top of page

প্রথম অধ্যায়

'ধর্ম' কী ও কেন

 

যেমন জলের ধর্ম— আগুনের ধর্ম, তেমনই জীবের ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’ হলো— তার সহজ আচরণ বা স্বভাবধর্ম। মানুষের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে। মানুষ তার স্বভাবধর্ম— সহজ আচরণের মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রমশ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনা লাভের মধ্য দিয়ে— মনোবিকাশের পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে— একসময় মানবত্ব লাভ করে। পূর্ণবিকশিত মনের মানুষ হয়ে ওঠে। মানব-মনের বিকাশ-পথ ধরে এগিয়ে চলাই হলো— মানবধর্ম।

 

‘ধর্ম’ মানে অন্ধ-বিশ্বাসে— কাল্পনিক কোনকিছুর পিছনে অথবা কোনকিছু লাভের পিছনে ছুটে চলা নয়। ‘ধর্ম’ মানে অজ্ঞান-অন্ধের মতো কোনকিছু মেনে চলা, কোনো আচার-আচরণ করা, কাল্পনিক ঈশ্বরের উপাসনা করা, অথবা কারো কোনো দুরভিসন্ধিমূলক নির্দেশ পালন করা নয়। ‘ধর্ম’ নামে এইরূপ কোনো ব্যবস্থা যদি মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, অথবা আরোপ করা হয়, —তা’ ধর্ম নয়, —অধর্ম।

 

এই প্রসঙ্গে আরোপিত ধর্মের কথা এসেই যায়। এক্ষেত্রে (আরোপিত) ‘ধর্ম’ হলো তা’ই,  —যাকে বা যে ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও ধারণ ক’রে একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে এবং দ্রুততার সঙ্গে সুস্থতা লাভসহ মানব-মনের তথা চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে মানবত্ব লাভে সক্ষম হতে পারে, তা-ই হলো মানুষের প্রকৃত ধর্ম— (আরোপিত) মানবধর্ম।

 

মানুষ ব্যতীত অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে— তাদেরকে কোনো ধর্ম গ্রহণ ও তা’ ধারণ-পালন করতে হয়না। তা’ তাদের মধ্যে স্বভাবতই কার্যকর থাকে। তাহলে, মানুষের ক্ষেত্রে নতুন ক’রে ধর্ম গ্রহণ ও পালনের কথা আসছে কেন?! আসছে এই কারণে— মানুষের ক্ষেত্রে ‘মানবধর্ম’ তার সহজ ও স্বভাবধর্ম হলেও, অভিসন্ধিমূলকভাবে তার উপরে অন্য বা অন্যান্য কৃত্রিম ধর্ম— বিশ্বাসমূলক ধর্ম আরোপিত হওয়া অথবা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে, সে তার আত্মবিকাশমূলক সহজ ও স্বভাবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে— বিপথগামী হয়ে পড়েছে। এখন, তাকে তার স্বধর্মে— মানবধর্মে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে, মানবধর্ম ভিত্তিক একটি নতুন ধর্মের একান্ত প্রয়োজন। এই নতুন ধর্মই হলো— মহাধর্ম।     

মহাধর্ম : সারকথা

 

মহাধর্ম হলো আসলে মানবধর্ম। আমাদের মূলগত— প্রাথমিক ধর্ম। আত্ম-বিকাশ তথা মানব-বিকাশের জন্য অনুশীলনীয় ধর্ম। শ্রেষ্ঠতর জীবনলাভের নিশ্চিত উপায়।

সারকথা— “তোমার একটি সচেতন মন আছে বলেই— তুমি মানুষ। তবে তোমার এই (সচেতন) মনটি এখনও যথেষ্ট বিকশিত নয়। যথেষ্ট বিকশিত একজন মানুষ হয়ে উঠতে— তোমার এই মনটির বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। আর এটাই তোমার প্রাথমিক ধর্ম।”

“তুমি একজন মানুষ রূপে জন্ম গ্রহন করেছ, তাই তোমার জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলো— পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা। জীবনের লক্ষ্যসহ— নিজেকে এবং এই জাগতিক ব্যবস্থাকে জানতে, সর্বদা সজাগ—সচেতন থাকতে চেষ্টা কর। নিজেকে প্রকৃত ও সর্বাঙ্গীন বিকশিত মানুষ ক’রে তুলতে উদ্যোগী হও।”

“জন্মসূত্রে বা ইচ্ছাক্রমে তুমি যে প্রচলিত ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত হওনা কেন, তোমার প্রথম পরিচয়— তুমি একজন মানুষ। একজন মানুষ হিসাবে, তোমার প্রধান ও মৌলিক ধর্মই হলো— মানবধর্ম। আর এই মানবধর্ম-ই মহাধর্ম। সর্বাঙ্গীন সুস্থতা সহ মানবমনের বিকাশ সাধনই যার মূল কথা।”  

“আমরা এখানে এসেছি— এক শিক্ষামূলক ভ্রমনে। ক্রমশ উচ্চ থেকে আরো উচ্চ চেতনা লাভই— এই মানব জীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। একানে আমরা জ্ঞান—অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে যত বেশি চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবো, —তত বেশি লাভবান হবো। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে— এখান থেকে চলে যাবার সময় কিছুই আমাদের সঙ্গে যাবে না, —একমাত্র চেতনা ব্যতিত।” —মহর্ষি মহামানস

সর্বপ্রথম আমাদের বুঝতে হবে— এই 'মহাধর্ম' আসলে কী। 'মহাধর্ম' হলো—   মানবধর্ম, আমাদের মৌলিক ধর্ম— মানুষ গড়ার ধর্ম। এই ধর্ম প্রচলিত কোনো ধর্ম বা রিলিজিয়নের সাথে তুলনীয় নিয়। ঈশ্বর ও বিশ্বাস এই ধর্মের মূল ভিত্তি নয়। এর ভিত্তি হলো— যুক্তি-বিজ্ঞান ও অধ্যাত্ম বিজ্ঞান। মহাধর্ম প্রচলিত ধর্মগুলি থেকে সম্পূর্ণতঃ ভিন্ন।

সঠিক আত্ম-বিকাশ শিক্ষাক্রম— ‘মহামনন’-এর (মহামনন হলো মহাধর্ম-এর ব্যবহারিক দিক) পথ ধরে প্রকৃত আত্মোন্নয়ন ও মানবোন্নয়ন ঘটানোই হলো— আমাদের প্রধান লক্ষ্য, আর এই হলো আমাদের প্রাথমিক বা মূলগত ধর্ম। চিরিন্তন মানবধর্মকে কেন্দ্র ক'রে গড়ে ওঠা— মহাধর্মকে আপাতদৃষ্টিতে একটি নতুন ধর্ম মনে হলেও, এটা কোনো নতুন ধর্ম নয়। এ’ হলো আমাদের শাশ্বত ধর্ম। আমাদের অজ্ঞানতার কারণে যা এতকাল ছিলো অন্তরালে। আত্ম-বিস্মৃত মানুষ আমরা আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্যকে বিস্মৃত হয়ে, মোহ-আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে— একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছি।

যে ধর্ম অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি সজাগ-সচেতনভাবে দ্রুত পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠার পথে অগ্রসর হতে পারে, তাই হলো 'মহাধর্ম' (পড়ুন— 'মানবধর্ম আসলে কী')। 

ব্যক্তি মানুষের বিকাশের মধ্য দিয়েই দেশের এবং মানবজাতির বিকাশ সম্ভব। আর সেই উদ্দেশেই মহাধর্ম কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একে সফল ক’রে তুলতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন, এবং সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করুন। তুমি তোমার এলাকাতেই মহাধর্ম কার্যক্রম শুরু করতে পারো। শুধু প্রয়োজন– আত্মনিবেদন, মহা-উদ্যোগ, সাংগঠনিক ক্ষমতা আর উপযুক্ত স্থান।

 

তোমার​ জীবনের প্রাথমিক চাহিদা— শরীর-মনের সুস্থতা, শান্তি, সমৃদ্ধি ও বিকাশলাভ করতে, মহাধর্ম (মানবধর্ম) অনুশীলন করো। মহাধর্ম ক্রমশ এক মহা বৈপ্লবিক উত্তাল তরঙ্গে পরিণত হতে চলেছে। জীবনে আমূল শুভ-পরিবর্তন আসতে চলেছে— মহাধর্ম-এর পথ ধরে। একে ত্বরান্বিত ক’রে তুলতে তুমিও শরিক হও।

সংক্ষেপে, মহাধর্ম ও মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বর: এই ধর্মে— মহাবিশ্বরূপ শরীর এবং তার মধ্যে অবস্থিত মহাবিশ্ব-মন নিয়েই ঈশ্বর অস্তিত্ব। আমরা তাকে বলি, বিশ্বাত্মা। বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে, চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

সমস্যা— তার মূল কারণ ও সমাধানঃ

সমস্ত অমানবিক—ধ্বংসাত্মক—নিষ্ঠুর কার্যকলাপের জন্য দায়ী— মানুষের অজ্ঞানতা বা জ্ঞানের স্বল্পতা, আর অসুস্থতা— অস্বাভাবিকতা বা বিকৃত মানসিকতা। সারা পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত হিংসা-বিদ্বেষ, নিপীড়ন-নির্যাতন-অত্যাচার-নিষ্ঠুরতা, ধর্ষন, প্রতারণা, হত্যা— ধ্বংস প্রভৃতি অসংখ্য অমানবিক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে। এ’সবের জন্য একমাত্র দায়ী হলো— মানুষের যথেষ্ট চেতনারহিত অজ্ঞান ও অসুস্থ মন।

