top of page

মহর্ষি মহামানস

সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য : একজন বিকাশযোগী ভক্তের কলমে (১৯৯২-বৈশাখ)

[অসাধারণ শক্তি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন— বহু জ্ঞান ও বহু গুণের অধিকারী, পরম প্রেমময় মহর্ষি মহামানস-এর জীবনকথা— আমার এই ক্ষুদ্র লেখনীতে কতটুকু প্রকাশ করতে পারব জানি না। আমার ভুল-ত্রুটি সবাই ক্ষমার চোখে দেখবেন, এই আশা নিয়ে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা ক’রে কলম ধরছি। মহামানস সম্পর্কে বেশিরভাগ সমস্ত তথ্য আমি পেয়েছি, তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য— পর্যটক-সন্ন্যাসী মহাযোগানন্দজীর কাছ থেকে। সম্ভবত তিনি এখন গাড়োয়াল হিমালয়ে অবস্থান করছেন। —বিকাশযোগানন্দ]

তাঁর জন্ম বৃত্তান্তটি আমি শুনেছি, মহাবিকাশানন্দজীর নিকট গঙ্গোত্রীতে। এখানে সেটি হুবহু তুলে ধরলাম।

গঙ্গানদীর তীরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের এক সাধারণ জনপদ— যা বর্তমানে গঙ্গাগর্ভে বিলীন। সুভদ্রাদেবী ও গৌরাঙ্গসুন্দর বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন কয়েকবছর হয়ে গেল, তখনও তাঁদের কোনো সন্তানাদি না হওয়ায়, সুভদ্রাদেবী সন্তান লাভের আশায় এক সন্ন্যাসীর পরামর্শ মতো শিবের কাছে মানত করলেন। নিয়মিতভাবে যথাযথ নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত-উপবাস-ধর্ণা, —গর্ভাধান এবং শিবনাম জপ ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে এক বিশেষ মুহূর্তে তিনি গর্ভবতী হলেন।

যত দিন যায়— সুভদ্রাদেবীর রূপ-লাবণ্য ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। চারপাশের মানুষজন বিস্মিত হয়ে যায় তাঁর ঐ রূপের ছটা দেখে। তখন তিনি প্রায় নয় মাসের গর্ভবতী, একদিন এক পর্যটক সন্ন্যাসীর মুখোমুখি হলেন আকস্মিকভাবে। সেই জটাজুটধারী বিশালদেহী সন্ন্যাসী সুভদ্রাদেবীর উদ্দেশে বলেন, তোমার গর্ভে একজন মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে, তিনিই এই যুগের উদ্ধারকর্তা। তিনিই প্রকৃত অধ্যাত্ম পথের দিশারী। শিঘ্রই তোমার কোল আলো করে তিনি অবতীর্ণ হবেন। সন্ন্যাসী এই কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ ক’রে অন্তর্হিত হন।

কিন্তু যে ভাবেউ হোক, এ’কথা চাপা থাকে না। ফলে সুভদ্রা দেবীর গৃহে ক্রমশই কৌতহলী মানুষের সমাগম ঘটতে থাকে। তাঁর গৃহে জনগনের কোলাহলে— একান্তে শান্তিপূর্ণভাবে ধ্যান-জপ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে তাঁর পক্ষে। আস্তে আস্তে ভক্তজন এবং কৌতুহলী মানুষের ভীড় এতই বেড়ে গেল, যে বাধ্য হয়ে গুরুজনেরা কোনো গোপন স্থানে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তাঁদের।

কিছুদিন পরে, এক রাত্রের অন্ধকারে— পূর্ব ব্যবস্থামতো— ছই ঢাকা গরুর গাড়ীতে ক’রে সুভদ্রাদেবী এবং তাঁর স্বামী গৌরাঙ্গসুন্দর নিঃশব্দে রওনা হলেন নিকটবর্তী এক আত্মীয় বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

শেষ রাত্রির দিকে— পথ মধ্যে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বিদ্যুতের আলোয় পথের পাশে— বনের ধারে, এক অতি প্রাচীন জীর্ন— ভগ্নদশাগ্রস্ত শিবমন্দির দেখতে পাওয়া গেলে, অগত্যা নিরুপায় হয়ে সেই নির্জন শিব মন্দিরের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিলেন সবাই। ঝড়-বৃষ্টি বজ্র-বিদ্যুত প্রবল পরাক্রমে মাতিয়ে তুলতে লাগলো চারিপাশের বন-বৃক্ষরাজীকে।

ভোরের দিকে এক অতি শুভক্ষণে মন্দিরের অভ্যন্তর থেকে নবজাত শিশুর ক্রন্দন শোনা গেল। সমস্ত ঝড়-জল-বিদ্যুৎ নিমেষে উধাও। একটু পরেই ভোরের সোনা-রবির কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল পূর্ব দিগন্ত। ক্রমে সমস্ত দিক আলোকময় হয়ে উঠলো। চারিদিক থেকে পাখীদের কলকাকলীতে বনরাজী প্রাণময়— আনন্দময় হয়ে উঠল।

গৌরাঙ্গসুন্দর নবজাত শিশুসহ সুভদ্রাদেবীকে নিয়ে রওনা হলেন নিজ বাটির উদ্দেশে। বাড়ীর সন্নিকটে এসে দেখেন, সেখানে বহু মানুষের সমাবেশ। শোনা গেল, ভোরবেলায় পার্শ্ববর্তী পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে, এক জেলের জালে উঠে এসেছে একটি শ্বেতপাথরের শিবমূর্তি।

গরুর গাড়ী চেপে শিশু শিবকে কোলে নিয়ে সুভদ্রাদেবীকে আসতে দেখে, সমস্ত জনতা সোল্লাসে জয়ধ্বনি ক্রে ওঠে। সমস্ত আকাশ—বাতাস ভ’রে ওঠে এক অনাস্বাদিত আনন্দ মূর্ছনায়।

বেশ কিছুদিন পর, নতুন মন্দির নির্মাণ ক’রে খুব ধূমধাম সমারোহের সাথে সেই শিব মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করা হলো। এবং নবজাত শিশুকে কেন্দ্র ক’রে সেইদিনেই সাড়ম্বরে প্রথাগত ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠিত হলো শিশু মহামানস-এর বাড়ীতে।

অভাবনীয়ভাবে ভিন রাজ্য থেকে আগত বহু সাধু-সন্ন্যাসী-ঋষির আবির্ভাব হয় সেই উৎসবে। তাঁরা বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন, এই দেবশিশুর দর্শন লাভের আশায়। ঐ শিশুর কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে, শিশু মহামানসের সামনে ভূমিতে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে প’ড়ে প্রণাম করলেন অনেকেই। ভোজনান্তে পরিতৃপ্ত সাধুগণ ফিরে গেলেন নিজ নিজ গন্তব্যে।

মহামানস একটু বড় হবার পর থেকেই খেলাধূলার ফাঁকে, মাঝে মাঝেই বাড়ীর নিকটস্থ নতুন শিবমন্দিরে গিয়ে একান্তে ধ্যানে বসে যেতেন। সেই বাল্যকাল থেকেই মহামানসের নিকট অনেকেই বিভিন্ন ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ করতে যেতেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর শরনাপন্ন হয়ে, বহু দুরারোগ্য রোগী— নির্মল আরোগ্যলাভ ক’রে, ক্রমে তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠে। ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো উপদেশ চাইতে গেলেই, তিনি ধর্মীয় উন্মাদনা, অজ্ঞান-অন্ধত্ব, কুসংস্কার, অন্ধ-বিশ্বাস, হিংসা-বিদ্বেষ, ধর্ম-ব্যবসা, এবং পুরহিততন্ত্রের ভন্ডামী ও অনাচার-অত্যাচার প্রভৃতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠতেন।

তিনি বলেন, “সে-ই হলো প্রকৃত মানবধর্ম, যা মানবমনের বিকাশ ঘটাতে সরাসরি সাহায্য করে। ধর্ম পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো— আত্মবিকাশ লাভ।”

ঈশ্বর লাভের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে একশ্রেণীর দুষ্ট লোকের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যা কিছু বলা হয় এবং করা হয়, তা’ আর যা-ই হোক, মানব বিকাশমূলক ধর্ম— মানবধর্ম মনে করেন না তিনি।

