top of page

তৃতীয় অধ্যায়

কর্ম ও কর্মফল (প্রথম পর্ব)


আমার কর্ম— এই মহাজাগতিক কর্মকান্ডেরই একটা অংশ। আমার কর্ম হতে উৎপন্ন হয় যে ফল, অর্থাৎ আমার কর্মফল— তা’ শুধু আমার নয়, তা’ এই জগতেরই—, এবং জগৎ জুড়েই তা’ প্রভাব বিস্তার করে। আর, সমস্ত জগতই সেই ফল ভোগ ক’রে থাকে। 

জগতের কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছুর সাথেই সবার যোগ রয়েছে। জাগতিক কর্মকান্ড এবং তা’ থেকে উৎপন্ন ফলের অধিকাংশই আমাদের পক্ষে অনুভব যোগ্য নয়। আমরা তার খুব সামান্য অংশই উপলব্ধি করে থাকি।

এই মহাজাগতিক কর্মকান্ড থেকে উৎপন্ন অসংখ্য প্রকারের— অসংখ্য ফলের মধ্যে আমিও একটি ফল। আমি যা কিছু করছি, তা’ এই জগতব্যাপী ঐচ্ছিক—অনৈচ্ছিক অসংখ্য কর্মকান্ডের মিলিত ফলেরই একটা অংশ।

আমার দ্বারা কৃত সমস্ত কর্ম— আমার ইচ্ছা মতোই সংঘটিত হয়না। এর পিছনে রয়েছে— বহু ঐচ্ছিক—অনৈচ্ছিক—  স্বয়ংক্রিয় ঘটনা, স্থান-কাল-পাত্র, অবস্থা প্রভৃতি। আর, এ সবই পুর্বনির্ধারিতভাবে যখন যেটা ঘটার— ঘটে চলেছে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, —আমার-তোমার —সবার এবং সবকিছুর ক্ষেত্রেই। 

সামাজিক দৃষ্টিতে কেউ খারাপ কাজ করলেই যে তাকে খারাপ ফল ভোগ করতে হবে— তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার কেউ ভালো কাজ করলেই যে সে ভালো ফল পাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পেতেও পারে, আবার নাও পেতে পারে। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।

কোনো কর্মই শুধু ভালো কর্ম অথবা শুধুই মন্দ কর্ম— এমন হয়না। প্রতিটি কর্মই কম-বেশি ভালো-মন্দ হয়ে থাকে। কোনো কর্ম কারো দৃষ্টিকোণ থেকে বা কারো পক্ষে ভালো, তো অপর কারো পক্ষে মন্দ হতে পারে। আবার, ভালো—মন্দের নুন্যাধিক্য গুণ বিচার ক’রে কেউ কেউ কোনো কর্মকে ভালো, আর কোনো কর্মকে মন্দ বলে, মনে করতে পারে।    

কর্ম হ’তে উৎপন্ন কর্মফলের মধ্যেও ভালো ও মন্দ উভয় ফলই বিদ্যমান থাকে। কেউ শুধু ভালোটা দেখতে পায়, মন্দটা তার দৃষ্টিগোচর হয়না। আবার কেউ শুধু মন্দটাই দেখতে পায়, ভালো দিকটা সে উপলব্ধি করতে পারেনা। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় দিকই সঠিকভাবে দেখতে পায়— এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। 

সাধারণত, কর্মের জন্য— কর্মফলের জন্য— একজন অপরজনকে দায়ি ক’রে থাকে। আবার, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দেখে, এদের মধ্যে কেউই দায়ি নয়, —পূর্ব-নির্দিষ্টভাবে যা ঘটার তা-ই ঘটে চলেছে। কোনো কর্মেই কারো হাত নেই। আর, তাই কোন কর্মের জন্যই কেউ দায়ি নয়। 

‘কর্মফল’-কে বুঝতে হলে, সর্বাগ্রে আমাদেরকে পূর্বনির্ধারিত ‘ভাগ্য’-কে বুঝতে হবে। ‘ভাগ্য’ আসলে কী— তা’ না বোঝা পর্যন্ত নানা সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঢেউয়ের দোলায় ও ধাক্কায় বিপর্যস্ত হতে হবে আমাদেরকে।

কোনো ব‍্যক্তি ভাগ্য মানবে--- কেউ মানবে না, কেউ কর্ম করবে--- কেউ করবে না, কেউ ভাগ‍্যের দোহাই দিয়ে কর্ম ত‍্যাগ করে বসে থাকবে, আবার কেউ ভাগ্যকে জেনেও কর্মের তাড়নায় কর্মে লিপ্ত হবে। যে যা-ই করুক না কেন, সবাই ভাগ‍্যক্রমে বা ঘটনাক্রমেই করবে। করতে বাধ্য হবে। 



কর্ম ও কর্মফল (দ্বিতীয় পর্ব) 
 



জীব হলো ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) সৃষ্ট--- বিভিন্ন চেতন স্তরের চেতনা যুক্ত, বিভিন্ন আকার ও প্রকারের দেহ ও মনরূপ 'হার্ডওয়্যার' ও 'সফ্টওয়্যার' সম্পন্ন জৈব যন্ত্রবিশেষ। যার মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতোই ঈশ্বরের নির্দেশ অন্তর্গ্রথিত করা আছে। জীব যা কিছু করে--- সেই নির্দেশ বা প্রোগ্রাম অনুযায়ী সে কাজ ক'রে থাকে। জাগতিক ব্যবস্থা এবং জাগতিক ঘটনা পরম্পরা, আর জগতে জীবের অবস্থান অর্থাৎ পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং জীবের দেহ ও মনের অবস্থা সহ অন্তর্নিহিত প্রোগ্রাম বা নির্দেশের ভিত্তিতে জীবের কর্ম সংঘটিত হয়। আমাদের মন-সফট্ওয়ারে ঈশ্বর কৃত প্রোগ্রামের বিশেষত্ব হলো, মন ওই প্রোগ্রামের ভিত্তিতে--- নিজেকে নিজে এবং অপরের দ্বারাও প্রোগ্রামড্ করতে এবং হতে পারে। 

অনেক মানুষই তলিয়ে ভাবতে চায় না, যে যা বলে, তা-ই সে বিশ্বাস করে। পূর্বজন্ম এবং পূর্বজন্মের কর্মফল পরবর্তী জন্মে ভোগ করা, ---তেমনই একটি অন্ধ-বিশ্বাস। পূর্বজন্ম বলে যে কিছু নেই, ---সে সম্পর্কে 'মহাবাদ' গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আর, পূর্বজন্ম না থাকলে--- পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ করার কথাই আসে না। তবুও, দৃঢ়মূল অন্ধ-বিশ্বাস এমনই একটা 'প্রোগ্রাম' বা সংস্কার--- যে যুক্তির ধার ধারে না। 

মানুষ আংশিক জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন--- সচেতন ও অবচেতন মনের অধিকারী। তাই সে নানা দোষ-গুণে ভরা। সুকর্ম--- কুকর্ম করা একমাত্র মানুষ নামক জীবের পক্ষেই সম্ভব। তবে, মনুষ্যসমাজে তার দোষ-গুণের বিচার হলেও, ঈশ্বর বা জাগতিক-ব্যবস্থার কাছে সে কিন্তু তার কর্মের জন্য মোটেও দায়ী নয়। মানুষ যা কিছু করে--- সবই সে করতে বাধ্য হয়। তার স্বতন্ত্র কর্মক্ষমতা বলে কিছু নেই। মানুষ যন্ত্রবৎ কর্ম করে যায়। স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণে সে ভাবে, ---'আমিই করছি'। আসলে, এই জগতে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন কর্ম ও অবস্থার জন্য দায়ী হলো--- ভাগ্য। 

সংক্ষেপে, ভাগ্য হলো— জগত সৃষ্টির মূহুর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে যাওয়া পরবর্তী সমস্ত ঘটনাক্রম। জগতব্যাপি সংঘটিত--- পরম্পরাগত ঘটনাপ্রবাহ এবং তার কারণ। প্রতিটি ঘটনা তার পরবর্তী পরম্পরাগত ঘটনার আপাত কারণ। কখন— কোথায়— কী ঘটবে—, সমস্ত জাগতিক ঘটনা সুনির্দিষ্ট হয়ে আছে— জগত সৃষ্টির একেবারে শুরুতেই। —এরই নাম ভাগ্য ('ভাগ্য' প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। এই ভাগ্যকে ভালোভাবে জানতে পারলেই, আমাদের ভিন্ন ভিন্ন কর্ম ও অবস্থা এবং অবস্থানের কারণ বোঝা যাবে। জীবের যাবতীয় কার্যকলাপ--- সবই ভাগ্য নির্ধারিত। আমরা কেউই জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের বাইরে নই। ভাগ্য আমাদের ভিতরে—বাহিরে, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে ক্রিয়াশীল। আমাদের চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাসহ আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের অস্তিত্বও ভাগ্যের দান।  

এই ভাগ্য— এই পূর্বনির্ধারিত ঘটনা কিন্তু আকস্মিক বা অযৌক্তিক কিছু নয়। কার্য-কারণের পথ ধরেই— জগতের প্রতিটি ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প চেতনার কারণে সে সমস্ত আমাদের বোধগম্য হয়না। আর, এসবের পিছনে কোন নিয়ন্তা বা নিয়ন্ত্রক সত্তাও নেই। যা কিছু ঘটছে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘটে চলেছে। 

পূর্বজন্মের কর্মফল না থাকলেও, পূর্বপুরুষদের কর্মফল অনেকাংশেই আমাদের ভোগ করতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে, নিজের এবং সমসাময়িক মানুষ এবং বিগত প্রজন্মের অপরাপর মানুষের কর্মফলও কম-বেশি আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই ভোগ করে থাকি। জাগতিক ক্ষেত্রে, সুকর্ম করলেই যে সব সময় এর সুফল অথবা জাগতিক সুখ লাভ হবে, আর কুকর্ম করলেই দুঃখ কষ্ট বা কুফল ভোগ করতে হবে, এইরকম অতি সরল হিসেবে জগত-সংসার চলে না। ভালো-মন্দ— কম-বেশি কিছু না কিছু ফল তো আমরা পেয়েই থাকি। তবে সবসময়ই যে তা' স্পষ্ট বোঝা যাবে, এমন নয়। জাগতিক কর্মের ফলে আধ্যাত্মিক উন্নতি অবশ্যই ঘটে থাকে। —তা' সে সুকর্মই হোক আর কুক‍র্মই হোক। কর্মের মধ্য দিয়ে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ এবং তার পরিণতিতে চেতনা লাভই হলো আধ্যাত্মিক উন্নতি। 

তাছাড়া, সুকর্ম বলতে ঠিক কী বোঝায়, বাস্তবিকই তা' সুকর্ম কি না, এবং তার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি আছে কি না, কর্ম কারকের শারীরিক— মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, চারিপাশের মানুষ তাকে এবং তার কর্মকে কিভাবে দেখছে, স্থান-কাল-পাত্র, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনা সাপেক্ষে এক-একটি ফললাভ হয়ে থাকে। সমস্ত জগতব্যাপি অসংখ্য ঘটনার যোগ-বিয়োগ— গুণ-ভাগ প্রভৃতির জটিল টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এক-একটি ঘটনার সৃষ্টি হয়। আমাদের সোজাসাপ্টা হিসেবে— একে মিলানো সম্ভব হয় না সব সময়। সুকর্মের মতো কুকর্মের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটে থাকে।

মানুষের ক্ষেত্রে সুকর্ম— কুকর্মের মোটামুটি বিচার করা গেলেও, মানবেতর নিম্নচেতন-স্তরের জীবদের ক্ষেত্রে সুকর্ম— কুকর্মের বিচার হবে কিভাবে? কীট-চেতন, সরিসৃপ-চেতন বা পশু-চেতন স্তরের জীবদের পক্ষে কি সুকর্ম বা কুকর্ম করা সম্ভব? এইসব নিম্ন-চেতন-স্তরের জীবদের মধ্যে সচেতন মন নেই। নেই বিবেকের শাসন। এরা যা কিছু করে, অত্যন্ত সহজ— সরল প্রোগ্রাম বা প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়েই তা' করে থাকে। এরা তেমন ভেবেচিন্তে কিছু করে না। এদের কর্ম ধারাকে তাই ওভাবে ভাগ করা চলে না। এদের কর্মের জন্যেও এরা কোনভাবেই দায়ী হতে পারে না। 

কিন্তু যখন দেখা যায়, একটি কীট বা একটি পশু খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, আর ঘটনাচক্রে অপর একটি কীট বা পশু ভালোভাবে জীবন অতিবাহিত করছে, —পূর্বজন্মের কর্মফলের 'সূত্র' কি তখন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? —হবে না। ঘটনাচক্রে বা ঘটনাক্রমেই কেউ ভালো— কেউ মন্দ, কেউ ভালো স্থান— কেউ মন্দ স্থান লাভ করেছে। ভিতর থেকে মেনে নেওয়া শক্ত হলেও, এটাই জগতের (অপ্রিয়) সত্য! 



কর্ম ও কর্মফল (তৃতীয় পর্ব)


'নিষ্কাম কর্ম' নিয়ে অনেকবারই আমাকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখানে 'কর্ম ও কর্মফল' প্রসঙ্গে সে সম্পর্কে কিছু বলবো। 'নিষ্কাম কর্ম' বলতে বোঝায়--- কাম বা কামনাশূণ্য কর্ম। কামনা কথাটির অর্থ ইচ্ছাও হয়, আবার প্রত্যাশাও হয়। তবে 'নিষ্কাম কর্ম' কথাটি অনৈচ্ছিক কর্ম বা ইচ্ছা বিরহিত কর্ম হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায় না। সাধারণত এই কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে— প্রত্যাশা বিহীন কর্ম অর্থাৎ কোনো ফলের আশা না করেই কৃত হয় যে কর্ম। 

আশা বা কামনা-ই যেহেতু দুঃখ-কষ্টের অন্যতম কারণ, তাই নিষ্কাম কর্মকে জাগতিক দুঃখ-কষ্টসহ মোহ-মায়া থেকে মুক্ত হওয়ার এবং মুক্ত থাকার এক অতি সরলীকৃত উপায় হিসেবে উপদিষ্ট হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। কিন্তু বেঁচে থাকার স্বার্থেই— আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত প্রোগ্রামের তাড়নাতেই— আমাদেরকে অনেক কিছু কামনা করতে হয়, কামনা করতে বাধ্য হতে হয়। একমাত্র অসাধারণ ও অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া, কোনোরূপ প্রত্যাশাবিহীনভাবে অর্থাৎ কর্মফলের আশা ছাড়াই— উদ্দেশ্যহীনভাবে সাধারণত কোনো কর্ম সংঘটিত হতে দেখা যায় না। কর্মের জন্য কর্ম, কর্মকে ভালবেসে কর্ম, কর্ম করতে ভালোলাগে— তা-ই কর্ম, এছাড়া, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা বা বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার বা শান্তি পাওয়ার জন্যেও অনেক কর্ম আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে প্রায়শই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই কর্মগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ফলপ্রাপ্তির আশা না থাকলেও, সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মভাবে এর মধ্যে ভালোলাগা —ভালোবাসা থাকে। অথবা শরীর এবং/ অথবা মনের আরাম— সুখ কিছু না কিছু থাকেই। 

ভালো লাগছে না, আবার কোন উদ্দেশ্যও নেই, কোনো ফলপ্রাপ্তির আশাও নেই, অথচ কেউ ঐচ্ছিকভাবে কর্ম করে চলেছে, এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক' সাধারণ চেতনাসম্পন্ন জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ যদি ক্রীতদাসের মতো কোনো শক্তি বা শক্তিমানের কাছে পরাভূত হয়ে— অনিচ্ছা সত্বেও, ভালো না লাগা সত্ত্বেও, বাধ্য হয়ে কোন কর্ম সম্পাদন করতে থাকে, —সেক্ষেত্রে, সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য, শাস্তি বা মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই তা' করে থাকে। তার সে কর্মও নিষ্কাম কর্ম নয়। তাই, 'নিষ্কাম কর্ম' যেন 'সোনার পাথরের বাটির' মতোই একটা কিছু। 

ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা— জীবের চেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যে, জীবকে কর্মে প্রবৃত্ত করার জন্য—প্রধানত দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তার একটি হলো— কর্মের মধ্য দিয়ে সুখকর ও সার্থানুগ ফল লাভের ব্যবস্থা। আর অপরটি হলো— কর্মের মধ্য দিয়ে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা— বিপদ, ক্ষয়ক্ষতি প্রভৃতি থেকে রেহাই বা মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা। উভয় ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু ফল লাভের ব্যবস্থা রয়েছে। মানুষ কর্মফলের আশা না করলে, মনুষ্যকৃত এই বিচিত্র কর্মময় জগৎ সৃষ্টিই হতো না। মানুষের চেতনার বিকাশও ঘটতো না সেভাবে। আর তা' ঈশ্বর বা বিশ্বাত্মার অভিপ্রায়-ও নয়। যথেষ্ট চেতনার বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত— জীবকে সকাম কর্মপথে চালনা করাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। 

এই জগতে কারণ ছাড়া কিছু ঘটে না। আর, চেতনা ও মন সম্পন্ন কোনো সত্তা-ই এখানে উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করে না। আদি-সত্তা (পরমাত্মা) থেকে ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) তথা জাগতিক-ব্যবস্থা— কেউই উদ্দেশ্য বিহীন নয়। কোনো লক্ষ্য ছাড়া— কোনোরূপ স্বার্থ ছাড়া, কোনো অভিপ্রায় ছাড়া, কেউ কিছু করে না। অংশানুক্রমে ঈশ্বর সৃষ্ট জীবও তাদের মন-সফট্ওয়ারে অন্তর্গ্রথিত প্রোগ্রাম বা নির্দেশ মতো, কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম ক'রে চলেছে। আর, যেখানেই উদ্দেশ্য আছে— উদ্দেশ্য সিদ্ধির বাসনাও আছে সেখানে। 

কামজ সন্তান--- সম্ভোগজাত বা কামনা থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান যদি নিষ্কাম হয়, বুঝতে হবে— সে অতি উচ্চ চেতনস্তরের মানুষ, আর নয় তো সে অসুস্থ। উচ্চ চেতনাসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষ জানে, এখানে যা ঘটার—ঠিক তা-ই ঘটে চলছে। সবই পূর্বনির্ধারিত মতো যথাস্থানে— যথাসময়ে— যথাযথভাবে ঘটে চলেছে। সে যা করছে, সে সবই পূর্বনির্ধারিতভাবে তাকে করতে হচ্ছে— করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। তার কর্মের ফলও পূর্বনির্দিষ্ট। তাছাড়া, অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে সৃষ্ট অনেক চাওয়া পাওয়াই আসলে মোহ-মায়ার খেলা। উচ্চ চেতনার কারণে ব্যক্তি— মোহ-মায়া অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে অনেকটাই মুক্ত হওয়ার ফলে, এবং তার জ্ঞান পাকাপোক্ত হওয়ার ফলে, সে তখন অনেকটাই নিস্পৃহ— নিরাসক্ত, উদাসীনভাবে কর্ম করে চলে। পূর্ণ জ্ঞান— পূর্ণ চেতনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত, পুরোপুরি কামনা-বাসনা, আসক্তি শূন্য হওয়া সম্ভব হয় না। আর এই মানব জীবনেই পূর্ণ বিকাশলাভ-ও সম্ভব নয়। 

পূর্ণ জ্ঞান পূর্ণ চেতনার জন্য আমাদেরকে মানবোত্তর জীবনে ক্রমশ উচ্চ চেতন-স্তরগুলি পার হতে হবে। উচ্চ মানব-চেতনায় যা হয়ে থাকে, তা' হলো— কামনার উগ্রতা অনেকটাই কমে গিয়ে, তা' ক্ষীন হয়ে আসে ক্রমশ। উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধির কামনা— ফল লাভের আশা-আকাঙ্ক্ষা —সবই থাকে, তবে তা' বেশ কম এবং নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় থাকে। আসলে, চেতনার সেই স্তরে— যা ঘটার ঠিক তাই ঘটে থাকে। তেমনি, নিম্ন চেতন-স্তরগুলিতেও, যেখানে যেমনটি ঘটার, ঠিক ঠিক ঘটে চলেছে। শত উপদেশ দিয়েও নিম্ন চেতনস্তরের মানুষকে উচ্চ চেতনস্তরের আচরণে অভ্যস্ত করে তোলা যাবে না। উচ্চ চেতন স্তরের মানুষের পক্ষে যে আচরণ স্বাভাবিক, নিম্ন চেতন-স্তরের মানুষের পক্ষে তা-ই অস্বাভাবিক। যে ব্যক্তি মানুষকে নিষ্কাম-কর্ম করার উপদেশ দিচ্ছে, দেখা যাবে, হয়তো সে নিজেই তা' করে উঠতে পারছে না।

অলৌকিকতা প্রসঙ্গে 



অলৌকিক হলো তা'-ই ---যা লৌকিক নয়। অর্থাৎ ইহলোকের বা ইহজগতের নয়। পরলোক বা প্রেতলোকসহ এই জগতের বাইরের বিভিন্ন বিষয়-বস্তু, শক্তি-ক্ষমতা, ঘটনা এবং চেতন-সত্তা যখন আমাদের গোচরে আসে, তখন তাকেই অলৌকিক বলা হয়। আমাদের ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিগ্রাহ‍্য নয় এমন কিছুকে অনেকে অলৌকিক মনে করলেও, সবসময় যে তা' অলৌকিক হবে এমন নয়। 

 

কঠিন বাস্তবের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে পর্যুদস্ত অসহায় মানুষ— স্বভাবতই অলৌকিকতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে থাকে। নিমেষের মধ্যে অথবা রাতারাতি ম্যাজিকের মতো সমস্ত আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ হয়ে যাক, এটাই তার অবচেতন মনের প্রবল চাহিদা। 

বিশ্বাস করি অথবা না করি, অলৌকিকতার প্রতি আমরা প্রায় সবাই— কমবেশি আকর্ষণ বোধ করে থাকি। আমরা আমাদের দেখা-শোনা— জানা জগতকে নিয়েই সন্তুষ্ট নই। আমাদের ধারণা— এর বাইরেও বহু কিছু আছে, —যা আমাদেরকে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আকর্ষণ করে। 

বিশ্বাসের সাথে সাথে সন্দেহও উঁকি দেয় আমাদের মনের কোণে। সত্যিই অলৌকিক বলে কি কিছু আছে? আমরা এমনতো অনেক কিছু দেখি, —যা গতকালের ভাবনায় ছিল অলৌকিক— অসম্ভব, আজ তা' লৌকিক হয়ে উঠেছে। শুধু অজানা থাকায় তারা অলৌকিক হয়ে ছিল আমাদের কাছে এত কাল। 

হ্যাঁ, ইহলোকের অনেক কিছুই এখনো পর্যন্ত আমাদের অজানা। আমাদের চেনা জগতের মধ্যেই— বিস্ময়কর এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাদের অজানা। অনেক সময়, তাদের সম্পর্কে কাল্পনিক ধারণা এবং তাদের কারো কারো আকস্মিক প্রকাশকেই আমরা আমাদের স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প চেতনার কারণে অলৌকিক বা অবাস্তব বলে ধরে নিই। কিন্তু এগুলিকে অলৌকিক বলা যাবে না। প্রথমেই বলেছি, অলৌকিক কথার অর্থ হলো--- যা লৌকিক নয় ইহজাগতিক নয়। 

দূরদর্শন— দূরশ্রবন যন্ত্র দেখতে আমরা অভ‍্যস্ত। সেক্ষেত্রে আমরা তেমন বিস্মিত হইনা। কিন্তু মন তথা মস্তিষ্ক যন্ত্রের দূরদর্শন— দূরশ্রবন ক্ষমতার কথা শুনলেই আমরা তখন বিস্ময় প্রকাশ করি। তাকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে ভেবে নিই।

পরলোক সম্পর্কে আমাদের অনেকের সন্দেহ— অবিশ্বাস থাকলেও, আগ্রহ ও কৌতুহলও কম নেই। সেই পারলৌকিক কোন সত্তা যদি সত্যিই কোন ভাবে আমাদের জ্ঞান-গোচর হয়, তাহলেও আমরা তাকে ইহজাগতিক বলবো না, অলৌকিক বা পারলৌকিক-ই বলব। চেনা-জানা হলেই তা' লৌকিক হয়ে যাবে না। 
আমাদের মধ্যে বেশকিছু মানুষ আছে, যারা অলৌকিকতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে থাকে। এরা অধিকাংশেই অত্যন্ত বিশ্বাসপ্রবন মানুষ। এদের এই বিশ্বাসপ্রবণতা আর অলৌকিকতার প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে— কিছু ধূর্ত-প্রতারক মানুষ এদেরকে শোষণ করে চলেছে। অনেকসময় ঠকলেও, এরা এদের অন্ধবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন হওয়া বিশেষ মনঃশক্তির দ্বারা মাঝে মাঝে লাভবানও হয়ে থাকে। —যা এদের কাছে কোনো অলৌকিক সত্তা বা শক্তির কৃপা বা দান বলেই মনে হয়। ('বিশ্বাস ও জ্ঞান' এবং 'ঈশ্বর প্রসঙ্গে' দ্রষ্টব্য) 

এ' হলো আসলে— অন্তর্নিহিত বিশেষ মনঃশক্তির তাৎক্ষণিক স্ফূরণ! এবং তার দ্বারা সাময়িকভাবে লাভবান হওয়ার ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা' এই বিশেষ মনঃশক্তি-কেন্দ্রের স্থায়ী বিকাশ নয়। মস্তিষ্কের এই বিশেষ শক্তি-কেন্দ্রের স্থায়ী বিকাশ ঘটলে, ব‍্যক্তি অনেক অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। —যা লৌকিক হলেও, অনেকের কাছে অলৌকিক ক্ষমতা বা শক্তি বলেই মনে হবে। মন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবেই আমরা অজ্ঞান-অন্ধের মত জীবন যাপন করে চলেছি। 

এই মহাজগতে অসংখ্য অলৌকিক অস্তিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অলৌকিক রূপে যেগুলি আমাদের সামনে আসে, তাদের মধ্যে কিছু অলৌকিক ঘটনা থাকলেও, বেশিরভাগেই থাকে অজানা জাগতিক ঘটনা আর প্রতারণামূলক কারসাজি, —যা ম্যাজিকের মতোই কোনো না কোনো কৌশল। জাগতিক ঘটনার মধ্যে আবার কিছু থাকে— বস্তুগত ও জাগতিক শক্তির খেলা। আর কিছু হলো— আমাদের মনোজগতের নানান কাণ্ডকারখানা। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যেগুলি আমাদের কাছে অলৌকিক রূপে প্রতীয়মান হয়। 

অলৌকিক ঘটনার মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য হলো, গ্রহান্তরের জীব ও যন্ত্র এবং মহাকাশযানদের পৃথিবীতে অবতরণের ঘটনা। এ' বিষয়েও মানুষের চরম কৌতূহল— আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এ'নিয়ে বহু গল্পগাঁথা, প্রবন্ধ, কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র প্রস্তুত হয়েছে, গবেষণাও হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো। কিন্তু এসবের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু প্রমাণ থাকলেও, সর্বজনগ্রাহ্য— যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য— নিশ্চিত প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। 

প্রকৃত অলৌকিক ঘটনা হিসেবে— যে ঘটনাগুলি সাধারণত ঘটে থাকে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই— প্রেতলোকের বাসিন্দাদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া ঘটনা। নিম্ন-চেতন-স্তরের প্রেতাত্মা, যারা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি, অতৃপ্ত সেইসব আত্মাই আমাদের চারিপাশে ঘোরাফেরা করে থাকে ('জীবাত্মা ও দিব‍্যাত্মা' দ্রষ্টব্য)। এবং ওরা আমাদের সাথে যোগাযোগ ঘটানোরও চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ 'রিসিভার' কেন্দ্রটি জাগ্রত ও সক্রিয় না থাকায়, ওরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাতে পারে না। 

কিছু প্রেতবিদ মানুষ বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে— ওদের সাথে যোগ স্থাপনে সক্ষম। তারা ওদের দ্বারা কিছু কিছু বিশেষ কাজও করিয়ে নিতে পারে, যে কাজ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়াও বিশেষ কিছু মানুষ আছে, যাদের মস্তিষ্কের বিশেষ 'রিসিভার' কেন্দ্রটি জাগ্রত ও সক্রিয় থাকায়, তারা প্রেতাত্মাদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়। তবে এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সাধারণত ভুতে-পাওয়া বা ভুতাবিষ্ট ব্যক্তিদের কার্যকলাপের মধ্যে, বেশিরভাগই কিন্তু প্রেত সম্পর্কিত— ভুত বা প্রেত আবিষ্ট হওয়ার ঘটনা নয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই 'হিস্টেরিয়া' অথবা বিশেষ ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ। 

আমরা অনেকেই দেব-দেবীদের অলৌকিক ক্ষমতার কথা বিশ্বাস ক'রে— তাদের দ্বারা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে, তাদের পূজা-উপাসনা ক'রে থাকি।  এইসব দেব-দেবী এবং ঈশ্বর সম্পর্কে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে, আমরা এগুলি ক'রে থাকি। কোন ঘটনা— তা' সে লৌকিক হোক, আর অলৌকিক হোক, তার সম্ভাব্য 'সোর্স অফ পাওয়ার' খুঁজে দেখার চেষ্টা করি না আমরা। যে যা বলে, তা-ই বিশ্বাস করে নিই। এই সমস্ত দেব-দেবীদের দ্বারা সংঘটিত হওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে, একশ্রেণীর ঘটনা ঘটে— পূর্বে উল্লেখিত আমাদের বিশ্বাস সম্ভূত বিশেষ মনঃশক্তির দ্বারা ঘটে থাকে, আর অপর শ্রেণীর ঘটনা ঘটে— প্রেতাত্মাদের দ্বারা। 

পরলোকের কিছু কিছু বিদেহী  আত্মাদেরকে অনেক সময়েই বিভিন্ন পূজিত দেবদেবীদের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। বিশেষত যেসব মন্দির ও তীর্থস্থান— অনাচার-কদাচার-দুরাচারে পূর্ণ। সেই সব স্থানেই ভুত-প্রেত-পিশাচাদি নিম্নস্তরের প্রেতাত্মাদের ভিড় থাকে। এদের মধ্যে কিছু কিছু চতুর প্রতারক মনের প্রেতাত্মাগণ অনেক সময়েই অজ্ঞান-অন্ধ অসহায় মানুষ অথবা দেব-ভক্তদের প্রতারণা ক'রে আনন্দ পায় এবং তাদের পূজা-অর্ঘাদি আত্মসাৎ করে তৃপ্ত হয়। 

এদের কেরামতিতেই সেইসব স্থান এবং সেইসব দেব-দেবী হয়ে ওঠে জাগ্রত। দেবতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায়, অনেক মানুষই প্রতারিত হয়ে আসছে এইভাবে। অনেকেই ঈশ্বর আর তথাকথিত দেবতাদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে মায়ার গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছে। 

সংস্কৃত ভাষায় দেবতার তার অর্থ— জ্ঞানী—বিদ্বজন, যারা তৎকালীন সাধারণ মানুষ থেকে বেশ কিছুটা উচ্চ শ্রেণীর মানুষ। ভগবান বলতেও সংস্কৃত ভাষায় শুধু ঈশ্বরকেই বোঝানো হয়না। দেবতুল‍্য ব্যক্তি, শৌর্য-বীর্যবান, ঐশ্বর্যশালী— জ্ঞানী যশবান ও সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকেও ভগবান বলা হয়। আর এর ফলেই, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে দেবতা আর ঈশ্বর সম্পর্কে গুলিয়ে ফেলে। 

এছাড়া আছে প্রতীকী দেবতা। প্রাকৃতিক শক্তি এবং প্রকৃতির নানা বিষয়বস্তুকেও অনেকে দেবতা বলে থাকে, অথবা দেবতা বলে চিহ্নিত করে থাকে। আবার, কোনো মানুষকে— কোন প্রাকৃতিক শক্তি অথবা প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর প্রতিভূ হিসাবে গণ্য ক'রে, তাকে দেবতা জ্ঞানেও পূজা করা হয়ে থাকে, অনেক জায়গায়। 

ঈশ্বর প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেব-দেবীদের কথা এসে যায়। বহু মানুষই ঈশ্বর ও দেব-দেবী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে, বিভিন্ন দেবদেবীকেই ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা উপাসনা করে থাকে। সারা পৃথিবীতে প্রচলিত অথবা কাল্পনিক দেব-দেবী বা দেবতাগণ, আর 'মহাধর্ম' ও 'মহাবাদ' উক্ত দেবতাগণ এক নয়। মহাবাদ-এর দেবতাগণ অনেক বেশি উচ্চ-চেতন-স্তরের সত্তা। পৃথিবীতে আগমন এবং মানুষের সঙ্গে লীলা-খেলায় অংশ নেওয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়। মহাবাদ-এ উক্ত দেব-চেতন-স্তরের বাসিন্দারাই প্রকৃত অর্থে দেবতা। এখানে দেব--দেবী বলে কিছু নেই। কারণ এই উচ্চ-চেতন-স্তরে কোনো লিঙ্গ ভেদ নেই। নেই বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা। 

