top of page

দ্বিতীয় অধ্যায়

আধ্যাত্মিকতা 

'অধ্যাত্ম' কথাটির অর্থ হলো--- আত্ম বা মন বিষয়ক। 'আত্মা আর 'মন' সমার্থক। সে মানব শরীর সম্পন্ন-ই হোক অথবা অশরীরী মন-ই হোক, মানবমন অথবা আরও উচ্চচেতন মন, অথবা ঈশ্বর মন, যা-ই হোক না কেন, একটি সচেতনতা সত্তা, যে অনুভব করতে সক্ষম চিন্তা করতে সক্ষম, সে-ই হলো মন।

 

অনেকেই প্রচলিত ধর্মাচারণকেই 'আধ‍্যাত্মিকতা' বলে, মনে করে থাকেন। কিন্তু তা' প্রকৃত আধ‍্যাত্মিকতা নয়। অন্ধবিশ্বাস--- অন্ধ-অনুসরণ থেকে মুক্ত হয়ে, সজাগ-সচেতনভাবে খোলা মনে যুক্তিপথ ধরে আত্ম-জ্ঞান-- আত্ম-উপলব্ধি-- আত্মবিকাশ লাভের জন্য অগ্রসর হওয়াই প্রকৃত আধ‍্যাত্মিকতা।

 

আমরা মূলত আধ্যাত্বিক অস্তিত্ব। বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর মন থেকে সৃষ্টি হওয়া, বিশ্বাত্মার মানস সন্তান স্বরূপ--- ভার্চুয়াল অস্তিত্ব (সৃষ্টিতত্ত্ব দ্রষ্টব্য)। মন থেকেই উৎপত্তি এবং প্রধানত মন সম্পন্ন অস্তিত্ব। আমাদের সমস্ত (মানসিক) কার্যকলাপই আধ্যাত্মিকতা। আমাদের সমস্ত কাজকর্মের পিছনেও রয়েছে আধ্যাত্মিকতা।প্রকৃতপক্ষে, আমাদের মানসিকতা আর আধ্যাত্মিকতা প্রায় সমার্থক। কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে, মানসিকতা বা মানসিক সক্রিয়তা থেকে আধ্যাত্মিকতা কথাটি অনেক বেশি অর্থবহ। আধ‍্যাত্মিকতা--- প্রধানত আত্মজিজ্ঞাসা, আত্ম-অন্বেষণ, আত্ম-উপলব্ধি, আত্মবিকাশ এই সমস্ত মানসিক সক্রিয়তার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।

 

আমরা যা কিছুই করিনা কেন, যা-ই ভাবিনা কেন, সবকিছুর পেছনেই--- আমাদের জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতসারে কাজ করছে--- সেই আদি প্রশ্ন--- আদি উদ্দেশ্য। 'এটা চাই' --- 'ওটা চাই' বলে, কতো কিছুর পিছনেই না ছুটে মরছি আমরা। কিন্তু কিছুতেই তৃপ্ত--- সন্তুষ্ট হতে পারছি না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যা চাই--- সেই অমূল্য রতন--- 'আত্মজ্ঞান' যতক্ষণ পর্যন্ত না লাভ করছি, ততক্ষণ এই চাওয়া আর ছোটার পালা চলতেই থাকবে।

 

আত্মজিজ্ঞাসা--- আত্ম-অন্বেষণ হলো আধ্যাত্মিকতার প্রথম কথা। আমি কে--- আমি কেন--- আমি কোথা হতে এসেছি, এবং কোথায় আমার গন্তব্য, এই মহাবিশ্ব-সৃষ্টির শুরু কোথায় এবং এর অন্তিম লক্ষ্য-ই বা কী---? এই নিয়েই আধ্যাত্মিক জগত। প্রকৃত আধ‍্যাত্মিকতা আর প্রচলিত বা তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা এক জিনিস নয়। 'কে আমি---?' এই হলো প্রকৃত অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশের প্রথম পদক্ষেপ। এবং তার অন্তিম লক্ষ্য হলো--- 'একত্ব'। চেতনার ক্রমবিকাশের পথ ধরে এগিয়ে গেলে, স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ অশরীরী আত্মা, উচ্চ থেকে উচ্চতর চেতন স্তরের সত্তা বা আত্মা, দেব-চেতন আত্মা, ---ক্রমে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরাত্মার সাক্ষাৎ ঘটবে এই পথে। বিকশিত হতে থাকবে একে একে ক্রমোচ্চ চেতন-স্তরের মনগুলি (বিকাশমান মনোপদ্মের ডায়াগ্রাম দ্রষ্টব্য)।

 

যদিও মন বা আত্মা-ই অধ্যাত্ম জগতের প্রধান কেন্দ্র, তবুও মনের মধ্যে--- আমিত্ববোধকারী যে সত্তা বা অংশটি রয়েছে, সেই 'আমি' বা 'অহম' আকারধারী অংশটিই হলো আধ্যাত্মিকতার মুল কর্তা। আত্মসচেতন তথা 'আমি' সম্পর্কে সজাগ-সচেতন সেই অংশটি, যে চিন্তা করে--- অনুভব করে, এবং ইচ্ছা প্রকাশ করে। এ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে 'মন' ও 'চেতনা' সম্পর্কিত অন্যান্য প্রবন্ধ গুলি পড়তে হবে।

নিজের স্বরূপ--- নিজের প্রকৃত রূপ বা অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছাই হলো আধ্যাত্মিকতা। ক্রমশ ব্যক্তি 'আমি' থেকে মহা 'আমি', অতঃপর আদি 'আমি' সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভের মধ্য দিয়ে আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ঐকান্তিকভাবে উদ্যোগী হয়ে ওঠাই হলো প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা।

 

মনে রাখতে হবে, বর্তমানে আমাদের সক্রিয় মন (সচেতন ও অবচেতন মন) দুটি-ই সমগ্র মন নয়। সমগ্র মনটি হলো অনেকটা বিকাশমান পদ্মফুলের মতো। সেখানে রয়েছে অনেকগুলি অংশ এবং অনেকগুলি মনোবিকাশের ধাপ বা পর্যায়। অনেকগুলি মনোস্তর সম্বলিত এই মনোপদ্ম--- বিকাশের বিভিন্ন ধাপ বা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে, একের পর এক, ধাপে ধাপে (মনো) বিকাশ ঘটে থাকে তার।

 

অস্ফূট চেতন-স্তরের মন থেকে, ক্রমশ কীট-চেতন-মন, তারপর সরিসৃপ-চেতন-মন বিকশিত হয় ক্রমে ক্রমে। মনোরূপ পদ্মের বিকাশমান পাঁপড়িগুলির পরবর্তী বিকাশ পর্যায় হলো--- পশু-চেতন- মনোস্তর। তারপরে বিকশিত হয়--- প্রাক মানব-চেতন- মন, এবং তৎপরবর্তী পর্যায়ে বর্তমান মানব-চেতন বা সচেতন মনের বিকাশ ঘটে। ক্রমশ অতিচেতন বা মহামানব-চেতন, ক্রমে দেব-চেতন, মহাদেব-চেতন প্রভৃতি স্তর গুলির বিকাশ ঘটতে থাকে একের পর এক। বোঝার সুবিধার জন্য পূর্বোক্ত কয়েকটি নামে বিভিন্ন চেতনস্তরের মনের উল্লেখ করা হলেও, এর মধ্যেও রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বহু মনোস্তর। আরো বিশদভাবে জানতে 'মহাবাদ' গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

 

শেষ পর্যায়টি হলো ঈশ্বর-চেতন মনোস্তর--- বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর মন। যদিও অন্তিমে আরও একটি পর্যায় আছে। যখন মনো-পদ্মের সমস্ত পাঁঁপড়িগুলি ঝরে গিয়ে--- থাকে শুধু বীজ সমন্বিত অবশিষ্ট অংশটি (পুনরায় সৃষ্টির জন্য) ---সেই হল আদি-চেতন-মন (সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় ব্রহ্ম) বা পরমাত্মা।

 

যে এই বহির্জগৎ সহ তার মন ও তার অন্তর্জগৎ সম্পর্কে সচেতন---অবগত, এবং সেই সাথে বিশ্বাত্মা--- মহা বিশ্বমন সম্পর্কেও সচেতন, সেই হল যথেষ্ট অধ্যাত্ম সচেতন মানুষ।

 

প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা বিশ্বাস নির্ভর নয়। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা অলৌকিকতার পিছনে ছোটা নয়। অনেক মানুষই মনে করে, ঈশ্বরের পূজা--- উপাসনা--- প্রার্থনা এবং যাবতীয় ধর্মীয় কার্যকলাপই হলো আধ্যাত্মিকতা। অনেকে মনে করে, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা--- অলৌকিক শক্তির অধিকারী হওয়ার জন্য সুলুক-সন্ধান জানা এবং সেই পথে সাধন করাই হলো আধ্যাত্মিকতা।

 

মানব-চেতন বা সচেতন মনের কোন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নেই, আছে যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণ বিজ্ঞান-মনস্কতা। অবচেতন মনের কিছু বিশেষ ক্ষমতা থাকলেও তা' অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নয়। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হলো--- সচেতন মন বা মানব-চেতন মনের পরবর্তী ক্রমোচ্চ চেতন-স্তরের মন গুলি। যারা মানব চেতনা মনের যথেষ্ট বিকাশের পর থেকে, একে একে ক্রমশ বিকাশ লাভ করতে থাকে। কারো মধ্যে পরবর্তী উচ্চ চেতন মনের কিঞ্চিৎ বিকাশ বা স্ফূরণ ঘটতে দেখা গেলে, বুঝতে হবে তা ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ' হলো, পরবর্তী সময়ে বিকাশযোগ‍্য মনটি তার অস্তিত্বের সংকেত পাঠাচ্ছে। এখন, আগের কাজ আগে করতে হবে। মানব মনের বিকাশ না ঘটিয়ে, পরবর্তী উচ্চ চেতন মনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।

 

বস্তুত, প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা আর প্রচলিত--- তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা অনেকাংশেই ভিন্ন। এবং প্রচলিত আধ‍্যাত্মিকতার পথে চলা, আসলে ভুল পথে চলা। এই কারণেই, প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক মানব বিকাশমূলক মৌলিক ধর্মের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। যে ধর্ম মানুষকে শিশু-চেতন স্তরে আবদ্ধ না রেখে, মিথ্যার পিছনে না ছুটিয়ে, সরাসরি মানব-মনের চেতনার বিকাশে সহায়ক হবে, এবং মানুষের কাছে প্রকৃত সত্যকে উন্মোচিত করে--- সেই সত্যে পৌঁছানোর পথ প্রদর্শন করবে। আমাদের সেই চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করে তুলতে, সময়ের প্রয়োজনে---'মহাধর্ম' মানবধর্মের সূচনা হয়েছে আজ। জয়, মানব ধর্ম--- মহাধর্ম-এর জয়।

মন-আমি
(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান হতে গৃহীত)

মানবধর্ম— ‘মহাধর্ম’ এবং মহাধর্মের অনুশীলনীয় পর্ব ‘মহামনন’ —আত্ম-বিকাশ বা মনোবিকাশ কার্যক্রমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমাদের ‘মন’ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক।

‘মন’ হলো— অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো প্রায় বর্ণনাতীত –সাধারণের পক্ষে প্রায় বোধাতীত এক অতি সুক্ষ্ম অস্তিত্ব। মন-সফটওয়ার ও শরীর (হার্ডওয়ার), —এদের মাঝে একটি প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার আছে। এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার-এর মাধ্যমেই শরীর যন্ত্রের যাবতীয় অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপাদি তথা সহজ-প্রবৃত্তিজাত কার্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে। শরীরকে ভিত্তি করেই এই জৈব সফটওয়ার তৈরী হয়েছে। আর, শরীরসহ এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারের ভিত্তিতেই তৈরী হয়েছে— মন-সফটওয়ার।

 

প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার, — উভয়েরই স্বতন্ত্র অবয়ব আছে। এই অবয়ব আমাদের বর্তমান চেতন-স্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। উচ্চতর চেতন-স্তরের মন এই অবয়ব উপলব্ধি করতে সক্ষম। অন্যান্য সমস্ত অস্তিত্বশীলদের মতই উভয় সফটওয়ারেরই আছে অশরীরী দিব্য অস্তিত্ব (দ্রষ্টব্যঃ এস-এক্সিসটেন্স)। একেই অনেকে আত্মা বলে থাকেন। কিন্তু, সমগ্র মন-অস্তিত্বই হলো— আত্মা। সে দেহযুক্তই হোক আর দেহাতীতই হোক (দ্রষ্টব্যঃ আত্মা)।

প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার— উভয়েরই নিজস্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকলেও, কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। একে অপরের উপর, এবং শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপর উভয় জৈব সফটওয়ারই কম-বেশি নির্ভরশীল। আবার, শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপরেও এরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। মানসিক কার্যকলাপ এবং শারীরীক কার্যকলাপ (যা প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার দ্বারা পরিচালিত অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপ) একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার ক’রে পরস্পর সহযোগী হয়ে কাজ ক’রে থাকে। এর পিছনে রয়েছে— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র কার্য-কারণ স্বরূপ অসংখ্য ঘটনার সম্মিলিত ঘটনাপ্রবাহ। শরীর ও মনের ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়া-কান্ডগুলি হলো— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে প্রসুত ফল, এবং সেই সম্মিলিত ঘটনা প্রবাহেরই অংশ, যা আরো অনেক ঘটনার জন্মদাতা (দ্রষ্টব্যঃ ভাগ্য)।

 

ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতই, সমগ্র মন— একের পর এক ক্রমোচ্চ স্তরে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। বিকাশের প্রতিটি চেতন-স্তরে মনের এক এক প্রকার রূপ—গঠণ—কার্যকলাপ। অস্ফূট-চেতন-স্তর থেকে পূর্ণ-চেতন-স্তর অভিমুখে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তুচ্ছ লক্ষ্য থেকে উচ্চ লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা (এ’নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘মহাবাদ’ গ্রন্থে)।

 

তবে, শরীর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অথবা স্বয়ংসম্ভুত হয়ে— মনের সৃষ্টি হয়নি। কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো— মন-সফটওয়ারেরও স্রষ্টা আছে। প্রোগ্রামার— ডেভলপার আছে। প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারসহ মন-সফটওয়ার এবং শরীরযন্ত্র তৈরী হয়েছে— বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর দ্বারা, —ঈশ্বরের মন ও শরীর উপাদান থেকে। এই মহাবিশ্ব— ব্রহ্মান্ডরূপ শরীর আর মহাবিশ্ব-মন নিয়েই হলো— ঈশ্বর অস্তিত্ব।

 

চেতনা হলো— শরীর ও মনের অনুভব—সংবেদন—বোধ করার ক্ষমতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা, কোনো কিছু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার, বিচার-বিবেচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, শরীর ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, কল্পনা—উদ্ভাবন—সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা স্বরূপ।

 

বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডস্বরূপ ঈশ্বর শরীরের সমস্ত কার্যকলাপ— ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই ঈশ্বর-মন ও ঈশ্বর-চেতনার প্রকাশ। আর, জীব ‘আমি’ হলো— সেই দিব্য-চেতন-মন-সিন্ধুর এক একটি বিন্দু স্বরূপ। ঈশ্বর-শরীরের অসংখ্য কোষের মধ্যে এক একটি কোষ-এর মতো। তবে, অন্যান্য কোষের সাথে এর একটু পার্থক্য আছে। জীব হলো— ঈশ্বর উপাদানে— ঈশ্বর সৃষ্ট জীব কোষ।

 

এই মানব-চেতন-স্তরে— দুটি সক্রিয় মন নিয়ে আমাদের মনোজগত। একটি হলো— অবচেতন মন, যে অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। আর অপরটি হলো— সচেতন মন, যে স্বল্পাংশে বিকশিত ও সক্রিয়। এই সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে, তবেই আমরা মানবত্ব লাভ ক'রে— মানবোত্তর উচ্চ-চেতন-স্তরে উপনিত হবো।

 

অবচেতন মন হলো— যুক্তি বিহীন আবেগপ্রবণ অন্ধ-বিশ্বাসী মন। সারা দিন-রাতের অধিকাংশ চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা ও কর্মের পিছনে রয়েছে এই মন। আর, সচেতন মন হলো— যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষনসহ সত্যপ্রিয় মন। অবচেতন মনের কাজকর্মকে যুক্তি-বিচার-সতর্কতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিচালনা করাই এর কাজ। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এই মনটি খুব সামান্য পরিমানে বিকশিত ও জাগ্রত, এবং অধিকাংশ সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায়, তাদের সচেতন মন যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে অবচেতন মনকে সবসময় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হয়না।

 

যে নিজেকে ‘আমি’ বলছে, সেতো আসলে ‘মন’-ই! তবে, কখনো অবচেতন-মন নিজেকে ‘আমি’ বলছে, আবার কখনো সচেতন-মন (মানব-চেতন-মন) নিজেকে ‘আমি’ বলছে। একে অপরকে দাবিয়ে রাখার আমিত্বের লড়াই চলছে— প্রায় সর্বক্ষণ। বেশিরভাগ সময়ে সবল অবচেতন-মন-ই জিতছে এই লড়াইয়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বল্প-বিকশিত দুর্বল সচেতন-মন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কখনো কখনো।

 

অদৃশ্য এই মনদুটিকে যদি মূর্তরূপে দেখতে চাও, তাহলে প্রচলিত ধর্মীয় ভাবনার বাইরে গিয়ে— মা-কালী্র সেই ছবিটাকে মানসপটে অবলোকন করো, যার পদতলে শিব শায়িত রয়েছে। এখানে, রণোন্মত্ত— নৃত্যরত কালী-ই হলো অবচেতন মন। আর, তন্দ্রাচ্ছন্ন শায়িত শিব হলো সচেতন মন।

 

প্রত্যেক (চেতন স্তরের) মনের নিজস্ব স্মৃতি ভান্ডার আছে।অবচেতন মনের স্মৃতিচারণের সময় যদি সচেতন মন সজাগ থাকে, এবং আগ্রহী থাকে, তবেই সচেতন মন সেই স্মৃতি গ্রহন করতে এবং তার স্মৃতি-ভান্ডারে সঞ্চয় করতে পারবে। অবচেতন মন প্রায় সব সময়েই সজাগ থাকায়-- সে আগ্রহী হলে, সচেতন মনের স্মৃতি গ্রহন করতে সক্ষম।

 

সচেতন-মনের শাসনাধীনে থাকতে অবচেতন-মনের মোটেই ভালো লাগেনা। তবু নিরুপায় হয়ে থাকতে হয় তাকে। আমাদের নিদ্রাকালে, সচেতন-মন যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিদ্রিত হয়ে পড়ে, তখন বেশকিছু সময়ের জন্য অবচেতন-মন স্বপ্ন-রাজ্যে কল্পনার পাখা মেলে দিয়ে— সম্পূর্ণতঃ বা অনেকাংশে স্বাধীনতা উপভোগ ক’রে থাকে। আমরা জাগ্রত থাকাকালেও, সচেতন-মনের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঝিমুনো অবস্থায়, অথবা তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অবচেতন-মন নিজের খেয়াল-খুশিমতো কল্পনার জগতে অথবা বাস্তব জগতে অনেক কান্ডই ঘটিয়ে থাকে।

একটি শিশুকে আগ্রহের সাথে বারবার নানাবিধ প্রশ্ন করতে দেখে, আমরা সাধারণতঃ তাকে উন্নতিশীল বা প্রগতিশীল শিশু বলে চিহ্নিত ক’রে থাকি। তার এইসব প্রশ্ন যদি নিছক কৌতুহল না হয়ে জানার আগ্রহ হয়, আর সে যদি তার স্বল্প জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সম্বল ক’রেই যুক্তি-বিচার সম্ভাবনা-অনুমান-এর সাহায্যে সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, এবং সেই পথে সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তখন তাকে আমরা উৎকৃষ্ট শ্রেণীর শিশু বলে থাকি।

 

শুধু শিশুই নয়, বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও এ’কথা প্রযোজ্য। যে সচেতন মনটির মালিক হওয়ার সুবাদে— আমরা মানুষ বলে গণ্য হই, সেই সচেতন বা মানব-চেতন মনটি এখনো আমাদের অধিকাংশের মধ্যে শৈশব অবস্থাতেই রয়েছে। তার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে— তবেই ঘটবে মনোবিকাশ —ঘটবে মানব-বিকাশ।

 

সঠিক বিকাশের জন্য— জানার আগ্রহের সাথে থাকতে হবে সুস্থতা। ক্রোধ-উত্তেজনা-অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, অলসতাউদাসীনতা প্রভৃতি অসুস্থতা জ্ঞাপক দোষসহ অন্ধ-বিশ্বাস, অন্ধবৎ অনুসরণ, নির্বোধের মতো সব মেনে নেওয়া, যুক্তি-বিচারের অক্ষমতা, এবং স্রোতে ভেসে চলার প্রবণতা প্রভৃতি দোষগুলি আমাদের বিকাশের পরিপন্থি। কষ্ট করতে রাজি নয়, এমন একজনের বক্তব্যঃ ‘বিশ্বাস করতে তো আর কষ্ট করতে হয়না, জ্ঞান অর্জনের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়!’ অথচ, জ্ঞানাভাবের কারণে তাকে আরো অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে!  