প্রচলিত ধর্মগুলির সাথে মহাধর্মকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। মহাধর্ম হলো আমাদের প্রাথমিক ধর্ম— মৌলিক ধর্ম— মানবধর্ম। সর্বাঙ্গীন সুস্থতাসহ মনোবিকাশের পথে এগিয়ে চলাই এই ধর্মের মূল কথা।

আমরা অধিক অংশেই অন্ধ-আবেগপ্রবণ অবচেতন মনের দ্বারা চালিত হই বলেই আমাদের এত দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা। আমাদের সচেতন মন এখনও পর্যন্ত তেমন বিকশিত নয়। সচেতন মনের বিকাশ ঘটানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। যার সচেতন মন যত বেশি বিকশিত, সে ততটাই বিকশিত মনের মানুষ। যে যত বেশি বিকশিত সে তত বেশি জীবনকে উপভোগ করতে সক্ষম।

একে তো আমরা বেশিরভাগ সময়েই (অবচেতন মনের) অন্ধ-বিশ্বাস— অন্ধ-আবেগের দ্বারা চালিত হই, তার সাথে যদি আবার যুক্ত হয় অসুস্থতা— অসুস্থ মানসিকতা, তখন সোনায় সোহাগার মতো— আমাদের ভিতরটা একেবারে নরকে পরিণত হয়। জীবন দুর্বিসহ—বিষময় হয়ে ওঠে তখন। ক্রোধ—অসহিষ্ণুতা—হিংসা—বিদ্বেষ—নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের মন।

যার যা আছে সে অপরকে তা-ই দিতে পারে। যার অন্তরে সুখ আছে—শান্তি আছে, সে অপরাপর মানুষকে তা’ শেয়ার করতে সক্ষম। যার অন্তর বিষে পরিপূর্ণ সে বিষই উদ্গিরণ করতে পারে। অমৃত সে দেবে কোথা থেকে!

অন্তরকে বিষ মুক্ত— সুস্থ ক’রে তুলে, জ্ঞান আলোকে আলোকীত হয়ে উঠতে পারলেই দিব্য-সুন্দর জীবন লাভ করতে পারবো আমরা। —এটাইতো মানব জীবনে একান্ত কাম্য হওয়ার কথা। কিন্তু অসুস্থ মনের কাছে তা’ কাম্য নাও হতে পারে। তার কাছে আত্ম-ধ্বংসাত্মক পথই শ্রেয় মনে হতে পারে। সে শুধু নিজেকেই ধ্বংস করে না—সমাজ-সংসার-জগতটাকেও ধ্বংস করতে চায় সে! তার মনোভাব হলো— আমি শুধু একাই কষ্ট পাব কেন! সবাইকে কষ্ট দিতে পারলেই তার সাময়ীক—অলীক সুখ অনুভূত হয়।

মহাধর্মের সাথে কারো বিরোধ থাকার কথা নয়, —একমাত্র অজ্ঞান-অন্ধ —অসুস্থ মন ছাড়া।

এখন, যারা তুলনামূলকভাবে সুস্থ আছে, —যারা এখনও জীবনকে ভালবাসে, তারা ভালভাবে বাঁচার জন্য, এই সমস্যার সমাধানের জন্য— অনেক পথ অনুসন্ধান করছে, —অনেক কিছুই চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিক যা করণীয়— তা’ না করার ফলে সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা এতটুকুও।

এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো— আত্মবিকাশ ও মানববিকাশমূলক ধর্ম— মহাধর্ম। সমস্যাকে ভালোভাবে তলিয়ে বুঝতে শেখায় এই ধর্ম, সমস্যার মূলে নিয়ে গিয়ে তার সমাধানের পথ দেখায় এই ধর্ম। এমনকি, সমস্যা থেকে মুক্ত হ’তে সরাসরি সাহায্যও করে এই ধর্ম। এখন, একে গ্রহন করা কি ত্যাগ করা ব্যক্তি বিশেষের নিজের নিজের জ্ঞান-চেতনা— বিচার-বুদ্ধি, পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভরশীল।  

প্রসঙ্গত জানাই— এই ধর্ম মূলতঃ জ্ঞান-পথের পথিকদের জন্য। এই ধর্ম গ্রহন করতে ও অনুশীলন করতে— পূর্বের ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক নয়। অর্থাৎ তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ না করেও এই ধর্ম অনুশীলনের মধ্য দিয়ে লাভবান হতে পারবে।

এই ধর্মের মূলে রয়েছে, যুক্তিসম্মত অধ্যাত্মবাদের একমাত্র গ্রন্থ— ‘মহাবাদ’ (Google search=  MahaVad)। মহাধর্ম অনুসরণ ও অনুশীলন করতে গিয়ে— মহাবাদের সমস্ত দর্শন ও মতবাদ তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে— গ্রহন করতে হবে, এমন নয়। যার যতটুকু ভালো লাগবে সে ততটুকুই গ্রহন করবে। এখানে মনোবিকাশ-ই হলো মূল কথা। অন্ধের মতো অনুসরণ মোটেই কাম্য নয়।

মানবধর্ম আসলে কী—

​(প্রথম অংশটি ভূমিকারূপে প্রকাশিত হয়েছে)

 

পৃথিবীর মুক্ত পাঠশালায়, এই জাগতিক শিক্ষা ব‍্যবস্থায়, পূর্বসূরিদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার দ্বারা সজাগ-সচেতন, যুক্তি-প্রিয় ও সত‍্যপ্রেমী হয়ে--- ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিঘ্ন-প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে— ক্রমশ মনোবিকাশ তথা চেতনা-বিকাশের পথে এগিয়ে চলাই মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম— মৌলিক ধর্ম এবং অন্যতম প্রধান ধর্ম। আর, এ-ই হলো মানবধর্ম।

 

আমরা সবাই এই একই পথের পথিক— ক্রমবিকাশমান চেতনার পথে। তবু আজ, কেউ চলেছে জ্ঞাতে, আর কেউ অজ্ঞাতে। কেউ পিছিয়ে— আর কেউ এগিয়ে। কেউ অতি ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে, আর কেউ দ্রুত গতিতে। কেউ মানবধর্ম থেকে বিচ‍্যুত হয়ে, চেতন-আলোকবিহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে হোঁচট খেতে খেতে, অত্যন্ত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ও অসুস্থতার মধ্য দিয়ে কোনোক্রমে এই পথ অতিক্রম ক’রে চলেছে, আর কেউ মানবধর্মের চেতন-আলোকে উজ্বল পথে— স্বচ্ছন্দে— জ্ঞানানন্দে স্ফূর্তিতে পূর্ণ-বিকাশের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে--- এই একই পথ ধরে। কেউ 'মানবধর্ম' সম্পর্কেই সজাগ নয়, ওয়াকিবহাল নয়, আর কেউ সজাগ-সচেতনভাবে 'মানবধর্ম' পালন ক’রে চলেছে।

 

এখন প্রশ্ন হলো, এমন অসামঞ্জস্য--- এমন পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার কারণ কী? আর, মানবধর্মের স্বাভাবিক ছন্দময় মূলস্রোত থেকে বিচ‍্যুত হয়ে, এমন দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ারইবা কারণ কী?

 

এর অন‍্যতম কারণ হলো, মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া কৃত্রিম ধর্ম।

 

একটাই জগত, পথও একটাই, শুধু জ্ঞান ও চেতনার পার্থক্যের জন্য এক একজনের এক এক দশা, এবং এই পথ ও জগত— এক একজনের কাছে এক এক প্রকার উপলব্ধ হয়। শুধু তা-ই নয়, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে এই পথ—এই জগতকেই দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনাময় নরক ক’রে তোলে কেউ কেউ।

এরজন্য অনেকাংশে দায়ী স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা পরিচালিত অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক প্রচলিত ধর্ম। ধর্ম--- যাকে ধারণ ও পালন করে আমাদের মনোবিকাশ বা মানব-বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা, উল্টে সেই ধর্মই যদি আমাদের বিপথগামী--- নিম্নগামী করে তোলে, তো সেই মিথ‍্যার বেসাতিকে কি ধর্ম বলা যাবে?

 

একশ্রেণীর কুচক্রী (অ)মানুষ, তাদের হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে, মানুষকে তাদের সৃষ্ট--- কাল্পনিক ঈশ্বর ভিত্তিক 'ধর্ম' নামে অধর্মের খাঁচাকলে পুরে, মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, মানুষকে তার স্বাভাবিক বিকাশমুখি --- 'মানবধর্ম' থেকে বিচ‍্যুত করে, তার অধঃপতন ঘটিয়েছে।

 

এই অজ্ঞান-অন্ধত্বজাত অশান্তি থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছন্দে সানন্দে এগিয়ে যেতে চাইলে, জ্ঞান ও চেতনা-বিকাশের পথে অগ্রসর হতে হবে আমাদের, 'মানবধর্ম' ভিত্তিক আত্মবিকাশ মূলক ধর্ম— 'মহাধর্ম'-এর পথ ধরে। মানবধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতেই আবির্ভূত হয়েছে--- মহাধর্ম। বিমূর্ত মানব ধর্মের মূর্ত রূপই হলো--- মহাধর্ম।

 

"যাকে ধারণ ক’রে মানুষ ভালভাবে বাঁচতে পারে, —অপরকে বাঁচাতে পারে এবং আত্মবিকাশের পথে নিজে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে অপরকে অগ্রসর হতে সাহায্য করিতে পারে, তা-ই হলো মানব ধর্ম। আর এই মানবধর্মই হলো মহাধর্ম।" —মহর্ষি মহামানস

 