ঈশ্বর সম্পর্কে এবং নিজের সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা না থাকাতেই যত সমস্যার উদ্ভব হয়। অলৌকিক প্রসঙ্গে ঈশ্বর সম্পর্কে শুধু এই কথাই বলবো, ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডকে লৌকিক অলৌকিক রূপে ভাগ করা চলে না। এই মহাজগৎটাই ঈশ্বর। এখানে যা কিছু ঘটছে ঈশ্বরের মধ্যেই ঘটছে, এবং এসব নিয়েই ঈশ্বরের মহা কর্মকাণ্ড চলছে। আলাদা করে ব্যক্তিবিশেষের জন্য অথবা সরাসরি আমাদের জন্য ঈশ্বর কিছু করে না। ঈশ্বর সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হলে, 'ঈশ্বর প্রসঙ্গ' 'ঈশ্বর ও আমরা' এবং 'মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস‍্য উন্মোচন' প্রবন্ধ গুলি পড়তে হবে।

মনেরেখো, কারও মধ্যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, অথবা কারও দ্বারা সংঘটিত কোনো অলৌকিক কাণ্ড দেখেই— কাউকে ঈশ্বর বা অবতার অথবা ত্রিকালজ্ঞ বা যথেষ্ট বিকশিত মানুষ ভেবে নিওনা। অলৌকিক কাণ্ডগুলি— বিশেষ কৌশল বা ম্যাজিক অথবা প্রেতাত্মার সাহায্যেও ঘটানো সম্ভব।   

প্রসঙ্গ : মোহ-মায়া 

 

মায়া হলো— চিত্তবিভ্রম, ভ্রান্তি, ভুল ধারণা, অন্ধবিশ্বাস— মিথ্যা প্রত্যয়। মায়া হলো— মোহ-আবেশে আচ্ছন্ন এমন একটা ঘোর লাগা মানসিক অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ সতত প্রতারিত হয়ে থাকে। এই মায়ার কারণ হলো— জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতা আর অসুস্থতা। সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনার অভাবে, এবং/অথবা অসুস্থতার কারণে— মানুষ মায়াকবলিত হয়ে নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে। এইভাবে চলতে চলতেই ক্রমশঃ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনা লাভের মধ্য দিয়ে, ধীরে ধীরে একটু একটু করে মোহমায়া থেকে মুক্তি লাভ করে থাকে মানুষ। 

অসুস্থতাও মোহ-মায়ার কারণ হতে পারে কখনো কখনো। অসুস্থতার কারণেও অজ্ঞানতা আসতে পারে এবং চিত্রবিভ্রম ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে অসুস্থতা থেকে মুক্তি ঘটলে— মানুষ অসুস্থতা জনিত চিত্তবিভ্রম বা মোহ-আবেশ থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়। 

স্নেহ-মমতাকেও মায়া নামে অভিহিত করা হয় অনেক সময়। সাধারণত, আমাদের স্নেহ-মমতা—ভালবাসার পিছনেও থাকে মায়া-মোহ অজ্ঞানতা জনিত ভ্রান্তি। নিজেকে নিজের স্বরূপে না জেনে, ভালোবাসার বিষয়-বস্তু বা ব্যক্তিকে সঠিকভাবে না জেনে, আমরা মিথ্যা প্রত্যয় নিয়ে যেভাবে ভালোবেসে থাকি, —তা' মায়া বৈ আর কিছু নয়। কে ভালোবাসছে— কেন ভালোবাসছে, কাকে ভালবাসছে, এবং 'ভালোবাসা'-টা আসলে কী— জানার পরে, কেউ যদি মোহমুক্ত হয়ে ভালবাসতে পারে, সেই হবে প্রকৃত ভালোবাসা। 

আমরা চাঁদকে ভালবাসি— ফুলকে ভালবাসি—, এইরকম অনেক কিছুকেই আমরা ভালোবেসে থাকি। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান বর্জিত ভক্তি-ভালোবাসা আসলে মায়া ছাড়া আর কিছু নয়। চাঁদ ও ফুলকে তাদের স্বরূপে জানার পরে— কেউ যদি তাদের ভালোবাসে, সেই হবে প্রকৃত ভালোবাসা। তুমি কি একটি ফুলকে— উদ্ভিদের জননাঙ্গ বিবেচনা করে ভালোবাসো? 

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঈশ্বরের আরাধনা করছে— শুধুমাত্র মায়ামুক্ত হওয়ার প্রার্থনা নিয়ে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝবে, সে-ও মায়ার বশবর্তী হয়েই তা করছে। মায়াকে ভালোভাবে না জেনে—না বুঝে, মায়ামুক্ত হতে চাওয়া তো মায়াই! নিজেকে না জেনে— ঈশ্বরকে তার স্বরূপে না জেনে, ঈশ্বরের উপাসনা করাটা মায়ার খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। 


একজন অজ্ঞান-অন্ধ —মোহ-মায়াচ্ছন্ন মানুষ, যে 'মোহ' ও 'মায়া' কি জিনিস, তা-ই জানে না, এখন সে যদি তাকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবার জন্য কারো কাছে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করে, কেউ তাকে মায়ামুক্ত করতে পারবে না। সে এভাবে কখনোই মায়ামুক্ত হতে পারবে না। মায়া-মোহ তো তার ভিতরে— তার মনে। মায়া থেকে মুক্তিকামী মানুষকে মায়া এবং তার কারণ সম্পর্কে জানতে হবে— ভালভাবে বুঝতে ববে। তারপরে, নিজের সম্পর্কে সজাগ-সচেতন-সতর্ক থাকার চেষ্টা করে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। তবেই সে একটু একটু করে ক্রমশ মায়ামুক্ত হতে পারবে। 


সবকিছু মোটামুটি জানা— বোঝার পরেও, অনেকসময় আমরা মায়ামুক্ত হতে পারি না। আসলে, আমাদের 'বোঝা'-টা উপরে উপরে 'বোঝা' হয়ে থাকে, সম্পূর্ণ উপলব্ধ জানা— বোঝা হয়না। বুঝতে পারছি, এটা করা ঠিক নয়, তবুও তা' থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না! এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। এটাই হলো মোহ-আবেশে আচ্ছন্ন মনের ঘোর লাগা অবস্থা। 

আমরা জানি, আমাদের এই মানব অস্তিত্বসহ আমাদের অর্থ-সম্পদ, আত্মীয়-পরিজন প্রভৃতি সবকিছুই অস্থায়ী। এ' সত্ত্বেও আমরা তা' বিস্মৃত হয়ে, কতোই না বাদ-বিবাদ অশান্তি সৃষ্টি ক'রে থাকি। এ' সমস্তই আমরা করে থাকি মায়ার বশবর্তী হয়ে।

মায়া মুক্ত হতে চাইলে, অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইলে--- মায়াজ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে চাইলে, মনের বিকাশ —আত্মবিকাশের পথে অগ্রসর হতে হবে আমাদের। সেইসাথে সর্বাঙ্গীন সুস্থতা লাভের চেষ্টা এবং সুস্থ থাকার চেষ্টা করতে হবে— সঠিক পথে। কিন্তু মায়ার কারণেই, আমরা অনেকেই সে পথে অগ্রসর হতে চাই না— অগ্রসর হতে পারিনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, মায়ামুক্ত হতে চাওয়াটাও আমাদের ভেতর থেকে চাওয়া নয়, ওপরে ওপরে চাওয়া। আমরা মোহ-মায়া বশতঃ প্রকৃতই মায়ামুক্ত হতে চাই না। 

অজ্ঞান-অন্ধকূপ-এর মধ্যে— নিজেদের চতুর্দিকে মায়াজাল বিস্তার ক'রে, তাতেই মোহ-মায়াজ সুখে আবিষ্ট হয়ে— বুঁদ হয়ে থাকতে চাই আমরা। মায়াবদ্ধ জীব, আমরা একে অপরের দ্বারা মায়াবদ্ধ হই, আবার একে অপরকে মায়াবদ্ধ করে থাকি। আসলে, কোনো কিছু বা কেউ আমাদেরকে মায়াবদ্ধ করে না। মায়াবদ্ধ— মোহাচ্ছন্ন আমাদের মনটাই। কেউ আমাদেরকে মায়া— মোহ-আবেশ থেকে মুক্ত করতে চাইলে, আমরা তার ওপরে বিরূপ হয়ে উঠি। তাকে শত্রু বলে মনে করি। —এরই নাম মায়া! 

যদিও, আমাদের অগোচরে— অন্তরের গভীরে, সেখানে বিকাশ লাভের তাড়নাও নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে। আর এই বৈপরীত্যের মাঝে প'ড়ে, আমরা যারপরনাই নাস্তানাবুদ হয়ে চলেছি। যখন যার ক্ষমতা বেশি— তার দ্বারা-ই চালিত হচ্ছি আমরা। কখনো বলছি, এই বেশ আছি— রসেবসে মায়ার আঁচল তলে। আবার কখনও বলছি, এই মায়া-ই যত অনিষ্টের কারণ। —আমাকে মায়া মুক্ত হতে হবে। এ-যেন, বাবা বলছে, খোকা বেরিয়ে পড়— যদি জীবনে উন্নতি করতে চাস তো বেরিয়ে পড়। আর মা বলছে, না আমার খোকা দূরে কোথায় যাবে না। সব সময় আমার চোখের সামনেই থাকবে। সচেতন আর অবচেতন মনের এই খেলা চলছে অবিরত আমাদের মধ্যে।

বর্তমান চেতন-স্তরে—  আমাদের পক্ষে পুরোপুরি মায়া-মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই, সজাগ-সচেতন থেকে যথাসম্ভব মায়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মায়াকে জয় করতে হবে। 

প্রসঙ্গ : সত্য 


 

চেতনার ন‍্যুনাধিক‍্যের ভিত্তিতে 'সত্য' বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়ে থাকে। কারো কাছে তার বিশ্বাসের বিষয়বস্তুই সত্য। কারো কাছে একমাত্র যুক্তি-প্রমাণ সিদ্ধ বিষয়বস্তুই সত্য। আবার, কারো কাছে সবকিছুই আপাত সত্য।

তাহলে প্রকৃত সত্য কাকে বলা হবে? যা আছে, যার অস্তিত্ব আছে, তাই হলো সত্য। কিন্তু সমস্যা হলো, সব বিষয় বস্তুর অস্তিত্ব সবার নিকট প্রতীয়মান নয়। আবার, অনেক কিছুই আছে বলে অনুমান, কিন্তু কারো কাছেই প্রত‍্যক্ষ বা উপলব্ধ নয়। সমস্যা এখানেই।

অন্ধবিশ্বাসীগণ সেই অপ্রত্যক্ষ অ-উপলব্ধ বিষয়বস্তুর কাল্পনিক অস্তিত্বকেই অনেক সময় সত্য বলে বিশ্বাস করে। আর যুক্তিবাদী-- বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের কাছে যুক্তি ও প্রমাণ সিদ্ধ বিষয়বস্তু ছাড়া বাকি অনুমান সাপেক্ষ সম্ভাব্য বিষয়বস্তু গুলি— প্রকল্প বা তত্ত্বপ্রকল্প (হাইপোথিসিস) অথবা তাত্ত্বিক দর্শন রূপে গণ্য হয়ে থাকে। আর, এর বাইরের কল্পনা বা ধারণাগুলোকে তারা— অসম্ভব বা অলীক, বা আপাত মিথ্যা বলে, অথবা গ্রহণযোগ্য নয় বলে, মনে করে।

এছাড়াও, একজন সত্যনিষ্ঠ দূরদর্শী দার্শনিক এর কাছে এই জগতের বাস্তব-অবাস্তব সবকিছুই আপাত সত্যরূপে গৃহীত হতে পারে। আজ যে সত্য— কাল সে মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, আজ যে মিথ্যা কাল সে সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। তাই, সে সব কিছুকেই আপাত সত্য রূপেই গ্রহণ করে থাকে।

'সত্য' হলো--- যথার্থ বা যথার্থতা, বাস্তব বা বাস্তবতা। প্রকৃত। আর, বাস্তবতা— যথার্থতা যার আছে, তার অস্তিত্বও আছে। সে অস্তিত্বশীল। সেই হিসাবে মিথ্যাও সত্য। মিথ্যা রূপে সে সত্য, অর্থাৎ ওটা যে মিথ্যা—সেটা তো সত্য!

'অস্তিত্ব' হলো— বিদ‍্যমানতা, অর্থাৎ বিদ‍্যমান থাকা। যা আছে তা-ই হলো অস্তিত্বশীল। সেই হিসাবে, ঠান্ডা ও অন্ধকারেরও অস্তিত্ব আছে। ঠান্ডা ও অন্ধকার এগুলো হলো এক একটা অবস্থা। আর সেই অবস্থাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ওরা ঐ ঐ অবস্থায় অস্তিত্বশীল।

কেউ যদি বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে ঠান্ডা ও অন্ধকার-এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তা' হবে দুর্ভাগ্যজনক। হবে, অপবিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের ভুল ব‍্যাখ‍্যা।

প্রচলিত ধর্ম— রাজতন্ত্র (অধুনা রাজনীতি) এবং বৈশ‍্যতন্ত্র এরা নিজেদের স্বার্থেই মানুষকে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়নি কোনো দিনও। তাই মানুষ ওপরে ওপরে —ভাসা ভাসা জ্ঞান আর শেখানো তোতাবুলি নিয়েই মজে আছে।


অনভ‍্যাসের কারণে তলিয়ে ভাবতে তাদের বড়ই অনিহা। ফলে, সত্য তাদের কাছে অধরাই থেকে যায়। আর স্বার্থান্বেষীরাতো এটাই চেয়ে এসেছে বরাবর।

বাস্তব সত্য

এই পরিবর্তনশীল অনিত‍্য বাস্তবে, স্বল্প জ্ঞান ও চেতনা সাপেক্ষে— সত্য কখনোই স্থির নিত্য হতে পারে না। আজ যা সত্য— কালই তা' মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। আবার, কালকের মিথ্যা আগামীতে সত্য বলে পরিগণিত হতে পারে।

কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকলেই হবেনা, আমাদের চেতনায় তা' ধরা না দিলে, আমাদের কাছে সে অস্তিত্বশীল হতে পারবে না। সত্য--মিথ্যা এসবই তো আমাদের জ্ঞান ও চেতনার উপর নির্ভরশীল। আমাদের জ্ঞান ও চেতনাও পরিবর্তনশীল হওয়ায়, এই জ্ঞান ও চেতনা সাপেক্ষে এখানে সব কিছুই আপাত সত্য।

যা অস্তিত্ব সম্পন্ন তা'ই বাস্তব, যা বাস্তব তা'ই সত্য। সে অস্তিত্ব আমরা বোধ করতে পারি বা না পারি, সে আছে। সে আমাদের নিকট অস্তিত্ব বিহীন হলেও সে আছে। আমাদের বোধ— উপলব্ধির বাইরে বহু অস্তিত্ব— বহু সত্য আছে, যারা আমাদের কাছে— থেকেও নেই।

আবার, কোনো কিছু আমাদের কাছে বিশেষ কোনো রূপে ধরা দিলেই যে সেটাই তার প্রকৃত রূপ তা' না ও হতে পারে। একটা মানুষকে আমরা যে রূপে দেখছি, সেটা তার প্রকৃত রূপ নাও হতে পারে। যেমন চাঁদকে আমরা যে রূপে দেখছি, সেটা তার প্রকৃত রূপ না হলেও, আমাদের কাছে (পৃথিবী থেকে, নির্দিষ্ট দূরত্ব সাপেক্ষে) সেটাই তার রূপ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমাদের কাছে অনেক কিছুর সাপেক্ষে অনেক প্রকার হতে পারে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের দৃষ্টিতে এই জগত যে রূপে প্রতীয়মান হচ্ছে, অন্য প্রাণী বা অন্য গ্রহের জীবের নিকট তা' সেই রূপে প্রতীয়মান নাও হতে পারে। 

এই মানব জীবনে পূর্ণ জ্ঞান ও চেতনা লাভ কখনোই সম্ভব নয়। একমাত্র অন্ধ বিশ্বাসের কাছেই আছে পূর্ণ জ্ঞানী, আছে পরম সত্য! অজ্ঞান-অন্ধত্ব দূর হয়ে গেলে , তখন সবই হয়ে যাবে আপাত সত্য।

