top of page

মানব ধর্মই— মহাধর্ম


শুরুতেই, কবির একটা বাণী মনে পড়ে গেল। ‘জন্মিলে মরিতে হবে— অমর কে কোথা কবে’। শুধু উদ্ভিদ আর জীব জগতেই নয়, সমস্ত ক্ষেত্রেই, মায় মহাবিশ্ব পর্যন্ত, যার জন্ম হয়েছে— তার মৃত্যু হবে। যার শুরু আছে— তার শেষ আছে। সৃষ্টি হলেই একসময় তার ধ্বংস অনিবার্য।

ধর্মের ক্ষেত্রেও সেই এককথা। প্রচলিত সমস্ত ধর্মগুলি এক এক সময়—এক একজন বা কয়েকজনের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। আবার পূর্বনির্ধারিত ভাবেই যখন যার শেষ হবার— শেষ হয়ে যাবে।

আচ্ছা? —একবারও কি আপনাদের মনে হয়না, আপনারা যে— যে ধর্ম অনুসরণ করে চলেছেন, সেই সেই ধর্মের স্রষ্টা যে বা যাঁরা— তাঁদের ধর্ম কি ছিলো?! তাঁদের পিতা—প্রপিতার ধর্ম কি ছিলো? তাঁদের পূর্বাদিপূর্ব পুরুষদের ধর্ম কি ছিলো?!

একবারও কি প্রশ্ন জাগেনা? শিকড়ের সন্ধানে একবারও কি চিন্তা-ভাবনার উদয় হয়না আপনাদের মনোজগতে?

হ্যাঁ, তখনো ধর্ম ছিলো। আমরা আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে তা’ অনুসরণ করে এসেছি। তা’ হলো— আত্ম-বিকাশমূলক ধর্ম— মানব ধর্ম। মানুষ সৃষ্টির সাথেসাথেই জাগতিক ব্যবস্থাই এই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। যতদিন মানবজাতি থাকবে— মানবধর্মও থাকবে ততদিন।

এই সাধারণ কথাটা আমাদের অবোধ মন কিছুতেই বুঝতে পারেনা, বুঝতে চায়না! আরে! ঈশ্বর সৃষ্ট ধর্ম —এত প্রকারের — এত ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হবে কেন?! বিভিন্ন চেতন-স্তরের জন্য হলে, তাও একটা কথা ছিলো। ঈশ্বর সৃষ্ট ধর্মতো সর্বত্র একই হবে! এক এক জায়গায় এক এক রকমের হবেনা। আর, তা’ হবে আত্ম-বিকাশ মূলক —মানব-উন্নয়ন মূলক ধর্ম।

একবারও কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে মনে— যে ঈশ্বরকে নিয়ে আমরা এতো মাতামাতি করি, এতো যার উপাসনা করি— যার কাছে দিন-রাত প্রার্থনা করি—, সেই ঈশ্বরের ধর্ম কী?

ঈশ্বরের ধর্মও সেই আত্ম-বিকাশের ধর্ম— মহাধর্ম। মানুষের ক্ষেত্রে তাকেই আমরা বলি, মানব ধর্ম। মানব চেতন-স্তরে এই মানব ধর্মই— মহাধর্ম। আত্ম-বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়—বিভিন্ন স্তর আছে। প্রতিটি স্তরের ধর্মের মধ্যেও কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন, শৈশবের ধর্ম, কৈশোরের ধর্ম, যৌবনের ধর্ম প্রভৃতি। আত্ম-বিকাশ জীবন তথা মহাজীবনের মূল কথা হলেও, প্রতিটি পর্যায়ের মধ্যে মাত্রাগত— আচরণগত পার্থক্য রয়েছে।

আমরা— কীট-চেতন-স্তর, পশু-চেতন-স্তর, আদিম-মানব-চেতন-স্তর প্রভৃতি বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে এসে এখন মানব-চেতন-স্তরে উন্নীত হয়েছি। যে পর্যায়ের যে ধর্ম—যে কাজ, তা’ শেষ করতে না পারলে, আমরা ঊর্ধতন স্তরে পৌঁছাতে পারবো না। নিম্ন-চেতন-স্তরগুলোতে আছে— দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা —শোক-সমস্যা-হতাশা! যত উচ্চ-চেতন-স্তরে উন্নীত হব, ততই এই সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি ঘটবে আমাদের।

এইভাবে, ধাপে ধাপে আমরা দেব-চেতন-স্তর —ক্রমে ঈশ্বর-চেতন-স্তরে উপনীত হবো। আমাদের জীবনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য এটাই। পূর্ণ বিকাশলাভ। এই লক্ষ্য কারো কারো কাছে স্পষ্ট— কারো কারো কাছে নয়। আগামী স্তরগুলিতে পৌঁছাতে হলে, আমাদেরকে পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয়ে উঠতে হবে সবার আগে। তার জন্য করণীয় যা, —তা-ই হলো মানব ধর্ম। এই মানব ধর্মই— মহাধর্ম।