একবার, অত্যন্ত দুর্ভাগা— দুর্দশাগ্রস্ত, অর্থ-সম্পদবিহীন এক ব্যক্তি তাঁর শরণাগত হলে, তিনি সেই ব্যক্তিকে সেই দিন থেকেই ‘মহাধর্ম’ পালন এবং ‘মহামনন’ অর্থাৎ ‘মহা-আত্মবিকাশ-যোগ’ অনুশীলন করতে নির্দেশ দেন।

প্রতিদিন যথাবিহিত ধ্যান-জপ ও ‘মহামনন’ অনুশীলনসহ প্রতি বৃহষ্পতিবার সেই ব্যক্তি তার গৃহে ‘মহাধর্ম’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তার প্রচারে এবং বাস্তবিক সুফল লাভের কারণে ক্রমশই তার ‘মহাধর্মানুষ্ঠান’-এ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে ছয় মাসের মধ্যেই সেই ব্যক্তির প্রভূত উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। ক্রমশ সবদিক থেকেই সে সৌভাগ্যশালী হয়ে ওঠে। শুধু বাইরের বিকাশ-ই নয়, তার অন্তরের বিকাশও ঘটতে থাকে অকল্পনীয়ভাবে।

মহামানস বলেন, “আমি একাই শুধু ‘মহামানস’ হব কেন, তোমরা সবাই মহামানস হয়ে ওঠো।”

অল্প বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ ক’রে, বহু জনপদ— বহু তীর্থ ঘুরে, সারা ভারত ভ্রমণ ক’রে, পরে হিমালয়ে গিয়ে অবস্থান করেন। অধিকাংশ সময় তিনি হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন সময়ে— বিশেষ কয়েকজনকে দীক্ষা দেন। বর্তমানে তাঁদেরই কয়েকজনের প্রচেষ্টায় ‘মহামানস মন্ডল’ এবং ‘মহাধর্ম সংসদ’ গড়ে উঠেছে। সমস্ত জগতবাসীকে মহামানসের ধর্ম— ‘মহাধর্ম’ এবং তাঁর উপদেশ— বাণী, শিক্ষা এবং তাঁর যুক্তিস্মমত অধ্যাত্ম-দর্শনসহ আত্মবিকাশ লাভের প্রকৃত ও সহজ উপায় জানানোর উদ্দেশ্যে আমরা প্রয়াসী হয়েছি। আসুন, আমরা সবাই মিলে মহামানসের দিব্য আলোকে আলোকীত হয়ে উঠি। জয় সদগুরু— মহর্ষি মহামানস।

 

পুর্বোক্ত এই অংশটি মহাবিকাশানন্দজীর নিকট হতে প্রাপ্ত। এরপর থেকে আমার লেখা পড়ুন।

                                                                                                          —বিকাশযোগানন্দ

ইংরাজী ১৯৫৩-র ১লা ফেব্রুয়ারী, মাঘ মাসে, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গানদীর অববাহিকায় এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে মহর্ষি মহামানস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে নবদ্বীপে মামার বাড়ীতে (নিজের মামা নয়, সম্পর্কে মামা)। আর, যৌবন— ‘পূর্ণ চেতনার পথে কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে অবিরাম চলা—।’ সে চলা আজও নেই থেমে।

খুব ছোট থেকেই তাঁর মধ্যে বহুমুখী শিল্প প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ দেখে সবাই মুগ্ধ। মাটির প্রতিমা গড়া, ছবি আঁকা, গান, আবৃত্তি, ছোট ছোট গল্প ও কবিতা লেখা, প্রবন্ধ লেখা—, এসব ছিল তাঁর অনায়াস সাধ্য। তাঁর পরিবারে কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কোন পরিবেশ ছিল না। খুবই সাধারণ ব্যবসায়ী হিন্দু পরিবার। পারিবারিক সাহায্য ও উৎসাহের পরিবর্তে শিল্পচর্চায় নানা বাধা-বিঘ্ন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনাই ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী।

শুনেছি, মহাদেব শিবের কাছে মানত করে, ধর্ণা দিয়ে— অনেক জপ-তপ, পূজা-অর্চনা করার ফলে নাকি তাঁর জন্ম হয়। ছোটবেলায় অত্যন্ত দুরন্ত দামাল ছিলেন তিনি। সারাদিন নাকি পাড়া— বাড়ী মাথায় করে রাখতেন।

নবদ্বীপের বৈচিত্রময় প্রেক্ষাপটে শৈশব ও কৈশোরের কিছুকাল কেটেছে— বিচিত্র রস-সুধা পান করে। সেখানে বহু বিচিত্র মানুষের ভীড়, বহু বিচিত্র রঙের খেলা। বারো মাসে তেরো পার্বণ। আজ ঝুলন, কাল সংকীর্তন, পরশু দোল, তো তরশু রাস। নিত্য নব অনুষ্ঠান লেগেই আছে সেখানে।

আগ্রহ ও বিস্ময়ের সঙ্গে প্রাণভরে সেই মিশ্র রস-সুধা পান করে যেন ঘোর লেগে যেত। জগতের রহস্যময়তার অকূল পাথারে ডুবে যেতেন তিনি। কিন্তু আর পাঁচটা ছেলের মতো— শুধু ডোবাই হতো না, কি যেন অনুসন্ধান করে ফিরতেন, সেই ছোট্ট মানুষটি। অল্প বয়সেই জগৎ সংসার সম্পর্কে তাঁর অদম্য জ্ঞান-অন্বেষণের তীব্র আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

স্কুলের বই একবারের বেশী পড়তে তাঁর ভাল লাগত না। আর, অপ্রয়োজনীয় বিষয় মুখস্থ করে মনে রাখার মধ্যে কোন আনন্দ পেতেন না তিনি। এই কারণে স্কুলের উপর তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিষয়-বস্তুর সার উপলব্ধি করে ফেলতেন। অল্পতেই ভোগ শেষ হয়ে যেত তাঁর। চলে যেতেন বিষয়ান্তরে।

নবদ্বীপে মামার বাড়ীতে থাকার পিছনে ঘটনা হলো— তাঁর মামা ছিলেন সেই অঞ্চলের নামকরা একজন বৈষ্ণব পন্ডিত। তিনি তখন নিঃসন্তান ছিলেন। আর, নিজের বাড়ীতে— মহামানসের দৌরাত্মি এবং পড়াশুনায় অমনোযোগীতার কারণে, এবং মামার একান্ত ইচ্ছাতে, শিশু মহামানস মামার বাড়ীতেই সযত্নে পালিত হয়েছেন। মহামানসের মামা ছিলেন একজন বেদজ্ঞ পন্ডিত। অনেক সম্মানীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে ভারতীয় দর্শন, সনাতন ধর্ম, বেদ-বেদান্ত, বেদাঙ্গ সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা গড়ে ওঠে সেই শৈশবেই।

চতুর্থ শ্রেণীতে ষান্মাসিক পরীক্ষায় খুব খারাপ রেজাল্ট হওয়ায়, প্রধান শিক্ষক তাঁর মামার কাছে অভিযোগ করেন, ‘পড়াশুনায় ওর একেবারেই মনোযোগ নেই, মাথায় শুধু নানান চিন্তা। তবে ব্রেন খুব ভাল, ইচ্ছা করলেই ভাল রেজাল্ট করতে পারে।’ এবার তাঁর ডাক পড়ল, কথা দিতে হলো— মামার সম্মান রক্ষার্থে তাঁকে ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। যা কথা— তা’ই কাজ। অল্প সময়ের পড়াশুনাতেই— তিনি ঐ স্কুলের প্রথম স্থান অধিকার করলেন।

ইতিমধ্যে তাঁর মামার একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। মহামানসকে তাঁর বাবা আর মামার বাড়ীতে রাখতে চাইলেন না। বাধ্য হয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হলো গ্রামের বাড়ীতে। যদিও তিনি খুব বেশীকাল বাড়ীতে থাকেন নি। অল্প বয়স থেকেই তিনি বাড়ী ছাড়া।

দর্শনের বীজ তাঁর সেই দশবছর বয়সের আগে থেকেই অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল। নিজের পরিবার, চারিপাশের আরো সংসার লক্ষ্য করতেন, আর ভাবতেন— ‘সবাই যেন একটা নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে, কলুর বলদের মতো ঘুরে চলেছে— সকাল থেকে রাত অবধি। দিনের পর দিন— সুখের মোহে। সুখ যেটুকু জোটে— তার থেকে অসুখই বেশী। তবুও—।’