অস্তিত্ব যে কত প্রকারের হতে পারে, তা' আমাদের ধারণার বাইরে। বস্তু, পদার্থ, শক্তি, তথ্য ও তত্ত্ব ছাড়াও এই বিশ্বে বহু প্রকারের অস্তিত্ব বিদ‍্যমান। আমাদের স্বল্প বোশশক্তি বা ক্ষমতা নিয়ে আমরা তার অতি সামান্য অংশকেই জানতে পারি— উপলব্ধি করতে পারি।

তবুও আমারা সত্য চাই— সত্যে উপনীত হতে চাই।যতই মিথ্যার কারবারে বিভোর হয়ে থাকিনা কেন, মিথ্যাকে সত্য ভেবে নিয়ে— যতই মাতামাতি করিনা কেন, সত্যই আমাদের অন্তিম লক্ষ্য।সজাগ-সচেতনভাবে সবকিছুকে আপাত-সত্য ধরে নিয়েও, সেই সত্যের হাত ধরেই পরম সত্যে পৌঁছাতে চাই আমরা। আসলে, সত্য না চেয়ে যে আমাদের কোনো উপায় নেই! সত্যলাভের এই চাহিদা যে ‘প্রোগ্রামীং’ রূপে আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত হয়ে আছে। তাই, সত্য লাভ আমাদের জীবনের অন্যতম এক প্রধান চাহিদা।  

"অজ্ঞান-অন্ধত্ব মোহ-মায়া থেকে যত মুক্ত হবে, সত্য তোমার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।" —মহর্ষি মহামানস

সত্যে পৌঁছাতে হলে~

সত্যে পৌঁছাতে হলে, আপাত দৃষ্টিতে প্রতিয়মান: সত্য--- মিথ্যা কোনো পক্ষাবলম্বন করলেই হবে না।  যথাসম্ভব প্রভাব মুক্ত হয়ে, নির্দিষ্ট বিষয় -বস্তুতে একাগ্র চিত্তে পুণঃপুণ ধ‍্যান দিতে হবে, তার অন্তঃস্থিত তথ্য ও তত্ত্বের উন্মোচন ঘটাতে। 

যতক্ষণ না সত্যে উপনীত হচ্ছি, ততক্ষণ কোনো কাল্পনিক বা বিশ্বাস করা সত্যের পক্ষে থাকলে বিপথগামী হবার সম্ভাবনাই অধিক।

নিজেকে জানতে, 'আমি' কে জানতে, আত্ম- ধ‍্যান -ই একমাত্র উপায়। আমার সত‍্যোপলব্ধী, আমার জানা বিবরণ পড়ে বা শুনে, তোমার সম‍্যক জানা হবেনা। আত্ম- উপলব্ধি করতে হলে, তোমাকেও ডুব দিতে হবে তোমার অন্তরের গভীরে।

 

বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের জন্য চাই— সত্যনিষ্ঠা, জ্ঞান অর্জনের তীব্র চাহদা। আর,  সজাগ-সতর্কতার সাথে মনোনিবেশ। আমরা বর্তমানে মানব-চেতন স্তরে অবস্থান করছি। যে মনটির কারণে আমরা নিজেদেরকে 'মানুষ' বলে থাকি, সেই সচেতন মনটি হলো— যুক্তিবাদী মন। আমাদের এই মনটির যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি এখনও। আর যে মনটি অধিকাংশ সময় আমাদেরকে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই অবচেতন মনটি হলো— অজ্ঞান-অন্ধ, আবেগপ্রবণ, অবুঝ মন। এই অবচেতন বা প্রাক-মানবচেতন মনটি জ্ঞান ও যুক্তির ধার ধারে না। সে হলো অন্ধ-বিশ্বাসপ্রবণ মন। সে অন্ধ-আবেগের দ্বারা চালিত হয়। 

জ্ঞান অর্জনের চাহিদা হলো— সচেতন মনের চাহিদা। জ্ঞান অর্জন করতে হলে, তোমাকে যুক্তিবাদী —মুক্তমনা হতে হবে। অবচেতন মনের কুপ্রভাব থেকে যথাসাধ্য মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে তোমাকে। 



সতপ্রেমী হও~ সত‍্যনিষ্ঠ হও



সত্যনিষ্ঠ হয়ে ওঠার একটা সহজ পন্থা হলো--- প্রতিদিন রাত্রে শোবার পূর্বে তোমার সারাদিনের গতিবিধি স্মরণ করা। আত্ম নিরীক্ষণ ও আত্মবিশ্লেষণ। সকাল থেকে রাত অবধি তুমি কি কি করেছো, কাকে কি বলেছো, সমস্ত ঘটনাবলি মনের পর্দায় 'রিভিউ' করতে থাকো। আর অনুসন্ধান করো— তুমি কখন কখন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছো। মিথ্যাচারণ— মিথ্যাকথন— মিথ্যাচিন্তন,  এগুলোর কতটা অত্যাবশ্যক ছিল বিচার করো। আর, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করো, বিশেষ বা মারাত্মক প্রয়োজন না হলে মিথ্যা কথা বলবেনা, মিথ্যাচারী হবে না। 

প্রতিদিন এভাবে অনুশীলন করার পাশাপাশি সর্বদা আত্মসচেতন থাকো, —সতর্ক থাকো। মনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখো। দেখবে, মিথ্যা ছাড়াই তোমার বেশ চলে যাচ্ছে। সত্যাচারণে তুমি অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। তবে সাবধান, সবাই যেন জেনে না যায়,  তুমি সত্যবাদী— সত্যনিষ্ঠ! তাহলে মুশকিলে পড়ে যেতে পারো। অনেকেই এর সুযোগ নিতে পারে। দু-তিন বছর এই ভাবে সত‍্যাশ্রয়ী হয়ে থাকলে, দেখবে, তোমার চিন্তা-ভাবনা— ধারণা এবং তোমার কথা— অনেকাংশে সত্য হয়ে গেছে। ধ‍্যান-যোগ অনুশীলনের সাথে সাথে যদি সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকতে পারো, তাহলে ধ‍্যান-যোগ সাধনায় অনেক ভালো ফল লাভ করতে পারবে।

এবার, এক এক করে দেখতে থাকো, আজ তুমি অন্ধ-আবেগে কি কি কাজ করেছো। কোন কোন কাজগুলো করেছো অন্ধ-বিশ্বাসে। ভুল করেছো কোথায় কখন। অমানবিক কাজ করেছো কোথায় কখন। কখন তুমি বোকামি করেছো, কখন মেজাজ হারিয়ে ফেলেছো। কখন তোমার আচরণ বেঠিক ছিলো। ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চিন্তা ও মনোভাব ছিল কখন কখন। এক এক করে দেখতে থাকো। সজাগ— সতর্ক থাকো, একটাও যেন বাদ না পড়ে যায়। এরপর সংক্ষেপে এক এক করে ক্রমান্বয়ে ডায়েরিতে রোজনামচা লিখে রাখো।

এরপর লক্ষ্য করো, প্রতিদিন একটু একটু করে এদের সংখ্যা কমতেই থাকছে। তুমি ক্রমশই নির্দোষ ও ত্রুটিমুক্ত হয়ে উঠছো। আর সেই সঙ্গে, তোমার জ্ঞান ও চেতনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুমি আস্তে আস্তে আরও ভালো বোধ করছো।

“একজন সত্যপ্রেমী-ই হলো প্রকৃত ঈশ্বরপ্রেমী। ঈশ্বরপ্রেমী হতে চাইলে, সবার আগে সত্যপ্রেমী হও।” 

                                                                                                              —মহর্ষি মহামানস   

বৈপরীত্যময় এই জগৎ

বৈপরীত্য নিয়েই এই জীবন— এই জগৎ। ভিতরে—বাইরে সর্বত্রই বৈপরীত্যের খেলা! আর এই বৈপরীত্যই যত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা —অশান্তির অন্যতম কারণ।

 

যেখানে দ্বন্দ্ব-বিরোধ-বৈপরীত্য যত কম, —সেখানে তত শান্তি। এই শান্তির পরম অবস্থায়— জীবন নেই—জগৎ নেই!

 

সম্পূর্ণ অজ্ঞান-অচেতন অবস্থা থেকে পূর্ণ জ্ঞান— পূর্ণ চেতনার লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই হলো— জীবন। আর মহাজগতের ক্ষেত্রে তা’ হলো— মহাজীবন। এই মহাজগৎ তথা ঈশ্বরও এগিয়ে চলেছে আমাদের মতোই।

এগিয়ে চলার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায়— অসুখ আর অশান্তির অধ্যায়। যত এগিয়ে চলে, ততই বাড়তে থাকে— দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-বিরোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস —বৈপরীত্যের খেলা। আর সেই সাথে বেড়ে চলে— দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা —অশান্তি, সুখ-অসুখের পালা। 

 

বিকাশমান চেতনা পথের মধ্যবর্তী অনেকটা জায়গা জুড়ে এই বৈপরীত্য— এই অশান্তির চরম অবস্থা চলে। এই চরম দুরাবস্থায় একটু শান্তির জন্য— একটু উপশমের জন্য প্রাণ ছটফট ক’রে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু কে দেবে উপশম— সাধ্য নেই কারো! আর দিলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ব-বিরোধীতা— বৈপরীত্যের কারণে তা’ গ্রাহ্য হয়না তখন!  

 

অনেকটা দুঃসহ কষ্টের পথ অতিক্রম করার পরে— ক্রমশ জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে— একটু একটু ক’রে দ্বিধা-দ্বন্দ বৈপরীত্যভাব ও সেইসাথে অশান্তিও কমতে থাকে। অতঃপর লক্ষ্যে পৌঁছে— পরম শান্তিতে উপনীত হবার সাথে সাথেই জীবনলীলা শেষ— জগৎ তথা মহাজীবনও বিলীন হয়ে যায় তখন।   

প্রসঙ্গঃ মানবসেবা ও মানবধর্ম

মানুষের সেবা করা— মানুষের উপকার করা— মানুষকে সাহায্য করা— এ’ হলো মানুষের অন্যতম কর্তব্যকর্ম। পরস্পর সহযোগিতার মধ্য দিয়েই মানুষ আজ এতটা উন্নত জীব হতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ আরো অনেক বেশি উন্নত হতে পারতো— আরো অনেক এগিয়ে যেতে পারতো, যদি তাদের কারো কারো মধ্যে অসহযোগিতা— হিংসা-বিদ্বেষ-শত্রুতার অজ্ঞান-অসুস্থ মনোভাব না থাকতো। মানুষের এই আত্ম-ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিই— মানুষের অধিকাংশ সংকটের মূল কারণ।

নিজেদের স্বার্থেই—এই সংকট থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে আমাদের। বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে— একজন মানুষ হিসাবে তুমি যে সুযোগ-সুবিধা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য— অধিকার প্রভৃতি ভোগ বা উপভোগ করছো, —সে সবের পিছনে রয়েছে অজস্র মানুষের অবদান। এ’ সমস্ত শুধু ভোগ করলেই চলবেনা, তোমাকে তোমার পরিবার ছাড়াও— অপরাপর মানুষের জন্যেও যথাসাধ্য দিয়ে যেতে বা ক’রে যেতে হবে। তবেই মানবজাতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব হবে। আর, এ’ ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে তোমাকে।

আমাদের চারিপাশে অনেক মানুষকেই বিভিন্ন প্রকারের সেবা ও সহযোগিতামূলক মহতী উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। এ’ সবেরই প্রয়োজন আছে। তবে, এর পাশাপাশি— এও ভাবতে হবে, কোন্‌ সেবা— কোন্‌ সময়ে— কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং কোন্‌ সেবার দ্বারা মানুষ কতটা উপকৃত হবে— লাভবান হবে, আর সেই উপকারের স্থায়ীত্ব কালই বা কত।

এছাড়াও, ভেবে দেখতে হবে, কী মনোভাব নিয়ে সেই সেবাকর্ম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। —তা’ কী মানুষ হিসাবে তার দায়ীত্ব— কর্তব্য কর্ম, নাকি— তার পিছনে কোন ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য অথবা সরাসরি কিছু পাওয়ার আশা আছে?!

বিভিন্ন ধরণের উপকার বা লাভের স্থায়ীত্বকাল— বিভিন্নরূপ হয়ে থাকে। তা’ কয়েক ঘন্টারও হতে পারে, আবার কয়েক দিন— অথবা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছরও হতে পারে। আবার, সর্বদা শুধু সময় দিয়েই তার বিচার করা যাবেনা। অনেক ক্ষেত্রে স্বল্প সময়কাল স্থায়ী সেবারও গুরুত্ব অপরিসীম হতে পারে।


ছোট—বড়, স্বল্পকালীন—দীর্ঘকালীন সেবা এবং স্বল্পস্থায়ী—দীর্ঘস্থায়ী উপকার— এ’ সবেরই প্রয়োজন আছে। তবে দেখতে হবে, সেই সেবার নামে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি অথবা ধর্মীয় দান— ভিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষকে ভিখারী বানানো হচ্ছে কি না, —ভিখারীসুলভ মনোভাব গ’ড়ে তোলা হচ্ছে কি না!

 

প্রকৃত সেবা— মানুষের আপৎকালীন সাহায্য ছাড়াও, মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে—, দেহ-মনে সুস্থ—সমর্থ, জ্ঞান ও চেতনায় সমৃদ্ধ ক’রে তুলে’ তা’কে যথেষ্ট বিকশিত মানুষ— আত্ম-জ্ঞানী মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এ-ই হলো চিরস্থায়ি সেবা।


মানুষের অধিকাংশ দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা ও সমস্যার মূলে আছে যে জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতা এবং শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, সেই মৌলিক অভাবকে দূর করতে, কেউ যদি যুক্তিসম্মত—কার্যকর পথে অগ্রসর হয়— সে-ই হবে সবচাইতে বড় মানবসেবা!


অনেকে মানবসেবাকেই একমাত্র মানবধর্ম বলে, জানেন। কিন্তু মানবসেবা হলো মানবধর্মের দ্বিতীয়অংশ। মানবসেবা করে যে জন, তার আত্ম-বিকাশ নাও ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু, একজন বিকশিত মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই মানবসেবা ক'রে থাকে। শত বছর ধরে কেউ (কোনো আদর্শ বা ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ) মানব সেবা করলেও তার যথেষ্ট মনোবিকাশ বা আত্মবিকাশ নাও ঘটতে পারে।

মানব সেবার পিছনে...
প্রথমে, আমাদের বুঝতে হবে, একজন মানুষ কি কি কারণে মানব সেবায় ব্রতী হতে পারে!

১। সে কোনো আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা প্রোগ্রামড হয়ে বা চালিত হয়ে এ কাজ করতে পারে।

২। কোনো ধর্মের, ব্যক্তির,পারিবারিক এবং/অথবা সামাজিক চাপ, রাজা বা রাজনৈতিক চাপ দ্বারা চালিত হয়ে বা প্রোগ্রামড হয়ে সে এ কাজ করতে পারে।

৩। কারো দ্বারা কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, সে মনের নির্দেশ বা তাড়না বা আবেগ থেকে সহমর্মী— সমব্যাথি হয়ে, এ কাজ করতে পারে।

৪। একজন বিকশিতমানুষ— সে সব মানুষ তথা সমস্ত জীবের সাথে একাত্ম বোধ ক’রে, নিজের স্বার্থ ভেবেই মানব তথা জীব সেবায় ব্রতী হতে পারে!

৫। একজন ব্যক্তি কোনো এক বা একাধিক জীবের সাথে একাত্ম বোধ ক’রে, সে ঐ এক বা একাধিক জীবের সেবায় ব্রতী হতে পারে। কিন্তু মানবসেবায় তার আগ্রহ নাও থাকতে পারে।

৬। কোনো ব্যক্তি সংস্কার (প্রোগ্রামিং) বশতঃ পূণ্যলাভের উদ্দেশে, ঈশ্বর বা দেবতাকে খুশি করার উদ্দেশে, এরদ্বারা লাভবান হওয়ার উদ্দেশে— মানব সেবায় ব্রতী হতে পারে!