 

মানব-জীবন লাভ ক’রে— মানব অস্তিত্ব সম্পন্ন উন্নত জীব হয়েও যদি কারো মধ্যে— নিজের সম্পর্কে—জীবন সম্পর্কে জোরালো প্রশ্ন না জাগে, আত্ম-জিজ্ঞাসা— জীবন-জিজ্ঞাসা —বিকাশাকাঙ্খা না জাগ্রত হয়, এবং যদি সে তার উত্তর সন্ধানে— সত্য সন্ধানে যুক্তিপথে অগ্রসর না হয়, সেক্ষেত্রে, তার সচেতন মনের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।

 

সচেতন বা মানব-চেতন মনের ধর্মই হলো— যুক্তি-বিচার-সতর্কতার সাথে বাস্তবপ্রিয়তা ও সত্যপ্রিয়তা প্রভৃতি। আর, অবচেতন বা প্রাক-মানব-চেতন মনের ধর্ম হলো— অন্ধ-আবেগ— অন্ধ-বিশ্বাস, অলীক কল্পনা প্রিয়তা প্রভৃতি। মনে রাখতে হবে, আত্ম-জিজ্ঞাসাই ঊর্ধগামী আত্ম-বিকাশ-পথের প্রথম সোপান। এবং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে— তা’ যেন নিম্নগামী অন্ধবিশ্বাসের আপাত সুখকর পথে নেমে গিয়ে— পথভ্রষ্ট না হয়, —বিপথগামী না হয়।

 

আমাদের সচেতন-মন যত বেশি বিকশিত হবে, আমরা ততই অন্ধ-বিশ্বাস মুক্ত হয়ে— যুক্তি ও জ্ঞানপথে অগ্রসর হতে পারবো। আমরা যুক্তি ও জ্ঞানের পথ ধরে যত চলবো— সেইমতো সচেতন-মনের বিকাশও ঘটতে থাকবে ততই।

 

স্বল্প-বিকশিত সচেতন-মনের মানুষ অন্ধ-বিশ্বাসের পথ ধরে চলতে গিয়ে— বারবার ঘাত-প্রতিঘাতে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত হতে থাকবে, এবং এরফলেই তিলে তিলে তাদের মধ্যে বাস্তব বোধ— যুক্তি বোধসম্পন্ন সচেতন-মনের বিকাশ ঘটতে থাকবে। এইভাবে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনাদায়ক বিচিত্র ঘটনার মধ্যদিয়ে একসময় তাদের সচেতন-মনের বিকাশ ঘটবে।

     

এরই মধ্যবর্তী কোনো কোনো সূক্ষ চেতনস্তরে, অন্ধ-বিশ্বাসকে অপযুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দেখা যাবে। আবার, অন্ধ-যুক্তিবাদী ও অন্ধ-বিজ্ঞান-সমর্থক মানুষের দেখাও পাওয়া যাবে কিছু কিছু, যারা আসলে একশ্রেণীর অন্ধ-বিশ্বাসী।

 

অন্ধ-বিশ্বাস-প্রবন স্বল্প-চেতন মানুষ— ভন্ড-প্রতারকদেরকেই বেশি পছন্দ ক’রে থাকে। যাদের দ্বারা সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তেমন ব্যক্তিদের প্রতিই সে বেশি আকর্ষন বোধ ক’রে থাকে। জ্ঞানী ব্যক্তি— যে প্রকৃতই তার মঙ্গল চায়, তাঁকে এবং তাঁর কথা তার ভালো লাগেনা। ফলে, বারবার প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে সে, যতদিন না তার চেতনা যথেষ্ট জাগ্রত হয়। আবার, কারো কারো চেতনার জড়তা এত বেশি, যে বারবার ঠেকে ও ঠকেও তাদের চেতনা জাগ্রত হয়না।    

নিজের মনকে জানো

(মহর্ষি মহামানস-এর  অধ‍্যাত্ম মনোবিজ্ঞাব হতে, 'মন' সম্পর্কে আরেকটি প্রবন্ধ ) 

মন সম্পর্কে প্রচলিত ধারনায়, মনের দুটি বিভাগ বা অংশের মধ্যে একটি হলো--- হৃদয়, আর অপরটি হলো--- মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক বড় না হৃদয় বড়, এই নিয়ে অনেকের অনেক কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন, হৃদয়বান মানুষ মস্তিষ্কজাত বুদ্ধিমান মানুষ থেকে শ্রেয়।

এখন, আমরাও আমাদের (সক্রিয় ও নিস্ক্রিয় মিলে) সমগ্র মনের মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকায় থাকা দুটি অংশ-মন সম্পর্কে জানি। তার একটি হলো---অবচেতন বা প্রাক-মানবচেতন মন, আর অপরটি হলো--- সচেতন বা মানবচেতন মন।

প্রথমটি হলো কল্পনা ও আবেগ প্রবণ--- যুক্তি-বুদ্ধি বিহীন অন্ধবিশ্বাসী, কাম-ক্রোধ-লোভ-লালসায় আসক্ত অবুঝ মন। প্রয়োজন বোধে এই মন তার চাহিদা পূরণের জন্য অপরাধ করতেও পিছু-পা নয়। এই মনের মধ্যে আবার রয়েছে, তার স্বজাতি---স্বধর্মী---স্বজনদের প্রতি সহজাত টান ও ভালোবাসা। এককথায়, মোহমায়ায় আচ্ছন্ন অজ্ঞান-অন্ধ এক দুর্বার-দুরন্ত শিশু-মানব-মন। 

এই মনটি এখন অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। সচেতন মনের সঙ্গে একত্রে বাস করার ফলে, সচেতন মনের বিকাশের সাথে সাথে এই মনটিও এখন পূর্বের তুলনায় অনেকটাই পরিশীলিত। সচেতন মনের কিছু কিছু গুণ এর মধ্যে সংক্রামিত হওয়ায় সে এখন অনেকটাই আধুনিকা। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় এই মনটির সুমধুর রূপ আমরা প্রত‍্যক্ষ করেছি অনেকবার। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে অসুস্থ হওয়ায়, এই মনও অসুস্থ--- বিকারগ্রস্ত।

দ্বিতীয় সক্রিয় মনটি হলো--- যুক্তি-বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন সজাগ-সচেতন মন। কিন্তু এই মনটি অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই খুব সামান্য মাত্রায় বিকশিত ও সক্রিয়। তাই, এখনো এর কার্যকলাপ খুবই অল্প ও সীমিত।

চোখে ঠুলি পড়ানো তীব্র বেগবান বুনো ঘোড়াসম অবচেতন মনের রাশ বা লাগাম ধরা রয়েছে এই মনের কাছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ ক'রে ভালোভাবে জীবন যাপন করা এবং বিকাশ লাভ করাই হলো এই সত্যপ্রিয় জ্ঞানপ্রিয় সচেতন মনের ধর্ম-কর্ম। অবচেতন মনকে ছাড়া যেমন আমরা চলতে পারিনা, তেমনি সচেতন মনকে ছাড়াও আমরা অচল। এই দুটি মনের মিলিত সহযোগে চলছে আমাদের মানব-মন-সংসার তথা এই মানবজীবন।

এখন, প্রচলিত অর্থে 'হৃদয়' বলতে আমরা এই অবচেতন মনকেই বুঝে থাকি। অনিয়ন্ত্রিত হৃদয়াবেগ-ই হলো অবচেতন মনের ধর্ম। সে সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণাধীন না থাকলে, অন্ধ-আবেগ বশতঃ কখন যে কী করে বসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সে নিজে অন্ধ-বিশ্বাসী হলেও, তাকে মোটেও বিশ্বাস নেই। সে যাকে ও যাদেরকে স্বজন--- সমগোত্রীয়--- সমভাবাপন্ন মনে করবে, তাকে ও তাদেরকে সে প্রাণ দিয়েও সমর্থন করে যাবে। বাকিদের প্রতি সে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। তাদের বিনাশই তার কাম‍্য।

এই আদিমভাব সম্পন্ন মনটিকেই যারা একমাত্র পছন্দ ক'রে থাকে, তাদের মনও সমানুরূপ আদিম অবস্থায় রয়েছে। তাদের সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি এখনও। চারিপাশে একটু পর্যবেক্ষণ করলেই এমন মানুষ বহু দেখতে পাওয়া যাবে।

মন সম্পর্কে আরেকটি কথা বলি, আমাদের এই মন সফ্টওয়্যার এমনভাবেই তৈরি হয়েছে, যে তার মধ্যে অন্তর্গ্রথিত--- জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত প্রোগ্রাম রূপ নির্দেশ মতো যেমন সে কাজ করে থাকে, তেমনি সেই প্রোগ্রামের ভিত্তিতেই সে আবার পরিবেশ- পরিস্থিতি পারিপার্শ্বিকতা থেকেও প্রোগ্রামড্ হতে পারে, এবং সেই প্রোগ্রামরূপ নির্দেশের ভিত্তিতে, তদনুরূপ কাজ করতে পারে। মনের যাবতীয় কার্যকলাপ--- আচরণ, তার চেতন-স্তরের ভিত্তিতে এই দুই প্রকার প্রোগ্রামিং -এর সমন্বয়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। সময়ান্তরে পরিবর্তীত পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে, মনের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে, তাকেই অনেকে মানসিকতার বিবর্তন বলে উল্লেখ করে থাকেন।তবে, সজাগ-সচেতন মন— নিজেকেও নিজে প্রোগ্রামীং করতে সক্ষম। 

সচেতন মন--- কোনোকিছুর সঙ্গে মনোযুক্ত হলে, তখন অবচেতন মন আগ্রহের সাথেই হোক আর বাধ্য হয়েই হোক, সেও সেই বিষয়-বস্তুর সাথে যুক্ত হয়। এবার, সেই বিষয়-বস্তু যদি স্থির বা একঘেয়ে কিছু হয়, অথবা তার আগ্রহের কিছু না হয়, তখন অবচেতন মন চেষ্টা করে--- সেই বিষয়-বস্তু থেকে নিজেকে এবং সচেতন মনকেও বিচ্ছিন্ন করে--- তার নিজের (কল্পনার) জগতে ফিরে আসতে। আর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে একাজে সফল হয়ে থাকে।

'মন' সফ্টওয়্যার-এর প্রোগ্রামিং হলো, মনের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত কোনো তথ্য, তত্ত্ব বা নির্দেশ। এমন এক প্রোগ্রাম-রূপ নির্দেশ, যার দ্বারা সে চালিত হতে পারে অথবা সেই নির্দেশ অনুসারে কাজ করতে পারে।

ধরো, কোনো একটি মনের মধ্যে এমন এক নির্দেশ অন্তর্গ্রথিত করে দেওয়া হলো~ 'এক দলা কাঁচা গোবর দেখলেই তার মধ্যে কামোত্তেজনা সৃষ্টি হবে।' পরবর্তীতে ঠিক তা-ই ঘটবে। তো এই হলো আমাদের মনের অবস্থা।

মনের মধ‍্যে থাকা সংস্কার বা প্রোগ্রামিং-এর সাংকেতিক ভাষা আমরা এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। তবে, মনের পক্ষে বোধগম্য সাধারণ কোনো মানুষি ভাষাতেও তার মধ্যে তথ্য-- তত্ত্ব ও নির্দেশ অন্তর্গ্রথিত করা যায়। আমাদের মন সাধারণ মানুষি ভাষাকেই তার প্রোগ্রামিং কোড-এ কনভার্ট করে, তাকে তার মধ্যে নথিভুক্ত করে নিতে পারে।

একটি বিশ্বাসপ্রবণ মন--- তার স্বভাব ও চাহিদা অনুযায়ী, অনেক তথ্য--তত্ত্ব ও নির্দেশ নিজের থেকেই গ্রহণ করে থাকে। আবার, বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে একজন মন-প্রোগ্রামার মনের মধ্যে কোনো তথ্য-তত্ত্ব ও নির্দেশ অন্তর্গ্রথিত করতেও পারে।

'আমি'--- এই 'আমি' কথাটি কে বলছে! একটু খুঁজলেই দেখা যাবে, এই 'আমি' শব্দটি বলছে, 'মন'। নিজেকে বোঝাতে, নিজের অস্তিত্বকে বোঝাতে, আবার কখনও কখনও নিজের উদ্দেশ্য বলছে সে 'আমি'।

এখন আমাদের এই যৌথ মানস সংসারে, দুটো মন-ই নিজেদেরকে 'আমি' বলছে। যে যখন সক্রিয় থাকছে, তখন তার আমিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে এদের মধ্যে আমিত্বের দ্বন্দ্ব থাকলেও, তার বহিঃপ্রকাশ নেই তেমন। মিলেমিশে 'এডজাস্ট' করে এদের মানস সংসার চলছে।

যখন এদের পার্ট চুকে যাবে, যখন এরা একে একে মঞ্চ থেকে বিদায় নেবে, উচ্চ থেকে আরও উচ্চস্তরের মনের প্রকাশ ঘটবে তখন। তারাও এক এক সময়ে এক একটি মন নিজেকে 'আমি' বলে উল্লেখ করবে। এভাবেই একসময় এই 'আমি' ঈশ্বর 'আমি' -তে পর্যবসিত হবে। এবং সবশেষে পরম আমি-তে মিলিয়ে যাবে সব আমি। এটাই হল বাস্তব ঘটনা।

আমাদের এই জগতের তথা মহাজগতের মূল স্রষ্টা— মূল চালকই হলো— মন। ছোট্ট একটি মিষ্টি নাম—‘মন’। এই জগতে যা কিছু দেখছি— যা কিছু ঘটছে— যা কিছু সৃষ্টি হচ্ছে ও হয়েছে, সমস্ত জগৎ সৃষ্টির পিছিনেই আছে— ‘মন’। শুধু জীবেরই মন আছে— তা-ই নয়, ঈশ্বর-মনও ‘মন’। সর্বোচ্চ চেতনস্তরের মন।

 

আমরা সজাগ—সচেতন মনের অধিকারী বলেই— আমরা মানুষ। অন্যান্য সমস্ত জীবেরই মন আছে, তবে সেই সব মন হলো— নিম্ন চেতনস্তরের অনুন্নত মন। আজকের উন্নত কম্পিউটারের তুলনায় প্রথম দিকের অনুন্নত কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর, সাধারণ মোবাইলফোন প্রভৃতি বিভিন্ন ‘গেজিট’ যেমন— তেমনি। 

আমাদের দর্শনে মনোবিকাশের বেশ কয়েকটি স্তর বা পর্ব রয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে, এক এক করে এই স্তর গুলোতে উত্তীর্ণ হচ্ছি। বর্তমানে মানব-চেতন স্তরের প্রথমাংশে অবস্থান করছি আমরা। মানব চেতন স্তরের বিশেষত্ব হলো যুক্তি-বিচার। পরবর্তী চেতন-স্তরে উত্তীর্ণ হলে, তখন আমাদের মধ্যে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা--- অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার বিকাশ ঘটবে। গন্তব্যে পৌঁছনোর পূর্বে বেশ কয়েকটি চেতন-স্তর পার হতে হবে আমাদের।

এখন, 'গাছে না উঠেই এক কাঁদি' লাভের আশায় স্বপ্ন দেখে দিন কাটালে, গাছে ওঠাই হবেনা। লাভও হবেনা কিছুই। শুধুই হাহুতাশ করে মরতে হবে আমাদের।

প্রচলিত ধর্মের প্রলোভনে মেতে উঠে আমরা এই কাণ্ডটাই করে চলেছি। বর্তমানের কর্তব্য কর্মকে উপেক্ষা করে স্বপ্নের ব‍্যাপারীর প্রলোভনের ফাঁদে পড়েছি আমরা। আগের কাজ আগে না করার ফলে, আমাদের আজ এই দুর্দশা। তা নাহলে, এতদিনে আমরা আরো অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারতাম। আমাদের বিকাশ থমকে রয়েছে এইসব ধর্ম নামের অধর্মের কারণে।


আমাদের মনরাজ্যে অবচেতন মনটি অধিক অংশে বিকশিত এবং অধিক সক্রিয়। সে-ই  এখন প্রধান ভূমিকায় কর্মরত। এই মনটির আছে বিশেষ কিছু গুণ, যাদের ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারলে— অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ সম্ভব, আপাতদৃষ্টিতে অনেক অসাধ্যকেই সাধন করা সম্ভব। তবে এই মনটির মধ্যে অনেক খারাপ গুণও আছে। এই কারণেই একে নিয়ন্ত্রণ করাও খুব দরকার।
 
ক্রমশ বিকাশমান সচেতন মনটি অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই অল্পাংশে বিকশিত— অল্প সক্রিয়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক। মনেরাখতে হবে, সচেতন মনের মালিক হওয়ার কারণেই আমরা— মানুষ। সচেতন মানুষ।


আমাদের এই সচেতন মনের যত বেশি বিকাশ ঘটবে, আমরা ততই বিকশিত মানুষ হয়ে উঠতে পারবো। পূর্ণবিকশিত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে— এই সচেতন মনের বিকাশ ঘটানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এই সচেতন মনকে দিয়ে— সচেতনভাবে, বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন অবচেতন মনকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে, এবং তাকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে— তার খারাপ গুণ গুলির জন্য।
 
কিন্তু যে মনের কারণে আমরা— ‘মানুষ’, -সেই মন সম্পর্কে আমরা অনেকেই বিশেষ অবগত নই, সজাগ-সচেতন নই, —সম্যক জ্ঞান নেই আমাদের। মানব-বিকাশ— দেশের ও সমাজের বিকাশ নিয়ে অনেক উদ্যোগ দেখছি আমরা, কিন্তু উন্নয়নের মূলে আছে যে ‘মন’ –সেই মনোবিকাশের কোনো উদ্যোগ নেই কোথাও।  
 

দেশ-সমাজ-সংসারের যাবতীয় সংকট-সমস্যার সমাধান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন পন্ডিতগণ— নেতা-নেত্রীগণ, কিন্তু অধিকাংশ সমস্যার মূলে রয়েছে যে অসুস্থ-বিকারগ্রস্ত— স্বল্পচেতন মন, সেদিকে খেয়াল নেই অনেকেরই। সমস্যার মূল ছেড়ে দিয়ে, —তার উচিৎ প্রতিকার না ক’রে, অধিকাংশ মানুষই তার শাখা-প্রশাখায় সমাধান খুঁজতে— ওষুধ দিতে ব্যস্ত।


আত্মবিকাশ শিক্ষাকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়, প্রসঙ্গক্রমে মন সম্পর্কে আরো অনেক জানতে পারবো আমরা।

 প্রসঙ্গ : চেতনা 

'চেতনা' সম্পর্কে অনেকের অনেক রকম ধারণা থাকতে পারে। আমি 'চেতনা' বলতে বুঝি, মনের শক্তি--- মানসিক ক্ষমতা। মনন শক্তি, বোঝার ক্ষমতা, অনুভব করার ---উপলব্ধি করার, জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উদ্ভাবন ক্ষমতা বা শক্তি প্রভৃতি। এই ক্ষমতা--- এই শক্তির বিকাশ ঘটলে, এই ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।

আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা যায়, চেতনা হলো— শরীর ও মনের অনুভব—সংবেদন—বোধ করার ক্ষমতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা, কোনো কিছু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার, বিচার-বিবেচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, শরীর ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, কল্পনা—উদ্ভাবন—সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা স্বরূপ।

চেতনার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে, ব‍্যক্তি ক্রমশ নিজেকে বুঝতে, মানুষকে বুঝতে, জাগতিক ব‍্যবস্থাকে বুঝতে ও জানতে সক্ষম হয়ে  ওঠে। সে তখন ক্রমশই (প্রকৃত অর্থে) মুক্ত-মনের মানুষ হয়ে উঠতে থাকে। সমস্ত বিশ্বটাই তার আপন হয়ে ওঠে। অন্ধবিশ্বাস, সংস্কার, প্রচলিত ধর্ম, সম্প্রদায়, রাজনীতিসহ সমস্ত মোহ-মায়ার বন্ধন থেকে সে ক্রমশই মুক্ত হয়ে ওঠে। তার আচরণে, তার মনোভাবেও এই পরিবর্তনের প্রকাশ ঘটতে থাকে ক্রমশ।