এখন, অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, তাহলে আলাদা করে মানব ধর্ম ভিত্তিক এই 'মহাধর্ম' গ্রহণ ও অনুশীলন করার প্রয়োজন কী। প্রয়োজন এই জন্য---, আমরা হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসেও, এখনো আমাদের যথেষ্ট মনোবিকাশ ঘটতে পারেনি। আমরা আজও যে তিমির ছিলাম সেই তিমিরেই পড়ে আছি। আমাদের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকদের চিহ্নিত করতে হবে প্রথমে। এরা হলো--- প্রচলিত ধর্ম, রাজতন্ত্র (বর্তমানে রাজনীতি), আর বৈশ‍্যতন্ত্র (ব‍্যবসা- বাণিজ‍্য ব‍্যবস্থা)। এরা চিরকালই আমাদেরকে এদের প্রয়োজনানুসারে মুর্খ বানিয়ে রাখতে সদাতৎপর। মানুষের মনোবিকাশ এদের কাম‍্য নয়। মানুষ বেশি সচেতন হয়ে উঠলে এদের সর্বনাশ। এদের কারসাজিতেই, আজ আমাদের যতটা মনোবিকাশ ঘটার কথা, তা' ঘটা সম্ভব হয়নি।

 

'মহাধর্ম' হলো একটি অতি উৎকৃষ্ট বিশেষ (প্র‍্যাকটিকাল ও থিওরিটিক‍্যাল) শিক্ষা ব‍্যবস্থা। যার দ্বারা বিভিন্ন প্রতিকূলতা দূর করে দ্রুত মনোবিকাশ ঘটানো সম্ভব। মানুষকে সুস্থ ও সচেতন করে তোলা এবং পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমাদেরকে এগিয়ে দেওয়াই 'মহাধর্ম' -এর কাজ। যেটা প্রচলিত শিক্ষা ব‍্যবস্থা অথবা প্রচলিত ধর্মের দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়। আশা করছি, 'মহাধর্ম' আসলে কি, এবং এর কি উদ্দেশ্য, তোমাদেরকে মোটামুটি বোঝাতে পেরেছি।

মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়া, অর্থাৎ মানবধর্মের স্বাভাবিক মানববিকাশমুখী পথ থেকে সরে এসে বিপথগামী হওয়ার কথা আগেই বলেছি। এবার বলবো, মানবত্ব লাভের কথা।

 

পশু যেমন পশুধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, মানুষও তেমনি মানবধর্ম নিয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকে। তবে, পশুর ক্ষেত্রে পশুধর্ম আর পশুত্ব প্রায় সমর্থক হলেও, মানুষের ক্ষেত্রে তা' নয়। পশুকে পশু অর্জন করতে হয়না। মানুষকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই) মানবত্ব অর্জন করতে হয়। মানবধর্মের পথ ধরেই মানবত্ব লাভ করে থাকে সে।

 

পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে উঠলে, তবেই একজন ব্যক্তি পূর্ণ মানবত্ব লাভ করে থাকে। মানব মনের (সচেতন মনের) যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে তবেই মানবত্ব লাভ হয়। মানবমনের যথেষ্ট বিকাশ (লাভ) আর মানবত্ব (লাভ) এখানে সমার্থক।

 

মানুষের প্রতি দয়া-প্রেম-ক্ষমা, সহানুভূতি ---সহযোগিতা প্রভৃতি গুণগুলি মানবত্ব বা মানবতা একটা অংশ মাত্র। মানবত্ব লাভ হলে, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগুলির বিকাশ ঘটে থাকে। তখন আর শিক্ষার মাধ্যমে তা' আরোপ করার প্রয়োজন হয়না।

 

ব্যক্তির চেতনা ও সুস্থতার ন্যূনাধিক‍্যের কারণে তাঁর স্বভাব ধর্ম--- মানবধর্মের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা দিতে পারে। বিকাশ পথে কেউ কিছুটা এগিয়ে--- কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে পরম্পরাগতভাবে উপযুক্ত শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে এবং কুশিক্ষার প্রভাবে বিপথগামীতার কারণে, কারও কারও মধ্যে অসুস্থতা জনিত বিকার-বিকৃতি, এমনকি পশুবৎ আচরণ পরিলক্ষিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারা এদেরকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

 

 

মানুষ হওয়া বলতে কী বোঝায়!

 

মনীষীরা যখন আশীর্বাদ ক’রে বলেন, —‘মানুষ হও’, তখন তাঁরা কি শুধু খেয়ে-প’রে বড় হওয়ার কথা বলেন? —একবারও ভেবে দেখিনা আমরা। অনেকের বক্তব্য, —মানুষ আবার কি হবো, আমরা তো মানুষই!

 

আসলে, এই মানুষ হওয়া বলতে বোঝায়, —যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হওয়া। অর্থাৎ যথেষ্ট বিকশিত মনের মানুষ হওয়া। আত্মবিকাশের অর্থ হলো— মনোবিকাশ। ‘মনের বিকাশ’ —ব্যাপারটা নিয়েও অনেকে ধন্দে আছে। কেউ কেউ ভাবে, আমাদের অনেক বয়েস হয়েছে— যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা হয়েছে, এর থেকে আবার কি বিকাশ হবে! এদের কাছে— পূর্ণবয়স্ক মানুষ আর পূর্ণবিকশিত মানুষ প্রায় সমার্থক!

 

বহীর্মুখী দৃষ্টি দিয়ে অন্তরের অন্ধকার—অসুস্থতা—অপূর্ণতা, অন্তরের বিকাশ বোঝা সম্ভব নয়। তার জন্য মন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান সহ, মন সম্পর্কে সজাগ-সচেতন হতে হবে আমাদের। মনের দিকে তাকাতে— লক্ষ্য রাখতে হবে মাঝে মাঝেই। মনেরাখতে হবে, এই মন আছে ব’লেই— আমরা মানুষ। তাই, একজন মানুষ হিসেবে, আমাদের মন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে। যার মন যত বিকশিত— সে ততটাই বিকশিত মানুষ।

 

মানুষে মানুষে এতো পার্থক্য সৃষ্টির পিছনেও বড় কারণ হলো— আমাদের মন। বিভিন্ন চেতনস্তরের— বিভিন্ন মানসিক গঠন এবং বিভিন্ন ধরণের সংস্কার বা ‘প্রোগ্রাম’ সংবলিত— বিভিন্নরূপ মনের কারণেই আমরা এক একজন এক এক ধরণের মানুষ।

 

আমাদের এই মনের মধ্যে— বর্তমানে সক্রিয় দুটি অংশী মনের একটি হলো— অন্ধ-আবেগ প্রবণ অবচেতন মন, আর অপরটি হলো— সচেতন মন। এদের সুস্থতা এবং সচেতন মনের বিকাশের উপরেই মানুষের যাবতীয় বিকাশ— উন্নতি— সমৃদ্ধি নির্ভর করে। মানব সমাজের অধিকাংশ অসুখ-অশান্তি-সমস্যার মূলেই রয়েছে— আমাদের এই মন। অজ্ঞান-অন্ধ, অসুস্থ-বিকারগ্রস্ত মন। তাই, সুস্থ-সুন্দর —শান্তিপূর্ণ-সমৃদ্ধ জীবন লাভ করতে— নিজের নিজের মনোবিকাশ ও সুস্থতা লাভের চেষ্টার সাথে সাথে, চারিপাশের সমস্ত মানুষের মনোবিকাশ এবং মানসিক সুস্থতা ঘটাতে সচেষ্ট হতে হবে আমাদেরকে।

ধর্ম কথা

ধর্ম কথা: স্বভাব ধর্ম ও আরোপিত ধর্ম 



মানুষের ক্ষেত্রে ধর্ম দুই প্রকারের। একটি হলো তার স্বভাব-ধর্ম, অপরটি আরোপিত ধর্ম। আরোপিত ধর্ম হলো একটি প্রায়োগিক ব‍্যবস্থা, যা তার অধিনস্ত অথবা অনুসরণকারীদের উপর প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়ে থাকে। আরোপিত ধর্ম গঠিত হয়ে থাকে, কয়েকটি বিষয় নিয়ে, যেমন--- দর্শন, নীতি, অনুশাসন, অনুশীলন, আচরণবিধি প্রভৃতি। স্বভাব ধর্মের মধ্যে থাকে, মূলত সুস্থ মানুষের সহজ ও স্বভাবগত আচরণ।

প্রচলিত আরোপিত ধর্ম হলো অজ্ঞান মানুষকে চিরকাল অজ্ঞান অন্ধ মূর্খ বানিয়ে রাখার এক সুন্দর খাঁচাকল।

ভালভাবে বাঁচার জন্য এবং সঠিকভাবে দ্রুত বিকাশলাভের জন্য এই আরোপিত ধর্মটির প্রয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়াও, স্বভাব ধর্মের মধ্যে কিছু ভালো গুণ থাকে এবং কিছু খারাপ গুণও থাকে। সেই খারাপ গুণগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও আরোপিত ধর্মের প্রয়োজন হয়।

কিন্তু প্রচলিত আরোপিত ধর্মগুলি-- এই দুটির কোনোটাই নয়। এই ধর্ম মানুষকে বিপথগামীই করে, বিকশিত করে না। 

মানুষের এই অভাব দূর করতেই আত্মপ্রকাশ করেছে, যুগোপযোগী নতুন ধর্ম--- মহাধর্ম।

অনেকেই মানবতা বা মানবিকতা এবং মানবধর্ম এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলেন। তাই, এখানে সে সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন।
মানবতা হলো--- মনুষ‍্যোচিত সদগুণাবলী। অনেকের মধ্যেই এই সদগুণাবলীর কিছু অংশ প্রকাশিত, আর কিছু অংশ সুপ্তাবস্থায় থাকে।