‘পৃথিবীর বুকে কতকাল ধরে যে এমনিভাবে চলছে, আর কতকাল যে চলবে, কে জানে! বিদগ্ধজনেরা বলেন, এসেছি ল্যাঙটা— যাব ল্যাঙটা, পাপ—পুণ্য, শাস্তি—পুরস্কার, হাসি—কান্না, উত্থান—পতন, সৃষ্টি—ধ্বংস, —পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে এই নাকি ঈশ্বরের লীলা। —ব্যস?! —এর কোন উদ্দেশ্য নেই, কোন লক্ষ্য নেই?! অনন্তকাল ধরে এইভাবে চলবে?! —তাই কখনো হয়! অসম্ভব!’ মহামানস সেই ছোটবেলা থেকেই, এই জীবন-চলার অর্থ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত নিদারুণ অস্বস্তিতে কাটিয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে।

আমাদের সদগুরু মহামানস ছোটবেলায় ধর্মীয় বাতাবরণে মানুষ হয়েছেন। ঠাকুরের জন্যে ফুল তোলা, মালা গাঁথা, পূজো করা, পাঁচালী পড়া— এ’সব ছিল তাঁর ছোটবেলার নিত্যকর্ম। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর যুক্তিবাদী মন— প্রচলিত ধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাঁর সত্যানুসন্ধিৎসু মন খুঁজতে থাকে— ধর্ম, ঈশ্বর ও জীবনের স্বরূপ। প্রকৃত কারণ ও উদ্দেশ্য।

ধর্মের প্রতি তাঁর এই পরিবর্তিত মনোভাবের জন্যে, তাঁকে তাঁর যৌথ পরিবারের তৎকালীন পরিমন্ডলে অনেক অশান্তি লাঞ্ছনা— গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। সাধারণ পরিবারের অতি সাধারণ এবং নিম্ন চেতনার মানুষের ভীড়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠতেন। তাঁকে বোঝার মতো, তাঁর কথা বোঝার মতো কেউ ছিলনা সেখানে। বাইরে বেরিয়েও দেখতেন, আশেপাশের গ্রাম-শহরে তাঁর কথা বোঝার মতো, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো মানুষ অমিল। ‘ এ কোথায় এসে পড়েছি! —নাকি সব ঠিকঠাকই চলছে, —সে-ই ঠিক নেই!’ যেন অন্য গ্রহ থেকে পথ ভুলে এসে পড়া এক আজব মানুষ সে! —এই রকম মনে হয়েছে, তাঁর অনেকবারই। শুধু একজন প্রাজ্ঞ প্রৌঢ় ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি হলে অনেকটাই ভবিষ্যতের মানুষ। অগ্রিম চলে এসেছ এখানে।’

সৃষ্টি রহস্যের অনন্ত জিজ্ঞাসায় মগ্ন হলেও, তাঁর চলা থেমে থাকেনি এক মুহুর্তও। তাঁর কথায়, ‘কে যেন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে মারছে আমায়।’ প্রচলিত একটি কথা আছে— ‘ঘুঁটি সব ঘর ঘুরে না এলে, পাকা হবে কি করে।’ বাস্তবিকই তাই দেখতে পাই মহামানসের জীবনে। এ যেন এক সন্ধি জীবন। সাধারণ জীবন আর দিব্য জীবনের মিলন।

একে একে সমস্ত ভোগ শেষ করে, এপারের সব পাট চুকিয়ে— পরপারের উদ্দেশ্যে খেয়া তরীতে পা বাড়ানো— একই জীবনে।

গুরুজীর প্রথম জীবন যেন কবি নজরুলের— ‘বিদ্রোহী’। কবি সুকান্তের মতো পৃথিবী তাঁকেও অবাক করেছে। —চারিদিকে অন্যায়, অত্যাচার, দারিদ্র, নিপীড়ন—অত্যাচার, হাহাকার দেখে ঠিক থাকতে পারতেন না তিনি। ঝাঁপিয়ে পড়তেন অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণের বিরুদ্ধে। পারেননি এই দুর্বিসহ যন্ত্রনাময় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে— দেখতে পেলেন, এখানে অন্যায় অত্যাচার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অজ্ঞানতা অচেতনতা নীচতার জমাটবাঁধা ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে চতুর্দিক। যত এগিয়ে যান, ততই চোখ খুলতে থাকে, ভরতে থাকে জ্ঞান-অভিজ্ঞতার ঝুলি।

যেন তিনি কোন গ্রহান্তরের মানুষ! যেন এখানে সব ঠিক ঠিক চলছে, তিনিই শুধু ব্যতীক্রম!। এ লড়াই তবে কার বিরুদ্ধে— কিসের লড়াই! —চেতনা? সে তো চাইলেই পাওয়া যাবে না, দেওয়াও যাবে না কাউকে। তাহলে সে কী করতে পারে— কী তার কর্তব্য?

এইভাবে ক্রমে ক্রমে আরো কিছুদূর অগ্রসর হতেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে— আমি কে? —আমি কেন? কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব—? অজস্র আত্ম-জিজ্ঞাসার তীরে বিদ্ধ হয়ে অব্যক্ত যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি। জীবন চলার উদ্দেশ্য সন্ধানেই শুরু হয়ে যায় তাঁর জীবন চলা। সত্যানুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনষ্ক সেই যুবক স্বভাবতঃই তন্ন তন্ন করে চষে ফেলে, অবশেষে পৌঁছে যান তাঁর অন্তর জগতে। যেখানে আছে সব প্রশ্নের উত্তর, সব সমস্যার সমাধান। গভীর আত্ম-ধ্যান, তীব্র ঐকান্তিক জ্ঞান-তৃষ্ণা, একাগ্র মনোনিবেশের ফলে খুলে যায় অন্তর্জগতের রুদ্ধ দুয়ার। এইভাবেই একসময় মিলে যায় আলোর ঠিকানা।

তাঁর চলাকে আরো গতিময় ও সফল করে তুলতে, তাঁকে দ্রুত পরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে, আধ্যাত্মিক সৌভাগ্যের সাথে দারিদ্র তথা দুর্ভাগ্যের দান অনস্বীকার্য। তাঁকে মহান করে তুলতে— দারিদ্রসহ যাবতীয় জাগতিক প্রতিকূলতাই সব চাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

এ সম্পর্কে তাঁর নিজের কথায়, “যখন নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছি, মাথার ঠিক নেই, একমাত্র তখনই —ঈশ্বর —ভাগ্য —দারিদ্র্যকে করেছি ভর্তসনা।”

বিচিত্র ঘটনা, বিচিত্র পথ ধরে— নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, মহামানস পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছেন— সিদ্ধার্থের মতো মহাবোধি লাভের লক্ষ্যে। ক্রমশ তিনি উপলব্ধি করেছেন, বিশ্বসত্তার অংশানুক্রমে তিনিও চলেছেন ছুটে সেই আদি প্রশ্ন নিয়ে। তিনি একা নন, সবাই। কেউ জ্ঞাতে— কেউ অজ্ঞাতে। কেউ এগিয়ে— আর কেউ পিছিয়ে। এক পথ— এক লক্ষ্য। এ তাঁর আত্মার মাঝে পরমাত্মার দর্শন। বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুলাভ।

মহামানসকে নিয়ে লেখা দুঃসাধ্য কর্ম। তবু প্রয়োজনের তাগিদে কলম ধরতে হয়েছে। এত অল্প পরিসরে অনেক কিছুই বলা সম্ভব নয়। বিশেষতঃ যাঁর একই অঙ্গে শত রূপ। তাঁর কোন রূপের বর্ণনা দেব!