চেতনা ও যন্ত্রনা

চেতন-অস্তিত্ব লাভ করার বা প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই যন্ত্রনার পালা শুরু হয়ে যায়। তবে, নিম্ন-চেতন-স্তরগুলিতে বোধ-শক্তি কম হওয়ায়— যন্ত্রনাও কম বোধ হয়। চেতনা যত বর্ধিত হয়, যন্ত্রনাও তত বর্ধিত হতে থাকে। আবার, উচ্চ-চেতনা লাভের পর থেকে যন্ত্রনা ধীরে ধীরে কম অনুভূত হতে থাকে। অনেকটা উচ্চ বা উচ্চতর চেতন-অবস্থায় আর তেমন যন্ত্রনা থাকে না।

পার্থিব দেহ-অস্তিত্ব সম্পন্ন চেতন-সত্তার যন্ত্রনা কিছু বেশি হলেও, দেহাতীত বা দেহ-বিহীন চেতন সত্তাকেও অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। তা’ হলো মানসিক যন্ত্রনা।

সাধারণ মানের--- অল্প সচেতন মানুষ, শারীরিক যন্ত্রনা থেকে মানসিক যন্ত্রনাই বেশি ভোগ করে থাকে। যন্ত্রনার মধ্যদিয়েই মনোবিকাশ তথা চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে তাদের। যে একবার চেতন-অস্তিত্ব লাভ করেছে, তার--- যন্ত্রনা থেকে রেহাই নেই। একমাত্র, দ্রুততার সঙ্গে উচ্চ চেতন-স্তরে উপনীত হতে পারলে, তবেই যন্ত্রনা থেকে অনেকাংশে মুক্তি ঘটবে। তাই, যন্ত্রনা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অথবা যন্ত্রনাকে ভুলে থাকার চেষ্টা না করে, দ্রুত আত্ম-বিকাশ লাভের চেষ্টা করো। আত্ম বিকাশই আমাদের অন্তিম লক্ষ্য।

জাগতিক-ব্যবস্থা মতো— আমাদের জীবন-চলা ঐ পরম লক্ষ্যপানেই এগিয়ে চলেছে। কেউ দ্রুত গতিতে— কেউ ধীর গতিতে, কেউ এগিয়ে, আর কেউ পিছিয়ে। আমরা সবাই এই একই পথের পথিক— বিকাশমান চেতনার পথে। মন থেকে চেতনাকে, চেতনা থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। একের অস্তিত্ব অপরের উপর নির্ভরশীল। চেতনার বিকাশ মানেই মনের বিকাশ বোঝায়


 

আত্মা—মন—পুণর্জন্ম

সমগ্র মন-ই হলো— আত্মা। আত্মা ব’লে আলাদা কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। অহম বোধ সম্পন্ন এবং মনন ক্ষমতা সম্পন্ন চেতন সত্তাটি আসলে মন-ই। সে পার্থিব দেহ সম্পন্ন মনই হোক আর অপার্থিব দেহ সম্পন্ন মনই হোক, জীব-মনই হোক আর ঈশ্বর-মনই হোক, আসলে সে— মন।

আমাদের বর্তমান মনোজগতে কতকটা স্বামী-স্ত্রীর মতই— সক্রিয় মনদুটির একটি হলো— ‘প্রাক মানব-চেতন-মন’ বা অবচেতন মন, আর অপরটি হলো— ‘মানব-চেতন-মন’ বা সচেতন মন। এরা হলো সমগ্র মনের (ক্রমবিকাশমান মনোপদ্মের ) অংশমাত্র। সমগ্র মন হলো— ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতো। অস্ফুট চেতন-স্তর থেকে একটু একটু ক’রে ক্রমশ বিকশিত হতে হতে এক সময় পূর্ণচেতন স্তরে পৌঁছে— পূর্ণ বিকাশলাভ করবে সে।

এক একটি চেতন-স্তরের এক একটি নাম, এক এক রূপ, এবং এক এক প্রকারের কার্যকলাপ। সংক্ষেপে চেতনস্তরগুলি হলো- কীট-চেতন স্তর, সরীসৃপ-চেতন স্তর, পশু-চেতন স্তর, আদিম-মানব চেতন স্তর, মানব-চেতন স্তর, মহামানব চেতন স্তর, দেব-চেতন স্তর, মহাদেব-চেতন স্তর, এবং ঈশ্বর-চেতন স্তর। সমস্ত চেতন স্তরগুলি পৃথিবীতে লভ্য নয়। মানব-চেতন স্তরের পরবর্তী স্তরগুলি অপরাপর বিভিন্ন লোকে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। তবে, মানব-চেতন ও মহামানব-চেতন স্তরের মধ্যবর্তী সন্ধি স্তরের ২।৪ জন মানুষকে কখনো কখনো পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে স্বল্প বিকশিত এই মানব-চেতন-মন বা সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে তবেই পরবর্তী উচ্চ-চেতন (স্তরের) মনের মালিক হতে পারবো আমরা। তারপরেও আরো অনেক পথ পেরতে হবে এই বিকাশপথ ধরে...।

আত্মার পুণর্জন্ম নিয়ে প্রচলিত মতবাদ, অর্থাৎ পরলোকগত আত্মা— পরলোক হতে পৃথিবীতে পুণরায় জন্মগ্রহন করে— এই মতবাদ অনুসারে প্রত্যেক নবজাত মানবশিশুই কোন একসময় পরলোকগত হওয়া কোনো মনুষ্য আত্মার— পরলোক হতে ইহলোকে পুণরাগমন ক’রে— মনুষ্য রূপে পুণর্জন্মলাভ করা এক মানব-অস্তিত্ব!

তাই যদি হয়, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারেনা। আর, মনুষ্যেতর অন্য কোনো জীবের আত্মার পক্ষেও মানুষরূপে জন্মগ্রহন করা সম্ভব নয়। কারণ, সচেতন বা মানব-চেতন মনের সামান্য উপস্থিতি বা বিকাশ না ঘটে থাকলে, তার পক্ষে মানব-অস্তিত্ব সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে স্বল্প মানব-চেতন বা সচেতন মন সম্পন্ন অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে, পৃথিবীতে আদিম মানুষের সংখ্যাও নগন্য। একমাত্র, বিকশিত আদিম মানুষের— যথেষ্ট বিকশিত আত্মার পক্ষেই– আজকের এই মানুষ রূপে পুণর্জন্ম লাভ সম্ভব হতে পারে। অন্য কোনো জীবের পক্ষে তা’ মোটেই সম্ভব নয়।

তাই, যুক্তিসম্মত আধ্যাত্মিক মতবাদ ’মহাবাদ’ —উপরে উল্লেখিত পুণর্জন্মের ধারণাকে সমর্থন করেনা।

 

পুনর্জন্মের প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই পুর্বজন্মের ‘কর্মফল’ কথাটা চলে আসে। ‘কর্মফল’ নিয়ে আমার একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ আছে। এখানে সংক্ষেপে দু’-একটা কথা বলি, ঈশ্বরের রাজ্যে— জাগতিক ব্যবস্থায় আমরা যাকিছু করি— তার জন্য আমরা দায়ী নই। পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যক্রমে (ভাগ্য সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) এখানে সবকিছু ঘটে চলেছে। আমরা যাকিছু করি— তা’ আমরা করতে বাধ্য হই, অর্থাৎ প্রায় ক্রিড়নকের মতোই বাধ্য হয়ে করি। তাই, তার ফলাফলের জন্য আমরা কোনভাবেই দায়ী নই। এখানে আমরা মায় সমস্ত কিছুই পরম্পরাগত ঘটনাস্রোতের ফসল। তবে, ঘটনাক্রমে— বহুকিছু সাপেক্ষে কোন কোন কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতে হয়, আবার কোন কোন কর্মের ফল আমরা ভোগ করিনা। সবকিছুর পিছনেই কার্য-কারণ থাকে।

আর যেহেতু, সাধারণভাবে পৃথিবীতে পুণর্জন্ম হয়না, তাই পূর্বজন্মের কর্মফল পরজন্মে ভোগ করার প্রশ্নই আসেনা। আমরা জীবমাত্রই, পিতা-মাতার নিকট হতে বংশানুক্রমে দেহ-মন লাভ করে থাকি। জীব-অস্তিত্বশীল হওয়ার জন্য পরোলোকগত কোন আত্মার অনুপ্রবেশের প্রয়োজনই নেই এখানে। তবে, বর্তমানের মানুষ সংকর জাতির জীব হওয়ার ফলে, আমরা এক একজন এক এক প্রকারের— বিচিত্ররূপী দেহ-মন সম্পন্ন মানুষ। ভাগ্যক্রমে আমরা এক একজন এক এক পরিবেশ— পরিস্থিতিতে, এক এক প্রকার ভাগ্য অনুসারে কর্ম করে চলেছি।

প্রসঙ্গ : শান্তি
 


'শান্তি— শান্তি’ বলে, মাতামাতি করলেই শান্তি আসবেনা। অশান্তির কারণটাকে বুঝতে হবে ভালোভাবে, এবং সবাইকে তা’ বোঝাতে হবে। তারপর, তার প্রতিকার করতে পারলে, তবেই শান্তি আসবে। যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব, আর শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতাই অধিকাংশ অশান্তির মূল কারণ।

শান্তির জন্য— ভিতরের ও বাইরের সুস্থতাসহ অন্তর্জগত ও বহির্জগত সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যার নিজের সম্পর্কে এবং বহীর্জগত সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই, সে অজ্ঞানতার কারণে— মায়ার বশবর্তী হয়ে, অশান্তিকেই ডেকে আনবে। যাতে অশান্তি সৃষ্টি হয়— সেইরূপ কাজই সে করবে।

বিশেষ চাহিদা বিহীন অর্থাৎ স্বল্প চাহিদা সম্পন্ন নির্জীব অথবা দাস মনোভাবাপন্ন অল্পকিছু অন্ধ-ভক্ত মানুষ— ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন ক’রে ব্যক্তিগতভাবে মানসিক শান্তিলাভে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু তার ফলে বা তার প্রভাবে মানব সমাজে শান্তি আসবেনা।

এখানে উল্লেখনীয়, সাধারণতঃ এরা নিজেকে ও ঈশ্বরকে নিজেদের স্বরূপে না জেনেই, এইরূপ ক’রে থাকে। যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভের পর, নিজেকে ও ঈশ্বরকে সম্যকভাবে জানার পর কেউ সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করলে, তা’ হবে ভিন্ন প্রকৃতির।

অধিকাংশ অশান্তির পিছনে আছে— নানা প্রকারের অনিয়ন্ত্রিত— অবুঝ কামনা-বাসনা —চাহিদা, এবং উগ্র ও বিকৃত চাহিদা। এই সমস্ত চাহিদার পিছনে থাকে— অজ্ঞান বা স্বল্পজ্ঞান সম্পন্ন অসুস্থ মন, এবং অসুস্থ শরীর। থাকে যথেষ্ট চেতনার অভাব।

অনেক অশান্তিকর পরিবেশ-পরিস্থিতির পিছনেও দায়ী মানুষের অজ্ঞান-অসুস্থ মন। তাই সার্বিক মনোবিকাশ না ঘটা পর্যন্ত— এ’সব চলবে— চলতেই থাকবে।

এর সমাধান আছে একমাত্র মানবধর্ম— মহাধর্ম-এ। বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্টায় মহাধর্ম-ই একমাত্র পথ। মহাধর্ম হলো— প্রকৃত মানব-বিকাশের জন্য মূলগত শিক্ষা বা বেসিক সেলফ-ডেভালপমেন্ট এডুকেশন।  

ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে নানাবিধ ক্ষুধা বা চাহিদারূপ অশান্তির বীজ বপন ক’রে দিয়েছে, যাতে আমরা এই সমস্ত ক্ষুধা বা চাহিদার তাড়নায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে— কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে— জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি। ক্রমশ লাভ করতে পারি সেই অমূল্য সম্পদ— চেতনা।

যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভ না হওয়াবধি, অবুঝের মতো শান্তি চাইতে গিয়ে— অশান্তিই বাড়ে। তাই, শান্তি লাভ করতে চাইলে, আত্ম-বিকাশ-এর পথ অবলম্বন করাই একমাত্র কর্তব্য। যার জন্য এই অশান্তি— যার অভাবে এত অশান্তি, সেই জ্ঞান ও চেতনা লাভ না হওয়া পর্যন্ত— ঈশ্বরের কাছে শত মাথা কুটলেও শান্তি পাওয়া যাবে না। 
তাই, নিজের চাহিদামতো ছোটার সাথে সাথে— ঈশ্বরের চাহিদাটাকেও বোঝার চেষ্টা করো।

 সুখ ও শান্তি 
 

শরীর ও মনের চাহিদামত কোন কিছু হতে পারা--- করতে পারা, পেতে পারার ফলে, যে তৃপ্তি--- সন্তোষ--- আরাম লাভ হয়, ভালোলাগা বোধ হয়--- তাই হলো 'সুখ'।

'আনন্দ' সুখেরই একটা রূপ। আনন্দ হলো--- আহ্লাদ ও পুলক যুক্ত, উত্তেজনা বা উচ্ছ্বাস যুক্ত, আমোদ যুক্ত সুখ। যার কমবেশি আচরণগত বহিঃপ্রকাশ ঘটে বা ঘটতে পারে। সুখ বা আনন্দ লাভের চাহিদা ঐচ্ছিক হতে পারে, আবার অনৈচ্ছিকও হতে পারে। অনেক সময়, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা তার সম্পর্কে সচেতন বা জ্ঞাত থাকি না।

আমরা স্ব-ইচ্ছায় যা কিছু করি, সবই ভিতরের চাহিদা--- আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনার দ্বারা তাড়িত হয়েই করে থাকি। এবং তার পিছনে থাকে সেই ইচ্ছা পরিপূর্ণ--- সফল হোক, এইরূপ চাহিদা। অর্থাৎ চাহিদামতো কর্মের ফল লাভের চাহিদা। এই চাহিদা মেটার ফলেই উৎপন্ন হয়--- সুখ। এই সুখ লাভের চাহিদাই আমাদের জীবনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।

চাহিদা সূক্ষ্মও হতে পারে, কোন কোন চাহিদার পিছনে সূক্ষ্ম স্বার্থ থাকতে পারে, আবার অনেক চাহিদা এবং তার সঙ্গে জড়িত থাকা স্বার্থ--- স্থূল বা মোটা দাগের বা মেটিরিয়ালও হতে পারে। কল্পনা ক'রে অথবা শুধু দর্শন লাভ ক'রেও সুখ হতে পারে, আবার ভোজন-- মর্দন বা স্পর্শের দ্বারাও সুখ অনুভূত হতে পারে। তারপর, জ্ঞান লাভেও সুখ অনুভূত হয়।

আর, কাম‍্য নয়--- এমন কিছু ঘটলেই সৃষ্টি হয়--- অসুখ। এই অসুখ--- মানুষকে সমস্ত বাধা-বিঘ্ন-বিপত্তি কাটিয়ে তুলতে, আরো বেগবান--- মরিয়া করে তুলতে, সংশোধিত করে তুলতে সাহায্য করে। নানা উপায় অনুসন্ধান ও উদ্ভাবনে সচেষ্ট এবং কৌশলী করে তোলে। কোন কোন সময়, চাহিদা মেটার ফলে--- সুখ উৎপাদিত না হয়ে, দুঃখ উৎপাদিত হতে পারে। এটা ঘটে--- স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ চাহিদার ফলে। অর্থাৎ যা চাওয়ার নয়, তা-ই চাওয়ার ফলে এমনটি ঘটতে পারে।

এই সুখ কিন্তু খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে--- ক্রমশ এই সুখানুভূতি ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে। কিছুকাল পরে, সুখের তীব্রতা স্তিমিত হয়ে এলে--- তখন, জোরালো সুখ লাভের জন্য অথবা ভিন্নরূপ কোনো সুখ লাভের জন্য ভিতরে ভিতরে নতুন নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা চাহিদার সৃষ্টি হতে থাকে আবার।

প্রধানত, সুখ লাভের চাহিদার জন্যই সবকিছু সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। সমস্ত ঘটন---অঘটনের পিছনে রয়েছে এই সুখ। শরীর ও মনের গঠন, আকার ও উপাদানের বিভিন্নতার কারণে, চাহিদারও প্রকারভেদ ঘটে থাকে। সুস্থ শরীর-মনের সুস্থ চাহিদা নিয়ে তেমন কোনো বিশেষ সমস্যা না থাকলেও, অসুস্থ--- বিকারগ্রস্ত শরীর-মনের অসুস্থ বিকৃত চাহিদা নিয়েই যত বেশি সমস্যার উদ্ভব হয়। সুস্থ ও অসুস্থ উভয় ক্ষেত্রেই--- জ্ঞানাভাব বা স্বল্পজ্ঞান থেকে উদ্ভূত চাহিদাই যত অঘটন--- অনাসৃষ্টি--- সমস্যার কারণ। আর এই অজ্ঞানতা থেকেই আসে অসুখ--- অসুস্থতা। অর্থাৎ অজ্ঞানতা বা সঠিক জ্ঞানের অভাবই অধিকাংশ সমস্যার মূল কারণ।

জাগতিক-ব্যবস্থা আমাদেরকে এই সুখের প্রলোভন দিয়েই কর্মে প্রবৃত্ত করিয়ে থাকে, অথবা কর্ম করতে বাধ্য করায় আমাদের। যাতে আমরা জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে--- ক্রমশ মোহমুক্ত হয়ে, আরো--- আরো বেশি চেতনা লাভ করতে পারি। আমাদেরকে আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই জাগতিক-ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।

শরীর ও মনের ভিতরকার অথবা বহিরাগত কোন অসহনীয় অসুস্থকর বা অসুখকর--- পীড়াদায়ক কিছু অথবা কোন অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটলে, শরীর ও মনের মধ্যে যে স্বস্তি--- উপশম--- আরাম অনুভূত হয়, তা-ই হলো শান্তি।

সুখ লাভ হয়--- সুখদায়ক কোন কিছু ভোগ বা তার সাথে যোগ -এর মধ্য দিয়ে। আর, শান্তি লাভ হয়--- অশান্তিকর কোন কিছু থেকে নিবৃত্তি অথবা তা' থেকে বিয়োগ বা ত‍্যাগের মধ্য দিয়ে। এক এক সময়ে সুখ-ও এমন অসহনীয় এবং পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে, যে তখন আমাদের মনে হয়, ---'সুখের চাইতে শান্তি ভালো'! কিন্তু এই চাওয়াও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাস্তবিকই, সুখ ও শান্তি কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়।

আসলে, দীর্ঘস্থায়ী সুখ ও শান্তি কোনটাই আমাদের কাম্য নয়। তা' হলো জীবন বিরুদ্ধ। আর তা' বিকাশের পক্ষে অনুকূল নয়। তাই, জাগতিক-ব্যবস্থা মতোই, আমরা অনেক সময় ওপরে ওপরে দীর্ঘস্থায়ী সুখ ও শান্তি চাইলেও, প্রকৃতপক্ষে ভেতর থেকে তা' চাই না, বা চাইতে পারি না। তাইতো--- আমাদের 'সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়'। আমাদের কার্যকলাপই অসুখ ও অশান্তিকে ডেকে আনে।

শান্তির জন্য--- ভেতরের এবং বাইরের সুস্থতাসহ অন্তর্জগৎ ও বহীর্জগৎ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যার নিজের সম্পর্কে এবং বহির্জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান নেই, সে অজ্ঞানতা বশতঃ অশান্তিকেই ডেকে আনে। যাতে অশান্তি সৃষ্টি হয় সেইরূপ কাজ-ই সে করে থাকে।

শান্তি বলতে আমরা বুঝি--- এমন একটি অবস্থা, যে অবস্থায় শরীর-মন সাময়িকভাবে উদ্বেগ--- উত্তেজনা, উপদ্রব--- যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট প্রভৃতি থেকে নিবৃত্তি লাভ ক'রে উপশম বোধ করে। সেই অবস্থা--- সেই অবস্থার বোধ-ই হলো শান্তি।

বস্তুত, এই জগত মোটেও শান্তি পূর্ণ নয়। আর আমাদের ভেতরটাও সর্বদা শান্তিপূর্ণ থাকে না। জীবনের চলা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই অশান্তি শুরু হয়ে যায়। কখনো কম কখনো বেশি। কখনো অনুভূত হয়, কখনো হয় না। ব্যক্তি বিশেষে এক এক জনের ক্ষেত্রে এক একটি সহ্যসীমা বা মাত্রা পর্যন্ত অশান্তি অনুভূত হয় না। এই সহ্যসীমা আবার সব সময় এক থাকে না।

জীবনের স্বার্থেই আমরা শান্তি কামনা করি, এবং মাঝে মাঝে কমবেশি তা' লাভ করেও থাকি। কিন্তু সাময়িক শান্তিতে আমরা অনেকেই খুশি নই। চাই আরো বেশি করে--- আরো স্থায়ীভাবে। আমরা অনেকে চিরস্থায়ী শান্তিও কামনা করি, যা আসলে জীবন বিরোধী। জীবনের লক্ষ্য--- জীবনের উদ্দেশ্য অনেকেরই জানা না থাকায়, আমরা এমনটি চেয়ে থাকি।