মানবধর্ম হলো--- মানুষের স্বভাব ধর্ম। এই সুস্থ স্বভাব ধর্মের মধ্যে রয়েছে, ভালভাবে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা আর বিকাশ লাভের প্রচেষ্টা।

কিন্তু প্রচলিত ধর্ম মানুষের এই বিকাশ লাভের স্বভাব ধর্মকে উৎসাহিত না ক'রে, সাহায্য না ক'রে, বরং উল্টে তাকে চাপা দেওয়ার এবং মানুষকে বিপথগামী করে তোলার চেষ্টা ক'রে থাকে। ঈশ্বর লাভ, ঈশ্বরের কৃপা লাভ, স্বর্গ লাভ প্রভৃতি অলীক বিষয় -বস্তুর পিছনে মানুষকে অন্ধের মতো ছুটিয়ে মারে। মুখে সত‍্যের কথা ব'লে, অসত‍্যের পিছনে মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় প্রবঞ্চক প্রতারকদের মতো। একে তাই মানুষের উপযোগী ধর্ম না বলে বলা উচিত অধর্ম।

মানবিকতা মানুষের স্বভাবগুণ বা স্বভাব ধর্মের একটা অংশ হলেও, অনেক সময় অসুস্থতা, অস্বাভাবিক মানসিক গঠনের কারণে, এবং কুশিক্ষার কারণে, স্বভাব ধর্মের মধ্যে কিছু কিছু খারাপ গুণও থাকতে পারে, অথবা প্রবেশ করতে পারে। ফলে, মানবিকতা রূপ সদগুণাবলীর অভাব দেখা দিতে পারে, এবং অমানবিক গুণের প্রকাশ ঘটতে পারে।

এখন, একটি উপযুক্ত আরোপিত ধর্মের দ্বারা তা' নিরাময়ের ব‍্যবস্থা করাই হলো আমাদের কর্তব্য। আর এই উদ্দেশ্যেই এসেছে--- মহাধর্ম। 

এই আরোপিত ধর্মও কিন্তু কিছু উন্নত চেতনার মানুষ তাদের উন্নত স্বভাব ধর্ম থেকেই সৃষ্টি ক'রে থাকেন। বিকাশ বলতে, এখানে মনোবিকাশ বোঝায়। আর, বিকাশের বিভিন্ন স্তরে স্বভাব ধর্মেরও কিছু কিছু পরিবর্তন হয়।

শুধু ধর্মই নয়, প্রায় প্রতিটি সিস্টেম বা ব‍্যবস্থার মধ্যেই কিছু ভালো কিছু খারাপ জিনিস থাকে। 

এখন, যদি সেই ব‍্যবস্থার নিয়ন্ত্রকগণ অথবা তার অধীনস্থ মানুষ---  সেই খারাপ দিকটাকে দূরীকরণের চেষ্টা না ক'রে, শুধু ভালো দিকটাকে নিয়েই গর্ব- মত্ত হয়ে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন, সেই খারাপ অংশটা বৃদ্ধি পেতে পেতে ক্রমশ সমস্ত অংশটাকেই গ্রাস করে ফেলে। ফলস্বরূপ একসময় সেই ব‍্যবস্থাটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।

হাজার হাজার বছর ধরে অজ্ঞান—অসহায় মানুষ অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক (আরোপিত) ধর্মের অধিনস্ত হয়ে আসছে। এই সুদীর্ঘকালের ধর্ম-শিক্ষায় মানুষের ওপরটাতে মেকী সভ্যতার চাকচিক্য— ধর্মীয় ভেক বা ভন্ডামোর ছাপ পড়েছে শুধুমাত্র, অন্তরের অন্ধকার ঘোঁচেনি এতটুকুও। মানুষ যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে আজও। প্রচলিত ধর্ম মানুষের সচেতন মনের বিকাশ ঘটাতে চায়নি কোনদিনই।

প্রচলিত ধর্ম ও রাজতন্ত্র (বর্তমানে রাজনীতি) উভয় উভয়ের স্বার্থে —একে অপরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেস্ট। মেকী মানবসভ্যতার অন্যতম ভিত্তি স্বরূপ শক্তিশালী তিনটি স্তম্ভ হলো— ধর্ম, রাজতন্ত্র আর বৈশ্যতন্ত্র। এরা পারতপক্ষে (কম-বেশি) প্রত্যেকেই মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ ক’রে রাখতে— তাদের খুশিমতো মানুষকে ব্যবহার করতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর। মানব মনের যথেষ্ট বিকাশ —এদের কাম্য নয়।

এককালে, আদিম মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, তাদেরকে সমাজবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ক’রে তুলতে, প্রচলিত ধর্মের প্রয়োজন ছিলো হয়তো। কিন্তু কালের সাথেসাথে তা’ সময়োপযোগী না হয়ে ওঠায়, এখন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে অনেকাংশে। অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্ম মানুষকে কখনোই প্রকৃত জ্ঞানের পথে— সত্যের অভিমুখে অগ্রসর হতে সাহায্য করেনা। আজ চারিদিকে যে ভীষন অসুস্থতা— অরাজকতা, বিকার-বিকৃতি, যে তমসাচ্ছন্ন ঘোর সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা’ অনেকাংশেই এই ধর্মের গর্ভে সৃষ্ট। ধর্ম নিজেই যদি অজ্ঞান-অন্ধ —দুষিত —অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত হয়, তার শাসনাধীন মানুষ ভাল হয় কীকরে! দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষকে নিয়ে আহ্লাদিত হলে হবেনা!

সারাবিশ্বে যত গন্ডগোল— যত সমস্যা— সঙ্কট, তার অধিকাংশের জন্যই দায়ী হলো— দৃঢ় বিশ্বাস বা অন্ধ-বিশ্বাস। যে ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে আমার সম্যক জ্ঞান নেই, সেই ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণাকে ‘সত্য’ বলে— নিশ্চিতভাবে মনে স্থান দেওয়াই হলো— বিশ্বাস বা অন্ধ-বিশ্বাস। এযে কত বিপদজনক —কী মারাত্মক, তা’ একটু সজাগ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালেই বোঝা যাবে। বোঝা না গেলে, —সে-ও হবে ঐ অন্ধ-বিশ্বাসের কারণেই। জ্ঞানী মানুষ মাত্রই তাদের ধারণা—বিশ্বাস—জ্ঞানকে আপাতসত্য জ্ঞান ক’রে থাকেন।

পুরস্কারের লোভ আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে পশুকে এবং পশুতুল্য নিম্নচেতনস্তরের মানুষকে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। একটু জ্ঞান-চক্ষু ফুটলে— সচেতন মনের একটু বিকাশ ঘটলেই— সে মানুষ তখন আর ওসবের দ্বারা কারো নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। তাই, ধর্মও চায়না মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটুক। স্বর্গলাভ—পূণ্যলাভ প্রভৃতি পুরস্কারের লোভ আর নরকাদি শাস্তির ভয় দেখিয়ে, দিব্য-চেতনার নামে আজগুবি দার্শনিক তত্ত্বে ভুলিয়ে— মানুষকে অচেতন করে রাখতেই সে বেশি আগ্রহী।

আজকের এই করুণ পরিস্থিতিতে মানবজাতিকে রক্ষা করতে, চাই— মানবধর্ম ভিত্তিক 'মহাধর্ম'। যে ধর্ম মানুষকে মিথ্যার পিছনে না ছুটিয়ে— ছোটাবে ‘পূর্ণ বিকশিত মানুষ’ হওয়ার লক্ষ্যে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে সে-ও একটু একটু করে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে! এখন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে আমাদের নিজেরদের স্বার্থেই। 

ধর্ম প্রসঙ্গে নানা কথা

যুগ যুগ ধরে মানুষ প্রচলিত ধর্মীয় শাসন ও শিক্ষার অধিনে থেকেও, তার যথেষ্ট মনোবিকাশ ঘটেনি এখনো। যে তিমির সেই তিমিরেই পড়ে আছে।​ এর চাইতে, মানুষ যদি প্রচলিত ধর্ম হতে মুক্ত থেকে, স্বাভাবিক মানবধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর মুক্ত-পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে অনেক অনেক বেশি বিকাশলাভ করতে পারতো।

***

ধর্ম-টা ব‍্যক্তিগত ব‍্যপার, ব‍্যক্তি স্বার্থের ব‍্যপার হলে বিশেষ সমস‍্যা থাকেনা। কিন্তু, সেটা যখন গোষ্ঠিগত ব‍্যপার, গোষ্ঠীগত স্বার্থের ব‍্যপার হয়, এবং সেই গোষ্ঠি যদি গোড়া মৌলবাদী গোষ্ঠি হয়, তখন সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অথচ স্বাধীনচেতা বা মুক্তমনের মানুষের পক্ষে তা' সঙ্কটের কারণ হয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রচলিত ধর্মের মধ্যে থেকে, তার সেই ধর্মকে সংশোধন —পরিবর্তন করতে চায়। খুব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব‍্যক্তি হলে, কিছুটা পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলেও হতে পারে। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা' সম্ভব হবেনা। উল্টে প্রাণটাই যাবে।
***

দিব্যজ্ঞান লাভ করতে চাও? —আগে কান্ডজ্ঞান লাভ করো! (ভক্ত ও অনুগামীদের প্রতি মহামানসের উক্তি)

যদি দিব্যজ্ঞান লাভ করতে চাও, তাহলে— আগে কান্ডজ্ঞান লাভ করো। মোহ-মায়া —অজ্ঞানতা, অন্ধ-বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে পারলে, —তবেই মুক্তিলাভ সম্ভব হবে।