গুরুজী নতুন—পুরাতন, দেশি-বিদেশি— সব নিয়ে অন্ততঃ দশটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি জানেন। বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন— যোগনিদ্রা, ধ্যান ও আধ্যাত্মিক চিকিৎসা, এবং হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে তিনি বহু আর্তজনের রোগ-যন্ত্রনা লাঘব করেছেন। নতুন জীবন দান করেছেন বহু মানসিক ও উন্মাদ এবং দুরারোগ্য রোগীর। তাঁর নিজের আবিষ্কৃত নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি— ‘মহাপ্যাথি’ বা সংক্ষেপে ‘এমপ্যাথি’ চিকিৎসা জগতে এক উল্লেখযোগ্য নব সংযোজন।

তাঁর অল্প বয়সে প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘জীবন চলার পিছনে যেমন শরীর ও মনের ক্ষুধাগুলি অংশত দায়ী, তেমনি রোগ-ব্যাধিও জীবনকে গতিময় করে তুলতে এবং চেতনা বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই রোগ-ব্যাধি কখন আসবে— কিভাবে আসবে, আর কখন সারবে— কিভাবে সারবে, সবই পূর্বনির্ধারিত। যখন যেখানে— যার হাতে, যেভাবে সারার (সুস্থ হবার) ঠিক সেভাবেই সারবে। তা৬র স্বচ্ছ দৃষ্টিতে— “চারিদিকে যাকিছু ঘটছে, সবকিছু পূর্বনির্ধারিতভাবে ঠিক ঠিক ঘটে চলেছে। যখন যেখানে যেমনটি ঘটার— কাঁটায় কাঁটায় ঘটে চলেছে।”

“কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই— ফাঁকি নেই। সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চলেছে এক নিখঁত সুসংবদ্ধ নিয়মে— সুশৃঙ্খলভাবে। প্রকৃতির অংশানুক্রমে সে নিজেও তা’ই। এখানে যা কিছু ঘটছে, তা’ ঘটার— তা’ই ঘটছে। প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু নয়। প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতির ঘটনাবলীকে আমরা যত বেশী উপলব্ধি করতে পারব, পরম সত্য আমাদের কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে আসবে। এইভাবেই একসময় লাভ করতে পারব পরম জ্ঞান।”

গুরুজী একসময় বলেছেন, “ছোট থেকেই বহির্জগতের প্রতি আমার ছিল তীব্র আকর্ষণ। ‘দেখব এবার জগতটাকে’ —এমনই ছিল আমার মনোভাব। পাগলের মতো ছুটে ছুটে গেছি বিভিন্ন জাগতিক বিষয়-বস্তুকে কেন্দ্র করে, আঁকড়ে ধরেছি উন্মাদবৎ প্রেমিকের মতো অধীর আগ্রহে। কখনো পেয়েছি সাধ মিটিয়ে, কখনো বা হতাশ হয়েছি। আবার কখনো খেয়েছি গলাধাক্কা। ছলনাময়ীর সাথে ছোঁয়া-ছুঁয়ি —লুকোচুরি, দৌড়ঝাঁপ করে হাঁপিয়ে উঠেছি। কখনো না পাওয়াতে আরো উগ্র হয়েছে কামনা-বাসনা।”

“এমনি করে দিনের পর দিন ধরে চলেছে— চাওয়া-পাওয়ার খেলা। এরই মাঝে সুযোগ পেলেই আত্ম-সমালোচনা। —সত্যিই কি চাই, যোগ্যতা আছে কি নেই, এমনি হাজারো বিচার-বিশ্লেষণ।”

“আস্তে আস্তে জগতের মোহময়ী রূপটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে। ক্রমশ বুঝতে পারি, এই জগৎ সংসারের তীব্র মোহিনী শক্তির দ্বারা কি নিদারুণভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে— এতদিন আমি ক্রীড়নকের মতো ছুটে ছুটে মরেছি। —ইন্দ্রজালের সেই বশীভূত মানুষটির মতো।”

“বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু করার নেই। সমস্ত শরীর-মন যেন অবশ হয়ে গেছে। কিছুতেই এই মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। একটু অসতর্ক হলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। হাবুডুবু খাচ্ছি, মায়ার খেলায়।”

“কোন ব্যক্তিকে যদি ক্রমশ উপর্যুপরি অত্যন্ত গভীরভাবে সম্মোহিত করার চেষ্টা করা হয়, তখন সেই ব্যক্তি গভীর থেকে গভীরতর মোহিত হতে হতে একসময় মোহ উদ্রেককারীর নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। আমার অবস্থাও হয়েছে তেমনি। এতদিন চেতনা ছিল সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন, এখন একটু একটু করে বেরিয়ে আসছি, আসছি নিজের নিয়ন্ত্রণে। বুঝতে পারছি, এই বহির্জাগতিক মোহিনী শক্তিই— এই মোহ-মায়ার খেলাই আজ আমায় এখানে পৌঁছে দিয়েছে।”

আরো একটু এগতেই দৃষ্টি বদলে যায়—

“না—না, এবার আমার ভুল ভেঙেছে। এবার বুঝতে পারছি, আসল রহস্যটা কি, শক্তির প্রকৃত উৎসটা কোথায়। জগৎ —সে তার মতোই আছে, তার কী ক্ষমতা আমাকে মোহগ্রস্ত করে! আসলে মোহ তো আমার মনে। আসল শক্তির উৎস তো আমার অন্তরে। সেখানকার পূর্বনির্দিষ্ট সংস্কার বা ‘প্রি-প্রোগ্রাম’ মতো আমি কাউকে সুন্দর দেখছি— কাউকে অসুন্দর। কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি— কারো প্রতি উদাসীন। নানা বিষয়-বস্তুর প্রতি নানা মনোভাব— সে তো আমার মনের কারণেই।”

“মনের প্রতি আকৃষ্ট হলাম এবার। শুরু হলো ‘মন’ চর্চার পালা। এইভাবে— এই মন পেরিয়ে অন্তরমন, ক্রমশ বিশ্ব-মনের হদিশ মিলেছে এই পথেই।”

“এতদিন যে যমস্ত জাগতিক কর্ম-কান্ড, বিষয়-বস্তু, সুখ-সৌন্দর্যকে আমি পরম কাম্য ভেবে আঁকড়ে ধরতে গেছি—, তখন তারা আমায় গলাধাক্কা দিয়ে বলেছে, ‘ফিরে যাও— ফিরে যাও আপন অন্তরে। যদি আমাদের পেতে চাও, আপন অন্তরে গিয়ে আত্মশক্তিতে শক্তিমান হয়ে ফিরে এসো। আমরা শক্তির দাস— শক্তির পুজারী। ওদের ভাষা তখন আমি বুঝতে পারিনি। আত্মবিস্মৃত ধনী— দীন-হীন ভিখারির মতো দ্বারে দ্বারে হাত পেতেছি, মাথা কূটে মরেছি, —এই অধম তোমাদের দাস বলে, বিলাপ করেছি— করুণা ভিক্ষা চেয়েছি।”

“কিন্তু তা তো হবার নয়। এই মহাজাগতিক ভোগ-সম্ভারের প্রভু হতে, ইচ্ছামতো একে ভোগ করতে চাই অর্থ— পরমার্থ। যা আছে তোমারই অন্তর ভান্ডারে। শুধু ফিরে তাকাবার অপেক্ষায়।”

তাঁর জীবনের প্রথমদিকে আমরা দেখেছি—, মানবজীবনে ক্রমবিকাশের (বহুকাল ব্যাপ্ত) সুদীর্ঘ পর্বগুলি, যা হাজার হাজার বছর ধরে— বহু জীবনব্যাপী একটু একটু করে ধীর গতিতে চলতে থাকে, তা’ তাঁর জীবনে অল্প পরিসরের মধ্যেই তীব্র গতিতে— একের পর এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, বিভিন্ন ছোট ছোট পর্বে ক্রমশ দ্রুত বিকশিত হয়ে চলেছে। যেন একটা রকেট গতির জীবন, যে অল্প সময়ের মধ্যেই বহু পথ অতিক্রম করে থাকে। তাঁর এই দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকেই তাল মেলাতে অক্ষম।

এযেন তাঁর শেষবারের মতো মেলা দেখা। বাড়ী ফেরার আগে খেদ মিটিয়ে ফিরে দেখা। দশ-পনের বছর বয়সেই গুরুজী সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন। তার সঙ্গে গান লেখা এবং সুর করাও চলতে থাকে। এসব খেয়াল যেমন তাঁর নিজের মাথা থেকেই আসে, খেয়াল চরিতার্থও করেন নিজের চেষ্টাতেই। কোন কাজেই তেমন কোন দোসর নেই, নেই কোন সাহায্যকারী বা পরামর্শ দাতা।

বহুমুখী শিল্পী-গবেষক-দার্শনিক মহামানসের আঁকা প্রতিটি ছবিই তাঁর বিভিন্ন সময়কার দার্শনিক চেতনার প্রতীকি ব্যঞ্জনায় বাঙময়। তাঁর অধিকাংশ ছবিই সাধারণ রঙে নিজস্ব ঢঙে আঁকা। ছবি আঁকার এবং মুর্তিগড়ার পাঠ তিনি কারো কাছেই নেননি। অন্যান্য শিল্প এবং অধিকাংশ ব্যাপারেই তাঁর কোন প্রত্যক্ষ গুরু নেই। দূর থেকে দেখে, বই পড়ে— শুনে এবং আপন চেষ্টায় আয়ত্ত করেছেন অনেক কিছু। হাতে ধরে কেউ তাঁকে বিশেষ কিছু শেখান নি।

