মধ্যে দেহ ও মন লক্ষণে অনেক সাদৃশ্য থাকায়, এবং পরবর্তী স্তরে সৃষ্ট জীবের মধ্যে পূর্ববর্তী স্তরের জীব থেকে কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হওয়ায়, স্বভাবতই মনে হতে পারে, বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বুঝি এদের উৎপত্তি হয়েছে।

কিন্তু তা’ নয়। একটি জীব বিবর্তিত হয়ে পরবর্তী ক্রমোচ্চ চেতনা সম্পন্ন জীবে পরিণত বা রুপান্তরিত হয়নি। প্রতিটি বিশেষ শ্রেণীর জীবের উৎপত্তি হয়েছে— বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়ে। বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর) অনেক সময়েই— তৎকর্তৃক পূর্বে সৃষ্ট কোনো বিশেষ প্রকৃতির জীবের ছাঁচ বা মডেলের উপর কিছু পরিবর্তন —পরিবর্ধন ঘটিয়ে, পরবর্তী আরেক প্রকারের জীব সৃষ্টি করেছে।

যদিও আপাত দৃষ্টিতে, ঈশ্বর তা’ সৃষ্টি করলেও, আসলে, আগের থেকেই— মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরু থেকেই, সমস্ত কার্যক্রম প্রস্তুত এবং নির্ধারিত হয়ে আছে। আমাদের সমস্ত কাজ-কর্ম এবং আমাদের সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে— আমরা যেমন নিমিত্ত মাত্র, ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও তা’ই। ঈশ্বর তথা এই জগতের সমস্ত কিছুই অনিত্য। উচ্চচেতনা সম্পন্ন জীব— মানুষের ক্ষেত্রে, তার চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটলেও, সংকর জাতির মানুষের মধ্যে বিকাশের ধারাবাহিকতা সবার ক্ষেত্রে সবসময় একভাবে ক্রম-ঊর্ধমুখী হয় না। তবে অসুস্থতা ব্যতীত, বিকাশের গতি কারো ক্ষেত্রেই কখনো নিম্নাভিমুখী নয়।

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের অবনতি, অথবা উচ্চ চেতনা সম্পন্ন কোনো পিতা/মাতার —তদপেক্ষা নিম্ন চেতনা সম্পন্ন সন্তান হলে— তা’ বিকাশের অধঃগতি বোঝায় না। প্রথম ক্ষেত্রে, বিকাশ হলো— মোটের উপর সুস্থ মনের এক স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব-ক্রিয়া। বিকাশ-পথ থেকে সরে আসা বিশেষ অসুস্থ মন বা মস্তিষ্কের অবনতিকে বিকাশের পশ্চাৎগতি ধরা হয় না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সংকর জাতির পিতা/মাতার মধ্যে বহু সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্পন্ন চেতন-স্তরের বংশবীজ উপস্থিত থাকায়, আপাতদৃষ্টিতে বিকাশের এই উত্থান—পতন পরিলক্ষিত হলেও, সার্বিক দৃষ্টিতে বিকাশ ক্রমশই ঊর্ধমুখীই থাকে।

এমনকি কোনো সদাচারী নিরীহ ভদ্রলোককে যদি বিশেষ অসুস্থতার কারণ ছাড়াই, পরবর্তীকালে উশৃঙ্খল— অনাচারী— কদাচারী হতে দেখা যায়, সেক্ষেত্রেও বিকাশ অধঃগামী বলা যায় না। মনে রেখো, একটি নিরীহ তৃণভোজী পশুর থেকে একটি ভয়ানক হিংস্র-ফন্দিবাজ শিকারী পশুর চেতনা অনেক বেশি হতে পারে।

একজন একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছিল, প্রশ্নটি হলো— ‘হাজার হাজার বছর আগেও বেশ কিছু উচ্চ চেতনার মানুষ ছিল, কিন্তু তাদের বংশধররা গেল কোথায়? —এতদিনে ক্রমবিকশিত হয়ে তাদের তো আরো অনেক বেশি উচ্চ চেতনার মানুষ হয়ে ওঠার কথা! কিন্তু কই, তেমন মানুষের তো দেখা মেলা না।

তাদের অনুপস্থিতির কারণ, বংশধারার গতিশীল বহু শাখা-প্রশাখার কোনো একটির অগ্রবর্তী ব্যক্তি যথেষ্ট উচ্চচেতনা সম্পন্ন হলে, সাধারণত তার আর বংশবৃদ্ধির চাহিদা থাকে না। এইরূপ মানুষের— পৃথিবীর ভোগ শেষ হয়ে যাওয়ায়, বংশধারার সেই উচ্চ শাখাটির বংশগতি বা বংশবৃদ্ধি স্থগিত বা রুদ্ধ হয়ে যায়।

আরেকটি ঘটনা হলো, সেই উচ্চচেতন ধারাটি ঘটনাচক্রে নিম্নচেতনার মানুষের সাথে মিলিত হয়ে— হারিয়ে যেতে পারে আপাতদৃষ্টিতে। বহুকাল পরে, মাঝে-মধ্যে এখানে ওখানে দু-একজন মহাপুরুষের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে তারই ফলস্বরূপ। তাছাড়া, সেই ব্যক্তি উচ্চ-চেতনা সম্পন্ন হলেও, তার সমস্ত বীজগুলি তো আর উচ্চমানের নয়। সংকর জাতির মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।

‘মহাধর্ম’ ও ‘মহাবাদ’ কোনো যুক্তিবিহীন— স্থিতিশীল— অন্ধবিশ্বাস ভিত্তিক ধর্ম ও মতবাদ নয়। ‘মহাধর্ম’ ও ‘মহাবাদ’ হলো ক্রমবিকাশমান অগ্রগতিশীল একটি যুক্তিসঙ্গত ধর্ম ও জ্ঞানদর্শন। তাই ‘মহাধর্ম’ ও ‘মহাবাদ’ কখনোই শেষ কথা বলে না। বলে, বিকাশমান চেতনার পথে এগিয়ে চলার কথা।
                                          —মহর্ষি মহামানস 
bottom of page