পূর্ণ বিকাশলাভই এই জীবনের অন্তিম লক্ষ্য। তার জন্য পায়ে পায়ে— সমস্ত পথ অতিক্রম করতে হবে। চেতনার পথে যত এগিয়ে যাবে, —ততই বন্ধন মুক্ত হবে, —ততই স্বাধীন হয়ে উঠবে। তবে, ফাঁকি দিয়ে— ফাঁক রেখে, কাউকে ঘুষ দিয়ে— কোনো জাদু-মন্ত্র বলে এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ডিঙিয়ে যাওয়ার অলীক চিন্তা কোরো না। 


যে যতই প্রলোভন দেখাক না কেন, বর্তমান মানব-চেতন স্তরে কোনো ভাবেই মুক্তিলাভ— মোক্ষলাভ— দিব্যজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তাই, যথাসম্ভব মুক্তমনা হয়ে, যথাসাধ্য সজাগ— সচেতন থেকে, আত্মজ্ঞান— আত্মবিকাশ লাভে সচেষ্ট হও।

কেউ অত্যল্প অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েই— নিজেকে একজন কেউকেটা ভাবছে। আবার কেউ কেউ মানুষ ঠকানোর মতো কিছু ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা, —কিছু প্রতারণা মূলক কৌশল অথবা প্রেতশক্তির সাহায্য নিয়ে— নিজেদেরকে ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের প্রতিনিধি রূপে উপস্থাপিত করছে।

কান্ডজ্ঞান বিহিন— লোভী মানুষই প্রধানত এদের শিকার হয়। এদের মতো লোভে পড়ে, বিকাশের পথ ছেড়ে— বিপথগামী হয়োনা।

 

আগের কাজ আগে করো। পূর্ণ বিকশিত মানুষ হওয়ার আপাত লক্ষ্যে এগিয়ে যাও। তার পরের ধাপে— ‘মহামানব’ হও। তারপর আস্তে আস্তে দেবচেতন স্তরে উন্নীত হবে। তারওপরে ‘মহাদেব’ চেতনা সম্পন্ন হয়ে উঠবে, এবং ক্রমে পূর্ণ বিকাশলাভ করবে। এই উচ্চতর থেকে উচ্চতম চেতনস্তর গুলির বিকাশ ঘটবে— ভিন্ন ভিন্ন লোকে, —এই পৃথিবীতে নয়।

মনেরেখ, ঈশ্বরের এই বিধান— এই জাগতিক ব্যবস্থাকে লঙ্ঘন করার সাধ্য— ঈশ্বরেরও নেই। সে তুমি যতই তার পূজা— উপাসনা ও প্রার্থনা করো না কেন!

***

ঈশ্বর আছে কি নেই, থাকলে তার স্বরূপ কি —তা’ যুক্তি-বিচার দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। অজ্ঞান-অন্ধের মতো কেন চোখ বুঁজে তা’ বিশ্বাস করবে!?

মনে রেখ, যুক্তি—কারণ ছাড়া এখানে কোন কিছুই ঘটে না। ঈশ্বরকে যুক্তি-বিচারের সাহায্যে বোঝা যায় না, —একথা ঠিক নয়। তোমার যেটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে— সে টুকুই বোঝ। কল্পনার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার চাইতে তা’ অনেক গুণে ভালো। কল্পনার ঈশ্বরকে নিয়ে তৃপ্ত থাকা— মুর্খের স্বর্গে বাস করার সমান।

ঈশ্বরকে তার স্বরূপে জানা—বোঝার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলে, ‘মহাধর্ম’ পুস্তকটি তোমার কাজে লাগতে পারে। মানবধর্ম হলো মানুষের মূলগত ধর্ম। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

মহাধর্ম এবং অন্যান্য ধর্ম

‘মহাধর্ম’ হলো মানুষের মৌলিক ধর্ম— মানবধর্ম। বিমূর্ত মানবধর্মের মূর্ত রূপই হলো— মহাধর্ম। অন্যান্য ধর্ম হলো অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক আরোপিত ধর্ম। ‘মহাধর্ম’ মূলতঃ যুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক ধর্ম। মানববিকাশ মূলক ধর্ম।
 
অন্যান্য ধর্মের লক্ষ্য— ঈশ্বরলাভ, ঈশ্বরের কৃপা লাভ, স্বর্গলাভ প্রভৃতি। মহাধর্মের অন্তিম লক্ষ্য— ঈশ্বরত্ব লাভ। তবে, ঈশ্বরত্ব লাভ হলেও, বিকাশমান চেতনার পথে— এই মানব-চেতন-স্তরে ঈশ্বরত্ব লাভ সম্ভব নয়, সে অনেক দূরের ব্যাপার, তাই, মহাধর্মমত অনুসারে এই মানব-জীবনের আপাত লক্ষ্য হলো— পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা। উচ্চ থেকে ক্রমোচ্চ— আরো কয়েকটি চেতনস্তর পার হয়ে— অন্তিমে আমরা ঈশ্বর-চেতন-স্তরে পৌঁছাবো। এই জীবনে পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা— মানবত্ব লাভই এই ধর্মের প্রধান লক্ষ্য।
 
অন্যান্য ধর্মের প্রধান ধর্ম-কর্ম হলো— নিয়মিতভাবে ঈশ্বর উপাসনা, প্রার্থনা এবং নিজনিজ ধর্মীয় রীতি-নীতি শাস্ত্র অনুসারে ধর্মানুষ্ঠান প্রভৃতি সম্পন্ন করা। মহাধর্মের প্রধান ধর্ম-কর্ম হলো— যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক পথে— সচেতনভাবে মনোবিকাশ— মানববিকাশ ও সুস্থতা লাভের জন্য, এবং আভ্যন্তরিক ও জাগতিক সত্য লাভের জন্য কর্তব্য কর্ম করা। যুক্তিবাদী হয়ে— জ্ঞানের পথ ধরে সুস্থ-সমৃদ্ধ-সুন্দর জীবন লাভ করাই একজন মহাধর্মীনের লক্ষ্য, এবং তার জন্য কর্তব্য কর্মই হলো মহাধর্মের ধর্ম-কর্ম।
 
আপনিও কি একই পথের পথিক? আসুন, আমরা সবাই মিলে এক উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলি।
 
প্রতিটি মানুষই বিকাশলাভ করে চলেছে। বিকাশলাভই মানুষের মৌলিক ধর্ম— স্বভাবধর্ম। তবে, শরীর-মনের অবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা, বাধা-বিঘ্ন-অভাব, প্রতিকূলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সু বা কু শিক্ষা প্রভৃতি সাপেক্ষে কারো বিকাশ ঘটছে খুব ধীর গতিতে, আবার কারো বিকাশ ঘটছে স্বচ্ছন্দে— সঠিকভাবে। কেউ সমগ্র আয়ুষ্কালের মধ্যে অতি সামান্যই বিকশিত হতে পারছে, কেউ যথেষ্ট বিকাশলাভে সক্ষম হচ্ছে।
 
এই বিকাশ হলো— মনোবিকাশ— আত্ম-বিকাশ— চেতনার বিকাশ। যার ফল স্বরূপ ঘটে মানব বিকাশ।
 
একটা পোষ্য চারাগাছকে যেমন প্রয়োজনীয় আলো—বাতাস—জল—খাদ্য, পরিচর্যা ও সুরক্ষা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যথেষ্ট বিকশিত করে তোলা হয়, মহাধর্মও তেমনিভাবে একজন মহাধর্মানুসারীর সার্বিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে থাকে। এখানেও কিছুকিছু নিয়ম-নীতি-পদ্ধতি আরোপ করা হয়ে থাকে, তবে তা’ করা হয়, বিকাশের প্রয়োজনে— বাধা-বিঘ্ন-প্রতিকূলতা অপসারণের জন্যে, শরীর-মনের সুস্থতা লাভের প্রয়োজনে।
 
অন্ধ-বিশ্বাস হলো বিকাশের পরিপন্থি। তাই, অন্যান্য ধর্ম সরাসরি মানুষের বিকাশ ঘটাতে পারেনা। তাছাড়া, যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে মানুষ আর ধর্মের বাঁধনে বাঁধা থাকেনা, তাই, অন্যান্য ধর্ম— প্রকৃত বিকাশ ঘটুক তা’ চায়না। ‘মহাধর্ম’ মানুষকে বিভিন্ন প্রতিকুলতা ও বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখায়।
 

নাস্তিকরা কি 'মহাধর্ম' গ্রহণ করতে পারে?