গুরুদেব বলতেন, “তোমরা সবাই আমার গুরু। তোমরা জানতেও পারছনা, তোমাদের কাছ থেকে কখন কি জেনে নিচ্ছি— শিখে নিচ্ছি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষাগ্রহন করে চলেছি তোমাদের কাছে, —পৃথিবীর এই মুক্ত পাঠশালায়।”

আমাদের শিক্ষার প্রথমার্ধের পরে গুরুদেব আমাদের বলতেন, “জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ সাঙ্গ করে এবার তোদের হৃদিরত্নাকরের গভীরে ডুবতে হবে। আর তার জন্য চাই— ভাব, ভালবাসা, সংবেদনশীলতা। যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞানের মোড়কে ঢেকে রেখেছিস যে আবেগ, অনুভূতি, অভিভব, প্রত্যাশা ও সংবেদনশীলতা— সেগুলোকে মোড়ক থেকে বের করতে হবে এবার। তা’ না হলে, অন্তরের গভীরে ডোবা যাবে না। যতই চেষ্টা করিস না কেন, গ্যাস ভর্তি পিপের মতো ভেসে উঠবি। আর না ডুবতে পারলে— পরম সম্পদ লাভ হবে কি করে!”

“অর্জিত জ্ঞান-বুদ্ধি-শক্তির মিথ্যা অহঙ্কার থেকে মুক্ত হতে হবে। আর এটা করতে হবে সচেতনভাবেই। বুদ্ধির দৌড় জানা হয়ে গেছে, মাথানত হয়ে গেছে আপনা থেকেই, এখন যুক্তি চাইনা, আন্দাজ— ধারণা— কল্পনাভিত্তিক জ্ঞান চাইনা, চাই প্রকৃত জ্ঞান। তার জন্য ডুবতে হবে— অন্তরের চৈতন্য সাগরের গভীরে ডুবতে হবে এখন। পরম শক্তির অধিকারী হতে— চাই পরম জ্ঞান। —যা আছে যুক্তি-বুদ্ধির অন্তরালে অন্তরের গভীর চেতন কেন্দ্রে।

গুরুদেব বলতেন, “যে (চেতন) স্তরের যা কর্ম তা করতে দেওয়াই ঠিক। নইলে চলা ব্যাহত হয়, পৌঁছাতে বিলম্ব হয়ে যায়। শুধু, এগিয়ে চলা যাতে দ্রুততর হয় সে ব্যাপারে চেষ্টা করা যেতে পারে। যে ক্লাস ফাইভ-এ পড়ে, তাকে উচ্চশ্রেণীর পাঠ ও আচরণ অনুসরণ করতে বললে, হবে না।”

একসময় তাঁর সাধারণ ভক্তদের প্রতি তাঁকে বলতে শুনেছি, “বিশেষ বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা ছাড়া সাধারণভাবে ভিক্ষা দেওয়া বা দান করা অনুচিত। বিনামূল্যে— বিনা প্রতিদানে সেবা—, এসব হলো শোষণকারী রাজতন্ত্র এবং তার পৃষ্ঠপোষক প্রচলিত ধর্মের অবদান। পাইয়ে দেবার রাজনীতি। সেবা ও ধর্মের নামে দান বা ভিক্ষার মধ্য দিয়ে তোমাদেরকে দিনকে দিন আরও দীন-দরিদ্র-দুর্বল, অসহায় মেরুদন্ডহীন ভিখারীতে পরিণত করে তোলা হচ্ছে। এসবই ভিখারী মানসিকতা গড়ে তোলার এক সুন্দর ষড়যন্ত্র।

এতে মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার —বিকশিত হওয়ার, আত্মনির্ভর হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহ করার শক্তিটুকু আর অবশিষ্ট নেই। উল্টে অত্যাচারিত— নিপীড়িত হয়েও উৎপীড়নকারী শোষক শ্রেণীর পা চাটার স্বভাব হয়ে যাচ্ছে। তাদের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে মানুষ। কখন দুটো দেবে, সেই আশায় ক্ষুধার্ত প্রভুভক্ত জীবের মতো কুঁই কুঁই করছে সব, মাথা তোলার ক্ষমতা নেই।

হ্যাঁ, যদি প্রকৃতই মানব সেবায় ইচ্ছুক হও, তাহলে এমন কিছু করো, যাতে মানুষ সজ্ঞান-সচেতন-স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারো। যদি এতবড় কিছু করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে যে সংস্থা এই ধরণের কাজ করছে, তাদের সাহায্যার্থে দান করো। সেটাই হবে প্রকৃত মানব সেবা।”

অন্যত্র জ্ঞান ও বিকাশযোগের উচ্চস্তরের ভক্ত-শিষ্যদের প্রতি তাঁকে বলতে শুনেছি, “আর জ্ঞান— জ্ঞান করিস না, এবার অন্তরের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তোল, ডুবতে হলে— ‘ভাব’ চাই—। সাহায্যের হাত এগিয়ে দিতে হবে—।” অবশ্য এর সাথে প্রচলিত সেবা বা ভিক্ষার পার্থক্য আছে।

একজন উচ্চ জ্ঞান ও চৈতন্য সম্পন্ন ব্যক্তি ভাবোন্মাদ হয়ে— ভিক্ষান্ন গ্রহনের মধ্য দিয়ে, তাঁর সমস্ত জ্ঞান-গর্ব, অহঙ্কার বিনাশ করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে— একজন অসহায় দীন-দরিদ্র ব্যক্তির ক্ষুধার তাড়নায় অথবা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভিক্ষান্ন গ্রহণ একই পর্যায়ে পড়ে না।

অজ্ঞান-অন্ধ-ভক্তি আর সজ্ঞান-প্রকৃত-ভক্তি সম্পর্কেও তিনি আমাদের অনুরূপ উদাহরণ দিয়ে বলতেন, “একজন উচ্চচেতনা লাভ করে, নিজেকে তথা ঈশ্বরকে সম্যক জেনে, বুঝে—উপলব্ধি করে, ঈশ্বর-প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে— বিরহী পাগল-প্রেমিকের মতো দু-বাহু ঊর্ধে তুলে— ‘হা ঈশ্বর’ বলে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছেন—। আর তা’ই দেখে, তাঁর প্রেমোন্মাদনায় সংক্রামিত হয়ে— আর পাঁচজন স্বল্পচেতন— প্রায় অজ্ঞান ব্যক্তি তাঁকে অনুসরণ করে অন্ধ-ভাবাবেগে— ‘হা ঈশ্বর’ বলে, ধরাতলে লুটোপুটি খাচ্ছে। উভয়ের দশা বাহ্যত এক মনে হলেও, প্রকৃত অবস্থা এবং প্রাপ্তি কি এক হবে?”

“চেতন পথে— বিকাশপথে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। লাফ দিয়ে— ডিঙিয়ে যাওয়া চলবেনা এখানে। পায়ে পায়ে সমস্ত পথটুকু পার হয়ে আসতে হবে, —পৌঁছুতে হবে পরম লক্ষ্যে। পরম ভক্তিযোগ বা প্রকৃত ভক্তিযোগে আসতে চাইলে, প্রকৃত জ্ঞানযোগ— আত্মবিকাশযোগের ক্রমোচ্চ পথটা পার হয়ে আসতে হবে আগে।”

ঈশ্বরের পূজা-অর্চনার ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। ঈশ্বর পুজা সম্পর্কে তিনি তাঁর অল্পবয়সের প্রথম কাব্যগ্রন্থে বলেছেন, “আমি ঈশ্বর পূজা করিনা, পূজার প্রয়োজন বোধ করিনা তাই—। আমি জানি, ঈশ্বরের সাথে আমাদের প্রভু-দাস সম্পর্ক নয়। পাপ-পূণ্য-পূজা এসবই স্বল্প-চেতন মানুষের জন্য। চেতনার যথেষ্ট বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত— দুর্বল মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং মনের ঋণাত্মক ভাব দূর করতে এ’সবের প্রয়োজন আছে। —একসময় আমারও ছিলো, এখন আর নেই। ভোগ শেষে জ্ঞান যোগ হলে, তখন আপনা থেকেই কর্ম ত্যাগ আসে।”