হাজার হাজার বছর পূর্বে, যখন অধিকাংশ মানুষের চেতনা ছিলো খুবই কম, তখনকার দিনের অপেক্ষাকৃত উন্নত চেতন-স্তরের কিছু মানুষ— সেই সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং তখনকার মানুষের বোধশক্তি— চেতনা, জ্ঞান-বুদ্ধি সাপেক্ষে— তখনকার মানুষের প্রয়োজন বোধ করে, তাদেরকে সমাজবদ্ধ এবং উন্নত করে তুলতে, সৎ ও সুস্থ করে তোলার উদ্দেশে, বিভিন্ন জন — বিভিন্ন স্থানে তখনকার কালোপযোগী বিভিন্ন ধর্মের জন্ম দিয়ে ছিলেন। যা তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে সঠিক ছিলো। পরবর্তীকালে, এই ধর্ম— কিছু স্বার্থান্বেষী কুচক্রীদের কবলে পড়ে— সে নিজেই হয়েছে ধর্মচ্যুত।

তারপর কেটে গেছে বহু সময়। বিজ্ঞানের পথ ধরে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। ক্রমশই গতি বেড়েছে। গরুরগাড়ি থেকে মোটরগাড়ি, তারপর একে একে গতি বাড়তে বাড়তে ইন্টারনেটের যুগে রকেটের গতি এসে গেছে আজ মানব জীবনে।

আমাদের একটা বড় অংশের চেতনাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। কিন্তু আমাদেরকে গাইড করার মতো— দ্রুত মনোবিকাশ— আত্ম-বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করার মতো সময়োপযোগী কোনো ধর্ম নেই আমাদের সামনে। প্রচলিত ধর্ম পড়ে আছে প্রায় সেই আদিম অবস্থাতেই। আমরা পড়ে আছি সেই তিমিরেই। ওপরে ওপরে কিছুটা আধুনিকতার রঙ লাগলেও, অন্ধ-বিশ্বাসের কালো পট্টি এখনো আমাদের চোখ ঢেকে রেখেছে। আমরা এখনও ঘুরে মরছি— অজ্ঞান-অন্ধের মতো, এক তীব্র মোহের ঘোরে। এই অজ্ঞানতার ঘোর থেকে —এই অন্ধত্ব থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলে— মুক্তি পেতে চাইলে, চোখ মেলে সত্যকে উপলব্ধি করতে চাইলে, জীবনে প্রকৃত সুখ-শান্তি-আনন্দ —সুস্থতা পেতে চাইলে, আমাদের মৌলিক ধর্ম মানবধর্মকে বরণ করে নিতে হবে, গ্রহন করতে হবে সর্বাত্মকরণে।

আজকের দিনে চাই— আজকের মানুষের উপযোগী ধর্ম— যুগোপযোগী ধর্ম— মানবধর্ম। সেই চিরন্তন ধর্ম— যা এতকাল আমরা বিস্মৃত হয়ে ছিলাম।

হাজার হাজার বছর ধরে অজ্ঞান—অসহায় মানুষ অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মের অধিনস্ত হয়ে আসছে। এই সুদীর্ঘকালের ধর্ম-শিক্ষায় মানুষের ওপরটাতে মেকী সভ্যতার চাকচিক্য— ধর্মীয় ভেক বা ভন্ডামোর ছাপ পড়েছে শুধুমাত্র, অন্তরের অন্ধকার ঘোঁচেনি এতটুকুও। অধিকাংশ মানুষ যে তিমির সেই তিমিরেই রয়ে গেছে আজও।স্বার্থান্বেষীদের কুক্ষিগত প্রচলিত ধর্ম মানুষের সচেতন মনের বিকাশ ঘটাতে চায়নি কোনদিনই।

প্রচলিত ধর্ম ও রাজতন্ত্র (বর্তমানে রাজনীতি) উভয় উভয়ের স্বার্থে —একে অপরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেস্ট। মেকী মানবসভ্যতার অন্যতম ভিত্তি স্বরূপ শক্তিশালী তিনটি স্তম্ভ হলো— ধর্ম, রাজতন্ত্র আর বৈশ্যতন্ত্র। এরা পারতপক্ষে (কম-বেশি) প্রত্যেকেই মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ ক’রে রাখতে— তাদের খুশিমতো মানুষকে ব্যবহার করতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর। মানব মনের যথেষ্ট বিকাশ —এদের কাম্য নয়।