নাস্তিকদের মধ্যে দুই শ্রেণীর নাস্তিক রয়েছে। যারা বলেন, জানিনা--- তাই মানিনা। ঈশ্বর অস্তিত্বের প্রমাণ পেলেই মানবো। আমারা জানতে চাই---


এরা মহাধর্ম গ্রহণ করার যোগ্য এবং অনেকেই মহাধর্ম গ্রহণ করছেন। মহাধর্মের মধ্যে যে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর সম্পর্কীত দর্শন আছে, তা' অজ্ঞান- অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে এবং গ্রহণ করতে বলিনা আমরা। এই দর্শনের বাস্তবতা ও গ্রহণযোগ্যতা উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত একে গ্রহণ করা যাবেনা।

নাস্তিকদের মধ্যে যাঁরা ঈশ্বর অনস্তিত্বে অন্ধবিশ্বাসী, যাঁরা অন্য কোনো দর্শনে অন্ধবিশ্বাসী হয়ে--- ঈশ্বর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে থাকেন, তাঁরা মুক্তমনের যুক্তিবাদী মানুষ নয়। আর তাই, তাঁরা 'মহাধর্ম' গ্রহণের যোগ্য নয়। বিশেষ স্বার্থ না থাকলে, তাঁরা 'মহাধর্ম' গ্রহণ করবেও না।

এই প্রসঙ্গে আরো দু-একটা কথাঃ প্রচলিত ধর্ম থেকে মুক্ত হয়ে মানবধর্মে স্থিত হতে, নাস্তিক-ই যে হতে (বিশ্বাত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে) হবে, এমন নয়। আর, মুক্তমনা হলেই যে, সে নাস্তিক হবে, আর নাস্তিক হলেই যে, সে মুক্তমনা হবে, এমন নয়। নাস্তিক হলেই যে সে একজন মুক্তমনের যুক্তিবাদী মানবতাবাদী এবং যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হবে, তেমন কোনো কথা নেই।

 
মানবধর্মই মহাধর্ম। যার মূল কথা হলো— মানব বিকাশ।
 

মানবদেহী বা মানবদেহধারী হলেই যে সে মানবত্ব লাভ করেছে অথবা তার আয়ুষ্কালের মধ্যেই মানবত্ব লাভ করতে পারবে, তেমন নয়। মানবত্ব লাভ হলো— পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা। মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যই হলো— মানবত্ব লাভ। একজন মানবদেহী (মানবদেহ ধারী) যে ধর্মরূপ পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন ক’রে মানবত্ব লাভ করতে পারে, সেই ধর্মই হলো— মানবধর্ম।

 

নানা মতবাদ অনুসরণ ক’রে ঈশ্বর ও স্বর্গরূপ মরীচিকার পিছনে অন্ধের মতো ছুটে চলা— মানবধর্ম নয়।

 

দেবত্ব এবং তৎপরবর্তী ঈশ্বরত্ব আমাদের মধ্যেই সুপ্তাবস্থায় এবং বিকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। দেবত্ব এবং ক্রমে ঈশ্বরত্ব লাভের জন্য আমাদেরকে মানবত্ব লাভ করতে হবে সর্বাগ্রে।

 

কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে— জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে— ক্রমশ মনোবিকাশ তথা চেতনার বিকাশ লাভ করা— আমাদের স্বভাবধর্ম। কিন্তু, আমাদের ভিতরে—বাইরে—চারিপাশে বিকাশের অনুকূল অবস্থা না থাকায়, নানা প্রতিকূলতা থাকায়, বিকাশ-উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহন —আবশ্যক হয়ে পড়ে। মানবধর্ম—  মহাধর্মই হলো সেই অত্যাবশ্যক ব্যবস্থা। একটা চারাগাছের সঠিক বিকাশের জন্য যেমন যত্ন-পরিচর্যা-সুরক্ষাসহ পুষ্টি ও সুস্থতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়, এ-ও ঠিক তেমনি।

 

মানুষের প্রকৃতি অনুযায়ী— বহু পথ বা মার্গ ধরে মানুষ অগ্রসর হয়ে থাকে। তার মধ্যে নিম্নগামী পথগুলি বাদ দিয়ে কর্মপথ—ভক্তিপথ—জ্ঞানপথ –এসবই মিলিত হয়েছে মহাধর্ম পথে। কর্ম ব্যতীরেকে ভক্তিপথ-জ্ঞানপথ –কোনো পথেই অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। আবার জ্ঞানপথেও ভক্তি থাকে। সে হলো জ্ঞানের প্রতি ভক্তি— সত্যের প্রতি ভক্তি। তবে তা’ অন্ধ ভক্তি নয়। অন্ধভক্তির পথ হলো নিম্নমূখী পথ –অধঃপতনের পথ।

 

ধর্মরূপ যে যুক্তিসম্মত পথ-পদ্ধতি ও ব্যবস্থা— একজন মানবদেহীকে মানবত্ব লাভে সাহায্য করে— তা-ই হলো মানবধর্ম। আর, এই মানবধর্মই— মহাধর্ম। 

'মহাধর্ম' প্রচলিত রিলিজিয়ন, প্রচলিত ধার্মিক সিস্টেমের মতো কোন ধর্মমত নয। মহাধর্ম হলো~ মানবধর্ম। মানুষের প্রাকৃতিক ধর্ম এবং ঠিকমতো বিকশিত হয়ে ওঠার ধর্ম। 

একজন মানুষ অনেক জ্ঞান, চেতনা ও সুস্থতা লাভের মধ্য দিয়ে অনেকটাই বিকশিত মানুষ হয়ে উঠলে, সে তখন নিজেই বুঝতে সক্ষম হয়, যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, কি তার করণীয়, কোনটা গ্রহণ করা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। এমনকি নতুন পথও উন্মোচিত হতে পারে--- সেই সচেতন দৃষ্টির সামনে। 

'মহাধর্ম' তাই আমাদের কোন তত্ত্ব--- কোন দর্শন চাপিয়ে না দিয়ে, যথেষ্ট বিকাশপ্রাপ্ত মানুষ হয়ে ওঠার উপরেই গুরুত্ব দেয়। পূর্ণবিকশিত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য পালনীয় কর্মই হলো--- মহাধর্মাচারণ। 

মহাধর্ম বলে, আগে নিজেকে জানো, জীবনের উদ্দেশ্য--- লক্ষ্য কি তা জানো, এবং সেই সঙ্গে জগত সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান লাভ করো। এই ভিত্তিমূল জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে--- চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে--- তুমি নিজেই নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারবে। কর্তব্যকর্মের মধ্যে আপাত করণীয় কিছু কর্ম আছে, ---যা তোমায় আগে করতে হবে, আর ভবিষ্যতে করণীয় কর্মগুলি ভবিষ্যতেই করতে হবে। শুধু মাথায় রাখতে হবে যে আপাত করণীয় কর্মগুলির মধ্য দিয়ে তোমাকে ভবিষ্যতে করণীয় কর্মের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। 

এই মহা-চেতন-সিন্ধুর তুমি হলে একটি বিন্দু স্বরূপ। যে ব্যক্তি নিজেকে প্রকৃতই জানে, একমাত্র সে-ই ঈশ্বরকে জানতে সক্ষম--- তার স্বরূপ-এ (প্রকৃতরূপে)। যার আছে নিজের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা--- ভ্রান্ত বিশ্বাস, তার ঈশ্বরও হয়, ভ্রান্ত ধারণা--- ভ্রান্ত বিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠা--- এক কল্পলোকের ঈশ্বর। 

তাই, নিজেকে না জেনে--- ঈশ্বরকে (তার স্বরূপে) না জেনে, ঈশ্বরলাভ--- ঈশ্বরের কৃপা লাভ--- মুক্তিলাভ বা স্বর্গ লাভের পিছনে ছুটে মরো না। বাস্তব জ্ঞানসহ প্রকৃত অধ‍্যাত্ম-জ্ঞান ও যথেষ্ট চেতনা লাভের মধ্য দিয়ে, এবং সর্বাঙ্গীন সুস্থতা লাভের মধ্য দিয়ে--- প্রকৃত বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠো। 

একজন মানুষ হিসেবে--- পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠার ধর্মই হোক তোমার ধর্ম। মহাধর্ম হলো মানুষের প্রাকৃতিক ধর্ম--- স্বধর্ম। যে ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ--- সার্বিক বিকাশপ্রাপ্ত মানুষ হয়ে ওঠার পথে অগ্রসর হতে পারে, সেই আচরিত ধর্মই হলো মহাধর্ম। 

আত্মবিস্মৃত মানুষকে তার আত্মা-স্বরূপ--- আত্মপরিচয় জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে স্বধর্মে দীক্ষিত ক'রে--- জীবনের মূল লক্ষ্য পানে এগিয়ে দেওয়া হলো, এই ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য। নিজের সাথে নিজের পরিচয় ঘটানোই এই ধর্মের প্রথম পাঠ। 

এই প্রসঙ্গে সেই বাঘ্রশাবকের গল্পটা উল্লেখযোগ্য: 
এক গ্রামে এক পশুপালক বাস করতো। তার সেই খোঁয়াড়ে অনেক গরু ছাগল ভেড়া ছিল। প্রতিদিন সেই পশুপালক তার পোষ‍্যদের বনের ধারে নিয়ে যেত, ঘাসপাতা খাওয়ানোর জন্য। 

একদিন সে দেখতে পায়, পথের ধারে একটা বাঘ্রশাবক প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে। স্নেহ-মমতা বশতঃ সে ওই বাঘ্রশাবকটিকে নিয়ে এসে--- অন্যান্য পশুদের সঙ্গেই লালন পালন করতে থাকে। বাঘ্রশাবকটি একটু সুস্থ হয়ে উঠতেই, সে নিজেকে ওই গরু-ছাগল-ভেড়াদের মতোই একজন ভাবতে থাকে, এবং ওদের দেখাদেখি সে-ও ওদের মতোই ঘাস পাতা আহার করতে থাকে। ওদের সাথে। 

বনের ধারে অন্যান্য পশুদের সঙ্গে বিচরণ করতে করতে, একদিন হঠাৎ সে এক বড় বাঘের সম্মুখীন হয়। বাঘটি আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখতে থাকে। বাঘ্রশাবক হয়েও, তাকে গরু-ছাগলের মতো আচরণ করতে দেখে, বাঘটি তার কাছে এগিয়ে আসে, এবং তাকে নিয়ে যায় নিকটবর্তী এক জলাশয়ের ধারে। জলাশয়ে উভয়ের প্রতিফলিত আকৃতি দেখিয়ে--- বড় বাঘটি তাকে বোঝায়, তার রূপ-জাত-ধর্ম সবই বাঘের মতো। যেসব পশুদের সাথে সে এতকাল কাটিয়েছে, মোটেই তাদের মত নয়। ওইসব পশুদের হত্যা করে খাওয়াই তার ধর্ম। 