এখানে ৩য় শ্রেণীরব্যক্তিগণ কিছুটা বিকশিত। আর ৪র্থ শ্রেণীর ব্যক্তিগণ অনেকটাই বিকশিত। বাকি অন্যান্য শ্রেণীর ব্যক্তিগণ তেমন বিকশিত নয়। বিভিন্ন কর্মের মধ্য দিয়ে—জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যেমন দীর্ঘ সময় ধরে— একটু একটু করে বিকশিত হয়ে থাকি, এরাও সেইভাবে ‘মানব সেবা’ কর্মের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে বিকাশলাভ করতে থাকবে। তবে, মানুষের অসদাচরণ, অকৃতজ্ঞতা, বিরোধীতা, শত্রুতা প্রভৃতির দ্বারা পীড়িত হয়ে, এরা কিছু বেশি জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভে সক্ষম হতে পারে।

কিন্তু, যে ব্যক্তি সরাসরি বিকাশলাভের পাঠ নিয়ে নিয়মিত তা’ অনুশীলন করবে, সে ঐ সময়ের মধ্যে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি বিকাশলাভে সক্ষম হবে।

একজন যথেষ্ট বিকশিত ব্যক্তি আর একজন স্বল্প বিকশিত ব্যক্তির 'মানবসেবা'-র মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সাধারণত, একজন স্বল্প বিকশিত ব্যক্তি, মানুষের আপাত প্রয়োজন— সাময়িক সমস্যা মেটাতে সাহায্য ক'রে থাকে। আর, একজন যথেষ্ট বিকশিত ব্যক্তি, —মানুষের স্থায়ী অভাব—মূলগত অভাব মেটাতে সাহায্য ক'রে থাকে। যাতে ক'রে সেই সাহায্য প্রাপ্ত মানুষটি সাবলম্বি হয়ে নিজেই নিজের এবং অপরাপরের অভাব ও সমস্যা মেটাতে সক্ষম হয়। তবে, উভয়েরই প্রয়োজন আছে।


মানব সেবা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দুঃখ-কষ্ট-অশান্তিকর ঘটনা ঘটতে পারে, তখন তাকে কে কীভাবে গ্রহন করবে, তা' সেবক ব্যক্তির জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনাসহ শারীরিক-মানসিক এবং অন্যান্য অবস্থার উপর নির্ভর করে।

মানবসেবা মানব বিকাশের প্রধান পথ হতে পারে না। জীবনের সীমিত আয়ুষ্কালের মধ্যে যথেষ্ট বিকাশলাভ করতে হলে, সুপরিকল্পিত—প্রণালীবদ্ধ পথে অগ্রসর হতে হবে। মানবসেবা তার অনুপূরক হতে পারে।

 

 

ঈশ্বরের সেবা--- ঈশ্বরকে খুশি করতে মানুষের সেবা করা, এগুলো আমাদের সমাজে বহু প্রচলিত--- বহুশ্রুত কথা। সেবা পাওয়া এবং সেবা দেওয়া--- এসবই হলো মানুষী চাহিদা--- মানুষী চিন্তা। মানুষের তৈরি ঈশ্বর, ---সেও যে সেই মানুষের মতই চাহিদা ও ভাবনা সম্পন্ন হবে, এতে আর আশ্চর্যের কী। তাই, তাদের ঈশ্বরও মানুষের কাছে--- মানুষের মতোই সেবা ও পূজা চেয়ে থাকে।

এখন, প্রকৃত ঈশ্বরের সন্ধান যার জানা নেই, জানার চেষ্টাও নেই, তার পক্ষে এই স্বরচিত অথবা অন্য কারো দ্বারা রচিত ঈশ্বরকে নিয়েই মেতে থাকা ছাড়া উপায় কী।


আর সেক্ষেত্রে, প্রকৃত ঈশ্বরের পক্ষে মানুষের কাছ হতে সেবা বা পূজা পাওয়ার চাহিদা থাকাটা আদৌ সম্ভব কি না, তা' তলিয়ে ভাবারই বা অবকাশ কোথায়!

মানুষের সেবা কর্মকে খুব মহৎ কর্ম হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু তা' যদি কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য এবং তাকে খুশি ক'রে কিছু লাভ করার জন্য সম্পাদিত হয়ে থাকে, তাহলে তখন তা' আর মহৎ কর্ম হিসেবে গণ্য হয়না।

মানবত্ব লাভের পরে, সমস্ত মানুষকে যখন নিজেরই অংশ মনে ক'রে ভালবাসতে পারবে, এবং নিজের সেবার্থেই মানুষের সেবা করতে পারবে, একমাত্র তখনই সাধিত হবে প্রকৃত মানবসেবা। তাই প্রকৃত মানব সেবার জন্য তোমাকে মানবত্ব লাভ করতে হবে অর্থাৎ যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হয়ে উঠতে হবে সবার আগে।

প্রসঙ্গ: পাপ

বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) কাছে~ তোমার কর্মের জন্য তুমি দায়ী নও। তুমি যা করো তা জাগতিক ব‍্যবস্থা দ্বারা করিত হও বা করতে বাধ্য হও। এখানে পাপ -পূণ্য বলে কিছু নেই।

এখানে, এই মনুষ্য সমাজে, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বা বিচারে এবং আইনে কোনো ব‍্যক্তি তার কোনো কোনো কর্মের জন্য অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, এবং শাস্তি পেতে পারে। কিন্তু বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর) ও জাগতিক ব‍্যবস্থার কাছে সেই ব‍্যক্তি অপরাধী বা পাপী রূপে পরিগণিত হয়না, আর কোনো শাস্তিও পায়না।

কে কাকে কেন শাস্তি দেবে!? মানুষ হলো এই জগতের— এই জাগতিক ব‍্যবস্থারই একটা অংশ। মানুষের ক‍র্মও এই জাগতিক কর্মকাণ্ডেরই একটা অংশ। আমি যা চিন্তা করছি, যে কর্ম ক‍রছি, সবকিছুই এই জাগতিক ব‍্যবস্থা আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। আমি হলাম বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) তৈরী ক্রীড়নক পুতুলের মতো। একথা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

'পাপ' কথাটা এবং পাপের শাস্তি— এই ব‍্যাপারটা প্রচলিত ধর্মের অবদান। তারা তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য— শাস্তি -পুরষ্কার এবং পাপ -পূণ্য প্রভৃতি সৃষ্টি করেছে।

এখানে মানব ধ‍র্ম— মহাধ‍র্ম -এর আলোচনায় অন্য কোনো ধর্মের প্রসঙ্গ আনলে হবে না। নিজস্ব জ্ঞান -বুদ্ধি, বিচার- বিবেচনা ও যুক্তি দিয়ে কথা বলবে, এটাই আশা করবো।

 যোগ রহস্য 
 

'যোগ' কথাটির অর্থ হলো মিলন বা যুক্ত হওয়া। যেমন, এক আর এক মিলে দুই হয়। কিন্তু অতি উচ্চস্তরের 'যোগ'-এ, এক আর এক মিলে 'এক' হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দুটি অস্তিত্ব মিলেমিশে একাত্ম বা একাকার হয়ে যায়। আসলে, 'যোগ' হলো কোনকিছুর সঙ্গে মানসিক সংযোগ স্থাপনের এক মনস্তাত্বিক পদ্ধতি।

ব্যবহারিক 'যোগ'-এ, 'যোগ' কথাটি ওই 'এক' হওয়ার উপায় বা পথ বা পদ্ধতি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাকার না হয়ে, নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই যতটা সম্ভব যুক্ত হওয়ার চেষ্টা থাকে। ব্যক্তিবিশেষের চাহিদা অনুসারে এটা ঘটে থাকে। যেমন, শরীর ও মনের যোগ, সচেতন-মন এবং অবচেতন-মনের যোগ, একজনের মনের সঙ্গে অপরজনের মনের যোগ। এছাড়াও ব‍্যক্তি-মনের সঙ্গে ঈশ্বর মনের যোগ ঘটানোর চাহিদাও থাকে অনেকের মধ্যে। এইরূপে নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখেই যোগ-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, একজনের চাহিদামতো কোনো কিছুর সঙ্গে মিলিত হবার একটি সক্রিয় উদ্যোগ-ই হলো, যোগ-প্রক্রিয়া বা যোগাভ্যাস, বা যোগ সাধনা। ধ‍্যানী ও ধ‍্যেয় বিষয়বস্তুর মধ্যে সঠিক ভাবে যোগ কার্যটি সংঘটিত হলে, যোগীর ধ‍্যেয় বিষয়-বস্তুটির অন্তর্নিহিত সত্যটি যোগীর নিকট উদঘাটিত হয় বা প্রকাশ লাভ করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলনের জন্যেই মিলন নয়, সত্য লাভ বা সত্য উদঘাটন-ই হলো যোগের মূল লক্ষ্য। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে অধিকাংশ গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পিছনেও থাকে এই যোগ। এখানেই যোগসাধনার সাফল্য।

এখানে আমরা যোগ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করি, উদাহরণস্বরূপ - আমি বলছি এবং তুমি শুনছো, এটিও আমাদের কাছে 'যোগ'। জীবন হ'ল যোগের একটি কোর্স, ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে যেমন, মহাজাগতিক জীবনের ক্ষেত্রেও তেমনি। জীবনের মূল লক্ষ্য হ'ল আত্ম-বিকাশ। আমরা একই পথের পথিক, বিকাশমান চেতনার পথ। অস্ফূট-চেতন স্তর থেকে ক্রমাগত বিকাশের মাধ্যমে— পূর্ণবিকাশের লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই হলো –মহাযোগ প্রক্রিয়া।

এই বিকাশ কাজটি ঘটে থাকে— বিভিন্ন বোধগম্য শক্তি ও বস্তু, তথ্য ও তত্ত্ব, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন ধারণাগুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এবং আনন্দ উপভোগের মাধ্যমে।

আমরা এখানে এক শিক্ষামূলক সফরে এসেছি। ধীরে ধীরে উচ্চ থেকে উচ্চতর চেতনা অর্জন করাই হলো এই মানব জীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এখানে, আমরা যত বেশি জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা- অর্জনের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হতে পারবো, ততই আমরা উপকৃত হব। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেই সময় যখন আমরা এখান থেকে চলে যাব— চেতনা ব্যতীত কিছুই আমাদের সাথে যাবে না।

আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞানে, আমাদের এই মন ক্রমবিকশমান পদ্ম ফুলের মতো। এই মন-পদ্মগুলিতে বেশ কয়েকটি বৃত্ত বা স্তর রয়েছে, প্রত্যেকটি স্তর কয়েকটি পাপড়ি দ্বারা গঠিত। পাপড়িগুলির বিভিন্ন স্তর বা বৃত্তগুলি হ'ল চেতনার বিভিন্ন চেতন-স্তর বা চেতন মনের বিভিন্ন পর্যায়। পদ্মের পাঁপড়ির মতোই, ক্রমশ ধীরে ধীরে মনোপদ্মের বিভিন্ন চেতন-স্তরের পাপড়িগুলি একের পর এক প্রস্ফুটিত হয়, এবং শেষ পর্যায়ে পূর্ণ বিকশিত বা প্রস্ফুটিত হইয়ে থাকে।  

এখন, আমাদের অবচেতন মন প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুষ্পিত বা বিকশিত হয়েছে, এবং সচেতন মন ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। বিকাশমান চেতনার এই পথে, বর্তমানে আমাদের জীবনের লক্ষ্য হ'ল সম্পূর্ণরূপে বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা। এইভাবে, বিকাশমান চেতনার পথে, একসময় আমরা পূর্ণ বিকাশ লাভ করব।

আসলে, ব্যবহারিক যোগ হলো— মূলত সেলফ-প্রোগ্রামিংয়ের এক মানসিক কৌশল বিশেষ। চিকিৎসামূলক ‘যোগ’ হলো— অবচেতন মনের সাহায্যে নিরাময় ঘটানোর প্রক্রিয়া, এবং সাধারণ ভাবাবেশমূলক ধ্যান-যোগ বা ‘মেডিটেশন যোগা’ হ'ল এক ধরণের স্ব-সম্মোহন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ যোগের ভিত্তি হ'ল মনের বিজ্ঞান। যোগের মূল বিষয় হলো— অবচেতন মনের সহায়তায় কোনো একটি বিষয়ে সাফল্য অর্জন করা অথবা লাভবান হওয়া। এই সাফল্য পেতে, যোগ অভ্যাসকারীর বিশ্বাস এবং মনের একাগ্রতা প্রয়োজন।

মানব-কল্যাণে অবচেতন মনের আশ্চর্য শক্তিকে ব্যবহার করার যোগ পদ্ধতিগুলি প্রাচীন ঋষিগণ উদ্ভাবন করেছিলেন। এমনকি এই সময়েও, কিছু মানুষ শান্তি ও সুস্থতার লাভের জন্য বিভিন্ন যোগ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন আবিষ্কার করে চলেছেন।

এই জগৎ ও আমরা


এই জগতে— এখানে, যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে। জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে আমরা জানতে পারি না, কখন কি ঘটবে। তাই, সবসময় সর্বপ্রকার ঘটনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকলে, যা-ই ঘটুক না কেন— বিশেষ মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হবে না। 

এটাই হবে, অথবা এটা হতেই হবে, বা পেতেই হবে—, এই রকম অন্ধ-আবেগ বা অন্ধ-বিশ্বাসের ফলে মানুষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

এখানে যখন যা হবার, তা-ই হয়। সবই পূর্ব নির্ধারিত ('মহা-সৃষ্টি-রহস্য উন্মোচন' প্রবন্ধের মধ্যে 'ভাগ্য' আসলে কী তা' জানো)। 

তাই, কোনো কিছু আশা করলেও, মনে রাখতে হবে— আশা মতো কিছু নাও ঘটতে পারে। আশা মতো কিছু না ঘটলে, —আমি যেন ভেঙে না পড়ি। আগের থেকেই   —এইরূপ স্ব- অভিভাবন বা সেল্ফ- প্রোগ্রামিং করা থাকলে, বিশেষ কোনো সমস্যা দেখা দেবে না।
 
 
 
তুমি আর জাগতিক ঘটনাপ্রবাহ
 

তুমি যা ভাবছো— যা করছো, তার পিছনে রয়েছে অসংখ্য ঘটনা। কোটি কোটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় আরো কোটি কোটি ঘটনা। আবার, সেইসব ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় আরো অজস্র ঘটনা। এইরূপে, পরম্পরাগতভাবে— বর্তমানে জন্ম নেওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি হলো— তোমার চিন্তা, আরেকটি— তোমার কর্ম।
 
এদের থেকে আবার জন্ম নেবে অজস্র ঘটনা। এই ভাবেই বয়ে চলেছে— ঘটনা প্রবাহ।
 
তোমার চিন্তা— তোমার কর্ম— বর্তমান ও অতীতের অসংখ্য ঘটনার সাথে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত, এবং অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অজস্র ক্রিয়া-বিক্রিয়ার-প্রতিক্রিয়ার ফল। তুমি— তোমার অস্তিত্ব— তোমার কর্ম, সব কিছুই এই জাগতিক ব্যবস্থার ফসল।

 প্রসঙ্গ : স্বাধীনতা 

 

স্বাধীনতা হলো নিজের ইচ্ছামতো চলতে পারা বা কাজ করতে পারার সক্ষমতা।

 

স্বাধীনতার বিপরীত শব্দ— 'পরাধীনতা'-র মানে, সবসময় শুধুমাত্র কোনো এক বা একাধিক মানুষের অধীনতা অথবা কিছু মানুষের দ্বারা তৈরি কোনো ব‍্যবস্থা বা সিস্টেমের অধীনতাই নয়। আমরা জীব মাত্রই কেউ পুরোপুরি স্বাধীন নই। আমরা প্রত‍্যেকেই কম-বেশি— নিজের নিজের শারীরিক-মানসিক গঠন ও ব‍্যবস্থা, মানুষ, সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং রাস্ট্রীয় ব‍্যবস্থা, প্রকৃতি এবং ঘটনাচক্র প্রভৃতির অধীন।

 

যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অভাবে আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারিনা, এবং নানাবিধ বাধা-বিঘ্ন— প্রতিকূলতা থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় খুঁজে পাইনা, মুক্ত হতে সমর্থ হইনা।

 

অজ্ঞান-অন্ধত্ব —বোধহীনতার কারণে, তাই রোগ-ব‍্যাধি থেকে মুক্তি, মোহ-মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে মুক্তি এবং ঘটনাচক্র থেকে মুক্তি আমাদের কাছে অধিকাংশ সময়েই অধরা থেকে যায়।

 

আবার, কখনো কখনো উপায় জেনেও, তা' কার্যকর করে উঠতে পারিনা, সেই অজ্ঞান-অন্ধত্ব, চেতনাহীনতা বা বোধহীনতার কারণেই।