এককালে, আদিম মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, তাদেরকে সমাজবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ক’রে তুলতে, প্রচলিত ধর্মের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময়ের সাথেসাথে তা’ সময়োপযোগী না হয়ে ওঠায়, বরং দুষিত ও বিকৃত হয়ে ওঠায়, এখন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে অনেকাংশে। অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক প্রচলিত ধর্ম মানুষকে কখনোই প্রকৃত জ্ঞানের পথে— সত্যের অভিমুখে অগ্রসর হতে সাহায্য করেনা।

কিছু স্বার্থান্ধ-কুচক্রী মানুষ— তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে— অন্যান্য সাধারণ মানুষকে মানবধর্ম— আত্ম-বিকাশের স্বভাব-ধর্ম থেকে বিচ্যুত করে— ভুল পথে চালিত করার ফলেই আজ মানুষের এই দুরাবস্থা। সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেও মানুষের যথেষ্ট চেতনার উন্মেষ ঘটেনি এই কারণেই।

অধিকাংশ প্রচলিত ধর্ম— সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষকে ভুল পথে চালিত করে আসছে। মানুষ তার প্রকৃত ধর্ম— মানবধর্ম ভুলে গিয়ে— বংশানুক্রমে এই ধর্মেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাকে তার মূল ধর্ম— আত্ম- বিকাশমূলক ধর্মে ফিরিয়ে আনতে, তাকে সচেতন করে তুলতে— মহাধর্মকে আজ আমাদের বিশেষ প্রয়োজন।

আজ চারিদিকে যে ভীষন অসুস্থতা— অরাজকতা, বিকার-বিকৃতি, যে তমসাচ্ছন্ন ঘোর সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা’ অনেকাংশেই এই সব ধর্মের গর্ভে সৃষ্ট। ধর্ম নিজেই যদি অজ্ঞান-অন্ধ —দুষিত —অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত হয়, তার গর্ভজাত সন্তান ভাল হয় কী করে! দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষকে নিয়ে আহ্লাদিত হলে হবেনা!

সারাবিশ্বে যত গন্ডগোল— যত সমস্যা— সঙ্কট, তার অধিকাংশের জন্যই দায়ী হলো— অন্ধ-বিশ্বাস। যে ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে আমার সম্যক জ্ঞান নেই, স্পষ্ট ধারণা নেই, সেই ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণাকে ‘সত্য’ বলে— নিশ্চিতভাবে মনে স্থান দেওয়াই হলো— বিশ্বাস বা অন্ধ-বিশ্বাস। এযে কত বিপদজনক —কী মারাত্মক, তা’ একটু সজাগ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালেই বোঝা যাবে। বোঝা না গেলে, —সে-ও হবে ঐ অন্ধ-বিশ্বাসের কারণেই। জ্ঞানী মানুষ মাত্রই তাদের ধারণা—বিশ্বাস—জ্ঞানকে আপাতসত্য বলে মনে ক’রে থাকেন। আর, একজন অন্ধ-বিশ্বাসী তার বিশ্বাসকেই পরম সত্য বলে মনে করে।

পুরস্কারের লোভ আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে পশুকে এবং পশুতুল্য নিম্নচেতন-স্তরের মানুষকে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। একটু জ্ঞান-চক্ষু ফুটলে— সচেতন মনের একটু বিকাশ ঘটলেই— সে মানুষ তখন আর ওসবের দ্বারা কারো নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। তাই, অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মও চায়না মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটুক। স্বর্গলাভ—পূণ্যলাভ প্রভৃতি পুরস্কারের লোভ আর নরকাদি শাস্তির ভয় দেখিয়ে, অলৌকীক কাহিনী আর আজগুবি দার্শনিক তত্ত্বে ভুলিয়ে— মানুষকে অজ্ঞান-অচেতন করে রাখতেই সে বেশি আগ্রহী।

আজকের এই করুণ পরিস্থিতিতে মানবজাতিকে রক্ষা করতে, চাই— প্রকৃত ‘মানবধর্ম’। যে ধর্ম মানুষকে মিথ্যার পিছনে না ছুটিয়ে— ছোটাবে ‘পূর্ণ বিকশিত মানুষ’ হয়ে ওঠার লক্ষ্যে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে সে-ও একটু একটু করে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে! এখন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে আমাদের নিজেরদের স্বার্থেই।

আরো জানতে, আমাদের পত্রিকা পড়ুন। গুগল বা ফেসবুকে গিয়ে— ‘মহাধর্ম’ (MahaDharma) সার্চ করলেই তার দেখা পাওয়া যাবে। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

ওয়েবসাইট দেখুনঃ www.mahadharma.wix.com/bangla


Featured Posts
Recent Posts
Archive
Search By Tags
No tags yet.
Follow Us
  • Facebook Basic Square
  • Twitter Basic Square
  • Google+ Basic Square
bottom of page