এখানে বিষয়টি হত্যা করা বা রক্ষা করা নয়, বিষয়টি হলো--- নিজের স্বরূপ -এর জ্ঞান। তুমি প্রকৃতই যা--- তোমার সেই স্ব-রূপের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেওয়াই হলো মহাধর্মের প্রথম পাঠ।

নিজেদের তথা মানবজাতির প্রকৃত উন্নয়নে, এই মহা কর্মযজ্ঞে শরিক হোন। মহাধর্ম -এর মনোবিকাশ মূলক (আত্মবিকাশ যোগ) শিক্ষার আলো চতুর্দিকে যত বেশি প্রসারিত হবে, অজ্ঞান- অন্ধত্ব- অন্ধকার ততই দূর হয়ে যাবে। আমরা ততই শান্তি-- সুস্থতা, আত্মবিকাশ লাভ করতে পারবো। আরো উন্নত, আরও ভালো জীবন লাভ করতে পারবো আম‍রা।

প্রত্যেক চেতনসত্তার ধর্ম— তার চেতনস্তরের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
 


সব কিছু সবার জন্য নয় –সবার উপযোগী নয়। মহাধর্মের ক্ষেত্রেও একথা খাটে। মহাধর্ম শুধু তাদের জন্যই, -যাদের মনোবীণার সুরের সাথে –এর সুরের, এর কম্পনাঙ্কের মিল আছে। মহাধর্মকে যাদের ভালো লাগে বা লাগবে, মহাধর্ম শুধু তাদের জন্যই। এই ধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ধর্ম নয়।  

বিশ্বাস প্রবণ- ধর্ম প্রবণ মানুষদের জন্য অনেক ধর্ম – অনেক ধর্মগুরু আছেন। তাদের নিয়ে মহাধর্ম বিশেষ চিন্তিত নয়। -এর বাইরে যে জগৎ আছে, -যারা আছে মাঝখানে, মহাধর্ম তাদের কথাই বেশী ভাবে। এছাড়া, মানবজাতির বয়স বাড়ছে – সেই সাথে মানবমনেরও বয়স বাড়ছে ক্রমশ। সেই বয়ষ্ক মন– মায়ের আঁচল তলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেড়িয়ে এসে– এই জগতটাকে দেখতে চায় – বুঝতে চায়, –নিজেকে জানতে চায়, –মহাধর্ম মূলতঃ তাদের কথা ভেবেই।  

বিভিন্ন চেতনস্তরের— মন বা চেতনসত্তার ধর্মও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন— বরফের ধর্ম, জলের ধর্ম এবং বাষ্পের ধর্মের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যে ব্যক্তি যে চেতনস্তরে অবস্থান করছে, তার ধর্মও তদনুরূপ। যে যা করছে, সবই সে করতে বাধ্য—  তাই করছে। অন্য চেতন স্তরের ধর্ম তার কাছে আশা করাই ভুল। সবাই নিজের নিজের ধর্ম অনুযায়ী কর্ম ক’রে চলেছে।  

তবু, জ্ঞান ও চেতনার স্বল্পতার কারণে —এই ভুল আমরা অনেকেই করে থাকি। উচিত— অনুচিত, ঠিক-বেঠিক নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, বিচার-আলোচনায় মেতে উঠি আমরা। হ্যাঁ, এটাও কিন্তু এই চেতন স্তরের মানুষের পক্ষে একেবারে স্বাভাবিক, –এটাই তাদের স্বভাব ধর্ম।

যুক্তিসম্মত আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক ধর্ম — ‘মহাধর্ম’ কখনোই কোনো ধর্মকে ছোট,  কোনো ধর্মকে বড়, অথবা নিজেকে বড় বলেনা। তবে সে তার অনুগামীদের কাছে সত্যকে যথাসম্ভব উন্মোচিত ক’রে—  তুলে ধরতে চেষ্টা করে। অবশ্য এতে কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারে। কিন্তু এই সত্য  –এই ধর্মমত তো তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তারা তাদের সত্যে —তাদের বিশ্বাসে অবিচল থাকুক !

আসলে, আমাদের এই সত্য —অসত্য –এসবই আপেক্ষিক ব্যাপার। আমার কাছে যা সত্য —অপরের কাছে তা’ সত্য নয়। তাই, আপাত সত্যের হাত ধ’রে বিকাশের পথে— পরম সত্যের লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই মহাধর্মীদের কাজ।

যুক্তি-বিজ্ঞানের পথ ধরেও যে ঈশ্বর উপলব্ধি সম্ভব, যুক্তি সম্মত আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হয়েও— আধ্যাত্মিক উন্নতি— আত্মবিকাশ লাভ সম্ভব, –যুক্তিবাদী —বিজ্ঞান মনষ্ক —মুক্ত মনের মানুষদের কাছে তা’ তুলে ধরা এবং সেই পথে সাফল্যের সাথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করাই মহাধর্মের মূল উদ্দেশ্য।

যা হচ্ছে— সবই যখন ঠিক ঠিক ভাবে ঘটে চলেছে, যা হবার ঠিক তা-ই হচ্ছে, তবে আবার এর প্রয়োজন হলো কেন ?   জাগতিক নিয়মেই— কালের চাহিদা মতো, অনিবার্য কারণেই এর সূচনা হয়েছে। ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা না চাইলে— কিছুই সম্ভব হয়না। জাগতিক নিয়মে— সময়ের চাহিদা মতোই ধর্ম বিপ্লব সম্ভব হয় যুগে যুগে !    


 

 

 

 মহাধর্ম :  আরো দু-চার কথা 



মহাধর্ম বলে, আমাদের প্রতি মহাবিশ্বরূপ সৃষ্টিকর্তার আর কিছু করার নেই। সৃষ্টিকর্তার প্রতিও আমাদের কিছু ক‍রার নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাছে আত্মবিকাশ (মনোবিকাশ) বৈ আর কিছু আশা ক‍রে না। আমরাও সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু আশা করি না।

কিছু পাওয়ার নেই, কিছু চাওয়ার নেই। তবু আছে নাড়ির টান। কোনো আশা নেই, তবু আছে তার প্রতি ক্ষোভ-অভিমান, আছে শ্রদ্ধা-ভক্তি, সহজ ভালবাসা।

সৃষ্টিক‍র্মে বা সৃজন কর্মে 'লাষ্ট ফিনিশিং টাচ্' দেওয়ার পর থেকে এই সৃষ্টির ব‍্যপারে সৃষ্টিকর্তার আর কোনো ভূমিকা নেই। সৃষ্টি চলছে জাগতিক ব‍্যবস্থা মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে। 

'ভগবান ভগবান' বলে, কেঁদে ম‍রে গেলেও ভগবান ছুটে আসবে না। ফিরে তাকিয়েও দেখবে না। ভাগ‍্যে যা আছে, পূর্ব নির্ধারিত মতো, তা-ই ঘটবে। তার বাইরে কিছুই হবার নয়। এটাই কঠিন সত্য।

সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে বিকাশের পথেই এগিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ---ঘটনাচক্রে, আমরা বিকাশের পথ থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে অজ্ঞান-অন্ধকারের পাঁকে পাক খেয়ে মরছি। আমরা ভুলে গিয়েছি, আত্মবিকাশই আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। 

ভাগ্য যে ঈশ্বরের থেকেও বলবান, এ' হলো তারই এক প্রমাণ। ভাগ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে, মৎ রচিত 'মহাসৃষ্টি রহস্য উন্মোচন' ও ভাগ্য সম্পর্কে প্রবন্ধটি পড়ো।

একমাত্র স্বল্প-চেতন স্তরের মানুষই চায়, সবাই তার পূজা করুক। বর্তমানে ঈশ্বরের চেতনার এতটা দৈন‍্য‍দশা নয়,  যে সে মানুষের পূজার জন্য লালাইত হবে!  

মহাধর্ম-এ দেব, ঈশ্বর, গুরু পূজার অবকাশ নেই।  আত্ম-বিকাশ লাভ এবং সুস্থতা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মই আমাদের ধর্ম, আমাদের পূজা। 

আরও জানতে এই ওয়েবসাইট দেখুন।  www.mahadharma.wix.com/bangla

আমরা সমমনষ্ক মানুষদের কামনা করছি।

মহাধর্ম গ্রহণ সম্পর্কে

আমরা কাউকে ধর্মান্তরিত (কনভার্ট) করতে আগ্রহী নই। আমরা কেবলমাত্র তাঁদেরকেই কামনা করি, যারা আমাদের সমমনস্ক— সম-মত পোষণকারী— সমধর্মী এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাধর্ম গ্রহণে ইচ্ছুক।

মহাধর্ম যেহেতু মানুষের মৌলিক ধর্ম, তাই যেকোন মানুষ তাঁর পূর্বেকার ধর্ম পরিত্যাগ না করেও ‘মহাধর্ম’ গ্রহণ ও পালন করতে পারবে।

তবে, যাঁরা সক্রিয় সদস্য হতে চাও, যাঁরা পরিপূর্ণভাবে মহাধর্ম অনুসরণ করতে চাও, তাঁদেরকে অন্যান্য মতবাদ পরিত্যাগ ক’রে— সম্পূর্ণরূপে মহাধর্মী/মহাধর্মীন হয়ে উঠতে হবে।

দীক্ষা শুধুমাত্র তাদেরকেই দেওয়া হবে, যারা পরিপূর্ণভাবে 'মহাধর্ম' অনুসরণ করতে ইচ্ছুক, এবং মহাধর্ম সংসদের সক্রিয় সদস্য হতে ইচ্ছুক।