স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে— সবকিছুই মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। বহু মানুষই স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হয়ে ওঠেনি এখনও। সবার আগে তাদের স্বাধীনতা লাভের যোগ্য ক'রে তুলতে হবে।

 

অজ্ঞান-অন্ধ মানুষের তো অনেক কিছুই ইচ্ছা করে। সেইসব ইচ্ছাগুলো কার্যকর হলে, তা' তাদের পক্ষে--- মানবজাতির পক্ষে হানিকর হবে কিনা, তা' যুক্তি-বিজ্ঞানসহ বিচার ক'রে দেখতে হবে, এবং যা উচিত মনে হবে— তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

 

ধর্মীয় বিধান— মানেই, তার সব পরিত‍্যাজ‍্য এবং সব অগ্রাহ্য করতে হবে, এমন নয়। তার মধ‍্যেও কিছু ভালো, কিছু সত্য রয়েছে। যেখানে যতটুকু মণি-মুক্ত পাওয়া যাবে, সেটুকু গ্রহন ক'রে, বাকী আবর্জনা যা আছে, তাকে পরিত্যাগ করতে হবে আমাদের।

 

 

আমরা ক্রমবিকাশমান প্রগতিশীল মানুষ। চিরসত‍্য— পরমসত‍্য এখনও আমাদের কাছে অধরা রয়েছে। কোনো কিছুকে চিরসত‍্য বা শেষ কথা ভেবে, তাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে, আমাদের বিকাশ— অগ্রগতি থমকে যাবে।

 

আপাত বিচারে যা সঠিক মনে হচ্ছে, পরবর্তী কালে তা-ই আবার বেঠিক মনে হতে পারে। তখন আবার নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ ক'রে —তখনকার হিসাবে যা সঠিক মনে হবে, তাকেই গ্রহন করতে হবে আমাদের। এই ভাবেই আপাত সত‍্যের হাত ধরে, পরম সত‍্যের লক্ষ্য পানে এগিয়ে যাওয়াই হলো প্রগতিশীল জীবন।

প্রসঙ্গ : মুক্তি

একবার মানব-অস্তিত্ব লাভ করার পর, পূর্ণ চেতনা— পূর্ণ মনোবিকাশ লাভ না হওয়া অবধি তোমার মুক্তি নেই। তাই, মুক্তি যদি পেতেই চাও, আন্তরিকভাবে— অজ্ঞানতা থেকে, অচেতনতা থেকে মুক্তি চাও। কারো মিথ্যা প্রলোভনে— প্রবঞ্চনাপূর্ণ বুজরুকীতে ভুলে বিপথগামী না হয়ে, জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য যত্নবান হও। সঠিক পথ অবলম্বন করে চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে এগিয়ে যাও।

 

‘মুক্তি চাই— মুক্তি চাই’ বলে, লক্ষ লক্ষ বার প্রার্থনা করলেও রেহাই নেই। তোমাকে মুক্তি দেবার ক্ষমতা নেই কারও। পূর্ণ জ্ঞান ও চেতনা লাভ হলে, তবেই তুমি মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করবে। তার আগে নয়।

 

পূর্ণ চেতনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে— এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকে। এই মানব জীবনেই পূর্ণ চেতনা লাভ সম্ভব নয়। মানব-চেতন-স্তরের পরে রয়েছে আরও কয়েকটি চেতন-স্তর। সবকটি চেতন-স্তর পার হয়ে— তবেই ঘটবে পূর্ণ চেতনা লাভ— ঘটবে মুক্তি।

শুধু 'আমি মুক্ত--- আমি মুক্ত' বলে, স্ব-অভিভাবনের সাহায্যে তুমি মুক্ত হতে পারবে না। মুক্ত হবার আন্তরিক ইচ্ছাসহ যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য সঠিক পথে অগ্রসর হতে হবে তোমাকে।

 

সবার আগে বুঝতে হবে, মুক্ত--- কীসের থেকে মুক্ত, কেন মুক্ত! মুক্ত, স্বাধীনতা লাভের জন্য, আরও ভালো জীবন লাভের জন্য, দুঃখ-কষ্ট থেকে অনেকাংশে মুক্ত হবার জন্য--- অজ্ঞানতা— অন্ধত্ব থেকে মুক্ত!

'মোহ-মায়া' ব'লে, বাইরের কোনো জিনিস বা প্রভাব নেই। মোহ-মায়ার উৎপত্তি হয় অজ্ঞানতা --অন্ধত্ব --স্বল্প-চেতনা থেকে। এ সমস্তই তোমার ভিতরের ব‍্যাপার, তোমার মনের ব‍্যাপার।

আরেকটি কথা, এই জগতে জীবদেহ ধারণ ক'রে, কেউই সম্পূর্ণ মুক্ত নয়, মুক্ত হতে পারে না। আর তাই কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তবে, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা লাভ করতে পারলে, তুমি অনেকাংশে মুক্ত হতে পারবে, এবং অনেকটাই স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে। যে যত জ্ঞানী— সে তত স্বাধীন।

জ্ঞান-অভিজ্ঞতাই আমাদের মধ্যে চেতনার জন্ম দেয়। আবার, চেতনা আমাদেরকে আরও বেশি জ্ঞান লাভে সমর্থ করে তোলে।

নিম্ন চেতন স্তরে— কিছু কিছু ভ্রমাত্মক বা মায়াত্মক জ্ঞান বা বিশ্বাস আমাদেরকে বদ্ধ করে তোলে। ক্রমশ উচ্চ চেতনা লাভের সাথে সাথে অর্জিত বিশুদ্ধ জ্ঞান— আমাদেরকে ক্রমোচ্চ চেতনা লাভে সহায়তা করে, এবং ক্রমশ আমাদেরকে অজ্ঞানতা ও অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করে তোলে। ফলস্বরূপ আমার আরও ভালো, আরও উন্নত জীবন লাভ করি।

মুক্তি চাই... জ্বালা জুরাইতে চাই...

জীব-অস্তিত্ব লাভ করার সাথে সাথেই জ্বালা-যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায়। সচেতন মনের জীব— মানুষের ক্ষেত্রে এই জ্বালা-যন্ত্রনা বহুগুণ বেশি। আর এই জ্বালা-যন্ত্রনা ভোগের মধ্য দিয়েই ক্রমশ জ্ঞান ও চেতনা লাভ করে থাকে সে। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনা লাভ না হওয়া অবধি— এই জ্বালা-যন্ত্রনা থেকে মানুষের মুক্তি নেই।


প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ এই জ্বালা-যন্ত্রনা ভুলে থাকার, অথবা তা’ এড়িয়ে থাকার অনেক উপায় আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তা’ নিতান্তই সাময়ীক উপশমদায়ক ব্যবস্থা। স্থায়ী 'রেমেডি' নয়। জ্বালা-যন্ত্রনা ভুলতে গিয়ে, এড়িয়ে চলতে গিয়ে— অনেক সময় আরো জ্বালা-যন্ত্রনা বেড়ে যায়। তারফলে সে আরও জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

প্রত্যেকের মুখে একটাই প্রশ্ন— মুক্তি! জাগতিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা হতে মুক্তি পাবার কি কোনো পথই নেই! অনেকেই অনেক কথা বলেছে, বলছে— বলবে। আমি শুধু এইটুকুই জানি, নির্ধারিত ভোগ কেউ খন্ডাতে পারে না। দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা, জ্বালা-যন্ত্রনা, শোক-সমস্যা-হতাশায় আঘাতে আঘাতে জর্জরিত— জড়বৎ মনে তিলে তিলে চেতনার সঞ্চার করাই ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থার কর্ম পদ্ধতি। সে কষ্টই যদি না থাকবে, তো চেতনা আসবে কোন পথে!

আকরিক লৌহপিন্ডকে পুড়িয়ে—পিটিয়ে, নানাবিধ শোধনের পর ঘষে-মেজে জাগানো হয় তার ঔজ্বল্য— তার শাশ্বত রূপ।

প্রসঙ্গ স্বার্থ
 

 

স্বার্থই এ জগতের মূল কারণ
 

হ‍্যাঁ, প্রকৃত অর্থে— স্বার্থই এই জগতের মূল কারণ। আমাদের চেতনার স্তর ভেদে, এবং সুস্থতা-অসুস্থতার অবস্থাভেদে— এই স্বার্থের অনেক প্রকারভেদ ঘটতে পারে। কিন্তু সে যা-ই হোক, মূলতঃ তা' স্বার্থ-ই। স্বার্থ হলো— নিজের সুবিধা, প্রয়োজন, মঙ্গল, তৃপ্তি—সুখ, লাভ, ভালোলাগা, এবং নিজের প্রতি ভালোবাসা। এবং তার জন্যই যাবতীয় কামনা-বাসনা— চাহিদা, অভিলাষ, স্পৃহা, অনুরাগ-প্রেম, আকর্ষণ, কর্মেচ্ছা প্রভৃতি। স্বার্থ অনেক সময় স্পষ্ট নাও হতে পারে। তা' আমাদের জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে— ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ভাবে কাজ করে থাকে।

এই জগতের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো ইচ্ছাশক্তি। আমাদের শরীর ও মনের মতই, এই জগতও ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক— উভয় প্রকার শক্তির সমন্বয়ে চালিত হলেও, এসবের পিছনে আছে আদি ইচ্ছাশক্তি। আবার, এই ইচ্ছা চালিত হয় মূলত স্বার্থের তাগিদে। 'সুখ ও শান্তি' প্রসঙ্গে বলেছি, প্রধানত সুখ লাভের চাহিদার জন্যই সমস্ত সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এই সুখ লাভের চাহিদাতো আসলে স্বার্থ-ই।

অনেক ভাববাদীগণ হয়তো বলবেন, প্রেম-ই সমস্ত জগৎ-সংসারের মূল কারণ। কিন্তু, এই প্রেমের মূলে আছে নিজের প্রতি প্রেম —নিজেকে ভালোবাসা। তার ভিত্তিতেই, পরবর্তীতে আসে অন্যান্য বিষয়বস্তু ও ব্যক্তি তে প্রেম। যাকিছু নিজের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটায়, স্বার্থ পূরণ করে, যাকিছু নিজেকে তৃপ্ত করে— সুখী করে। এবং যার মধ্যে নিজের ছায়া বা সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তাদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা জন্মায়। সব প্রেমের মূলেই আছে স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া প্রেম হয় না।

অবস্থাভেদে, এই 'স্বার্থ' সূক্ষ্ম হতে পারে, এমনকি আপাত দৃষ্টিতে দৃশ্যমান নাও হতে পারে। আবার এই 'স্বার্থ' স্থুল বা পার্থিব-ও হতে পারে। প্রকৃতি ভেদে, কেউ নিজ স্বার্থের জন্য অপরের ক্ষতি করতে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। কেউবা অপরের লাভ-ক্ষতির কথা কিছুই ভাবে না, শুধু নিজের স্বার্থটাই বোঝে। কেউ আবার দেশের ও দশের স্বার্থকেই নিজের স্বার্থ মনে করে থাকেন। আর তাই তিনি অপরের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে নিজের স্বার্থ পূরণের অনিচ্ছুক। আবার কোটি হলেও, উচ্চ চেতনাসম্পন্ন এমন মানুষও আছেন, যাঁঁরা সবকিছুর সাথে একাত্ম বোধ করে থাকেন।

স্বল্প-জ্ঞান ও স্বল্প-চেতনার কারণে, কারো স্বার্থবোধ —স্বার্থ চিন্তা এবং কর্মে তার প্রতিফলন— এক প্রকারের হয়। আর উচ্চ চেতনাসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের স্বার্থচিন্তা এবং তার কর্ম হয় আর এক প্রকারের। স্বার্থচিন্তা ছাড়া যাদের এক মুহূর্তও চলে না, তাদের কেউ যদি 'স্বার্থ' কথাটি ব্যবহারে শুচিবায়ুতা দেখায়, তা' আসলে ভাবের ঘরে চুরি করাই বোঝায়। এ'ভাবে আর কতদিন চলবে, এবার সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে! যথেষ্ট চেতনার অভাবে, উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে— মানুষ নিজের স্বার্থটাই ঠিকমতো বুঝতে শেখেনি এখনো। তাই সে আত্ম-ধ্বংসাত্মক— স্বার্থবিরোধী কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

আদিসত্তা —পরমাত্মা এবং বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের এই জগত সৃজন লীলার পিছনেও আছে— স্বার্থ। আত্মজিজ্ঞাসা, আত্ম-অন্বেষণ, আত্মবিকাশ —এসবই স্বার্থ সম্পর্কিত। ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তার অংশরূপে আমাদের মধ্যেও ঈশ্বরের গুণ বর্তমান। আমরা এখন যে চেতন-স্তর গুলিতে অবস্থান করছি, বিশ্বাত্মা অর্থাৎ ঈশ্বরও তার শৈশব ও কৈশোরের বিভিন্ন সময় এই চেতন-স্তরগুলিতে অবস্থান করেছে (সৃষ্টিতত্ত্ব দ্রষ্টব্য)। সেই সময়, ঈশ্বরের চাহিদা— স্বার্থচিন্তাও প্রায় আমাদের অনুরূপ ছিল। চেতনার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর এখন অনেক উচ্চচেতন-স্তরে উপনীত হয়েছে। এখনকার চেতনা সাপেক্ষে তার স্বার্থচিন্তাও তদনুরূপ।

স্বার্থরক্ষা হলে— চাহিদামতো প্রাপ্তি ঘটলে, তার পরিণতিতে আমাদের মনের মধ্যে 'সুখ' নামক এক ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। —যা আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত নির্দেশ বা (কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতো) 'প্রোগ্রাম' অনুযায়ী আমাদের কাছে অত্যন্ত কাম্য বলে বোধ হয়ে থাকে। তাই, স্বার্থরক্ষা যেমন আমাদের কাছে অভিষ্ট, তেমনি স্বার্থরক্ষার অন্তিম ফলস্বরূপ— লব্ধ 'সুখ'-ও আমাদের কাছে অভীষ্ট হয়ে থাকে।

এখন, বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ সম্বন্ধীয় বিষয়ের মধ্যে— সুখ-ও একটি স্বার্থ। আবার, অন্যান্য স্বার্থরক্ষার অন্তিমেও ঘটে সেই সুখলাভ। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কোনটি আমাদের প্রধান অভিষ্ঠ? বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ বা স্বার্থানুগ চাহিদার মধ্যে সুখলাভের চাহিদাই কী তাহলে প্রধান অভীষ্ট?

আসলে, সুখলাভের চাহিদা না থাকলে, জীব তথা মানুষ— কর্মে প্রবৃত্ত হতে, শরীর ও মনের প্রয়োজন মেটাতে ততটা উদ্যোগী হতো না, যতটা সে সুখ লাভের জন্য হয়ে থাকে। তাই, কতকটা 'খুড়োর কল'-এর মতো, সুখলাভের এই কল বা কৌশল রচনা করেছে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর। ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তার এ'হলো এক স্পষ্ট প্রমাণ। জীবকে বংশবৃদ্ধিতে বাধ্য করতে, সেখানেও সে রেখেছে এই সুখ-এর প্রলোভন।

স্বল্প-চেতন বন্যপ্রাণীকে পোষ মানাতে, তাকে দিয়ে ইচ্ছেমতো বা প্রয়োজন মতো কাজ করিয়ে নিতে, যেমন পুরস্কার ও তিরষ্কার-এর ব্যবস্থা করা হয়, তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা নিয়েছে ঈশ্বর। 'সুখ' হলো সেই পুরস্কার আর দুঃখ-কষ্ট হলো ঈশ্বরের তিরস্কার স্বরূপ। দুঃখ-কষ্টের ব্যবস্থা থাকার ফলেই আমরা ক্রমশ আরও উন্নত— আরও বিকশিত হয়ে উঠতে পারছি। আমাদের বিকাশ ঘটানোই বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) প্রধান উদ্দেশ্য।

এরপর যে প্রশ্নটি উঠে আসে, সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটি হলো— তাহলে মূল চালিকাশক্তি কে? আর, মূল কারণটাই বা কি? সুখ লাভের চাহিদা, না অন্যান্য স্বার্থরক্ষা ও আত্মরক্ষার চাহিদা, নাকি ইচ্ছাশক্তি?