তাছাড়া, ঘটনাচক্রে বা দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকের জীবনে অশান্তির পরিমাণ খুব বেশি হওয়ায়, এবং /অথবা অনেকের ক্ষেত্রে সহ্য ক্ষমতা কম থাকায়, তারা তীব্রভাবে শান্তিকামী হয়ে ওঠে।

অনেককে দেখা যায়, তারা একদিকে শান্তির জন্য ব্যাকুল, আবার অপরদিকে--- যাতে ঘোর অশান্তির সৃষ্টি হবে, তার আয়োজনে ব্যস্ত। তারা অজ্ঞানতাবশত নিজেদের অজান্তেই অশান্তি ডেকে আনে। অনেক মানুষই সারাজীবন শান্তির খোঁজে ছোটাছুটি ক'রে--- হতাশ হয়েছে এবং হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার জীবনের মূল স্রোত থেকে সরে গিয়েছে অথবা সরে যাচ্ছে।

একটু ভালো ক'রে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, অশান্তির মূল কারণই হলো--- যথেষ্ট জ্ঞান-চেতনা এবং সুস্থতার অভাব। এই জাগতিক সিস্টেম আমাদেরকে ক্রমশ জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন করে তুলতেই আমাদের জীবনে অশান্তির বন্যা বইয়ে দেয়। অপরপক্ষে, জ্ঞান ও চেতনার অভাবেই আমরা নানা অশান্তি--- দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে থাকি।

যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা লাভ হলে, তখন সুস্থতা ও শান্তি আমাদের করায়ত্ত হবে। সুতরাং সত্যিই যদি শান্তি চাও, তাহলে শান্তি না চেয়ে জ্ঞান ও চেতনা চাও। ---একান্ত ভাবে চাও। জ্ঞান-চেতনা লাভের পথেই প্রকৃত শান্তি লাভ সম্ভব হবে। জ্ঞান ও চেতনা লাভ-ই আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

কখনো কখনো চরম অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে--- আমরা শান্তি কামনা করি। কিন্তু শান্তি লাভ হলেই, তখন আমরা সুখ লাভের জন্য ব‍্যাকুল হয়ে পড়ি। তখন সেই সুখ লাভের চাহিদা এবং লব্ধ সুখ থেকেই আবার সৃষ্টি হয় অশান্তি। অধিকাংশ সময়েই আমরা শান্তির চাইতে সুখ ও আত্মসন্তুষ্টি-ই বেশি কামনা করে থাকি।

অনেক সময়েই, আমরা ঠিক কী চাই, তা' আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমরা ওপরে ওপরে শান্তি চাইলেও, আমাদের ভিতরে--- অন্তরের গভীরে যেন এক বিরোধী সত্তা বসে আছে। সে এমন সব কর্ম ক'রে চলেছে, যার ফলে আমরা দুঃখ-কষ্ট-অশান্তি ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছি। অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে, চাই--- আত্ম-জ্ঞান, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, যা মহা আত্মবিকাশ শিক্ষাক্রম তথা 'মহাধর্ম' গ্রহণের মধ্য দিয়েই লাভ করা সম্ভব।

প্রসঙ্গ: যুদ্ধ ও শান্তি 
 

অধিকাংশ সাধারণ মানুষই যুদ্ধ ও ধ্বংস চায় না। তারা শান্তিতে জীবন যাপন করতে চায়। কিন্তু শান্তি পেতে গেলে--- শান্তিতে জীবন যাপন করতে গেলে, যা করণীয় ---তা' কিন্তু তারা করে না। বরং যারা যুদ্ধ চায়--- অশান্তি চায়, বিভিন্নভাবে তাদেরকেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে এবং সহযোগিতা করে থাকে তারা মূর্খের মতো।

এরফলে শান্তি তাদের কাছে অধরাই থেকে যায় চিরকাল।


বাস্তব ঘটনা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীনতা, রাজনীতি --- কূটনীতি এবং মানুষের মন সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায়, তলিয়ে বোঝার চেষ্টা বা ক্ষমতা না থাকায়, সব দেশের অধিকাংশ জনগণই চিরকাল বেদম মার খেয়ে আসছে। এত সত্ত্বেও তাদের চেতনা হয়না।

যুদ্ধের ও অশান্তির কারণ কী, কারা যুদ্ধ ও অশান্তি চায়, কেন চায়--- এগুলো বোঝার সময় এসেছে এখন। নিজেদের স্বার্থেই এগুলো বুঝতে হবে। আপাতত বোঝার পরেও, তা' যদি মোহ- মায়া -অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে, আবার ভুলে যাও, উদাসীন হয়ে যাও, যথাযথ ব্যবস্থা না নাও, ---তাহলে সেই সাংঘাতিক অপরাধের অবধারিত শাস্তি তোমাদের উপর নেমে আসবে। বারবার।

যুদ্ধ ---অশান্তি ---ধ্বংস চায় কিছু অসুস্থ ও বিকৃত- বিকারগ্রস্ত মনের যুদ্ধ- উন্মক্ত ---ধ্বংস-উন্মত্ত মানুষ। আর চায়, কিছু জঘন্য নিচ মনের-- সংকীর্ণ স্বার্থান্বেষী মানুষ। এদের মধ্যে--- মারন- অস্ত্র ব্যবসায়ী, রয়েছে--- রয়েছে ধর্ম ও রাজনীতির সুচতুর ধান্দাবাজ কিছু মানুষ। আর আছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী। এছাড়া অপরাধপ্রবণ সন্ত্রাসবাদী' কিছু মানুষ তো আছেই। নির্বোধের মতো তাদের গোলামী করেই আনন্দ পায় অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। নির্বোধ মানুষ-- নিজেদের অজ্ঞানতার কারণে, ধান্দাবাজ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দলগুলোর দলদাস হয়ে, অত‍্যাচারী ---ষড়যন্ত্রকারীদের নিপীড়নের হাত ক্রমশই শক্ত করে চলেছে।

এদের চিনতে না পারলে, --- চিহ্নিত ক'রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারলে, কোনদিনই অশান্তি থেকে--- নির্যাতন-নিপীড়ন আর বুক ভাঙ্গা কান্না থেকে মুক্তি নেই মানুষের।

সাধারণ মানুষকে নির্বোধ বানিয়ে রাখার পিছনেও রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র! অসৎ ধর্মীয় কারবারি ---রাজনৈতিক কারবারি এবং ব‍্যবসায়ী চক্রের মিলিত ষড়যন্ত্র! এই ষড়যন্ত্রকে চিনতে না পারলে, এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে--- মানুষের মুক্তি নেই। প্রচলিত ধর্ম -- রাজতন্ত্র বা আধুনিক রাজনীতি এবং একশ্রেণীর ব‍্যবসায়ী, এরা একে অপরের স্বার্থের পরিপুরক। যুগযুগ কেটে গেল, তবুও মানুষ এদের চিনতে পারলো না। চেনার চেষ্টাও করলো না! এর চাইতে পৃথিবীতে বড় আশ্চর্যের আর কী থাকতে পারে!!

আবার দেখো, এই মানুষগুলো এতটাই মোহাচ্ছন্ন, ---যে ব‍্যক্তি এদের মোহভঙ্গ করতে যাবে, এরা তাকেই শত্রু মনে করে, সেই উপকারীর উপরেই হিংসা-উন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে!! তো এদের দুর্দশা ঘুঁচবে কি করে?!

জাগো--- ওঠো, বিকাশ লাভ করো।
।। মানব ধর্মই মহাধর্ম ।।

বিশ্বাস কী ও কেন
 

 

যথেষ্ট যুক্তি-প্রমান ছাড়াই, সজাগ-সচেতন-মনের সাহায্যে সম্যকভাবে জানা ছাড়াই— অজ্ঞান-অন্ধত্ব— মোহমায়া বশতঃ কোনোকিছুকে সত্য বলে মেনে নেওয়া, ভ্রমাত্মক বা মায়াত্মক কোনো দর্শন — শ্রবনকে সত্য বলে মনে করা, অথবা কাল্পনিক কোনোকিছু সম্পর্কে স্থির নিশ্চয়াত্মক ধারণাই হলো ‘বিশ্বাস’। অন্যভাবে বলা যায়, ‘বিশ্বাস’ হলো— কোনোকিছু সম্পর্কে অজ্ঞান-অন্ধের মতো ধারণা লাভ করার জন্য অবচেতন মনের এক বিশেষ মানস-ক্রিয়া।

 

অবচেতন মন (আমাদের অধ্যাত্ম মনোবিজ্ঞানে— শিশুমন)-এর মানসক্রিয়া থেকে উদ্ভূত এক বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতাকে বলাহয় বিশ্বাসের শক্তি। ‘বিশ্বাস’ সুপথে চালিত হলে অথবা বিশ্বাসকে ভালো উদ্দেশ্যে— ভালো পথে চালিত করতে পারলে, অনেক ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আবার অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে অথবা কারও হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তা’ বিপথে চালিত হলে— তখন তা’ অত্যন্ত কুফলদায়ক হয়ে থাকে।

বিশ্বাসের বিপরীত দিক— ‘অবিশ্বাস’ নয়। অবিশ্বাস-ও একপ্রকার বিশ্বাস। অন্যকিছুতে বিশ্বাস। বিশ্বাসের অপরদিকে থাকে জ্ঞান। কোনোকিছু সম্পর্কে সচেতন-মন (আমাদের অধ্যাত্ম মনোবিজ্ঞানে— কিশোরমন)-এর ধারণা লাভের মানসক্রিয়া এবং সেই ক্রিয়া হতে লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব জ্ঞান। জানি বা জানিনা। ‘জানিনা’ –এও একপ্রকার জ্ঞান। নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা বা উপলব্ধি থাকলে, এবং সজাগ-সচেতন সত্যাশ্রয়ী হলে, তবেই বলা যায়— ‘জানিনা’। এই ‘জানিনা’-র কাছেই জানার দুয়ার খোলা থাকে।

‘বিশ্বাস’ হলো আমাদের জ্ঞান ও চেতনা লাভের পথে সবচাইতে বড় বাধা। মিথ্যা অহমিকা মুক্ত সজাগ-সচেতন মনে— ‘জানিনা’ শব্দটি থেকে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ‘জানিনা এবং জানতে চাই’ —এই ভাবনাটি আমাদের জানার পথকে প্রশস্ত করে তোলে। আর ‘বিশ্বাস’ সেই জানার পথকে রুদ্ধ করে রাখে।

 

বিশ্বাসের পিছনে থাকে সজাগ সচেতন-মনের অনুপস্থিতি, থাকে অজ্ঞান-অন্ধত্ব —জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতা। থাকে অহমিকা— মিথ্যা অহংবোধ। সেও এক বিশ্বাস। ‘বিশ্বাস’ কথাটির মধ্যেই অজ্ঞান-অন্ধত্ব প্রচ্ছন্ন থাকে। থাকে বিকশিত সচেতনমনের অনুপস্থিতি। তবুও যখন ‘অন্ধবিশ্বাস’ কথাটি বলা হয়, তখন বুঝতে হবে, সেখানে রয়েছে প্রগাঢ় অজ্ঞানতার অন্ধকার। খুব দৃঢ় এবং গভীর বিশ্বাস। যেখান থেকে একজন বিশ্বাসকারী কোনোভাবেই বেড়িয়ে আসতে পারেনা।

 

কোনোকিছু সম্পর্কে না জানা সত্বেও ‘আমি জানিনা’ —একথা স্বীকার করতে চায়না এই অহমিকা। সে নিজের অজ্ঞানতা— অক্ষমতাকে সহজভাবে মেনে নিতে অপারক। তা’ তার আত্মাভিমানকে আহত করে। তাই, সে তার এই অক্ষমতাকে চাপা দিয়ে রাখতে— অনেকসময় ‘বিশ্বাস’-এর আশ্রয় নিয়ে থাকে।

 

একজন স্বল্প-জ্ঞান ও স্বল্প-চেতন মানুষের পক্ষে বিশ্বাস ছাড়া এক পা-ও নড়া সম্ভব নয়। আবার সে যদি তার বিশ্বাসকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে, জ্ঞানলাভে যদি তার অনীহা থাকে, তাহলে তার গতবিধি সেই খুঁটিতে বাঁধা গরুর মতোই সীমাবদ্ধ থাকবে। তার বেশি সে এগুতে পারবে না।

 

বিশ্বাসকে পরিপুষ্ট এবং প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য বিশ্বাসকারীদের একটা অতিসরল যুক্তি হলো— ‘এতো লোক যখন বলছে, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে সত্য আছে’। তারা এটা ভেবে দেখেনা, সারা পৃথিবীর মানুষ যখন বিশ্বাস করতো— সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে, তখন গ্যালিলিওর মতো মাত্র কয়েকজন শুধু জানতো— সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তাহলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস-ই যে সবসময় সত্য হবে, এমন কথা বলা যায়না।

 

বলা হয়ে থাকে, কারো বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবেনা— কারো বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া যাবেনা। কিন্তু না, সব ক্ষেত্রে এ’কথা খাটে না। তার সেই বিশ্বাস যদি অপর কারো পক্ষে ক্ষতিকর হয়, যদি তা’ মানুষ বা মানবজাতির পক্ষে হানিকর হয়, সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বলা যাবে। অবশ্যই প্রতিবাদ করা যাবে।

 

অজ্ঞান-অন্ধ মোহগ্রস্ত মানুষ— মনুষ্যেতর জীবের মতোই সহজপ্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে থাকে। এই মানবজীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই— জানারও আগ্রহ নেই। অন্ধ-আবেগে মিথ্যার পিছনে ছুটে চলাই যেন তাদের জীবন। এর উপরে আবার রয়েছে— প্রচলিত ধর্ম এবং তদ্দ্বারা আরোপিত ধর্মীয় বিশ্বাস। এই ধর্মীয় বিশ্বাস হলো— মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ মুর্খ বানিয়ে রাখার এক গভীর ষড়যন্ত্র।

 

মানুষ যদি হাজার হাজার বছর ধরে, তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া— আরোপিত ধর্মবিশ্বাসের পিছনে না ছুটে, কোনোরূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাডাই— শুধুমাত্র পৃথিবীর মুক্ত পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে সে অনেক বেশি জ্ঞান ও চেতনা লাভ করতে পারতো। তা’ না হয়ে, হাজার হাজার বছর ধরে আরোপিত বিশ্বাসের পিছনে ছুটে চলার ফলে, মানুষের তেমন মনোবিকাশ ঘটেনি। সে আজ গভীরভাবে যুক্তি-বিচার ভিত্তিক মানসিক পরিশ্রম করতে গেলেই কাতর হয়ে পড়ে।

 

আসলে, জ্ঞান অর্জন করতে কিছু মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, —বিশ্বাস করতে তো আর তার দরকার হয়না! তাই, মানুষ জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে জ্ঞানী হয়ে ওঠার শিক্ষার পরিবর্তে— বিশ্বাসী হয়ে ওঠার শিক্ষালাভেই বেশি আগ্রহী। সে মুখে সত্য চাইলেও, অন্তর থেকে চায়না। তার মনোভাব হলো— ‘ঝুটা হি সহি’ অথবা ‘…জাগিও না আমায় জাগিও না…’। আর তাই, মানবসমাজে বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষার এতো রমরমা বাজার।

 

আগেই বলেছি, বিশ্বাসের আছে অনেক শক্তি— অনেক ক্ষমতা। আর এই বিশ্বাসকে সম্বল করেই চতুর্দিকে ঘটে চলেছে বহু প্রতারণামূলক ঘটনা— বহু ঠকবাজীর ব্যবসা। তার মধ্যে প্রধান হলো— ধর্মব্যবসা। বিশ্বাসের প্রবল ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হলে, আধুনিক মনোবিজ্ঞানসহ আমাদের অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান ভালভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এ’নিয়ে ‘মন’ সম্পর্কীত প্রবন্ধে কিছুটা আলোচনা করেছি।

 

আমরা স্বল্প-জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন অসহায় মানুষ। এখনো আমাদের সচেতন-মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি। সাধারণত আমরা যাকে জ্ঞান ব’লে থাকি, তা’ অনেক সময়েই বিশ্বাস মিশ্রিত থাকে। আমাদের অনেক জ্ঞানই বিশ্বাস নির্ভর— বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তা’ গড়ে ওঠে। তাই আমাদের সমস্ত জ্ঞানই বিশুদ্ধ জ্ঞান নয়। ‘বিশ্বাস’ প্রসঙ্গে ‘জ্ঞান’ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। ‘জ্ঞান’ লাভ এবং ‘জ্ঞান’ হলো— সচেতন মনের এক বিশেষ মানসিক ক্রিয়ার দ্বারা কোনকিছু সম্পর্কে ধারণা লাভ, তথ্য ও তত্ত্ব গ্রহণ বা আহরণ, এবং সংগৃহীত সেই তথ্য ও তত্ত্ব ধারণার মানসিক ভান্ডার। সচেতন মনের বিকাশের উপর এই জ্ঞানের মাত্রা নির্ভরশীল। কারো মধ্যে সচেতন মন কম বিকশিত হলে, স্বভাবতই অবচেতন মনের কর্তৃত্ব সেখানে বেশি থাকে। এবং তার ফলে, তার ‘জ্ঞান’ হয় আংশিক ‘জ্ঞান’ এবং তা’ অনেকটাই বিশ্বাস মিশ্রিত এবং বিশ্বাস নির্ভর হয়ে থাকে।

যেহেতু আমাদের জ্ঞান ও চেতনা খুবই কম, তাই বিশ্বাস ছাড়া আমরা চলতে পারিনা। আবার এই বিশ্বাসই অধিকাংশ অনিষ্টের মূল কারণ। এমতো জটিল অবস্থায়, সবচাইতে ভালো উপায় হলো— সমস্ত জ্ঞানকে 'আপাত জ্ঞান' বা 'আপাত সত্য' রূপে গ্রহণ ক’রে, এবং সমস্ত বিশ্বাসকে 'আপাত বিশ্বাস' রূপে গণ্য করে— চোখ-কান খোলা রেখে, সজাগ-সচেতনভাবে যুক্তি-বিচারের পথ ধরে সত্যান্বেষণে এগিয়ে চলা। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও চেতনা লাভ না হওয়া অবধি এইভাবেই চলতে হবে।

 

মনেরাখতে হবে, আমরা এখানে এসেছি এক শিক্ষামূলক ভ্রমনে। ক্রমশ উচ্চ থেকে আরও উচ্চ চেতনা লাভই —এই মানবজীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এখানে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে যত বেশি চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবো, তত বেশি লাভবান হবো। মানবজীবন সার্থক হয়ে উঠবে তত বেশি।

 

প্রকৃতির নিয়মেই আমরা বিশ্বাস করে থাকি, বিশ্বাস না করে উপায় থাকেনা। আবার প্রকৃতির ব্যবস্থা মতোই আমরা একসময় বিশ্বাসের পর্যায় বা স্তর পার হয়ে— ক্রমে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাই। যেমন শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন..., ঠিক তেমনভাবেই ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলা। যদিনা কোনো কারণে কেউ শৈশবে বা কৈশোরেই আটকে থাকে।

 

এই বিকাশ-পথটির মধ্যে কয়েকটি ধাপ বা পর্যায়ভাগ আছে। পুরোপুরি বিশ্বাসের স্তরটি হলো— শৈশব স্তর। তারপর জ্ঞান ও বিশ্বাসের মিশ্র স্তরটি হলো— কৈশোর। যৌবন হলো— যুক্তি-বিচার-প্রমানসহ জ্ঞান-পথ ধরে এগিয়ে চলার পর্যায় বা স্তর। এই স্তরে বিশ্বাসের উপস্থিতি খুবই কম। এর পরের স্তরটি হলো— প্রজ্ঞান স্তর। যৌবনের পর এই প্রৌঢ় পর্যায়ে— যুক্তি-বিচার-প্রমান ভিত্তিক জ্ঞানের প্রাধান্য কমে গিয়ে, ক্রমশ অন্তর্জ্ঞান— অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ ঘটতে থাকে। এই ভাবেই মনোপদ্মের পাঁপড়িগুলি একের পর এক স্তরে স্তরে বিকাশলাভ করতে থাকে, এবং সেই সঙ্গে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে একসময় পূর্ণ বিকাশলাভ করতে সক্ষম হই। বর্তমানে আমরা কেউ শৈশবে— কেউ কৈশোর-চেতন স্তরে অবস্থান করছি। এখন বিশ্বাসের পথ পেরিয়ে এসে জ্ঞানের পথে অর্থাৎ যৌবনে বা মানব-চেতন-স্তরে পদার্পন ক’রে, পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য।