  

মহাধর্ম যাঁদের জন্য

মহাধর্ম-এর মুল সুরের সাথে যাঁদের মন-বীণার সুরের মিল আছে, মহাধর্ম-কে ভালবেসে যাঁরা গ্রহন করবে, তাঁদের জন্যই মহাধর্ম। সাধারণতঃ মুক্তমনের যুক্তিবাদী সত্যপ্রিয় জ্ঞানপিপাসু  আত্ম-বিকাশকামী মানুষরাই মহাধর্ম গ্রহন করে থাকে। 

যে পথ ও পদ্ধতিকে ধারণ ক’রে একজন মানুষ নিজেকে— নিজের স্বরূপে উপলব্ধি করতে পারে, আরো ভালো জীবন লাভে সক্ষম হতে পারে, এবং পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠার লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে, তা’ই হলো— ‘মহাধর্ম’।​

‘মহাধর্ম’ হলো—   অন্ধ-বিশ্বাস মুক্ত যুগোপযোগী মানব-বিকাশমূলক ধর্ম। মানবধর্ম। সদস্য হও। তোমার এলাকায় শাখা-কেন্দ্র গড়ে তোলো। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও।

পূজা-আরাধনা-প্রার্থনা প্রসঙ্গে

'মহাধর্ম'-এ প্রচলিত পূজা-আরাধনা-প্রার্থনার পরিবর্তে রয়েছে— ‘মহামনন’ ধ্যান-যোগ (আত্ম-ধ্যান), প্রাণযোগ, সুষুপ্তি যোগ, মহামানস যোগ, স্ব-অভিভাবন সঙ্গীত, প্রাকৃতিক চিকিৎসা প্রভৃতি। এইগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিতভাবে অনুশীলন করলে, মানুষ প্রভূত উন্নতি লাভসহ বিভিন্ন দিক থেকে লাভবান হতে পারবে।

তবে, পুরোনো সংস্কার থেকে, যদি পূজো করার প্রবল বাসনা জাগে তোমার মনে— তাহলে, নিজেকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে— নিজের পূজো করো। নিজের ছবিকে মালা-ফুল-চন্দন দিয়ে সাজিয়ে, ধূপ-প্রদীপ সামনে রেখে, তোমার ছবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকো। আর, গান করো— 'জাগো ওঠো--- জাগো ওঠো---'। গান গাইতে গাইতে ধ্যানস্থ হয়ে যাও। এই পদ্ধতিতে তুমি অনেক সুফল লাভ করতে পারবে। 

 অন্তরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে, নিজেকে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের অংশ রূপে— নিজের মধ্যে বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করো। এ-ই হলো বিশ্বাত্মা বা ঈশরের প্রকৃত উপাসনা।  

 

দীক্ষা প্রসঙ্গে

মানবধর্ম— ‘মহাধর্ম’-এ দীক্ষিত হতে চাইলে, এবং মহর্ষি মহামানসের সান্নিধ্যে দীক্ষিত হবার সুযোগ না থাকলে, মনেমনে দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে স্ব-দীক্ষিত হওয়া যায়। অথবা, ধ্যানাসনে বসে— মহর্ষি মহামানসের স্মরণ ও শরণ নিয়েও মনেমনে তাঁর কাছ হতে দীক্ষিত হওয়া সম্ভব।এছাড়া, মহর্ষি মহামানসের নিকটে দীক্ষিত হয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিতভাবে ‘মহাধর্ম’ অনুশীলণকারী ব্যক্তির কাছ থেকেও দীক্ষিত হওয়া যাবে।  

।। সময়োপযোগী সতর্কীকরণ ।।

আমরা এখন সময়ের এক চরম সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছি। ভিতরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, চতুর্দিকে অত্যন্ত দ্রুত গ‍তিতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা যদি নিজদেরকে পরিবর্তিত করতে না পারি, যদি সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারি, তাহলে অচিরেই অনিবার্যরূপে আমাদের বিলুপ্তি ঘটবে।

বেশি দূরের কথা নয়, আগামী ২০ বছরের মধ্যেই প্রকৃতিসহ আমাদের জীবনে এত বেশি পরিবর্তন ঘটবে, যে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়োপযোগী ও পরিবর্তিত হতে না পেরে, বহু মানুষই জীবন চলার পথে মুখ থুবড়ে পড়বে।

এই করুণ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে, আমাদেরকে অনেক বেশি সজাগ-সচেতন-সতর্ক হয়ে উঠতে হবে। সময়োপযোগী হয়ে উঠতে হবে। তা' না হলে, আমরা হারিয়ে যাবো অতীতের সেই বিলুপ্ত প্রাণীদের মতোই।

তাই সময়ের ডাকে, মানবধর্ম ভিত্তিক সময়োপযোগী ধর্ম~ 'মহাধর্ম' -কে মনে-প্রাণে গ্রহণ ক'রে, তা' নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন করে যথেষ্ট মনোবিকাশ ঘটাতে পারলে, তবেই এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।

কঠিন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে, কঠিন পদক্ষেপ নিতেই হবে আজকে আমাদের। এখনো সময় আছে, সমস্ত অন্ধবিশ্বাস ও আলস‍্য ত‍্যাগ করে, আত্মবিকাশ অর্থাৎ মনোবিকাশের নিমিত্ত, অবিলম্বে মানবধর্ম~ মহাধর্ম গ্রহণ ও পালন করতে হবে আমাদেরকে।

এটা কোনো ভয় দেখানো কথা নয়। এটাই হলো আজকের চরম সত্য।

আমাদেরকে এই চরম দুরবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারবেনা প্রচলিত কোনো ধর্ম-ই। কোনো ওপরওয়ালা-ই নেমে আসবে না তখন এই পৃথিবীতে। নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে, যুক্তি-বিজ্ঞান, প্রজ্ঞান ও প্রকৃত অধ‍্যাত্ম জ্ঞানের সাহায্যে। পরিবর্তীত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে টিঁকে থাকতে, প্রয়োজন মতো নিজেদের সংশোধন পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

সেই পরিবর্তনের ডাক দিয়েছে 'মহাধর্ম'। মানুষের আদি ধর্ম, মৌলিক ধর্ম, একমাত্র ধর্ম। মানবধর্ম। মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আবির্ভূত হয়েছে, মানুষের প্রকৃত কল‍্যানকামী ধর্ম।

মানুষ যদি এখনো নিজের ভালো নিজে বুঝতে না পারে, নিজের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে এগিয়ে যেতে না পারে, সত্য ও মিথ্যা এবং শত্রু ও বন্ধুর পার্থক্য বুঝতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, তার অন্তিম কাল আসন্ন হয়েছে।

'মহামানব-প্রেমিক মহর্ষি মহামানস -এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানবধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করুন। এই দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়ে সর্বোত্তম জীবন লাভ করুন।'— সম্পাদক

স্বতঃস্ফূর্তভাবে অথবা আরোপিতভাবে প্রকৃত মনোবিকাশের জন্য অনুসরণীয় ধর্মই হলো মানবধর্ম।

যাকে ধারণ করে মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে ও সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে, তা-ই হলো ধর্ম। তাকেই বলা হয়~ মানব ধর্ম।

আর, যাকে ধারণ করে মানুষ অজ্ঞান-অন্ধের মতো নিম্নগামী হয়ে ভুল পথে এগিয়ে যায়, যা মানুষকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে গহ্বরে ডুবিয়ে রাখে, তা' কখনোই ধর্ম নয়, তা' হলো অধর্ম। যারা মানবধর্ম থেকে বিচ‍্যুত হয়েছে, অথবা মানবধর্ম বিস্মৃত হয়েছে, তাদের জন‍্য আজ প্রয়োজন 'মহাধর্ম' নামে এই আরোপিত মানবধর্ম।

সন্তানদের প্রকৃত মানুষ করে তুলতে চাইলে, শুরু থেকেই তাদেরকে মানবধর্মের পাঠ দিতে হবে। সন্তান অমানুষ তৈরি হলে, তারজন্য দায়ী হবে তোমরাই, আর, তার কুফল শুধু তোমরাই নও, ভোগ করতে হবে গোটা মানব সমাজকেই।


তাই, আর বিলম্ব না করে, আজই মানবধর্মে দীক্ষিত হও সবাই।

মানবধর্ম-ই মূর্ত হয়েছে 'মহাধর্ম' রূপে। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

।। জাগো~ ওঠো, আত্মবিকাশ লাভ করো ।।
।। জয় মানবধর্মের জয় ।। 

।।জয় মহাধর্মের জয়।।

মানবসমাজ হলো একটা শরীরের মতো। আর, এই শরীরে— জ্ঞান ও চেতনায় পিছিয়ে পড়া— অনগ্রসর মানুষ হলো দুষিত ক্ষতের মতো।প্রকৃত মানববিকাশসহ দেশের সামগ্রিক বিকাশ ঘটাতে চাইলে, সুস্থ-সমৃদ্ধ অপরাধ-অশান্তি মুক্ত দেশ গড়তে চাইলে, এদের উপেক্ষা বা ঘৃণা করে নয়, হিংসা-বিদ্বেষ দমন-পীড়নের মাধ্যমে নয়, এদের কিছু পাইয়ে দিয়ে লাভবান হওয়ার রাজনীতি করে নয়, একমাত্র আত্মবিকাশ বা মনোবিকাশমূলক শিক্ষাসহ সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমেই এই ক্ষত নিরাময় করতে হবে।     ~মহর্ষি মহামানস
bottom of page