আপাতদৃষ্টিতে আমাদের ইচ্ছাকেই প্রধান চালিকাশক্তি মনে হলেও, শরীর ও মনের চাহিদার দ্বারাই আমাদের ইচ্ছা চালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, অনৈচ্ছিকভাবেও আমরা অনেক কিছুই করে থাকি, অথবা আমরা চালিত হয়ে থাকি। সুখলাভ এবং অন্যান্য স্বার্থরক্ষার চাহিদার দ্বারাও আমরা যেমন চালিত হই, তেমনি দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার দ্বারাও আমারা চালিত হই।

প্রয়োজন ও চাহিদা মতো প্রাপ্তি না ঘটার ফলে, উৎপন্ন হওয়া দুঃখ-কষ্ট এবং বহিরাগত আক্রমণ, আকস্মিক দুর্ঘটনা ও অসুস্থতার কারণে ক্ষয়-ক্ষতি জনিত দুঃখ-কষ্ট-ও আমাদের চালনা করে থাকে। দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার চাহিদাও অন্যতম চালিকাশক্তি। এছাড়াও, আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত রয়েছে আরও কিছু প্রবৃত্তি বা নির্দেশ বা 'প্রোগ্রাম', যারা আমাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভিতর থেকে চালনা করে থাকে। আর, সর্বোপরি রয়েছে 'ভাগ্য' বা জাগতিক ব‍্যবস্থা।

সব দিক বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত 'প্রোগ্রাম' এবং জাগতিক ব‍্যবস্থারূপ পূর্বনির্ধারিত নির্দেশ বা প্রোগ্রাম এবং 'ভাগ্য' রূপ অনৈচ্ছিক শক্তি সম্মিলিতভাবে আমাদের চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে চলেছে। আর এইসব প্রোগ্রামের পিছনে আছে স্বার্থ। প্রোগ্রাম রচয়িতা— সেই প্রোগ্রামার-এর স্বার্থ।

 
আগ্রহ— ভালবাসার মূলে থাকে স্বার্থ
 

আগ্রহ— ভালবাসার মূলে থাকে স্বার্থ—লাভ—আনন্দ—উপকার প্রভৃতি। কিন্তু স্বার্থ থাকা সত্বেও অনেকের ক্ষেত্রে আগ্রহ—ভালবাসার অভাব দেখা যায়। কেন এটা হয়?

যে ব্যক্তি নিয়মিত আমার স্বার্থ দেখছে— আমার স্বার্থ পুরণ ক’রে চলেছে। যে আমাকে খাওয়াচ্ছে— পড়াচ্ছে, তার প্রতি আমি উদাসীন—অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকছি। আর যে হঠাৎ ক’রে একদিন আমাকে কিছু উপহার দিলো, অথবা কোনো কিছু খেতে দিলো, —তার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেলো আমার! এরকম কেন হয়?

এর পিছিনে থাকে ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা অথবা শিক্ষার অভাব। আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে থাকা কোনো ভুল ‘প্রোগ্রাম’ —যা আমাদেরকে ভুল পথে চালিত করে, এবং/অথবা মানসিক অসুস্থতা বা চেতনার অভাব বা বোধ হীনতা।

উন্নত পারিবারিক বা সামাজিক পরিবেশ এবং সেই সাথে উপযুক্ত শিক্ষা আমাদের বোধোদয় ঘটাতে পারে। এখানে মা-বাবা ও শিক্ষকের মুখ্য ভূমিকা থাকে। তাই, সর্বাগ্রে মা-বাবা ও শিক্ষককে প্রকৃত শিক্ষা— জীবন মুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। তবেই ছাত্র-ছাত্রী —সন্তানকে শিক্ষিত ক’রে তোলা সম্ভব হবে।  

এইসব শিশুরা কিন্তু প্রকৃতই ‘স্বার্থপর’ নয়। স্বার্থ কি জিনিস সেটাই এরা ঠিকমতো জানেনা। নিজের স্বার্থ সঠিক ভাবে বুঝতে পারলে— এরা নিজের স্বার্থেই অপরের স্বার্থ দেখবে। অপরাপর সব মানুষের স্বার্থ দেখাটাও এরা নিজেদের স্বার্থ মনে করবে।   

তুমি যা ভাবছো— যা করছো, তার পিছনে রয়েছে অসংখ্য ঘটনা। কোটিকোটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় আরো কোটিকোটি ঘটনা। আবার, সেইসব ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় আরো অজস্র ঘটনা। এইরূপে, পরম্পরাগতভাবে— বর্তমানে জন্ম নেওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি হলো— তোমার চিন্তা, আরেকটি— তোমার কর্ম। এদের থেকে আবার জন্ম নেবে অজস্র ঘটনা। এই ভাবেই বয়ে চলেছে—ঘটনা প্রবাহ।
 
তোমার চিন্তা— তোমার কর্ম— বর্তমান ও অতীতের অসংখ্য ঘটনার সাথে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত, এবং অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অজস্র ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। তুমি— তোমার অস্তিত্ব— তোমার কর্ম, সব কিছুই এই জাগতিক ব্যবস্থার ফসল।

প্রসঙ্গ ভালোবাসা 


 

ভালোবাসা মূলতঃ দুই প্রকার। সজ্ঞান—সচেতন ভালোবাসা, আর অজ্ঞান— সহজাত ভালোবাসা।

প্রত‍্যেকের ক্ষেত্রেই তার নিজের অজান্তেই প্রথম ভালোবাসা— সহজাত ভালোবাসা হলো, —নিজেকে ভালোবাসা। নিজের প্রতি ভালোবাসা।

এই নিজেকে ভালোবাসার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে অপরাপর মানুষ ও জীবসহ বিভিন্ন বিষয়-বস্তুকে ভালোবাসা। যে বা যারা অংশত নিজের অনুরূপ তাদের প্রতি স্বভাবতই ভালোবাসা জন্মায়। তারপর, যাকিছু নিজেকে তৃপ্তি দেয়, আরাম— আনন্দ দেয়, সুখ ও শান্তি দেয়, সেইসব বিষয়-বস্তুকে পছন্দ, এবং ক্রমে ভালোবাসা গড়ে ওঠে।


আর এর ব‍্যতীক্রম ঘটলেই, সেখানে ভালোবাসার অভাব দেখা দেয়। অজ্ঞান-অন্ধ-আবেগপূর্ণ ভালোবাসা অনেক সময়েই উন্মাদনা সৃষ্টি করে— বিপত্তি ঘটাতে পারে।কিন্তু সজ্ঞান-সচেতন ভালোবাসায় আবেগ কিছু কম থাকলেও, তা অনেকাংশে নিরাপদ এবং শুভ ফলপ্রদ।

ভালোবাসার মূলে থাকে স্বার্থ। সে— জ্ঞাতেই হোক, আর অজ্ঞাতেই হোক, সহজাত অজ্ঞান ভালোবাসাই হোক, আর সজ্ঞান— সচেতন ভালোবাসাই হোক, স্বার্থ-ই হলো ভালোবাসার মূল উৎস।

নিষ্কামকর্ম যেন সোনার পাথরবাটি !

শরীর ও মনের মধ্যে থাকা অথবা উৎপন্ন হওয়া নানা প্রকার অভাব— শূণ্যতা— ঘাটতি থেকেই সৃষ্টি হয়— সেই অভাব— শূণ্যতা পূরণের চাহিদা বা কামনা। আর, সেই কামনাকে মেটাতেই আমরা কর্ম ক’রে থাকি। এই চাহিদা বা কামনা— সচেতনভাবে ঘটতে পারে, আবার অবচেতনভাবেও ঘটতে পারে। অর্থাৎ সচেতন মনের চাহিদামতো কর্ম হতে পারে, আবার কখনো, সচেতন মনের অজ্ঞাতসারে— অবচেতন মনের চাহিদামতোও কর্ম হতে পারে।

যেখানে অভাব নেই— শূণ্যতা নেই, সেখানে তা’ পূরণ করার চাহিদা বা কামনাও নেই। কামনা থেকেই কর্ম। এই বিশ্বজগৎ জুড়ে যা কিছু ঘটছে— তার পিছনে আছে কামনা। কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে নিষ্কাম কর্ম করা সম্ভব নয়। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে সে যা-ই করুক না কেনো, তার পিছনে অভাব—শূণ্যতা থেকে উৎপন্ন চাহিদা বা কামনা থাকবেই। তা’ সে শরীরের চাহিদাই হোক আর মনের চাহিদাই হোক, অথবা তা’ ভিত্তিমূল মন-সফটওয়ারের চাহিদাই হোক। তার, সেই কামনা সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল থাকুক আর না-ই থাকুক। কাম বা কামনা ছাড়া কর্ম হবেনা।

আপাতদৃষ্টিতে, ঐচ্ছিকভাবে অথবা অনৈচ্ছিকভাবে, যে কোনোভাবেই কর্ম সংঘটিত হোক না কেনো— বুঝতে হবে, তার পিছনে কারো না কারো ইচ্ছা বা কামনা কাজ করছে। সে জাগতিক-ব্যবস্থা হতে পারে, ঈশ্বর হতে পারে, অথবা আদি-সত্তা পরমাত্মাও হতে পারে। 

আমাদের অন্তরের গভীরে আছে শূণ্যতা— আছে অভাব। জ্ঞানের অভাব— চেতনার অভাব। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে— সর্বদা আমরা সেই শূণ্যতা মোচনের জন্য— পূর্ণতালাভের জন্য ব্যকূল হয়ে আছি। এবার, যার যেমন জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা, যেমন শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, সেই মতো তার চিন্তা-চাহিদা-কামনা। কিভাবে কীসে যে তার অভাব পূরণ হবে, —অনেক মানুষই তা’ বোঝার মতো অবস্থায় নেই। অজ্ঞান শিশুর মতো তাই— চারিপাশে যাকিছু সে দেখছে, —তা’ই দিয়েই সে তার শূণ্যতা দূর ক’রে— পূর্ণতা লাভের চেষ্টা ক’রে চলেছে। ভাবছে, এটা পেলে অথবা ওটা করলে বুঝি তার চাহিদা পূর্ণ হবে। এইভাবে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে— দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগের মধ্য দিয়ে, একটু একটু ক’রে ক্রমশ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভের দ্বারা মানুষ নিজের অজান্তেই তিলেতিলে পূর্ণতা লাভের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এটাই জাগতিক ব্যবস্থা।

আরেকটু তলিয়ে দেখলে— দেখা যাবে, আমরা যাকিছু করছি— যে সমস্ত কর্ম করছি, কামনা করছি— চিন্তা করছি, এ’সব কিছুই আমরা করতে বাধ্য হচ্ছি। জাগতিক-ব্যবস্থা আমাদের দিয়ে যা করাচ্ছে, আমরা তা’ই করছি। ভাগ্যরূপ জাগতিক ঘটনাপ্রবাহের অধীন আমরা— যা কিছু করছি— সে সবই বাধ্য হয়ে করছি।

চলে যাই আরো অনেক দূরে— অনেক গভীরে—। যে আদি সত্তা— পরমাত্মা থেকে সমস্ত জগত-সংসার সৃষ্টি হয়েছে, সে-ও কিন্তু পূর্ণ নয়। পূর্ণাবস্থা থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয় (মহাবাদ দ্রষ্টব্য)। পূর্ণাবস্থায় কোনো চাহিদা— কোনো কামনা থাকেনা, কোনো কর্মও থাকে না। পরমাত্মাকেও তার অভাব থেকে উৎপন্ন চাহিদা বা কামনা পূরণের উদ্দেশেই কর্ম করতে হয়েছে ও হচ্ছে। আর, সেই কর্ম থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড —চলছে এই মহা সৃষ্টিলীলা।

তার অংশানুক্রমে— তার চাহিদানুসারে আমরাও কর্ম ক’রে চলেছি। তবে, স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণে— আমাদের কামনা-বাসনা-কর্মের জন্য অনেক সময়েই আমাদেরকে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করতে হচ্ছে— (যার জন্য আমরা মোটেই দায়ী নই)। এর কারণ সেই অপূর্ণতা— জ্ঞান ও চেতনার অভাব। আমরা যদি জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য সচেতনভাবে কর্ম করতে পারি— সেই কর্মই হবে শ্রেষ্ঠ কর্ম।

 

 মানবতা 


মানুষের প্রতি মানুষ সহানুভূতিশীল হয়ে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করাকেই বলে মানবতা। মানবতা হলো মানসিক গুণ বিশেষ। তাই মনের উপর ভিত্তি করে এই মানবতা মূলত দুই প্রকারের। অবচেতন মনের মানবতা, আর সচেতন মনের মানবতা।

প্রথম প্রকারটি হলো, মোহ- মায়া যুক্ত স্বল্পজ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন অন্ধবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে অপরাপর মানুষের প্রতি যে সহজাত আবেগধর্মী মমত্ববোধ ও সহানুভূতি, এবং ধর্মীয় শিক্ষার দ্বারা চালিত হয়ে যে কর্তব্যবোধ থাকে, তা হলো প্রথম প্রকারের মানবতা। এদের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষ আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের গোষ্ঠী -সম্প্রদায়, আত্মীয়- পরিজনদের প্রতিই মমত্ব— সহানুভূতি এবং কর্তব্য বোধ করে থাকে। কখনো কখনো এরা তার বাইরের মানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ভাবাপন্ন-ও হয়ে থাকে।

আর অপরটি হলো, মানবত্ব লাভ করার পরে, অর্থাৎ যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হওয়ার পরে, সজ্ঞান- সচেতনভাবে— যুক্তিযুক্তভাবে অপরাপর সমস্ত মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব— কর্তব্য ও একত্ব বোধ থেকে, সমগ্র মানুষের হিতার্থে কাজ করার সজাগ ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা। এই হলো দ্বিতীয় প্রকারের মানবতা।

প্রসঙ্গ: ভয়

ভয় হলো আমাদের একটি সহজাত সংস্কার বা ‘প্রোগ্রাম’। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে জাগতিক-ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে ভয় রূপ এই সংস্কার অন্তর্গ্রথিত করে দিয়েছে। যার জন্য আমরা ভয় পাই— ভয় করি বা ভীত হই।

কিন্তু কোনো কারণে— শারীরিক ও মানসিক গঠন, জৈব-রাসায়নিক কারণে, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিরস ক্ষরণে, এবং আমাদের ‘মন-সফটওয়ার’-এর কার্যকলাপের তারতম্য ঘটলে, এই ভয় কারও ক্ষেত্রে কম— কারো ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে। কেউ অল্পতেই ভয় পেতে পারে, কেউ যথেষ্ট কারণ ছাড়া ভয় পায় না।

ভয় পাওয়ার পিছনে আরো অনেক কারণ থাকে। কেউ ভয়ানক পরিবেশে দীর্ঘসময় থাকার ফলে, পরবর্তীকালেও সেই ভয় তার মধ্যে বাসা বেঁধে থাকতে পারে, আবার ঐ ভয়ঙ্কর পরিবেশে দীর্ঘসময় থাকার ফলে কারো কারো ভয় কেটে যেতেও পারে।

স্বল্প কারণে অথবা আপাত কারণ ছাড়া— ভয়-উদ্বেগ-উৎকন্ঠার পিছনে অনেক সময়েই পরিপাকতন্ত্র অথবা কোনো অরগানের উত্তেজনা দায়ী থাকে। তারমধ্যে, অম্লাধিক্য বা অত্যাধিক এসিড, কৃমি, জীবানু, পরজীবী, লিভারের উত্তেজনা পাকাশয়িক উত্তেজনা— এগুলি প্রধান কারণ। অত্যাধিক ভয়— অনেকসময় মানসিক রোগ হিসাবেও গণ্য হয়ে থাকে।

যে সুস্থ এবং যত বেশি যুক্তিবাদী, সে ভয়কে ততটাই জয় করতে সক্ষম। ভয় পাওয়ার পিছনে স্নায়ু-মনের দুর্বলতা ছাড়াও অন্যতম কারণ হলো— জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতাজনিত অসহায়তা। যার জন্যে শিশুরা বেশি ভয় পেয়ে থাকে। বেশি ভয় পাওয়ার পিছনে অন্ধ-বিশ্বাসও একটি বড় কারণ। চেতনার স্বল্পতাই অন্ধ-বিশ্বাসের জন্ম দেয়। 

উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, আশঙ্কা প্রভৃতি ভয়েরই সমগোত্রীয় সংস্কার। অনেক সময়েই এদেরকে আলাদা করে চেনা মুস্কিল হয়ে যায়। অনেক সময়, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, আশঙ্কার পিছনে বাস্তব কারণ থাকে। সেখানেও, কেউ অল্প কারণেই ভীত হয়, কেউ সেই ভয়কে সহ্য করতে পারে— নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার কেউ কোনো বাস্তব কারণ ছাড়াই কাল্পনিক কারণে অথবা অন্ধ-বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত হতে পারে।