বিশ্বাস নিয়ে আরও কিছু রচনা—

দৃঢ় বিশ্বাসই হলো অন্ধ-বিশ্বাস।

দৃঢ় অবিচল বিশ্বাসই হলো অন্ধ-বিশ্বাস। যা স্বল্পজ্ঞান বা অজ্ঞান-অন্ধত্বের পরিচায়ক। এই বিশ্বাসই হলো যত নষ্টের মূল। সারা পৃথিবী জুড়ে, মানব জগতে যত সমস্যা, যত অঘটন, যত সঙ্কট, তার অধিক অংশের মূলেই আছে--- বিশ্বাস বা অন্ধ-বিশ্বাস।

অন্ধ-বিশ্বাসের অন্ধকার দুনিয়াটাকে যদি বদলাতে চাও, যদি জীবনকে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে তুলতে চাও, তাহলে এখন থেকে 'বিশ্বাস' কথাটাকে বিদায় দিয়ে বলো, ধারণা বা অনুমান অথবা আপাত আস্থা, আপাত সত্য, আর না হয় বলো, আপাত বিশ্বাস। অস্পষ্টভাবে অনেক জানার চাইতে, স্পষ্টভাবে একটু জানা অনেক ভালো। 

ঈশ্বর এবং আধ‍্যাত্মিক বিষয়েও, বিশ্বাস ছাড়াই--- যুক্তি পথেই বেশি জানা সম্ভব। শুধু এতদিনের অভ‍্যাসটাকে পাল্টে, যুক্তিপথে সত‍্যানুসন্ধিৎসু মুক্তমন নিয়ে এগতে হবে আমাদের।

নিজ সম্পর্কে--- নিজ অস্তিত্ব, নিজের অবস্থান সম্পর্কে, নিজের ক্ষমতা ও প্রবনতা, নিজের লক্ষ্য--- কর্তব্য, অন‍্যান‍্য ব‍্যক্তি এবং তাদের সঙ্গে নিজের সম্মন্ধ, নিজের অধিকার, নিজের অর্থ-সম্পদ, নিজের ক্ষুদ্র জগত থেকে বৃহত্তর জগত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, ঈশ্বর সহ অদেখা বহু অস্তিত্ব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং তার ভিত্তিতে সৃষ্ট--- ভ্রান্ত চাহিদা ও স্বার্থবোধের বশবর্তী হয়ে, আমরা মোহগ্রস্তের ন‍্যায় এক মায়াত্মক জগতের মধ্যে বাস করছি। অনিত‍্যকে নিত্য ভেবে, ক্ষুদ্রকে সম্পূর্ণ ভেবে, যা নিজের নয় তাকে নিজের ভেবে, যে যা নয়--- তাকে তা-ই ভেবে, ভ্রমাত্মক 'আমি' -কে নিয়ে সর্বক্ষণ মত্ত হয়ে আছি আমরা।

যতক্ষণ না এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে এসে, নিজেকে এবং এই জগতকে নিজেদের স্বরূপে আবিষ্কার করতে পারছি, ততক্ষণ এই নরক-যন্ত্রণারূপ ভ্রমাত্মক-যন্ত্রণাময় জীবন থেকে আমাদের মুক্তি নেই। 
ভ্রান্ত ধারণা--- ভ্রান্ত বিশ্বাস-ই আমাদের অধিকাংশ সুখ-অসুখ, দুঃখ-কষ্ট-অশান্তির কারণ। 

অন্ধবিশ্বাস--- সাংঘাতিক সংক্রামক জীবাণুর চাইতেও ভয়ংকর! 



মাঝে মাঝেই অন্ধবিশ্বাসীদের বলতে শোনা যায়, তাঁঁদের বিশ্বাস (যা আসলে অন্ধবিশ্বাস)-এর বিরোধিতা করা নাকি তাঁঁদের ব‍্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা! 



এখন, একজন অন্ধবিশ্বাসী কি তার বিশ্বাস শুধু তাঁঁর ব‍্যক্তিগত ক্ষেত্রে— নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে? না, তা' রাখে না। তারা তা' যদি রাখতো, তাহলে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি হতোনা। 



ঠিক ভয়ানক সংক্রামক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত মানুষের মতোই, একজন অন্ধবিশ্বাসী--- তাঁঁর সন্তান এবং নিকটজনসহ তাঁঁর চারিপাশের বহু মানুষের মধ্যেই তাঁঁর অন্ধবিশ্বাসের সংক্রমণ ঘটাতে সদা তৎপর থাকে। আর এইভাবেই, ক্রমাগত মানব সমাজের সাংঘাতিক ক্ষতি করে চলেছে তারা!

ভ্রান্ত ধারণা--- ভ্রান্ত বিশ্বাস-ই আমাদের অধিকাংশ সুখ-অসুখ, দুঃখ-কষ্ট-অশান্তির কারণ। নিজ সম্পর্কে--- নিজ অস্তিত্ব, নিজের অবস্থান সম্পর্কে, নিজের লক্ষ্য— কর্তব্য, অন‍্যান‍্য ব‍্যক্তি এবং তাদের সঙ্গে নিজের সম্মন্ধ, নিজের অধিকার, নিজের অর্থ-সম্পদ, নিজের ক্ষুদ্র জগত থেকে বৃহত্তর জগত সম্পর্কে, ঈশ্বর সহ অদেখা বহু অস্তিত্ব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং তার ভিত্তিতে সৃষ্ট— ভ্রান্ত চাহিদা ও স্বার্থবোধের বশবর্তী হয়ে, আমরা মোহগ্রস্তের ন‍্যায় এক মায়াত্মক জগতের মধ্যে বাস করছি।

​অনিত‍্যকে নিত্য ভেবে, ক্ষুদ্রকে সম্পূর্ণ ভেবে, যা নিজের নয় তাকে নিজের ভেবে, যে যা নয়, তাকে তা-ই ভেবে, ভ্রমাত্মক 'আমি' -কে নিয়ে সর্বক্ষণ মত্ত হয়ে আছি আমরা। যতক্ষণ না এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে এসে, নিজেকে এবং এই জগতকে নিজেদের স্বরূপে আবিষ্কার করতে পারছি, ততক্ষণ এই নরক যন্ত্রণাময় জীবন থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

 

বিশ্বাস ও জ্ঞান


প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থেকেই বিশ্বাসের জন্ম। প্রকৃত বা অপর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব সত্ত্বেও, কোন বিষয়-বস্তু বা ব্যক্তি সম্বন্ধীয় ধারণাকে , অথবা স্পষ্ট উপলব্ধ নয়--- এমন কোনো ধারণাকে সত্য বলে মনে করা বা মেনে নেওয়া অথবা লব্ধ জ্ঞান বলে মনে করাই হলো বিশ্বাস। আর, এই সহজ স্বভাবজ বিশ্বাসকে দৃঢ়মূল এবং আমাদের মজ্জাগত করে তুলেছে, প্রচলিত ধর্ম।

দুর্বল বা শিথিল বা সন্দেহযুক্ত বিশ্বাসকে প্রকৃত বিশ্বাস বলা যায় না। সেক্ষেত্রে বিশ্বাস দৃঢ়--- একমুখী হয় না। বিশ্বাসের মধ্যে দ্বিধা- দ্বন্দ্ব- সন্দেহ যুক্ত থাকে। অথবা বিশ্বাসের সাথে জ্ঞান মিশ্রিত থাকে সেখানে। তবে, কোনো কিছু অনুমান করা অথবা কাজের সুবিধার জন্য কোন কিছু ধরে নেওয়া, অথবা কল্পনা করে নেওয়াটা--- বিশ্বাস নয়। 

অবিশ্বাসও বিশ্বাস। তা' অপর কোন কিছুতে বিশ্বাস। অপর কোনো কিছু বিশ্বাসের সাপেক্ষে--- 'এটা নয়' অথবা 'এটা হতে পারে না' ---এরূপ বিশ্বাস। 

বিশ্বাস অনেক প্রকারের হতে পারে, ---প্রকৃত বিশ্বাস বা দৃঢ় (অন্ধ) বিশ্বাস, জ্ঞানের মোড়কে বিশ্বাস, আংশিক বিশ্বাস বা আংশিক জ্ঞান মিশ্রিত বিশ্বাস, বিশ্বাসের মোড়কে জ্ঞান--- যে জ্ঞানকে যুক্তি-প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর এক প্রকার হলো, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্ট বিশ্বাস--- কাল্পনিক কোনো কিছুকে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে
বিশ্বাস রূপে, অর্থাৎ সত্য বলে, প্রতিষ্ঠা করা--- বিশ্বাস।

প্রকৃত বা দৃঢ় (অন্ধ) বিশ্বাসী বা বিশ্বাসকারীদের কাছে,  তার বিশ্বাসই শেষ কথা। ---তা'ই পরম সত্য! সেখানে কোনো তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে না। তবে, যারা তাঁদের বিশ্বাসকে--- লব্ধ জ্ঞান বলে মনে করে, তারা অনেক সময়েই যুক্তি প্রমাণাদির দ্বারা তাদের বিশ্বাসকে প্রকৃষ্ট জ্ঞান রূপে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। অনেক সময়েই এদের বিশ্বাসের সাথে জ্ঞান মিশ্রিত থাকে।

অনেক সময়, জ্ঞান আর বিশ্বাসকে আলাদা ক'রে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সাধারণত, মানুষ যাকে 'জ্ঞান' বলে থাকে, অনেক সময়েই দেখা যায়, সেই জ্ঞানও এক প্রকার বিশ্বাস। অর্থাৎ কোনো অপ্রত‍্যক্ষ অনুপলব্ধ তথ্য বা তত্ত্বকে জ্ঞান ব'লে, বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। অনেক সময়, এই সমস্ত জ্ঞান নানা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে, এবং এই সমস্ত জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসও মিশ্রিত থাকে। তাই, এইসব জ্ঞান আসলে বিশ্বাসেরই নামান্তর। এগুলি প্রকৃত বা বিশুদ্ধ জ্ঞান নয়।

জ্ঞান হলো
কোন বিষয়-বস্তু সম্বন্ধে নিরপেক্ষ দৃষ্টি সম্পন্ন অথবা ওই বিষয়-বস্তুতে অনাসক্ত একজন যথেষ্ট সজাগ-সচেতন-সত্যপ্রিয়, সতর্ক, সত‍্যানুসন্ধিৎসু মানুষের লব্ধ তথ্যতত্ত্ব ও উপলব্ধি বা পর্যাপ্ত ধারণা। যদিও, এইরূপ ব্যক্তি সমস্ত জ্ঞানকেই আপাত জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। একজনের কাছে যেটা জ্ঞান, আরেকজনের কাছে সেটাই আবার বিশ্বাস হতে পারে। যদি কোনো বিশ্বাসপ্রবন মানুষ ওই জ্ঞানীর উপলব্ধ জ্ঞানের কথার উপর বিশ্বাস ক'রে থাকে, তখন তার কাছে তা' শুধুই বিশ্বাস।

কোনটা জ্ঞান কোনটা জ্ঞান নয়, অথবা শুধুই বিশ্বাস, ---এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা থাকা আবশ্যক। সেইসাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টি বা অনাসক্ততাসহ থাকতে হবে সত্যপ্রিয়তা। বিশ্বাসপ্রবণতা--- ব্যক্তিকে প্রকৃত জ্ঞান লাভে অক্ষম করে তোলে।

এই মানব জগতে
এত অন্ধকার কেন! এই জগতের একটা অংশ গড়ে উঠেছে--- জ্ঞান-বুদ্ধি যুক্তি-বিচার ও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি ক'রে। আর, অপর অংশটি গড়ে উঠেছে--- অজ্ঞান অবচেতন মনের অন্ধবিশ্বাস, সহজপ্রবৃত্তি ও অন্ধ-আবেগের উপর ভিত্তি করে। সচেতন মনের বিকাশের সাথে সাথে--- মানুষ এদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে, এদের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম হয়ে উঠলে, তবেই এই জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকার দূর হয়ে--- জ্ঞান ও চেতনার আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে এই জগত।

বিশ্বাস হলো
অন্ধ ধারণা, মায়াত্মক জ্ঞান। আবার, সাধারণত আমরা যাকে জ্ঞান ব'লে, বিশ্বাস করে থাকি, তার অধিকাংশই  কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে প্রতীয়মান সত্য বা আপাত সত্য। যাকে বলে, ওপর ওপর--- ভাষা ভাষা জ্ঞান। বিশ্বাসের বিষয়-বস্তু কখনো সত্য হতেও পারে, আবার কখনো নাও হতে পারে। কখনো আবার আংশিক সত্যও হতে পারে। কিন্তু সে যা-ই হোক, তা' বিশ্বাসকারীর উপর নির্ভর করেনা।

আমরা সত্যকে ভালোবাসি
শুধু মুখের কথায়, ওপরে ওপরে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা সত্যকে চাইনা। আমরা আসলে সত্যকে ভয় পাই। এই ভয় হলো, আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ভয়। যা দাঁড়িয়ে আছে অনেকাংশে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে। আমরা আমাদের বিশ্বাসকেই সত্য বলে ভাবতে ভালোবাসি। তবে এসবই ঘটে আমাদের অজান্তে অবচেতনে।

আমাদের অজ্ঞান-অন্ধ মন, ---তার বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে, সে নানা যুক্তি
কারণ প্রমাণ খোঁজ ক'রে থাকে। অনেক সময় সে তার বিশ্বাসকে মজবুত করে তুলতে, ভালো কোনো গল্প ফাঁদে। যারা তার ওই বিশ্বাসকে এবং তার গল্পকে সত্য বলে মেনে নেয় বা বিশ্বাস করে, সে তাদেরকেই ভালোবাসে এবং তাদেরকে তার নিজের লোক বলে, মনে করে। অধিকাংশ মানুষ গল্পেই মজে থাকতে ভালোবাসে, সত্যে তাদের অত্যন্ত অনীহা।

এ এক মায়াময় জগত। বিশ্বাসই এই জগতকে কখনো স্বর্গীয় সুষমামন্ডিত করে তোলে, আবার বিশ্বাসই এই জগতকে নরকে পরিনত করে তোলে। বিশ্বাসেই মানুষ নিজেকে সুখী মনে করে, আবার বিশ্বাসেই মানুষ নিজেকে দুঃখী ভেবে থাকে। অজ্ঞান-অন্ধ মানুষ
তাদের এই মায়াত্মক বিশ্বাসের জগত থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের এবং এই জগতের প্রকৃত স্বরূপকে জানার বা দেখার কথা ভাবতেই পারেনা। তাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে এবং এই জগৎ ও তার কার্যকারণ সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়না। তাদের কাছে তাদের ঐ বিশ্বাসের জগৎটাই বাস্তব জগত। তার বাইরে আর যা কিছু সব অবাস্তব। 

এত অল্প জ্ঞান--- চেতনা ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে, মানুষ ভিতরে ভিতরে মোটেই সুখী--- সন্তুষ্ট নয়। আবার এই স্বল্প জ্ঞান ও চেতনার কারণেই মানুষের অহংকার
আত্মম্ভরিতাও বেশি। জ্ঞানাভাবকে মানুষ তাই মেনে নিতে পারে না। অনেকে আবার তাদের জ্ঞানাভাবকে স্বীকারই করতে চায় না। অপরাপর মানুষের কাছে নিজেদেরকে অসাধারণ জ্ঞানী প্রতিপন্ন করতে গিয়েই যত সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক বিশ্বাসের সৃষ্টি হয় এখান থেকেই। 

অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণ সেই সব মানুষদের সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। জ্ঞান
চেতনা, বোধশক্তি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও, যারা ওপর-চালাকির দ্বারা জ্ঞানের ঘাটতি পূরণে সর্বদা তৎপর, যারা মনে করে অথবা ভান করে তারা সব জানে, অথচ বিশেষ কিছুই জানে না, জাগতিক দুর্ভোগ দুঃখ -কষ্ট, যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই বহুকাল ধরে তিলে তিলে জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে তাদের। 

চেতনা বৃদ্ধির সহজ ও স্বাভাবিক পথ হলো, মানুষ যদি তার নিজের সম্পর্কে, নিজের ক্ষমতা-অক্ষমতা
অজ্ঞানতা সম্পর্কে সজাগ থেকে, জ্ঞান লাভের জন্য সত্যান্বেষীর মতো চোখ-কান খোলা রেখে সর্বদা সচেষ্ট থাকে, তাহলেই তার দ্রুত জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধি পাবে। 

কিন্তু জ্ঞান অর্জন করতে যে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, বিশ্বাস করতে তো আর তার দরকার হয় না! তাই পরিশ্রম বিমুখ কল্পনাবিলাসী মানুষ জ্ঞানের পথে না গিয়ে
বিশ্বাসেই মজে থাকতে ভালোবাসে। 

অল্প বা স্বল্প চেতন-স্তরের মানুষের পক্ষে বিশ্বাস ছাড়া বাঁচাই সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বিশ্বাস উভয়কেই প্রয়োজন। এদের জ্ঞানের যা অবস্থা, তাতে করে সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর বা ভরসা করে থাকা সম্ভব নয়। তাই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে বা ভরসা করেই বেঁচে থাকে তারা। কিন্তু এভাবে তো আর চিরকাল চলে না, জীবনের পথে চলতে চলতে--- মনোবিকাশের সাথে সাথে, জ্ঞান ও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে
বিশ্বাসের ক্ষয় হতে থাকে ক্রমশ। 

চেতনায় এগিয়ে থাকা অনেক মানুষই এটা বোঝেন, যে অন্ধ-বিশ্বাস তাদের বিকাশের পরিপন্থী। তাই, বিশ্বাস থাকুক বিশ্বাস রূপেই, জ্ঞান বা সত্য রূপে নয়। 

বিশ্বাসের প্রয়োজন আছে, কিন্তু বিশ্বাসকে সচেতন ভাবে
'বিশ্বাস' রূপে অথবা আপাত-বিশ্বাস রূপেই চিহ্নিত করতে হবে, এবং গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাসকে সত্য বা উপলব্ধ জ্ঞান রূপে গ্রহণ করলে, আমাদের বিকাশ প্রায় থমকে যাবে, অথবা বিকাশের গতি অতি মন্থর হয়ে পড়বে। আর যথাযথ বিকাশ না ঘটলে, এইভাবে অজ্ঞান-অন্ধ হয়ে, দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণা, দুর্দশার মধ্য দিয়েই কাটাতে হবে সারা জীবন। মনে রাখতে হবে, আমাদের একটি সচেতন মন আছে বলেই, আমাদের অন্ধ-আবেগকে সচেতন মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই বলেই, আমরা মানুষ। সেই সচেতন মনের বিকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হওয়াই প্রতিটি মানুষের প্রধান কর্তব্য।

শুনতে অবাক লাগলেও, আমার অভিধানে 'বিশ্বাস' নামে কোনো শব্দ নেই। এই 'বিশ্বাস'-ই হলো~ পৃথিবীতে যত নষ্টের গোড়া। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ধর্ম মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, তার স্বার্থে। তাই বিশ্বাস মানুষের মজ্জাগত হয়ে গেছে। বিশ্বাস ছাড়াও যে জীবন চলতে পারে, এ কথা মানুষ ভাবতেই পারেনা। 


আমি কখনোই বলি না, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি বলি, যুক্তি-বিচার আর বিজ্ঞান-মনষ্কতার কষ্ঠিপাথরে আমার কথা যাচাই ক'রে, তারপর গ্রহণযোগ্য মনে হলে, তবেই তাকে গ্রহণ করো। আমি তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে চাইনা, চাই নির্ভরযোগ্য হতে।

বিশ্বাস কথাটা নয়, বলো-- 'জানি' অথবা 'জানি না'। এর মাঝখানে আছে হতে পারে, অনুমান, ধারণা, মনে হয়, প্রভৃতি। বড়জোর বলা যেতে পারে, আপাত বিশ্বাস। 


এভাবে চললে, কখনোই বিশ্বাস হারানো বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়া, অবিশ্বাস করা, এবং বিশ্বাস ঘাতকের কবলে পড়তে হবেনা। 'বিশ্বাস' ছাড়াই— যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে চললে, জীবন অনেকটাই শুভ ও ধনাত্মক হয়ে উঠবে। ঋণাত্মকতা দূর হয়ে যাবে।

তা'ই বলে আমি বলছি না, অবিশ্বাস করতে, সন্দেহের চোখে দেখতে। আমি বলতে চাইছি, সর্বদা সজাগ- সচেতন ভাবে থাকতে।

'বিশ্বাস' কথাটার মধ্যেই নিহিত থাকে অজ্ঞান-অন্ধত্ব, অনিশ্চয়তা, সন্দেহ-অবিশ্বাস-এর একটা চোরা স্রোত। থাকে বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার বা বিশ্বাস হারানোর আশঙ্কা।

'বিশ্বাস' মানেই নিশ্চয় জ্ঞান নয়, এটা জানা সত্বেও, সম‍্যক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও, সচেতন মনের সতর্কতার বিরুদ্ধে গিয়ে-- কোনো কিছুকে বা কাউকে জোর ক'রে সত্য বলে মেনে নেওয়ার ভিতরে প্রচ্ছন্ন থাকে— আত্মপ্রবঞ্চনা। থাকে দুটি (সচেতন ও অবচেতন) মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। 