অন্যত্র তিনি আমাদের বলেছেন, “তবে স্বল্প-চেতন মানুষের মতই, ঈশ্বরেরও যখন চেতনা কম ছিলো, —সে-ও অত্যন্ত মোহগ্রস্ত ছিলো তখন। তখন তারও পূজা পাবার বাসনা ছিলো মনে। কিন্তু এখন সে চেতনার পথে অনেক এগিয়ে গেছে, অনেক উচ্চ চেতন স্তরে পৌঁছে গেছে সে আজ। এখ আর তার ওসব কামনা-বাসনা নেই।”

আবার আরেক জায়গায় বলেছেন, “ঈশ্বর ও আমরা অভিন্ন নই। পাপ-পূণ্য, শাস্তি-পুরস্কার— ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া, এ’সবই নিজেদের ব্যাপার, অন্য কারো হাত নেই এতে। ঈশ্বরের কৃপালাভ— সম্ভব সে নয়, পূজাদির প্রয়োজন নেই, ঈশ্বর হতে বিপদের ভয় নেই কোনো। মুক্তি দেবার অধিকার— বিন্দুমাত্র নেই তার জেনো।”

—এই কথাগুলি তাঁর অল্পবয়সের লেখা হলেও, তাঁর এ’সমস্ত কথা উপলব্ধি করতে হলে, জানতে হবে তাঁর সৃষ্টিতত্ত্ব সহ সমগ্র দর্শন, এবং তাঁর অতুলনীয় শিক্ষাক্রম— ‘মহা-আত্ম-বিকাশ-যোগ’ সংক্ষেপে ‘মহামনন’।

তাঁর ‘মহাবাদ’ গ্রন্থের সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে না প’ড়ে আংশিকভাবে পড়লে, অনেক ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। জ্ঞান ও চেতনার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে— দর্শনের সুক্ষ্ম পার্থক্যগুলি বিশেষ লক্ষ্যনীয়।

অস্পৃশ্যতা সম্পর্কে একসময় তিনি আমাদের বলেছেন, “প্রাচীনকালের ঋষি-বিজ্ঞানীগণ জীবাণু সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁদের রচিত স্বাস্থ্য অনেকে মেনে নিলেও, তমঃগুণাত্মক বন্য ইতর শ্রেণীর রাক্ষস (যাঁরা কাঁচা মাংস খেতো, পেলে নরমাংসও খেতো) এবং অসভ্য আদিম মানুষরা অনেকেই তা’ মেনে নেয়নি। ফলে, তখন তাদের অস্পৃশ্য ব’লে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। তাদের সংস্পর্শ এডিয়ে চলার নির্দেশ ছিলো সভ্য মানুষের প্রতি। কঠিণ দূরারোগ্য রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জাতি-সমাজ যাতে ধ্বংসের মুখে পতিত না হয়, সেই উদ্দেশ্যেই তাঁদের সতর্ক বাণী ছিলো।”

“তারপর কালক্রমে বহুদেশের বহু জাতি, গোষ্টি, সম্প্রদায়ের মধ্যে অনিবার্যভাবে বহু মিশ্রণের ফলে, আজ আমরা এক সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছি। কারো সাথে কারো মিল নেই। বিচিত্র রঙে-রূপে, ভাবে-আচারে, সভ্য জগতের প্রায় প্রতিটি মানুষই এখন আলাদা আলাদা জাতের। এই অবস্থায় আমাদের উগ্র জাতের বড়াই বড়ই বেমানান। —তবুও অজ্ঞান-অন্ধত্বের কারণে জাতপাতের লড়াই চলছে এখনো।”

“এখন, জাত হিসাবে— স্পৃশ্-অস্পৃশ্য বিচার করা অনর্থক। যদি দেখা যায়, সভ্য জাতির তথাকথিত কোনো উচ্চবর্ণের একজন— সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অক্ষম, সেক্ষেত্রে তাকেও স্পর্শের অযোগ্য বলে গণ্য করা উচিত। আবার তথাকথিত নিম্নবর্গের কোনো একজন যদি সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সেক্ষেত্রে সে সাদরে গ্রহণীয়— অবশ্যই স্পর্শযোগ্য।”

আমাদের সমাজের প্রচলিত সংস্কার এবং কুসংস্কারগুলিকে গুরুদেব অত্যন্ত সুন্দরভাবে— তার ভিতরকার রহস্য— প্রকৃত সত্যকে আমাদের কাছে উদ্ঘাটন করেছেন।

তিনি বলতেন, “আঁতুর ঘরের সদ্যজাত শিশুটি অস্পৃশ্য নয়, বরং বাইরের মানুষগুলোই তার কাছে অস্পৃশ্য। সদ্যজাত শিশু— সে নির্মল পবিত্র। তার শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তখনও পৃথিবীর জীবাণুরাশির মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। —এটা খুব ভালভাবেই বুঝতেন তৎকালীন অনেক ঋষি-বিজ্ঞানীগণ। তাঁরা এ-ও জানতেন, সাধারণ মূর্খ মানুষকে ছুঁতে বারণ করলে তারা তা’ শুনবেনা। তাই বাধ্য হয়ে একটু কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ছিলেন তাঁরা। পুরোপুরি ব্যাপারটাকে উল্ট বুঝিয়ে, ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন মানুষকে। ঐ শিশুকে ছুঁলেই সে অশুচি অস্পৃশ্য হবে এবং তাকে স্নান ক’রে শুচি হতে হবে। এই ভয়ে কেউ যাতে সদ্যজাত শিশুটিকে বেশী ঘাঁটাঘাটি না করে, —তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। ঐ শিশুর মাকেও অচ্ছুত করে তোলার পিছনেও রয়েছে ঐ একই কারণ।”

“স্বজনের মৃত্যুতে শোকাহত মানুষকেও অনুরূপভাবে অশুচি— অস্পৃশ্য ক’রে তোলা হয়েছে, যাতে অসংখ্য জীবানুযুক্ত সাধারণ মানুষ তাকে স্পর্শ না করে। শোকাহত মানুষের ‘নার্ভ-সিস্টেম’ সহ সমস্ত শরীরযন্ত্র সাময়ীকভাবে বিবশতা বা আংশিক নিষ্ক্রিয়তা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে, তার শরীরের প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট মাত্রায় কার্যকর থাকে না। এই সময় তার নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে থাকা কর্তব্য। জীবাণু সংক্রমণ এড়িয়ে চলা উচিত যথাসাধ্যভাবে। তা’ না হলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল।”

কিন্তু হায়, আজও অধিকাংশ মানুষ সেই আদিমেই প’ড়ে আছে। তাদের মধ্যে আজও তেমনভাবে সত্যানুসন্ধিৎসুতা জাগেনি, জাগ্রত হয়নি আত্মজিজ্ঞাসা। ভাবতে অবাক লাগে, এই যে আমরা একটা জীবন পেয়েছি, প্রত্যেকেই এক একটা প্রাণবন্ত জীবনের মালিক। অথচ একবারের জন্যেও কি নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন জাগেনা! কেমন ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর! সত্যই অবাক হই, আমার চারিপাশে এই যে লক্ষ লক্ষ জীবন ঘুরছে— ফিরিছে, সুখ-দুঃখের হাসি-খেলায় মেতে আছে, —এদের একবারও কি প্রশ্ন জাগেনা এই জীবন সম্পর্কে?! —হয়তো জাগে, আবার পরমুহূর্তেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে হয়তো।

দুঃখিত, তাঁর কথা বলতে গিয়ে— অন্য কথায় চলে এসেছি। তবে এ’কথা সত্য, তাঁর সংস্পর্শে না এলে আজও এই মেলার ভীড়ে নেশাচ্ছন্নের মতো আত্মবিস্মৃত হয়ে— দিশাহারার মতো ঘোরের মধ্যেই কাটিয়ে দিতাম— না জানি কতদিন। সারাজীবনই হয়তো এভাবেই কেটে যেত।

এখনকার অনেক খেলাধুলাতেও তিনি মধ্যযুগীয় অতি স্থূল আমোদ-প্রমোদের ছাপ দেখতে পেতেন। যেন দুটো মোরগকে মারামারিতে উস্কে দিয়ে, একপাল মানুষ বন্য আদিম উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে নৃত্য করছে। কখনওবা এক এক দল, এক একটা মোরগের পক্ষ নিয়ে নিজেরাই বিধ্বংসী তাণ্ডবলীলায় আত্মহারা!