কোনো কোনো সময়, আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ‘প্রোগ্রামড’ করে তুলি। এটা কেউ কেউ সচেতনভাবে— ইছাকৃতভাবেও করে থাকে, আবার অনেকে নিজেদের অজ্ঞাতেই নিজেদেরকে সংস্কারাবদ্ধ বা ‘প্রোগ্রামড’ করে তোলে। তবে, সচেতনভাবে যারা নিজেদেরকে ‘প্রোগ্রামড’ করে তোলে, তাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে ধনাত্মক (পজেটিভ) বা উন্নয়নমূলক ‘প্রোগ্রাম’ করে থাকে। আর যারা নিজেদের অজ্ঞাতেই নিজেদেরকে ‘প্রোগ্রামড’ করে থাকে, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋণাত্মক (নেগেটিভ) বা অবনয়নমূলক ‘প্রোগ্রাম’ করে থাকে।

যেমন। একটি উন্নয়নমূলক ‘প্রোগ্রাম’ হলো— ‘আমি চেষ্টা করলেই পারবো।’ আর একটি ঋণাত্মক ‘প্রোগ্রাম’ হলো— ‘আমি পারিনা বা পারবোও না।’ অথবা ‘আমার দ্বারা ওটা হবে না।’ ভয়ের ক্ষেত্রেও, কেউ যদি ভয়কে মনে পুষে রাখতে চায়, কেউ যদি বলে, ‘ওরে বাবা— অঙ্ক দেখলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।’ —সেক্ষেত্রে এই স্ব-অভিভাবনমূলক ‘প্রোগ্রাম’ তাকে অঙ্কের ক্ষেত্রে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত করেই রাখবে।

একজন— মনের অধিকারী ‘মানুষ’ হয়েও, যদি আমি মন সম্পর্কে সচেতন না হই, মন সম্পর্কে অভিজ্ঞ না হই, তাহলে আমার মানব-জীবনই বৃথা। অন্ধ-আবেগ— অন্ধ-বিশ্বাসপ্রবণ যুক্তিবিহীন অবচেতন মনের দাস হয়ে— অজ্ঞানের উপাসক হয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। একজন সচেতন মানুষ হয়ে— জ্ঞানের পথে এগিয়ে চলা সম্ভব হবেনা কোনো দিন।

কেউ যদি নিজেকে ‘স্বল্প-চেতন’ মানুষ বলে, চিনতে পারে, অথবা চিহ্নিত করতে পারে, এবং সেইসঙ্গে চেতনা লাভের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠতে পারে, তাহলেই তার চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকবে দ্রুত গতিতে। আর কেউ যদি স্বল্প-চেতন হওয়া সত্বেও, নিজেকে তা’ মনে না ক'রে, বরং নিজেকে খুব জ্ঞানী— বুদ্ধিমান ভাবে, সেক্ষেত্রে তার চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকবে খুবই মন্থর গতিতে।

এবার, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া এবং বিভিন্ন বিষয়ে ভয়ের কথায় আসছি। অনেকসময় ছাত্র-ছাত্রীদের সরল বিশ্বাসপ্রবণ মনে ভয়ের সঞ্চার করে থাকে— তাদের পরিবারের এবং/অথবা তাদের চারিপাশের কেউ না কেউ। ভয় দেখিয়ে তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া, তাদেরকে বাধ্য— বশীভূত করে রাখার ঘটনা ঘটে থাকে অনেকের ক্ষেত্রেই।

অভিভাবকদের কেউ অংকে বা ইংরেজিতে ভীত হলে, সে যদি ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে তার সেই ভয় প্রকাশ করে থাকে, তাহলে সেই ভয় ছাত্র-ছাত্রীদের মনেও সংক্রামিত হতে পারে। অনেক অভিভাবককেই দেখা যায়, ছাত্র-ছাত্রীদের সাহসী করে তোলা--- যুক্তিবাদী করে তোলা--- তাদেরকে পজিটিভ ভাবনায় ভাবায়িত করে তোলার পরিবর্তে, বরং তাদেরকে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করতে--- ভয় পেতেই বেশি প্ররোচিত করে থাকেন। তাঁঁরা ভাবেন, এতেই বুঝি ভালো হবে। কিন্তু তা' না হয়ে--- ভবিষ্যতে সেই প্ররোচনার কুফল তাদেরকেই ভোগ করতে হয়।

কেউ কোনো বিষয় ভালোভাবে বুঝতে না পারলে, আয়ত্ত করতে না পারলে, তাকে সেই কাজ করতে বললে, তার পক্ষে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কথা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা অনুযায়ী প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব যার বা যাদের উপর দেওয়া হয়েছে, সে কি তার দায়িত্ব পালন করছে? 

একেবারে উপর তলা থেকে নিচু তলা পর্যন্ত--- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, প্রজা--- অধস্তন--- শিষ্য ও সন্তানদেরকে বোকা বানিয়ে রাখার এক নিদারুণ অপচেষ্টা লক্ষ্য করার মতো। এই ওপরচালাকির কুফল ভোগ করতে হচ্ছে আজ সবাইকে। দেশ--- সমাজ--- সংসার সর্বত্রই আজ যে দুর্দশা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ এই বোকা ব'নে থাকা, এবং সেইসাথে বোকা বানিয়ে রাখার এক করুণ প্রচেষ্টা। জ্ঞানের উপাসনা ছেড়ে--- অজ্ঞানের উপাসনাই আজ এই দেশের দুরাবস্থার প্রধান কারণ।

এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে, দূরভিসন্ধিমূলকভাবে সরল বিশ্বাসী মানুষের মনে ঈশ্বর--- নরক--- পাপ ও শাস্তির ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে, তাকে মানসিকভাবে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার এক দুর্দান্ত কৌশলের নামই হলো--- ধর্ম। তথাকথিত ধর্ম। ধর্ম নাম্নী অধর্ম।

প্রসঙ্গ : ভক্তি

অজ্ঞান ভক্তি ◆ সজ্ঞান ভক্তি
 

পথ মূলতঃ দুটি। একটি হলো বিশ্বাসের পথ, আর অপরটি হলো যুক্তি বা জ্ঞানের পথ । ভক্তি ও কর্ম~ দুটি পথের সঙ্গেই যুক্ত থাকে। কর্ম ছাড়া কোনো পথেই চলা সম্ভব নয়। জ্ঞানপথের পথিকেরও ভক্তি থাকে, সে হলো জ্ঞান ও সত‍্যের প্রতি ভক্তি। সাধারণত, যাকে ভক্তিপথ বলা হইয়ে থাকে, সেটি আসলে বিশ্বাসের পথ।

ভক্তিযোগ দুই প্রকার। এক— অজ্ঞান ভক্তি, দুই— সজ্ঞান ভক্তি। ক্রমবিকাশমান চেতনার পথে—, একই পথের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন রূপ।

অজ্ঞান ভক্তিযোগের পরে, হোঁচট খেতে খেতে একটা সময়ে আসে নাস্তিকতা। তারপর আসে জ্ঞানযোগের অধ‍্যায়। জ্ঞানযোগের মধ‍্যেও রয়েছে কয়েকটি স্তর। এই জ্ঞানযোগের পরে যে ভক্তিযোগের অধ‍্যায় আসে, সে-ই হলো সজ্ঞান ভক্তিযোগ।

নিজেকে তথা ঈশ্বরকে নিজেদের স্বরূপে জানার পর যে ভক্তি জন্মায়, সেই হলো বিশুদ্ধ ভক্তি। মায়া-মোহমুক্ত— অজ্ঞানতা মুক্ত শুদ্ধ ভক্তি। সে-ই শ্রেষ্ঠ ভক্তিযোগ। এই স্তরগুলির আগে— পরে ও মাঝেও অনেক ছোট ছোট স্তর আছে।

এই ভাবেই ধাপে ধাপে— পায়ে পায়ে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে একসময় আমরা পৌঁছে যাবো পরম লক্ষ্যে। পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে। অন্তিমে ঘটবে ঈশ্বরত্ব লাভ। চেতনার পূর্ণ বিকাশ।

 

 

প্রার্থনা প্রসঙ্গে : আত্মশক্তিই বিস্ময়কর বহু শক্তির উৎস শক্তি
 

ঈশ্বর বা স্রষ্টা অথবা কোনো ব্যক্তি বা দেবতা অথবা প্রাকৃতিক শক্তির নিকট, যার কাছেই প্রার্থনা করো না কেন, জেনে রাখো, মূল শক্তির উৎস হলো— তুমি। তোমার অন্তর নিহিত শক্তি। আত্মশক্তি।

তবে, সাধারণভাবে কামনা বা প্রার্থনার ক্ষমতা খুবই কম। এইরূপ প্রার্থনার দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে অন্তর-শক্তির বিকাশ ঘটে না। তবে, তীব্র বা দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রার্থনা করলে, বেশকিছু শক্তির বিকাশ ঘটে থাকে।

আবার, দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে, এক সুরে, একাত্ম হয়ে, অনেকে মিলে কোনো একটি বিশেষ (বাস্তবসম্মত) আকাঙ্খা নিয়ে প্রার্থনা করলে, সবার মিলিত শক্তি কেন্দ্রীভূত ও একমুখী হয়ে, সেই প্রার্থনা ফলপ্রসূ হতে পারে। তবে, সেই ঐক্যবদ্ধ প্রার্থনায়, একজনেও যদি অন‍্যমনষ্ক থাকে, একাত্ম না হয়, বেসুরো হয়, সেক্ষেত্রে সেই প্রার্থনা কার্যকর নাও হতে পারে।

বিশেষ কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে, যেমন ধ‍্যান-যোগ-প্রক্রিয়ার দ্বারা তুমি যদি তোমার নিজের আত্মশক্তিকে তীব্র একাগ্র একমুখী করে, কোনো বিশেষ (বাস্তব) উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আত্মশক্তির বিকাশ বা স্ফূরণ ঘটাতে পারো, তখন সেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।

আত্মশক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা গড়ে তুলতে, 'মন-আমি' ও 'নিজের মনকে জানো' 'বিশ্বাস ও জ্ঞান' প্রবন্ধগুলি পড়ে দেখো। আত্মশক্তির ক্ষণিকের স্ফূরণের দ্বারা বহু সময়ে, বহু কঠিন ও বিস্ময়কর কার্য সংঘটিত হতে দেখেছি, আমার জীবনে। 

এই ধর্ম (মহাধর্ম) ঈশ্বরের কৃপা লাভের কথা বলেনা। বলে, আত্মবিকাশ লাভ ও মানবত্ব লাভের কথা।এই ধর্ম বলে, ঈশ্বরের (বিশ্ব-অস্তিত্ব) কাছে কৃপা প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই। ভাগ্যে যা আছে ঠিক তা-ই হবে। ঈশ্বরও ভাগ্যের অধীন।

বিজ্ঞান প্রসঙ্গে

বিশেষভাবে উল্লেখিত 'জ্ঞান' এবং 'বিজ্ঞান' হলো— বিশ্বপ্রকৃতি এবং তার অন্তর্গত বিভিন্ন বিষয়-বস্তু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অথবা যুক্তি-বিচার-প্রমান সাপেক্ষে বিশেষভাবে অবগত বা উপলব্ধ তথ্য এবং/অথবা তত্ত্ব মূলক (আপাত) সত্য। 

আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞান-ই একমাত্র বিজ্ঞান নয়। এই বিজ্ঞানের কথাই সব নয়--- শেষ কথা নয়। এখনো এর জানার বাহিরে রয়েছে আরও অনেক কিছু, অনেক বিজ্ঞান। সে সবই রয়েছে এই বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আগামীতে কোনো একসময় আজকের এই বিজ্ঞান হয়তো তা' উপলব্ধি করতে পারবে--- আবিষ্কার করতে পারবে। আবার, আজ যা বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য, কালই তা অসত্য বলে, বাতিল হতে পারে। তাই, সবকিছুকেই আপাত সত্য ধরে নেওয়াই হলো বিজ্ঞান।

এখন নিত্য-নতুন যেসমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কার হয়ে চলেছে, সে সবই অতীতের বিজ্ঞানের কাছে ছিল অজানা। তাই আজকের বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে এখানো পর্যন্ত যা কিছু অজানা ও অপ্রামাণ্য--- সে সবকিছুই অবিজ্ঞান হবে, এমন নয়।

এমন অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়বস্তু আছে যাকে গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা আজকের বিজ্ঞান এখনো লাভ করে উঠতে পারেনি।

এই রকমই একটি হল--- হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতি। অধ‍্যাত্ম-বিজ্ঞানও একটি বিজ্ঞান। এখনো পর্যন্ত এই বিজ্ঞান আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের উপলব্ধির বাহিরেই রয়ে গেছে।

বিজ্ঞান-সচেতন মানুষ যেমন রয়েছে, তেমনই আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা অধ্যাত্ম-সচেতন। এখন, বিজ্ঞান সচেতনতার পাশাপাশি যদি তোমার মধ্যে আধ্যাত্মিক সচেতনতা না থাকে, সেক্ষেত্রে আমার কথাগুলি তোমার কাছে অবান্তর— মূল্যহীন মনে হবে।  

জ্ঞানী কাকে বলা হবে?

প্রত্যেকেই নিজের নিজের ধারণা ও সাধ্যমতো অপরের জ্ঞানের পরিমাপ ক'রে, কোনো কোনো ব্যক্তিকে জ্ঞানী বলে সাব্যস্ত করে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক। তাই কাউকে জ্ঞানী হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে, তার জ্ঞান দিয়ে নয়, জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার চাহিদা লক্ষ্য করে। জ্ঞান অর্জনের চাহিদা যার মধ্যে যত বেশি, তার জ্ঞান ততো বেশি। জ্ঞানের চাহিদা থেকেই জ্ঞান লাভ হয়।

অনেক জ্ঞান অর্জন করার পরে, কারো মধ্যে যদি উত্তরোত্তর জ্ঞান অর্জনের চাহিদা না থাকে, তার পূর্বার্জিত জ্ঞান ক্রমশ আপডেটেড না হয়ে, ব্যাকডেটেড হয়ে পড়ে। নিয়মিত অগ্রগতিশীল চর্চা না হলে, সেই জ্ঞানে মরচে ধরে যায়।

আবার, কিছু জ্ঞান লাভ করার পরে, কেউ যদি ভাবে সে সব জেনে গেছে, তার আর জানার কিছু নেই, অথবা যদি মনে করে, বা বলে, সে যা জানে সেটাই পরম সত্য, তার কথাই শেষ কথা। তাহলে বুঝতে হবে সে জ্ঞানী নয়।

এই মানব-চেতন-স্তরে আমাদের কোন জ্ঞানকেই চিরসত্য~ সম্পূর্ণ জ্ঞান বলা যাবেনা। কোন জ্ঞান হয়তো পাঁচশো বছর পর্যন্ত সত্য, আবার কোন জ্ঞান হয়তো পাঁচ হাজার বছর পর্যন্ত সত্যরূপে স্থির থাকতে পারে। পর্যাপ্ত চেতনা না থাকার কারণে আমাদের কোন জ্ঞানই স্থির--- নিশ্চল--- পরম সত্য জ্ঞান নয়। সবই আপাত সত্য--- আপাত জ্ঞান।

জ্ঞান হলো এক সচল জিনিস। সময়ের সাথে সাথে সে পরিবর্তিত হয়। এক জায়গায় থেমে থাকা জ্ঞানকে ঠিক জ্ঞান বলা যাবে না। বড়জোর বলা যেতে পারে, তৎকালীন জ্ঞান বা প্রাচীন জ্ঞান। জ্ঞানীর ক্ষেত্রেও একথা খাটে। জ্ঞানীর জ্ঞান-অন্বেষা চলতেই থাকে। জ্ঞানের কোন শেষ নেই--- জ্ঞান-অন্বেষারও শেষ নেই।

তাই, চিরকাল যে শিক্ষার্থী, যার জ্ঞান-অন্বেষা কখনই থেমে থাকে না, সেই হলো প্রকৃত জ্ঞানী। নিয়মিতভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে--- চর্চা বিহীন জ্ঞানের অধিকারীকে জ্ঞানী বলা যায়না।

আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, পন্ডিত আর জ্ঞানী এক নয়। প্রকৃত জ্ঞানী তার সমস্ত জ্ঞানকে আপাত জ্ঞান বলে মনে করে থাকে। সে জানে বিকাশমান চেতনা পথের--- মাঝপথে থেকে, সম্পূর্ণ পথের জ্ঞান লাভ করা কখনোই সম্ভব নয়।

ভারতবাসী আত্মবিকাশমূলক~ মানবধর্মের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে, যেদিন যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে, সেইদিন এই ভারত জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে।    ~মহর্ষি মহামানস
bottom of page