 

প্রসঙ্গ : জ্ঞান
 

বিজ্ঞান প্রসঙ্গে বলেছি, (বিশেষভাবে উল্লেখিত) জ্ঞান ও বিজ্ঞান হলো— বিশ্বপ্রকৃতি এবং তার অন্তর্গত বিভিন্ন বিষয়-বস্তু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অথবা যুক্তি-বিচার-প্রমান সাপেক্ষে বিশেষভাবে অবগত বা উপলব্ধ তথ্য এবং/অথবা তত্ত্ব মূলক (আপাত) সত্য। এছাড়া, বোধ-বুদ্ধি-প্রাণময়তাকেও জ্ঞান বলা হয়ে থাকে। তবে, এখানে সে কথা নয়।

আমাদের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে বহুমাত্রিক স্তর। জ্ঞানীর গ্রহণ ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা এবং অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কোনো বিষয়-বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান এবং তার গভীরতার বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন স্তরের জ্ঞান লব্ধ হয়ে থাকে।

তবে, বিভিন্ন বিষয়-বস্তু সম্পর্কে এই সমস্ত জ্ঞান-স্তরগুলি ঠিকমতো নির্ধারণ করা বা পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এখনও।

আমরা সোজা কথায়, সমস্ত জ্ঞানকে দুই ভাগে বিভক্ত ক'রে বলে থাকি, ওপরে ওপরে বা ভাসাভাসা জ্ঞান, আর গভীর জ্ঞান। কিন্তু এ' হলো অতি সরলীকরণ। ভাসাভাসা জ্ঞানের মধ‍্যেও রয়েছে বহু স্তর। আবার গভীর জ্ঞানের মধ‍্যেও রয়েছে বহু স্তর।

এটা হলো জ্ঞানের একটা দিক। আরেকটা দিকেও রয়েছে দুটি বিভাগ। তার একটা হলো তথ্যগত জ্ঞান, এবং অপরটি হলো উপলব্ধ বা অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান। এই দুটি বিভাগের মধ‍্যেও রয়েছে বহু মাত্রিক স্তর।

তথ্য-জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের একটা মোটামুটি ধারণা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তত্ত্ব-জ্ঞান-ও যদি কারো সম‍্যক উপলব্ধ জ্ঞান না হয়, সেক্ষেত্রে সেও হবে তথ্য-জ্ঞান।

এছাড়াও, জ্ঞানের আরও কয়েকটি প্রকারভেদ আছে, যেমন অন্তর্জ্ঞান ও বহীর্জ্ঞান, জ্ঞান রূপে বিশ্বাস অর্থাৎ জ্ঞান বলে মনে করলেও আসলে তা' বিশ্বাস, বিশ্বাস মিশ্রিত জ্ঞান, ভ্রমাত্মক জ্ঞান বা মায়াত্মক জ্ঞান, মনোদর্শন ও বিচার-বিশ্লেষণ হতে উৎপাদিত তত্ত্ব-জ্ঞান, কল্পনা হতে উৎপন্ন হওয়া নিশ্চয়াত্ম জ্ঞান, আর বিশুদ্ধ জ্ঞান। তবে বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রায় অমিল বলা চলে।

কোনো তথ্য ও তত্ত্বমূলক বই বা শাস্ত্র পড়ে মুখস্ত করা, এবং/অথবা সেই বইয়ে বলা কথাগুলি অন্ধের মতো বিশ্বাস করাকে জ্ঞান অর্জন করা বলা যায় না। সেই বই বা শাস্ত্র প'ড়ে, তাতে বলা কথাগুলির মধ্যে সত্য-মিথ্যা, ভুল-ত্রুটি যাই থাকুক--- যতটুকু থাকুক, প্রভাবমুক্ত হয়ে-- গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ পূর্বক তা' উপলব্ধি করা, এবং তারমধ্যে কোনো গূঢ় অর্থ বা সারমর্ম নিহিত থাকলে, তা' উদ্ধার করা, এছাড়াও, সেই বইয়ে উল্লেখিত বিষয়-বস্তু বা কথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো অতিরিক্ত কোনো সত্য থাকলে তা' উপলব্ধি করা, এই সব মিলিয়ে যা অর্জিত হয়, তাকেই বলে, জ্ঞান অর্জন করা।

'জ্ঞান' সম্পর্কে আরো দু-চার কথা বলে, এখনকার মতো এই প্রসঙ্গ শেষ করবো। সাধারণভাবে জ্ঞান হলো--- কোন বিষয়-বস্তু, ঘটনা, তথ্য বা তত্ত্ব সম্পর্কে ইন্দ্রিয়, চেতনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লব্ধ ধারণা--- উপলব্ধি—বোধ। যেসমস্ত ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও সূত্র বা উৎস গুলির উপর ভিত্তি করে জ্ঞান অর্জিত হয়, সেগুলির একটিও যদি ব‍্যক্তিকে ভুল পথে চালনা করে অথবা প্রতারণা করে, তাহলে লব্ধ জ্ঞানও অসম্পূর্ণ বা ভুল বা মিথ্যা হয়ে যাবে। বিশ্বাসের উপর ভিত্তি ক'রে অর্জিত জ্ঞান অনেক সময়েই  অপ্রকৃত জ্ঞান বা ভুল ধারণা হতে পারে। 



পূর্বলব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং ইন্দ্রিয়াদির কার্যক্ষমতাসহ মনের বোধশক্তি বা বোঝার ক্ষমতার উপর ভিত্তি ক'রে জ্ঞান অর্জিত হয়। এছাড়া, যে বিষয়বস্তুর উপর জ্ঞান লাভ ঘটছে, সেই বিষয়বস্তুও যে সব সময় সঠিক ভাবে জ্ঞান লাভকারী ব্যক্তির কাছে আত্মপ্রকাশ করবে, এমন নাও হতে পারে। লব্ধ জ্ঞান সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে— সব সময় একরকম এবং সঠিক হবে এমন নয়। 



বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভের জন্য, জ্ঞান লাভের যথেষ্ট চাহিদা সহ, সত্যপ্রিয় এবং যথাসাধ্য (জ্ঞান ও সত্য ব্যতীত অন্যান্য বিষয়বস্তুতে) আসক্তিমুক্ত--- নিরপেক্ষ হয়ে, জ্ঞান লাভের সময় বিভিন্ন দিক থেকে--- বিষয়-বস্তুকে পর্যবেক্ষণ এবং যাচাই ক'রে তারপর তাকে গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান— বিশ্বাস— অনুমান— ধারণা, চিন্তা-ভাবনা সবকিছুকেই সজাগ ও সচেতন মনের আলোকিত আলোকিত আঙিনায় নিয়ে আসতে হবে। 



তারপরেও সময়ান্তরে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এটা আমার জ্ঞান না বিশ্বাস? তারপর তাকে নানা দিক থেকে— নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক'রে 'আপডেট' করতে হবে। এর পরেও মনে রাখতে হবে, তোমার এই জ্ঞান প্রকৃত সত্য নাও হতে পারে। সমস্ত জ্ঞানকে 'আপাত সত্য' ধরে নিয়েই এগোতে হবে তোমাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞান লাভে উৎসাহিত করতে পারলে, পরবর্তীকালে তারা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়ে উঠবে। 



প্রকৃত জ্ঞান কখনো শেষ কথা বলে না। বলে না, আমিই একমাত্র সত্য। প্রচুর জ্ঞান অর্জন করার পরে— কেউ যদি বলে, 'আমি যা জানি তা-ই একমাত্র সত্য, এর অন্যথা হতেই পারে না'। অথবা 'এটাই শেষ কথা'। তাহলে বুঝবে, এটা তার জ্ঞানের কথা নয়, বিশ্বাসের কথা। আর, সেই ব্যক্তিও প্রকৃত জ্ঞানী নয়। 



প্রাক-চেতনা থেকে পূর্ণ-চেতনার লক্ষ্যে— ক্রমবিকাশের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা সবাই। এই পথের মধ্যবর্তী কোন চেতন স্তরে অবস্থান ক'রে, পূর্ণতার জ্ঞান বা সম্পূর্ণ পথের জ্ঞান সম্ভব নয়। —একথা বলার সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, এই জ্ঞানও আপাত সত‍্য।




 


'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর' 

---বাস্তবিকই, বিশ্বাসের যে কি অসাধারণ বিস্ময়কর ক্ষমতা, ---সে সম্পর্কে অনেক মানুষই অবগত নই। অনেক ক্ষেত্রেই, দৃঢ় বিশ্বাসকারী জানেনা--- তার বিশ্বাসের ফলেই তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাটি ঘটে গেছে। এই না জানার কারণ হলো--- মন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব। আর, মানুষের এই বিশ্বাস ও অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়েই, কিছু ধূর্ত প্রবঞ্চক ব্যক্তি মানুষকে প্রতারিত করে চলেছে। 

প্রকৃত ঘটনা হলো: বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে অনেক সময় আমাদের (অবচেতন) মন কোন একটি বিষয়বস্তু বা চাহিদাতে একাগ্র কেন্দ্রীভূত হয়ে, সেই চাহিদাকে সফল করে তুলতে, কার্যকর বিশেষ মনঃশক্তি বা অবচেতন মনের ইচ্ছাশক্তির স্ফুরণ বা বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এ সমস্তই ঘটে থাকে সেই বিশ্বাসী ব‍্যক্তির সচেতন মনের অগোচরে। আবার, মনের এই কর্মকাণ্ডটি সচেতন মনের ইচ্ছাক্রমেও কখনো কখনো সম্পাদিত হয়ে থাকে, বিশেষ যোগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে অত‍্যন্ত কর্মদক্ষ বা সিদ্ধ ব‍্যক্তির দ্বারা। যদিও, সেখানেও থাকে বিশ্বাস। 

আমরা জগতের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভে আগ্রহী ও সচেষ্ট হলেও, যে শরীর ও মন নিয়ে আমরা অস্তিত্বশীল, যাদের ক্ষয়-ক্ষতিতে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই। নিজেদের মনের ক্ষমতা সম্পর্কেও আমাদের বিশেষ ধারণা নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণভাবে নিজেকে জানা
নিজের শরীর-মনকে জানার শিক্ষা অবহেলিত।

আংশিক বিকশিত এই সচেতন মনটি ছাড়াও যে আমাদের আরও একটি সক্রিয় মন আছে, আমরা অনেকেই তা' জানি না। আমাদের মনের ঐচ্ছিক চিন্তাশীল অংশটি ছাড়াও যে তার একাধিক শক্তিশালী অনৈচ্ছিক অংশ আছে, সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। ( 'নিজের মনকে জানো' ও 'মন-আমি' প্রবন্ধ দুটি দ্রষ্টব্য)।

উচ্চচেতনা সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের অনেকে--- সচেতনভাবেই তাদের মনের শক্তিকে ব্যবহার করতে সক্ষম। আর, স্বল্প-চেতন বিশ্বাস-নির্ভর মানুষ, তারা তাদের বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে নিজেদের অজান্তেই--- নিজেদের মনঃশক্তির দ্বারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ফলেলাভ করে থাকে। এবং তারা ভেবে থাকে, কোন দেবতা অথবা কোন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিই সেই ফলদাতা।

অবশ্য, কোন কোন ক্ষেত্রে যে সুফলদাতা ব্যক্তি থাকেনা তা' নয়। ফলদাতা ব‍্যক্তিও যদি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে কিছু ঘটাতে চায়, অথবা কোনোরূপ সুফল দিতে চায়, তাও হতে বা ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের মনের শক্তি একত্রিত হয়ে, আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে--- কার্যটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। 

এছাড়া ফলদাতা যদি প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হয়, এবং যদি সে নিজের মনের শক্তি দ্বারা সরাসরি কার্যসম্পন্ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্বাসের কোন ভূমিকা থাকে না। 

এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, প্রেতলোকের বাসিন্দাদের দ্বারাও অনেক কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ যাদের দেব-দেবী ভেবে ভুল করে থাকে ('জীবাত্মা ও দিব্যাত্মা' প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। 

বিশ্বাসভিত্তিক এই মনঃশক্তি---  সাধারণত আমাদের শরীর ও মনের উপরেই কাজ করে থাকে। তবে, কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম হতেও দেখা যায়। অর্থাৎ শরীর ও মনের বাইরেও তাকে ক্রিয়া করতে দেখা যায় কখনো কখনো। শরীর ও মনের বাইরে ক্রিয়া করতে হলে, তাকে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে হবে। এবং তার জন্য মন ও মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশের বিকাশ ঘটে থাকতে হবে। 

বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন বা জাগ্রত মনঃশক্তি শুধু বিশ্বাসকারীর শরীর ও মনের উপরেই যে ক্রিয়াশীল হয়, এমন নয়। সে অপর ব্যক্তির শরীর ও মনের উপরেও ক্রিয়া করতে সক্ষম। যেমন, মন্ত্রপুতঃ জল বা জলপড়া-র দ্বারা একটি শিশুও আরোগ্য লাভ করতে পারে। যার নিজের কোন বিশ্বাস থাকে না। 'মেডিকেল ট্রিটমেন্ট'-এর ক্ষেত্রেও চিকিৎসক ও রোগী উভয়েই যদি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ঔষধ প্রদান ও সেবন করে, সেক্ষেত্রে উভয়ের মনঃশক্তির সাথে ওষুধের গুণ বা শক্তি মিলিত হয়ে চমৎকার ফল দিয়ে থাকে।

আবার, কোনো চিকিৎসকের মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভাব থাকে, সে অনেক ভেবে-চিন্তে বিচার-বিবেচনা ক'রে রোগীকে সঠিক ওষুধ দিলেও, চিকিৎসক হিসেবে সাফল্য লাভ করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এমনও দেখেছি, একজন কোয়াক ডাক্তার--- চিকিৎসাশাস্ত্রে তার বিশেষ জ্ঞান নেই। মাত্র অল্প কয়েকটি ওষুধের ব্যবহার সে জানে। তা-ও সেই ওষুধগুলির সঠিক কার্যকারিতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা নেই। কিন্তু তার মধ্যে আছে একমুখী তীব্র বিশ্বাস
যে, এই ওষুধেই রোগী সেরে উঠবে। এই অন্ধবিশ্বাসযুক্ত আবেগময় মনঃশক্তির দ্বারাই সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে আসছে। তার বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, রোগীরাও বিশ্বাস করে--- এই ডাক্তারের ঔষধ একেবারে অব্যর্থ! ফলে, তার ডাক্তারখানায় সবসময় রোগীর ভীড় লেগেই থাকে।


বিশ্বাস প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, আমার পরিচিত একটি ছেলের কথা। যে তার (বহুগামী) মায়ের কথামতো অর্থাৎ মায়ের কথার উপর বিশ্বাস ক'রে, এক ব্যক্তিকে বহুকাল যাবৎ তার পিতা বলে জেনে এসেছে। অবশেষে হঠাৎ একদিন ঘটনাচক্রে সে জানতে পারে, সেই ব্যক্তি তার পিতা নয়।  তার পিতা অন্য কেউ। 

এক ব্যক্তিকে জানি, ঈশ্বর সম্পর্কে সে একটি বিশেষ ধারনা বা মতে বিশ্বাস ক'রে এসেছে--- দীর্ঘকাল ধরে। একদিন সেই বিশ্বাসে চিড় ধরে যাওয়ার ফলে, তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। তারপর থেকে বহুকাল যাবৎ সে বিষাদ-উন্মাদ অবস্থায় দুঃসহ জীবন কাটানোর পর, তাকে সুস্থ করে তোলা হয়--- 'মাইণ্ড-প্রোগ্রামিং' -এর মাধ্যমে। ঈশ্বরকে তার প্রকৃত স্বরূপে না জেনে, শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে
ঈশ্বর লাভের জন্য, ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য, আজীবন ছুটে মরছে কত যে মানুষ, তার কোন হিসেব নেই। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত অসংখ্য বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটে চলেছে। এই জগতে বিশ্বাসের দ্বারা যত ভালো কাজ হয়েছে, মন্দ কাজ হয়েছে তার চাইতেও অনেক গুণ বেশি।

নিত্যকার প্রয়োজনে
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, অনেক সময়েই আমাদেরকে অনেকের উপর বিশ্বাস করতে হয়, অথবা বিশ্বাস করতে বাধ্য হতে হয়। এবং বিশ্বাস ক'রে ঠকতে হয় অথবা প্রতারিত হতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই। এক এক সময় এই বিশ্বাস ভঙ্গের ফল এতো সাংঘাতিক বা এতো মারাত্মক হয়ে ওঠে, যে স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ---তাহলে কি আর কাউকে বিশ্বাস করব না? বিশ্বাস করা কি তাহলে খারাপ? একটু জ্ঞান চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথেই এই প্রশ্ন জাগ্রত হয় মনে। কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞান -চেতনার অধিকারী না হওয়া অবধি, এই বিশ্বাস করার প্রবণতা যায় না আমাদের মন থেকে। 

জাগতিক ব্যবস্থা বা 'ওয়ার্ল্ডলি সিস্টেম' আমাদের মধ্যে প্রয়োজনের তাগিদেই বিশ্বাস প্রবনতার জন্ম দিয়েছে। আবার সেই বিশ্বাসকে দূর ক'রে সেখানে জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থাও রেখেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি কর্তব্য? যারা জ্ঞান-পথের পথিক, তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো--- 'বিশ্বাস' কথাটিকে তোমাদের খাতা থেকে আস্তে আস্তে তুলে দিতে চেষ্টা করো। তার জায়গায় 'অনুমান'--- 'ধারণা' বা 'আপাত ধারণা' 'আপাত বিশ্বাস' এইরূপ অন্যান্য কথা ব্যবহার করতে শুরু করো। কারো উপর বিশ্বাস থাকা
এক্ষেত্রে বলতে পারো, তার উপর আমার আপাতত আস্থা, অথবা আপাত ভরসা আছে। অগাধ বিশ্বাস মানেই অগাধ অজ্ঞানতা অন্ধত্ব। বিশ্বাস বা জ্ঞান যা-ই হোক না কেন, তাকে 'আপাত সত্য' বলে গ্রহণ করবে। তাহলেই দেখবে, সমস্যার সবটা না হলেও, অনেকটাই দূর হয়ে যাবে।

এবার, বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ, যাদের পক্ষে বিশ্বাস না করে থাকা সম্ভব নয়, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, বিশ্বাস করবে
— খুব সাধারণভাবে। তা' যেন দৃঢ়--- অন্ধবিশ্বাস না হয়ে ওঠে। অন্ধবিশ্বাসের কুফল অনেক সময়ই মারাত্মক হতে পারে। যে বিষয়-বস্তু সম্পর্কে তোমার কোন সম্যক ধারণা নেই, তার উপর অগাধ বিশ্বাসের কোন মানেই হয় না। সাধারণত মানুষের মন পরিবর্তনশীল, এবং যে কোন সময় সে অসুস্থ--- বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ-পরিস্থিতি, ঘটনাপ্রবাহও পরিবর্তনশীল। সেখানে মানুষের বিশ্বস্ততা কি করে স্থায়ী হতে পারে! তাই, বিশ্বাস করবে নির্ভর করবে ততটাই, যাতে পরবর্তীকালে বিশেষ আশাহত বা শোকাহত হতে না হয়। 

মনে রাখবে, যেকেউ যেকোনো সময়, বিশ্বাসভঙ্গ করতেই পারে। এ ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি থাকলে, তখন আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকবে না। এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারলে, অন্য ক্ষতি হলেও, বিশেষ কোনো মানসিক ক্ষতি হবে না। কিন্তু তাই বলে, এখানে কোন সন্দেহ
অবিশ্বাস থাকবে না। থাকবে বাস্তব জ্ঞান। মন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। মানুষ চেনা ও নিজেকে জানার চেষ্টা সহ, বাস্তব জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়েযথেষ্ট আত্মবিকাশ লাভ করতে পারলে, আর বিশ্বাস হারাতে হবে না। 

বিশ্বাস (বা ভরসা বা আপাত বিশ্বাস) করার আগে, নিজেকে প্রশ্ন করো--- কেন আমি বিশ্বাস করবো? বিশ্বাস করার কি যুক্তি আছে? খুব ভালো করে না ভেবে, না বিচার করে--- তুমি যদি সরল মনে সবকিছু বিশ্বাস করে নাও, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে তোমাকে আবার হোঁচট খেতে হবে, বিপর্যস্ত হতে হবে।

যে গ্রন্থই হোক, আর যে ব্যক্তিই হোক, তার কথা গ্রহণ করার পূর্বে, সেই বক্তব্যের বাস্তব সম্ভাবনা
যুক্তি-বিচারপূর্বক খতিয়ে দেখে, তবেই তা' গ্রহণ করবে আপাতসত্য রূপে। যুক্তি-বিচার প্রয়োগে কারো অনীহাআলসেমি থাকলে, তাকে কলুর বলদের মতো বিশ্বাসের ঘানি টানতেই হবে। 
 