এসব দেখে প্রথমদিকে তিনি খুব মর্মপীড়া ভোগ করতেন। আক্ষেপের সুরে ওনেক সময় বলেছেন, “খুব ধীর গতিতে সার্বিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। লক্ষ-কোটি বছর পেরিয়ে এসেও মানুষ এইটুকু মাত্র চেতনার অধিকারী!” —আগে এ’নিয়ে অনেক ভাবতেন তিনি।

পরে তিনি এ’কথাও বলেছেন, “তবে, বর্তমানে আমাদের চেতনা যেন চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে উচ্চ চেতন স্তরে পৌঁছাতে খুব বেশী সময় লাগবে না।”

মহামানসের ঘটনাবহুল জীবনে দুর্ঘটনাও কম ঘটেনি। মারাত্মক সব দুর্ঘটনা থেকে তিনি প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছেন। মনেহয়, আধ্যাত্মিক শক্তি বলেই— তিনি বিপদমুক্ত হয়েছেন। যে শক্তি সুপ্ত অবস্থায় আমাদের সবার মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। রয়েছে বিকাশের অপেক্ষায়।

দেবশিশুর মতো— প্রস্ফূটিত কুসুমের মতো ঋষিতুল্য মহাপুরুষ— এই দিব্যকান্তি মানুষটি সর্বদা সরল-স্নিগ্ধ-রসময়। এত ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে, এত দুর্গম পথ পেরিয়ে এসে আজও তিনি হাস্যোজ্বল— প্রাণোচ্ছল— সদানন্দ যোগী।

কখনো তিনি বালকোচিত চঞ্চল— সরল। কখনো গভীর মনোযোগী— ধ্যানস্থ। কখনো ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তায় জাজ্বল্যমান। আবার কখনো দেখি, বোকার মতো সংসারের সাধারণ হিসেবটুকু রাখতেও অপারক। কখনো কখনো স্ফূলিঙ্গের মতো ভীষনাকার অগ্নিমূর্তি। কখনোবা কমলবৎ কোমল— মধুর— প্রেমময়।

একজায়গায় নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমাকে দেখে তোমাদের পছন্দ হবে না। আমার মুখশ্রী এবং চেহারা ঠিক শুকনো নারকোলের মতো। তবে ভিতরটা অত্যন্ত পুষ্টিকর সুস্বাদু নরম শাঁসে ভরা। আর তার সাথে আছে স্নিগ্ধ— সুমিষ্ট পানীয় জল। যার সন্ধান এবং উপযোগিতা সবার জানা নেই...।”

এই শিবকল্প মানুষটির কোনো বন্ধু আমরা কখনো দেখিনি। তাঁর জীবনে বন্ধু ও নারী —এ’দুয়েরই অবিদ্যমানতা চোখে পড়ে। অথচ তিনি তো সন্যাসী নন। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন ঋষি —মহান ঋষি। এই শতাব্দীর একজন আধুনিক ঋষি-বিজ্ঞানী। ঋষিদের জীবনে প্রেম, বিবাহ, সংসার— সন্তান প্রভৃতি সবকিছুই থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। তাঁর শিষ্য—ভক্ত বহু, কিন্তু বন্ধু করার মতো বোধহয় কাউকে পাননি তিনি। সমগোত্রীয় না হলে প্রকৃত বন্ধু হয় না। ভাবের আদান-প্রদানে সামঞ্জস্য না থাকলে, সে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং স্থায়ী হয় না।

তবে সাময়িকভবে শিশুদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব জমে উঠতে দেখেছি। দেখেছি, ওঁর ঘনিষ্ঠ শিশুরা ওঁকে বয়ষ্ক বলে মনেই করে না। তাদের বাবা-মায়ের বারণ সত্বেও তারা গুরুজীকে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে। তাদের সাথে খেলাধুলায় মত্ত হয়ে তিনিও শিশুসম হয়ে যান তখন।

গুরুদেব তাঁর ভাবের এবং ভাবনার জগতে সম্পূর্ণ একা। সেখানে তিনি একলা চলার পথিক। অবশ্য দার্শনিক— বৈজ্ঞানিক— মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে নামমাত্র ব্যবহারিক বন্ধু কিছু থকলেও, প্রকৃত বন্ধুযোগ খুব কমই ঘটতে দেখা যায়। কে তাঁর বন্ধু হব, আর প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে কে-ই বা এমন মানুষকে ভালবাসতে যাবে! আর তাঁর ভালবাসার যোগ্য পাত্রীই বা কোথায় মিলবে! তারপর, যাঁর দিন কাটে শিবের মতো, —ছন্নছাড়া ভবঘুরে জীবন। যাঁর নেই জাগতিক অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য, তাঁর কাছে পার্বতীর মতো কোন রাজার দুলালী এসে তরী ভেড়ালেও, পরে তাঁর দুর্গতির কথা ভেবে— তিনি সে চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছেন হয়তো। আপাতঃ রুক্ষতার আড়ালে ঢেকে রেখেছেন তাঁর প্রেমময় কোমল হৃদয় (এই লেখার অনেক পরে তিনি বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন)।

গুরুদেব বলেন, “তোমরা যাকে দুর্ভাগ্য ভাবছ, দুরবস্থা বলছ, ের জন্যে তো আমিই দায়ী। ‘সত্য’ চেয়েছি, ‘জ্ঞান— চেতনা’ চেয়েছি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ-সমৃদ্ধি এসব তো চাইনি। সত্য আর মিথ্যা, আলো আর আঁধার তো একই সাথে থকতে পারে না। একের উপস্থিতিতে আরেকজনকে বিদায় নিতে হয়। তাছাড়া কিছু পেতে— কিছু মূল্য দিতে হবেই। বিশেষ ক’রে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে— অজস্র দুখঃ-কষ্ট-যন্ত্রণার বিনিময়েও যে চেতনারূপ সোনার ফসল আজও আমাদের ঘরে ওঠেনি, —সেই অমূল্য ধন লাভ করতে— নিজেকে নিঙরে শেষ বিন্দুটুকু নৈবেদ্য দিয়েও যদি তা’ পাওয়া যায়, তা’ও পেতে হবে।”

“না, ভয় পেলে চলবে না। বিমুখ হলেও উপায় নেই। ডাক যখন আসবে— তখন সে ডাকে সাড়া দিতেই হবে তোমাকে। তাতে যায় যাক সব রসাতলে, —কিছু করার নেই। বিমুখ হলে বরং কষ্ট আরো বাড়বে। আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে যন্ত্রনা। তার চাইতে এই ভাল, সত্য-জ্ঞান-চেতনার আগমনের সাথে সাথে এখানকার মায়াবী সুখ-সমৃদ্ধি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও আমি সুখী। আমার চাহিদা মতো প্রাপ্তিতে যে পরম সুখ, সে সুখে আমি অবশ্যই সুখি।”

‘সত্য’-কে চাইতে দেখা যায় বহু মানুষকেই। গালভরা আর পাঁচটা কথার মতো— ‘সত্য চাই’ —একথা বাজারে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য যখন তার স্বরূপে প্রকাশ হতে থাকে, তখন মোহগ্রস্ত মানুষের দৃষ্টি আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে! মোহিত আত্মা আঁতকে উঠে বলে, নানা— এ’ আমি চাই না! স্বপ্ন— মায়া যতই সে মিথ্যা হোক, তা’ মধুর। আমি তা-ই চাই, ঝুটা হি সহি।

কি করেননি তিনি! তাঁর জীবন কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। যেন পৃথিবীর সমস্ত রঙ-রূপ-রস শুঁষে নিয়ে তিনি নিজেকে পুষ্ট ক’রে তুলেছেন, ‘চেতনা’ নাম্নী প্রেমিকের পায়ে সেসব নিবেদন করবেন বলে।

এই জগতের মধ্যে আছে যে অসংখ্য বৈচিত্রময় ছোট-বড় জগত, তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। মিশেছেন বহু শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর স্বাতন্ত্র নিয়ে নয়। যাদের সঙ্গে মিশেছেন, নিকটজনের মতো বা তাদের এওকজন হয়ে, সমব্যাথী হয়ে— তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। দেখেছেন কত আশ্চর্য জগত। আর শুধু মেশার জন্যেই তো মেশা নয়, প্রকৃতি বিজ্ঞানীর মতো জানার জন্যে মেশা। তবে সব পরিবেশেই বেশীদিন স্বাতন্ত্র্য গোপন রাখা সম্ভব হয়নি, ধরা পড়ার পূর্বেই স’রে আসতে হয়েছে সতর্ক হয়ে।