 বিশ্বাস ও আরোগ্য 


 

মানব জাতির বহু সমস্যার কারণ এবং প্রগতি ও বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধ হলো অন্ধ বিশ্বাস বা দৃঢ় বিশ্বাস।

আমি বরাবরই অন্ধবিশ্বাসের বিরোধী এবং মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস এবং তার মূল কারণ অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে সর্বদা সচেষ্ট রয়েছি। কিন্তু সমদর্শী মনোভাব নিয়ে দেখলে, বিশ্বাসেরও কিছু সুফল আছে, বিশেষত শরীর মন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বাসের একটি ধনাত্মক ভূমিকাও রয়েছে।

আর বাস্তব সত্য হলো, পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য স্বল্প-জ্ঞান ও স্বল্প-চেতন মানুষের চেতনার যথেষ্ট বিকাশ ঘটতে এখনো বহু সময় লাগবে। মানুষ যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন না হওয়া অবধি বিশ্বাস আছে--- বিশ্বাস থাকবে।

তাই, মানুষকে অজ্ঞান অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা বজায় রেখে, মানুষকে সুস্থ ও যন্ত্রণা মুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বাস মূলক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। যদি না সেখানে মানুষকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্য থাকে।

সব চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গেই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বিশ্বাস যুক্ত থাকে। তার মধ্যে, শুধু বিশ্বাস ভিত্তিক চিকিৎসা হলো একেবারেই নির্মল চিকিৎসা। 'ফেইথ হিলিং' হলো মনোপথে আরোগ‍্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।

তবে, আমি একথা বলছি না, যে এই পথেই সমস্ত রোগ আরোগ্য করা সম্ভব। জানতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে আরোগ্য হতে পারে। সাইকোটিক ও সাইকোসোমাটিক রোগ-ব‍্যাধির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অধিক কার্যকর।

তবুও বলবো, অন্ধ-বিশ্বাসে এই পদ্ধতির উপর রোগীকে দীর্ঘকাল ফেলে না রেখে, প্রয়োজনে অন‍্যান‍্য চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে, তা আরোগ্য করতে, বিশ্বাস খুব তীব্র হওয়া দরকার। সাংঘাতিক বা মারাত্মক রোগ-ব‍্যাধির ক্ষেত্রে, এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা উচিৎ নয় বলেই মনে ক‍রি।

বিশ্বাসের পিছনে থাকে অবচেতন মন। আর, এই অবচেতন মনের অধিকারে রয়েছে আমাদের শরীর ও মন অনেকাংশে। বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে অবচেতন মনের আরোগ্যকর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, বিশ্বাস ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি সাফল্য লাভ করে থাকে।

সাংঘাতিক কুফল দায়ক বিষাক্ত ওষুধ গ্রহণের চাইতে, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিশ্বাস ভিত্তিক নির্মল চিকিৎসাপদ্ধতি বহুগুণে ভালো বলেই মনে করি আমি। 

সন্দেহ ও সতর্কতা


আজকের এই প্রবঞ্চনাপূর্ণ--- অসুস্থ মানসিকতাপূর্ণ কঠিন সময়ে, নিরাপদে জীবন যাপন করতে চাইলে, 'সন্দেহ' নামক বিশেষ মনোভাবটিকে গুরুত্ব না দিলেই পদে পদে ঠকতে হতে পারে। ছোটখাটো ঠকা বা প্রতারিত হওয়া ছাড়াও, কখনো কখনো মারাত্মকভাবেও ঠকতে হতে পারে।

চারিদিকে যত সমস্যা, অসুখ, অশান্তি, নির্যাতন--- নিপীড়ন, প্রতারণা মূলক নানা ঘটনা ঘটে চলেছে, তার অধিক অংশেরই কারণ হলো অন্ধ-বিশ্বাস বা সরল বিশ্বাস। অসতর্কতা।

আজ সরল বিশ্বাস অথবা অন্ধ-বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে চলা খুবই মুশকিল। ধর্ম, রাজনীতি, ব‍্যবসাদিসহ দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে 'সন্দেহ' থাকা যেন অত‍্যাবশ‍্যক হয়ে উঠেছে আজ।

তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই 'সন্দেহ' যেন 'সন্দেহ রোগ'-এ না দাঁড়িয়ে যায়। তা' হলেই আবার, নিজের এবং অপরাপরের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।

এই 'সন্দেহ' হতে হবে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ, বিজ্ঞান-মনষ্কতার 'সন্দেহ'। হতে হবে মুক্ত-মনের যুক্তিবাদী মানুষ। 'আমি মানতে প্রস্তুত আছি, যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণ পেলে তবেই মেনে নেবো' —এইরূপ মনোভাব। এই 'সন্দেহ' তখন আর 'সন্দেহ' থাকবে না, তখন এর নাম হবে 'সতর্কতা'।

লোভ আর ভয়, এই দুটি জিনিস স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প চেতনা সম্পন্ন মানুষকে অনেক সময়ে এতটাই বিবশ করে তোলে, যে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়। কোনো সন্দেহ সতর্কতা-ই মনে স্থান পায়না তখন। ফলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিবার্যভাবে বিপদাপন্ন হয়ে থাকে মানুষ। 

এরজন্যই প্রয়োজন, সর্বদা সজাগ-সচেতন-সতর্ক হওয়ার শিক্ষা, যুক্তিযুক্ত হওয়ার শিক্ষা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা এবং নিয়মিতভাবে দৈনন্দিন জীবনে তার প্রয়োগ বা অনুশীলন। আর, এর জন্যেই প্রয়োজন—আত্মবিকাশ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা।

সন্দেহের প্রয়োগ ঘটাতে হবে সুচারু ভাবে। নিজের মনের দিকেও সজাগ দৃষ্টি থাকবে। তাহলেই 'সন্দেহ' তখন 'সতর্কতা'-য় পরিণত হয়ে, আমাদের জীবন-কলার একটি অঙ্গ হয়ে উঠবে। নির্বিচারে অথবা অসতর্কতা বশতঃ বিশ্বাস করে, প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কমতে থাকবে ক্রমশই।

 
বিশ্বাস ও দর্শন

অনেকেই বিশ্বাস ও দর্শন -এর পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেন। দর্শন হলো-- জ্ঞান ও সত্যের প্রতি অনুরাগ থেকে, নিয়ত ধ‍্যানের মধ্যে একজন দার্শনিকের মানসপটে যা ফুটে ওঠে, তা'ই তার দর্শন। দর্শন থেকেই বিজ্ঞানের সৃষ্টি। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান হলো বিজ্ঞানের দর্শন। তা' কিন্তু বিশ্বাস নয়।

আবার ধর্মানুরাগীদের বিশ্বাস ভিত্তিক দর্শন, আর বিজ্ঞান-মনষ্ক মানুষদের সত‍্যানুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে মানসপটে উন্মোচিত দর্শনে অনেক পার্থক্য আছে।

দর্শন হলো একটি সম্ভাবনাময় তত্ত্ব-চিত্র। তা' কখনই বিশ্বাস নয়। এবার কেউ যদি কোনো দর্শনকে সত্য বলে, মনে করে, তখন তার কাছে সেটি বিশ্বাস। অন‍্যথায় দর্শন— দর্শনই থাকে।

দর্শনকে এক কথায় বলা যায়, একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। মহাবিশ্ব এবং তার কোনো অংশ— মানব ও মানবসমাজ সম্পর্কে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান-দর্শন। দর্শন হলো— কতকটা 'থিসিস' বা 'হাইপোথিসিস' -এর মতো। 

মুক্তমনার স্বরূপ 


সমস্ত প্রভাব থেকে মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীণ- সুস্থ ও জাগ্রত মনই হলো প্রকৃত মুক্ত-মন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তাই, অনেকাংশে প্রভাব মুক্ত, স্বনিয়ন্ত্রনাধীণ—স্বাধীণ ও সুস্থ মনকেই আমরা মুক্ত-মন বলে থাকি।

এই মন কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়লেও, -অচিরেই সে সেই প্রভাব থেকে নিজেকে অনেকাংশে বা সর্বাংশে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। যে তার মনের অবস্থা বুঝতে পারে— মনকে দেখতে পারে, তেমন আত্মসচেতন মনই হলো— মুক্ত-মন।

যে যত জ্ঞানী এবং যার সচেতন মন যত বেশী বিকশিত, সে ততটাই স্বাধীণ। সেই মনই হলো মুক্ত-মন, যে যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনার অধিকারী, এবং ক্রমশ আরো বেশি জ্ঞান ও চেতনার অধিকারী হবার জন্য- নিজের মনোবিকাশের জন্য সদা সচেষ্ট থাকে।

জ্ঞান ও চেতনা যত বৃদ্ধি পাবে, ততই আমাদের মন প্রভাব মুক্ত-স্বতন্ত্র-স্বনিয়ন্ত্রনাধীন হয়ে উঠবে। এই প্রভাব শুধু বাইরের নয়, ভিতরেরও। ভিতরের সহজাত প্রবৃত্তি— বদ্ধমূল সংস্কার, অজ্ঞানতা প্রসুত মোহ-মায়া —মিথ্যা অহংকার প্রভৃতি থেকে মুক্তি ঘটলে— তবেই সে হতে পারবে মুক্তমনা।

খুবই কম জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন মনকে চলতে হয়- বিশ্বাস, অন্ধ-আবেগ এবং তদভিত্তিক কল্পনা, আর কিছু সাধারণ যুক্তির সাহায্য নিয়ে। পরবর্তী উচ্চ চেতনা সম্পন্ন মন— তার সর্বোচ্চ বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত, সে ক্রমশ প্রভাব মুক্ত হয়ে, প্রায় নিরপেক্ষ যুক্তি-বিচার এবং তদভিত্তিক কল্পনার পথ ধরে এগিয়ে থাকে।

মুক্তমনা মানেই যে সে নাস্তিক হবে— এমন ধারণা ঠিক নয়। আবার, কোনো নাস্তিক যদি নিজেকে মুক্তমনা ভাবে, সেটাও ঠিক নয়। কারো বিশ্বাসের সাথে কেউ সহমত না হলেই সে নাস্তিক হয়ে যায়না। নাস্তিক কখনোই মুক্তমনা হতে পারেনা। কারণ, নাস্তিক মানেই সে অন্য কোনো দর্শন বা তত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসকারী।

‘বিশ্বাস’ কথাটি মুক্তমনার খাতায় নেই। সে এগিয়ে চলে- আপাত সত্যের হাত ধরে, পূর্ণ সত্যের লক্ষ্যে। যুক্তি-বিচার-প্রমানাদির মধ্য দিয়ে, তার ঈশ্বর-অস্তিত্বের উপলব্ধি ঘটতেই পারে। যদি সে সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে আত্মজ্ঞান লাভে এবং জীবন রহস্য উন্মোচনে (কে-কি-কেন-কোত্থেকে-কোথায় জানতে) ব্রতী হয়। যদি সে সত্যনিষ্ঠ হয়ে শিকরের সন্ধান করে। তবে, স্বভাবতই— তার ঈশ্বর আর সাধারণ বিশ্বাস প্রবণ মানুষের প্রচলিত ধারণার ঈশ্বর কখোনই একরূপ হবেনা।

প্রকৃত মুক্তমনা হলো— অনেকটাই উন্নত মনের মানুষ, বিকশিত মনের মানুষ। যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা বিকাশের ফলে সে মোহ-মায়া— বিশ্বাস-কুসংস্কারের বন্ধন থেকে অনেকটাই মুক্ত।

একজন মুক্তমনা কখনোই আত্মবিকাশ— মনোবিকাশের পথ থেকে সরে আসতে পারেনা, মানবধর্মকে অস্বীকার করতে পারেনা।

মুক্তমনা মানে সমাজ-সংসারের বাধা-বন্ধন, মানবতার দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত— বাতুল বা বায়ু প্রকৃতির মানুষ নয়। কান্ডজ্ঞানহীন বায়ু রোগগ্রস্ত যথেচ্ছাচারী মানুষ আসলে অসুস্থ মানুষ। আমি মুক্ত— আমি মুক্ত বলে, চিৎকার করলেই, মুক্ত হওয়া যায়না।

চেতনার পূর্ণ বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত, কারো পক্ষেই সম্পূর্ণতঃ জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া— পুরোপুরি স্বাধীন হওয়া সম্ভব নয়।

একটি অতিশিশু অথবা অতিশিশু-চেতন স্তরের মানুষকে, অথবা অস্ফূট মনের মানুষকে আমরা মুক্তমনা বলতে পারি না। কোনো অসুস্থ মনের মানুষকেও মুক্তমনা বলা যাবেনা।

প্রকৃত মুক্তমনা মানুষ সচরাচর দেখা না যাওয়ার ফলে, অনেকে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে, এদেরকেই মুক্তমনা ব’লে, মনে ক’রে থাকে। প্রকৃত মুক্তমনা হতে হলে, অনেক উন্নত মনের— অনেকটাই বিকশিত মনের মানুষ হতে হবে। মনোবিকাশের পথই জীবনের পথ, পূর্ণ মনোবিকাশই আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য।
"মন সম্পর্কে যে যতটা সচেতন, মনকে যে যতটা জানে এবং মনের উপর যার যতটা দখল, —সে ততটাই বিকশিত মানুষ। যেদিন তুমি মনের মালিক হতে পারবে— বুঝবে, সেদিন তুমি পূর্ণবিকশিত মানুষ হলে।
জীবনে উন্নতি করতে চাইলে— মনের বিকাশ ঘটাতে হবে। যে ব্যক্তি মন সম্পর্কে যত জ্ঞানী— মন-শক্তি ও মন-সম্পদে যত বেশি সমৃদ্ধ, এই মানব জীবনে সে ততটাই ধনী। মনোবিকাশের লক্ষ্যে— পূর্ণবিকশিত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে— সচেতনভাবে অগ্রসর হতে হবে আমাদের। পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠাই মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।”        —মহামানস  

 

বিজ্ঞানকে কী নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা যায়?

বহকাল ধরেই একশ্রেণীর অত্যন্ত লোভী ব‍্যবসায়ীদের চক্রান্তের শিকার হয়েছে আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় "বিজ্ঞান"! বিশেষত, একশ্রেণীর ওষুধ ব‍্যবসায়ীদের দ্বারা 'বিজ্ঞান' হয়েছে অতীব দূষিত ও কলঙ্কিত। এই ওষুধ ব‍্যবসার একাংশ দিনের পর দিন আমাদেরকে প্রতারিত করে চলছে।

তারপরে রয়েছে, যুদ্ধাস্ত্র ব‍্যবসায়ীগণ। বিজ্ঞানকে তারা তাদের অতি হীন সংকীর্ণ স্বার্থের দাসে পরিণত করেছে। মানুষ অসহায়ের মতো প্রতিনিয়ত নিপীড়িত অত‍্যাচারীত হয়ে চলছে এদের দ্বারা।

ইনফরমেশন ও ডিজিটাল টেকনোলজির ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের চুড়ান্ত অপব্যবহার হয়ে চলেছে। আপনারা বলবেন, এরজন্য তো বিজ্ঞান দায়ী নয়!

সংক্ষেপে 'বিজ্ঞান' হলো একটা নিয়মমাফিক পদ্ধতিগত ব‍্যবস্থা বা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে তত্ত্ব ও তথ্য যাচাই করা, বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণা লব্ধ জ্ঞান ও ফলকেও অনেকে বিজ্ঞান বলে থাকে।

এখন এই বিজ্ঞান নামক সিস্টেম ও নলেজকে মানুষ যেভাবে ব‍্যবহার করবে সে সেইরকম ফল প্রসব করবে! বিজ্ঞান কোনো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের বিষয়ই নয়। তার উপর বিশ্বাস করার অর্থ হলো, তাকে নিয়ে যে সমস্ত মানুষ কাজ করছে, তাদের উপর বিশ্বাস করা। এখন কথা হচ্ছে, সেই সমস্ত মানুষদের কি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা যায়!? যায় না।

ধর্ম, বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্ষেত্রে থাকা অনেক মানুষই আসলে খুব সাধারণ মানুষ, যে বিচারপতির একটা রায়ে অনেককিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে, সেও আদপে একজন সাধারণ মানুষ। সেও হতে পারে একজন ধর্মান্ধ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অন্ধবিশ্বাসী মানুষ।

বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভালো-মন্দ সব রকম মানুষই আছেন। সেখানে লোভ-মোহ, অন্ধবিশ্বাস, রাজনীতি, ব‍্যবসা, লবি, হিংসা-বিদ্বেষ, সৎ-অসৎ আছে। আছে অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার, এবং ষড়যন্ত্রকারী।

তাই, বিজ্ঞানীরা যাই করুক বা যাই বলুক না কেন, তা' বিজ্ঞানের নামে বিচার-বিবেচনা না করে, ভালো করে তলিয়ে না বুঝে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করাটা হলো অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞানীরা সর্বদাই ঠিক বা সত্যি বলবেন, এই মিথ্যা ধারণা পোষণ করাও অন্ধবিশ্বাস। ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগুরুদের কথায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও তেমনি। অন্ধবিশ্বাস হলো, দৃঢ় অবিচল বিশ্বাস। যাকে কোনো যুক্তি দিয়েই টলাতে পারা যায়না।

তাই, বিজ্ঞান মানেই সত্য ও পরীক্ষিত। বিজ্ঞানকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা চলে, এই অন্ধ ধারণা থেকে এখনো মুক্ত হোন। মানুষকে সজাগ হতে বলছি। গভীরভাবে বিচার বিবেচনা করে, ভালভাবে যাচাই করে তবেই বিজ্ঞানের ফল গ্রহণ করতে হবে।

অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের সবকিছু মেনে নিলে, নির্বিচারে বিজ্ঞানের সুফল ও কুফল না বুঝে, বিজ্ঞানের দান গ্রহণ করলে, ভয়ানক পস্তাতে হবে অবশেষে। তখন আর আফশোষ করারও সময় থাকবে না। একথা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, ধর্ম, রাজনীতি এবং অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। সামনে খুব কঠিন সময় আসছে, তাই সর্বদা সজাগ সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।

আমি জানি, ধর্মের মতোই বিজ্ঞানের অজ্ঞান অন্ধভক্ত অন্ধবিশ্বাসীদের পক্ষে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সহ‍্য করা একটু কঠিন-ই হবে।

যুক্তিবাদী কাকে বলা হবে?

দু-চারটে যুক্তিপূর্ণ কথা বললেই কেউ যুক্তিবাদী হয়ে যায়না। একজন যুক্তিবাদীকে হতে হবে যথেষ্ট সজাগ-সচেতন মনের অধিকারী। সেইসঙ্গে জগত-সংসার এবং নিজের সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

একজন যুক্তিবাদী হবে মুক্তমনের মানুষ। ধর্ম, দর্শন, শাস্ত্র, মতবাদ, উক্তি, ধারণা প্রভৃতি সমস্ত কিছুর প্রভাব থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাকবে, অথবা মুক্ত থাকতে সচেষ্ট থাকবে সে। সংস্কার মুক্ত মানুষ।

যুক্তিবাদীর মধ্যে কোনরকম দৃঢ় বিশ্বাস বা অন্ধবিশ্বাস থাকবে না। সে যুক্তি-বিচার ও আপাত বিশ্বাসের হাত ধরে, সবকিছুকে আপাত সত্য জ্ঞানে এগিয়ে যাবে পূর্ণ সত‍্যের লক্ষ্যে। যুক্তিবাদী মানুষ আস্তিকও নয় আবার নাস্তিকও নয়। সে বলে, আমি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। তুমি গ্রহণযোগ্য যুক্তি বা প্রমাণ দিতে পারলেই আমি মেনে নেবো। তবে তার সমস্ত মানা বা জানা হবে, আপাত সত্য রূপে।

একটা ধারণা যাকে সে দীর্ঘকাল ধরে সত্য বলে ভেবে এসেছে। হঠাৎ কেউ যদি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারে, সেটা একটা ভুল ধারণা ছিল, যুক্তিবাদী মন (আসক্তি ও অভ‍্যাসের দাস না হয়ে) তৎক্ষণাৎ সেই পুরোনো ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে, তার জায়গায় নতুন ধারণাকে গ্রহণ ও স্থাপন করবে।

যেহেতু সে জানে, তার জ্ঞান অতি সামান্য। তাই কোনো জ্ঞান, কোনো মত, অথবা কোনো ধারণাকেই সে বলেনা, "এটাই শেষ কথা।" অথবা "এটাই পরম সত্য।"

যুক্তিবাদী হতে হলে, তাকে মন সম্পর্কে অবগত হতে হবে। নিজের মনের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সে পথভ্রষ্ট হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে তাকে সতর্ক থাকতে হবে। যুক্তি বিজ্ঞান সম্পর্কে অবগত হতে হবে। কখোনোই সে অপযুক্তি বা কুযুক্তির কূটকৌশলের আশ্রয় নেবে না। সে যুক্তি দিয়ে জেতার চেষ্টা করবে না। যুক্তির সাহায্য নিয়ে জেতার সম্ভাবনা থাকলেও, সে সত‍্যকেই মেনে নেবে। সর্বোপরি সে হবে সত্যবাদী। সত‍্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, সত‍্যে উপনীত হতেই সে যুক্তিপথকে বেছে নিয়েছে। এর চাইতে আরও ভালো কোনো পথের সন্ধান পেলে, সে যুক্তিসঙ্গতভাবে তখন সেই পথই অবলম্বন করবে। সত‍্যই হবে তার মূল লক্ষ্য।

তবে এই সংজ্ঞা তথাকথিত যুক্তিবাদীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তথাকথিত যুক্তিবাদীগণ অনেক সময়েই যুক্তি মানেন না। এঁঁরা একটা নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের বাঁধনে বাঁধা। তার বাইরে এঁঁরা যেতে পারেন না।

* সবশেষে উপসংহার: এপর্যন্ত আমি যা বললাম, এটাই শেষকথা নয়।

স্বপ্ন কথা

স্বপ্নের স্রষ্টা বা রচনাকার হলো আমাদের অবচেতন মন। এই মনটি এক বড় চলচ্চিত্রকার। স্বপ্ন শুধুমাত্র নিদ্রাকালেই সৃষ্টি হয়না, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়, এমনকি একটু ঝিম মেরে পড়ে থাকলেও স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে যেতে পারে। যাদের অবচেতন মন— সচেতন মন থেকে বেশি শক্তিশালী, অস্থির-উত্তেজিত মন, যারা বায়ুপ্রধান বা স্নায়বিক প্রকৃতির, তারা কিছুক্ষণ একটু চুপ ক'রে শুয়ে বা বসে থাকলেও, তাদের স্বপ্ন রচনা শুরু হয়ে যেতে পারে। জাগ্রত অবস্থায় সৃষ্ট এই স্বপ্নকেই আমরা সাধারণত কল্পনা বলে থাকি। বেশি কল্পনাপ্রবণ মন--- জাগ্রত ও নিদ্রিত অবস্থায় অলৌকিক— অবাস্তব— উদ্ভট সব কল্পনা ও স্বপ্ন রচনা করতে পারে।

সচেতন মন কিছুটা সজাগ থাকলে, অবচেতন মন অনেক সময় সচেতন মনকে বুঝতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে— তাকে ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতীকী আকারেও স্বপ্ন রচনা ক'রে থাকে। এমন অনেক প্রতীকী স্বপ্ন রচিত হয়, অনেক সময়েই যার অর্থ বোঝা সম্ভব হয়না।

স্বপ্ন অনেক প্রকারের হয়ে থাকে, যেমন—
দৈনন্দিন কাজকর্ম, ঘটনা, চিন্তা-ভাবনা সংক্রান্ত জাবরকাটা স্বপ্ন হতে পারে। জাগ্রত অবস্থায় ভুলে যাওয়া কোনো কথা বা কোনো কিছু আমাদের স্বপ্নে প্রকাশ পেতে পারে। বিশেষ কোনো ইচ্ছা— চাহিদা— লোভ-লালসা, কোনো ভয়, আশঙ্কা, সন্দেহ, বিশ্বাস প্রভৃতি নিয়ে অবচেতন মন নাটকরূপ স্বপ্ন রচনা করতে পারে। কখনো কখনো ঐসব স্বপ্ন প্রতীকী আকারেও রচিত হতে পারে। আমাদের অবচেতন মন হলো এক বড় শিল্পী।


মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধবোধ, গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট, শোক, হতাশা, অপমান, যৌনাকাঙ্খা প্রভৃতি স্বপ্নাকারে মনের পর্দায় প্রকাশ পেতে পারে। এছাড়া মৃত্যুভয় বা মরনাকাঙ্খা, প্রিয় বা অপ্রিয় ব‍্যক্তি, মৃতব‍্যক্তি মনের পর্দায় উঠে আসতে পারে।

এছাড়া, শরীর ও মনের অসুস্থতার কারণে, এবং মনের বিকারগ্রস্ত অবস্থায় অনেক প্রকারের উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা ও স্বপ্ন সৃষ্টি হয়ে থাকে। অবচেতন মনের দ্মৃতিভান্ডারে অসংখ্য স্মৃতি জমা হয়ে আছে। তার মধ্যে থেকে অকারণে কখন যে কোনটা মনের পর্দায় ভেসে উঠবে, আর সেই স্মৃতিকে কেন্দ্র করে মন কখন কি যে গড়ে তুলবে, তা' সবসময় মনও জানতে পারে না। 

কিছু কিছু ক্ষেত্রে, খুব অনুভূতি প্রবণ মন— অথবা বেশ দূরদর্শী মন, অথবা ভবিষ্যতের স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণা সম্পন্ন মন, অনেক সময় নিদ্রার মধ্যে ভবিষ্যতের ঘটনাবলী স্বপ্নাকারে দেখতে সক্ষম হতে পারে।

অনেক সময়, নিদ্রাকালে মন যখন নিস্তরঙ্গ—শান্তিপূর্ণ থাকে, তখন পূর্বের কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা অথবা কোনো সমস্যার সমাধান বা সমাধান সূত্র স্বপ্নাকারে দেখা দিতে পারে। আসলে, নিদ্রাকালেও ভিতরে ভিতরে ঐ বিষয় নিয়ে নিজের অজান্তেই চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকে।

এছাড়া, 'স্বপ্ন'— আমাদের 'মন' 'সফ্টওয়্যারের ক্লিনিং সিস্টেম হিসাবেও কাজ করে।

স্বপ্ন রচনাকার এই পাগল মনটি এতটাই কলাকুশল এবং খামখেয়ালী, যে কখন সে কি করবে, কি কল্পনা করবে, তার হদিস পাওয়া খুব মুস্কিল। তার সৃজন ক্ষমতা এতটাই প্রবল এবং বেগবান, যে সে পূর্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ— বিভিন্ন বস্তু, প্রাণী বা উদ্ভিদ অথবা বিভিন্ন ব‍্যক্তির বিভিন্ন ইমেজের অংশ জুড়ে জুড়ে তৎক্ষণাৎ নতুন নতুন বস্তু, প্রাণী বা ব‍্যক্তির ইমেজ সৃষ্টি করতে সক্ষম। যাদের সাথে পূর্বে দেখা কোনো ব‍্যক্তি বা কোনো কিছুর সাথেই আপাত দৃষ্টিতে মিল খুঁজে পাওয়া মুস্কিল।

সচেতন মনের দুর্বলতা বা অনুপস্থিতির সুযোগে এই মনটি কি করতে পারে, আর কি না পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। স্বপ্নকে যদি ভবিষ্যতে কোনো প্রযুক্তির সাহায্যে রেকর্ডিং করা সম্ভব হয়, তখন এক নতুন জগত আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।

প্রসঙ্গ:  পাগল ও পাগলামি


মন তথা মস্তিষ্কের অসুস্থতার কারণে, অত্যন্ত বিকারগ্রস্থ --অস্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত মানুষকেই সাধারণত পাগল বলা হয়ে থাকে। তবে সব মানসিক রোগীই কিন্তু পাগল নয়।  যারা মানসিক অসুস্থতার কারণে তাদের চারিপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষ-জনের সঙ্গে  মানিয়ে চলতে অক্ষম, স্বাভাবিক জীবন যাপনে অক্ষম, আচরণগত ত্রুটি সম্পন্ন সেই সব মানুষকেই সাধারণত পাগল বলা হয়ে থাকে। কমবেশি মানসিক অসুস্থতা অনেকের মধ্যেই রয়েছে। তাই বলে, তারা কিন্তু পাগল নয়।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, কোন স্থানের বা কোন দেশের অধিকাংশ মানুষই যদি পাগল হয়, সেক্ষেত্রে সেখানে উপস্থিত সুস্থ-স্বাভাবিক দু-চারজন মানুষ--- অন্যান্যদের দৃষ্টিতে পাগল বলেই গণ্য হবে।

পাগল বহু প্রকারের। বলা ভালো, অসংখ্য প্রকারের। কোনো দুটি পাগল একেবারে এক রকমের হবে না। কোন পাগলের সঙ্গে কোন পাগলের সর্বাংশে মিল থাকেনা। তবে বোঝার সুবিধার জন্য, তাদের মধ্যে ক্যাটাগরি বিভাগ করা যেতে পারে।

অনেকের ধারণা, পাগলরাই বুঝি পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ। বাস্তবে কিন্তু তা' নয়। দুঃখী পাগল, শোকাচ্ছন্ন পাগল, উত্তেজিত পাগল, ক্রোধোন্মাদ পাগল, এবং বদ-মতলবি পাগলের সংখ্যাও কম নয়।

একশ্রেণীর পাগলকে বলা যেতে পারে জিনিয়াস পাগল। অল্পকিছু শিল্পী-সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক ব‍্যক্তি এবং কিছু দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার-মত্ত মানুষ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। অজ্ঞান পাগল যেমন অনেক আছে, তেমনি অল্পসংখ্যক হলেও, জ্ঞানী পাগলেরও দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।

অনেক সময় দেখা যায়, দুজন পাগলের মধ্যে একজন সবার কাছে লাথি ঝাঁটা অবজ্ঞা-উপহাস পেয়ে আসছে। আর একজন পাগল শুধুমাত্র ধর্মের আঙিনায় থাকার কারণে, সে বহু মানুষের কাছে পুজো পাচ্ছে। 

দেখা গেছে, ধনীদের অনেক পাগলামি মানিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তাদের অনেক পাগলামিকে বাহবা দিয়ে থাকে। প্রশংসার চোখে দেখে থাকে। আবার ওই পাগলামিই যদি কোন গরীব লোককে করতে দেখা যায়, তখন তা' আর তার সাজে না। বাহবার বদলে তখন তার ভাগ্যে লাথি-ঝাঁঁটাই জুটে থাকে।

অজ্ঞান-অন্ধত্ব অন্ধ-বিশ্বাসের সঙ্গে, কেউ যদি একান্তে উদ্ভট ধর্মীয় কার্যকলাপ নিয়ে মেতে থাকে, সে ক্ষেত্রে তাকে মানসিক রোগী বলা যাবে কিনা, সেটা বিশেষজ্ঞদের বিচার্য বিষয়। তবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এদের মধ্যে একটা অংশ মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু ঐ সমস্ত কার্যকলাপই যদি কেউ প্রকাশ্যে এবং অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে— উন্মাদনার সঙ্গে করতে থাকে, তখন তাকে অবশ্যই পাগল বা ধর্মোন্মাদ বলা হবে।

'শরীর ভালো না' বললে, আমরা শরীরের অসুস্থতা বুঝে থাকি। কিন্তু, 'মন ভালো না', বললেই, আমরা অন্য রকম বুঝি। আসলে, মন ভালো না থাকাও যে মনের অসুস্থতা, তা' অনেকেই অনেকসময় বোঝার চেষ্টা করে না। 

শরীর খারাপ হলে, অসুস্থ হলে, আমরা সমবেদনা জানাই। কিন্তু কারো মন খারাপ হলে, মন অসুস্থ হলে, আমাদের প্রতিক্রিয়া তখন ভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। অনেকে আবার ওটাকে বদমাইশি বলেও বিরুদ্ধাচরণ ক'রে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে, মন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবেই আমরা এই রকম ভুল বুঝে থাকি। শরীর কেন্দ্রিক (হলেও, শরীর সম্পর্কেও অজ্ঞান) মানুষ, শারীরিক বিষয়ে যেটুকু উপলব্ধি করতে সক্ষম, মন সম্পর্কে সেটুকুও নয়। মন তার কাছে ধরা ছোঁয়া— উপলব্ধির বাইরেই থেকে যায়।

অসুস্থ মন তাই, আমাদের কাছে সমবেদনা ও চিকিৎসার বদলে, অবজ্ঞা অযত্ন— অত‍্যাচার— নির্যাতন-ই লাভ করে থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে। 

যে মনের কারণে আমরা মানুষ বলে পরিচিত, সেই মনের কী দুরবস্থা! প্রচলিত মানসিক চিকিৎসার অবস্থাও মোটেই সন্তোষজনক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, যথেষ্ট বিদ‍্যা, অর্থ-সম্পদ, আপনজন থেকেও মনোরোগীর যেন কিছুই নেই। এমনও দেখেছি, বড় ঘরের ধনীর ছেলে, বহু দিনের ময়লা ছেঁড়া পোষাক পড়ে, বিভৎস নোংরা চুল-দাড়ি নিয়ে, পথে পথে ঘুরে ঘুরে, ডাস্টবিন থেকে— ফেলে দেওয়া উচ্ছিস্ট বাসি-পচা খাবার  কুকুরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে।
ট্রান্স বা ঘোর সম্পর্কে কিছু কথা

আচ্ছন্ন ভাব বা ঘোর (ট্রান্স) মোটামুটি তিন প্রকার। আমরা প্রায় সবসময় অজ্ঞান- অন্ধত্বের কারণে মোহাচ্ছন্ন হয়ে একটা ঘোরের মধ্যে অবস্থান করি। এই অবস্থাকে আমরা সাধারণত ভাবাচ্ছন্নতার ঘোর মনে না করে, স্বাভাবিক অবস্থা বলেই মনে করে থাকি।

দ্বিতীয় প্রকার ঘোর বা আচ্ছন্নভাব ঘটে সম্মোহন নিদ্রা এবং ভাবাবেশ মূলক ধ‍্যানস্থ অবস্থায়। এই সময় সচেতন মন আংশিক বা পূর্ণ অবশতা প্রাপ্ত হয় বা নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, এবং অবচেতন মন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুতে আকৃষ্ট হয়ে স্থির- বিহ্বল ভাবগ্রস্ত হয়। 

তৃতীয় প্রকার ঘোর বা আচ্ছন্নভাব ঘটে আত্ম-ধ‍্যানে, অথবা মহামনন ধ‍্যান এবং তৎপরবর্তী মহাসমাধি অবস্থায়। তখন, অবচেতন মন অবশতা প্রাপ্ত হয়ে নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়ে, এবং সচেতন মন জাগ্রত থাকে। এইসময় সচেতন মন প্রথমদিকে জাগ্রত থাকলেও, ক্রমশ সে আপনাতেই আপনি মগ্ন হয়ে— একপ্রকার ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে ভাবাবিষ্ট অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
মনের শান্তি ও সুস্থতা লাভের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো শারীরিক অসুস্থতা।

তাই, মনকে সুস্থ করে তুলতে হলে, শরীরকে সুস্থ করে তুলতে হবে সবার আগে। শরীরের মধ্যে ক্রমশ জমতে থাকা নানা প্রকারের বিষ বা রোগবিষ-ই (Toxin) হলো শারীরিক অসুস্থতার প্রধান কারণ। শরীরকে বিষমুক্ত করে তুলতে এবং বিষমুক্ত রাখতে, যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ৭ম অধ্যায়ে। মনোবিষ— মনোদুষণ দূর করতে নিয়মিতভাবে বিশেষ বিশেষ ধ‍্যান-যোগ অনুশীলন করতে হবে। আর, দেহবিষ দূর করতে 'রোগবিষ দূরীকরণ পদ্ধতি' অনুসরণ করতে হবে।

নিজের মধ‍্যেকার বিপরীতধর্মী প্রবৃত্তি সম্পর্কে সচেতন হও।
 

আমরা জানি, আত্মরক্ষার একটা সহজ প্রবৃত্তি আমাদের মধ্যে আছে। কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও, আত্মঘাতী—আত্ম ধ্বংসাত্মক একটি বিপরীতধর্মী সহজ প্রবৃত্তিও রয়েছে আমাদের মধ্যে।

 

সাধারণত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিটি বেশি জোরালো ও সক্রিয় হওয়ায়, বিপরীতধর্মী অপর প্রবৃত্তি-টি সম্পর্কে আমরা তেমন সচেতন নই। এই প্রবৃত্তি-টি মাঝে মাঝে একটু আধটু মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও, সাধারণত, জোরালো প্রথম প্রবৃত্তি-টি তাকে মাথা তুলতে দেয় না। কিন্তু এর বিপরীতধর্মী প্রবৃত্তি-টি ভিতরে ভিতরে তার কাজ করে চলে। সে সুখে-শান্তিতে থাকতে দেয় না আমাদের। তার তাড়নাতেই 'সুখে থাকতে ভুতে কিলোয় আমাদের।'

 

এই আত্মঘাতী কার্যকলাপ ঘটে থাকে দুটি স্তরে। এক, দেহ-স্তরে, আর দুই, মন-স্তরে। শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যখন, একের পর এক— বিভিন্ন প্রকারের, অধিক সংখ্যক রোগ জীবাণু ও রোগবিষের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে পরাজিত হতে থাকে, তখন সেই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। সে তখন রোগ-জীবাণু ও রোগবিষ ধ্বংস করার পরিবর্তে নিজেকে নিজেই ধ্বংস করতে শুরু করে দেয়। একেই চিকিৎসা জগতে 'অটোইমিউন ডিজিজ' বলা হয়।

 

আবার মানস ক্ষেত্রেও, মন যখন বারবার বিফল হয়ে, পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে, একের পর এক বাঁধাবিঘ্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বারবার আশাহত ও মর্মাহত হয়ে ভেঙে পড়ে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন ব্যক্তির মানসিক গঠন ও ক্ষমতা অনুসারে, কোন কোন ব‍্যক্তির ক্ষেত্রে সে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজে ধ্বংস করে ফেলতে সচেষ্ট হয়। পরিণামে আত্মহত্যা অথবা আত্মহানিকর কজে লিপ্ত হতে দেখা যায় তাকে।

ঈশ্বর দর্শন

ঈশ্বর দর্শনের কথা উঠলেই, আমার জানা সেই প্রেমোন্মাদ ছেলেটির কথা মনে পড়ে যায়।

সেই ছেলেটি একটি মেয়েকে খুব ভালোবেসেছিল। সে দূর থেকেই ভালোবাসতো। কথা বলার তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি তার। বেশকিছুদিন এইভাবে চলছিল। শয়নে—স্বপনে— সদা জাগরণে সে তার কথাই ভাবতো। আর কল্পনায় নানা ছবি আঁকতো সেই ছেলেটি।

হঠাৎ করে মেয়েটিকে আর কোথাও দেখতে না পেয়ে, ছেলেটি পাগলের মতো চারিদিকে খুঁজতে লাগলো তাকে। কিন্তু কোথাও তার দেখা মিললো না। তার সন্ধানও পাওয়া গেলনা। ভয় ও সঙ্কোচের কারণে, কাউকে মেয়েটির সম্পর্কে জিজ্ঞাসাও করতে পারেনা সে। তখন তার সে কি করুণ অবস্থা।

আসলে, মেয়েটি তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে কিছুদিন এখানে ছিল। তারপর সে তার নিজের বাড়িতে চলে গেছে।

শেষে এমন অবস্থা হলো, ছেলেটি যেদিকে তাকায় সেদিকেই মেয়েটিকে দেখতে পায়। আরে! ঐতো সেই মেয়েটি! ... নাঃ কোথায় গেল!! একটু নিকটে এগিয়ে যেতেই মেয়েটি যেন নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল!!!

বলতে চাইছি, ঈশ্বরের জন্য— ঈশ্বর দর্শনের জন্য এমনই পাগল হলে, তখন ঈশ্বরকে ঐ ছেলেটির মতো অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়। যা দেখা যায়, তা' আসলে তার মেন্টাল প্রোজেকশন ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমার বড় শত্রু এবং অশান্তির বীজ রয়েছে আমার মধ্যেই। আমাদের বড় শত্রু এবং অশান্তির কারণ রয়েছে আমাদের মধ্যেই। নিজের এবং নিজেদের ভিতরকার শত্রুকে চিহ্নিত করতে হবে সবার আগে।

নিজেকে না জানলে, নিজের ভিতরকার শত্রুকে জানা যাবে না। নিজেকে না জানলে, মানুষ চেনা যাবেনা। নিজেদের মধ্যে মিশে থাকা শত্রু -মিত্র, ভালো ও মন্দ মানুষকে চিনতে হলে, মানুষ চেনার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর তার জন্য সবার আগে নিজেকে চিনতে হবে— জানতে হবে।

তা' না হলে চিরকাল যেভাবে মার খেয়ে এসেছো সেভাবেই মার খেয়ে যেতে হবে। গোড়ার কাজ গোড়ায় না ক'রে, গোড়াকে শক্ত না করে, ওপরে ওপরে বেশি আন্দোলিত হলে, সে গাছ সমূলে উপড়ে যাবে। যেমনটি হয়ে এসেছে এযাবৎ।  

        —মহর্ষি মহামানস

bottom of page