তিনি আত্ম-জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে বহুদিকে ছুটে বেড়িয়েছেন এক সময়। সরাসরি কারো সাছ থেকে উত্তর না পেলেও, তিনি যে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভ করেছেন, —তারই ভিত্তিতে তিনি উত্তর খুঁজে পেয়েছেন নিজের অন্তরের কাছেই।

ঘুরতে ঘুরতে অন্ধকার জগত থেকে আলোর মুখোস পরা তমসাচ্ছন্ন জগত দেখেছেন অনেক। বহু ভণ্ড তপস্বী, বহু বেপথু সন্ন্যাসী, অনেক তথাকথিত অবতারের দেখা পেয়েছেন তিনি। অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধার্মিক-পণ্ডিত, সমাজপতি, বিচারকের সাক্ষাত হয়েছে, কিন্তু কা দেবে তাঁর প্রশ্নের সঠিক উত্তর! অগত্যা চারিদিক থেকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে— ফিরে এসেছেন আপন অন্তরে।

এই প্রসঙ্গে একদিন কৌতুক ক’রে বলেছেন, “এদিকে বালিকাবধু অন্দর-মহলে কবেই অপরূপা যৌবনা হয়ে উঠেছে, সে খেয়াল নেই আমার! আমি কিনা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছি তাঁরই খোঁজে।”

অনেককেই বলতে শুনেছি, ওঁর দর্শনে নাকি যথেষ্ট ভাবের অভাব— রসের অভাব। প্রথম প্রণয়ের সময়— সে মানুষের ক্ষেত্রেই হোক— আর ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই হোক, বেশ এক রহস্যময়তার মায়ায় আবিষ্ট হয়ে, ভাবের ঘোরে অভিভূত হয়ে থাকি আমরা। কেমন গদগদ ভাব। তারপরে যতই ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে, ভাবের ঘোরও কমতে থাকে ততই। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা যাবে।

যাঁরা ঈশ্বর সম্পর্কে ভাবের ঘোরে ডুবে আছেন, আমি বলব, ঈশ্বর থেকে তাঁরা এখনো অনেক দূরে রয়েছেন। প্রথম প্রণয়ের পর্ব অথবা প্রণয় পূর্বের একটু দেখা— একটু কথার পর্ব তাঁরা এখন কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। ক্রমশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠলে, তখন আর এতো ভাব— এতো রস থাকবে না।

তবে রসজ্ঞ যিনি— গভীর রসবোধ আছে যাঁর, সেই পরম রসতত্ত্বে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ নিশ্চয়ই ‘মহাবাদ’-এর মধ্য দিয়ে ‘ততস্বরূপ’ দর্শন করতে পারবেন। ‘মহাবাদ’ বা ‘মহামানসবাদ’ কোনো আকস্মিক আবির্ভাব নয়। সময়ের প্রয়োজনে, এর বীজ গুরুদেবের জন্মের পর থেকেই ক্রমে অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছিল। এর সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই তাঁর অল্পবয়সের প্রথম কাব্যগ্রন্থ— ‘মন-আমি’–র মাধ্যমে।

গুরুদেবের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণার শুরু খুব ছোট বেলা থেকেই। বুদ্ধদেব ও শিবের ধ্যানস্থ মুর্তি তাঁকে ছোট থেকেই খুব আকর্ষণ করত। সময় সুযোগ পেলেই তিনি ধ্যানে বসে যেতেন। ধ্যানের মধ্যে প্রায়ই সৌমকান্তি বুদ্ধমুর্তি, কখনওবা শিবমুর্তি তাঁর সামনে ভেসে উঠত। ক্রমশ সেই মুর্তি তাঁর কাছে এগিয়ে এসে— তাঁর মধ্যে মিলিয়ে যেত।

প্রথমদিকে ধ্যানের কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিলনা। শুধু ডুবে যাওয়া। তাতে খুব রোমাঞ্চ— খুব শান্তি বোধ হোত। একটা নেশার মতো। তিনি বলতেন, “সব চাইতে বড় নেশা— এই ধ্যানের নেশা। আর সব নেশা— সর্বনাশা।” ধ্যানের পরে শরীর-মন আরো বেশি সুস্থ-সতেজ-সক্রিয় মনে হতো তাঁর।

পরবর্তীকালে যখন আস্তে আস্তে বুঝলেন, মানুষ কত অসহায়। যত অর্থবল আর লোকবলই থাকুক, শারীরিক শক্তিতে সে যতই গর্বমত্ত হোক না কেন, জ্ঞানাভাবে— চেতনাভাবে, আত্মিক শক্তির অভাবে সে ভীষন দুর্বল— অসহায়। তারপর থেকে তাঁর লক্ষ্য স্থির হলো— আত্মিক (অন্তর মনের) শক্তিতে বলবান হয়ে উঠতে হবে, যথেষ্ট জ্ঞান ও চেতনা লাভ করতে হবে।

তিনি হিমালয়ের গিরি-গহ্বরে থেকেও ধ্যান-তপস্যা করেছেন। এ’পথেও তাঁর কোন্নো গুরু নেই। গুরুকরণ ও দীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারেও তাঁর জীবনে অদ্ভুত ও আকস্মিক ঘটনা আছে।

বহুকাল আগের কথা, তখন তাঁর অল্প বয়স। হিমালয়ের এক সন্ন্যাসিনী একদিন তাঁকে দেখে, হঠাৎ জেদ ধরলেন, তাঁর কাছে মহামানসকে দীক্ষা নিতে হবে। গুরুজী নারাজ। কারণ, ভাবের অমিল, পথের অমিল, জ্ঞান-চেতনার অমিল। মাতাজীর কাছে পাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। মাতাজীও নাছোড়, —শুরু করলেন অনশন। পণ করেছেন, তাঁকে দীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত জলগ্রহণ করবেন না। মহাবিপদ। অবুঝ ঐ মাতৃসমা মহিলাকে কোনোমতেই বোঝ মানানো গেল না। মাতাজী যেমন তেমন পথের সন্ন্যাসীও নন, তাঁর বড় বড় বিশাল আশ্রম, বহু ধনী শিষ্য-ভক্ত। তবে তাঁর কিসের অভাব! কিসের টানে— কি উদ্দেশ্যে এমন ধনুক ভাঙা পণ, এই বিসদৃশ ব্যবহার।

এইটুকু জানা গেল, গুরুদেব মহামানসের শরীরে বিশেষ একটি উচ্চ আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ দেখে তাঁর এতো আগ্রহ। যাহোক, মাতাজীর শিষ্যগণ এসে আমাদের গুরুজীকে অনেক ধরাধরি করলো— গুরুজীকে রাজী করানোর জন্য নানারূপ চেষ্টা চালাতে লাগলো তারা। তাদের কাছেই জানা গেলো, বহু মানুষ মাতাজীর কাছে দীক্ষা নিতে চাইলেও, তিনি অনেককেই ফিরিয়ে দিয়ে থাকেন। তাহলে—? অবশেষে, অগত্যা বাধ্য হয়ে রাজী হলেন তিনি।

মহা আড়ম্বরে দীক্ষা হলো তাঁর। বহু সাধু-সন্ন্যাসীর সমাবেশে যাগ-যজ্ঞ-ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, তিনি দীক্ষা নিলেন মাতা ব্রহ্মানন্দার নিকট। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ম্যাগনেটিক ফিল্ড— তাঁর বিশেষ কম্পনাঙ্ক থেকে মাতাজী বুঝতে পারলেন, এ’ অন্য ধাতু দিয়ে গড়া— এর স্থান অন্যত্র। তখন তিনি মহামানসকে স্বাধীনভাবে চলার নির্দেশ দিলেন। বললেন, “তোমার এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। যাও— ফিরে গিয়ে তোমার কাজ সম্পূর্ণ করো। তারপর তুমি মানুষের কাছে খুলে দেবে অধ্যাত্ম জগতের দরজা। আমি আশীর্বাদ করছি, তোমার মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে।”

তার কিছুদিন পরেই গুরুজী হিমালয় থেকে নিচে নেমে আসেন। বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডাক্তারি শুরু করলেন, আর সেই সঙ্গে চলতে থাকলো— আত্মান্বেষণ, ধ্যান-যোগ, গবেষণা প্রভৃতি। আত্মোন্নয়নমূলক কাজ।

পরবর্তী সময়ে গুরুজী একজন সদগুরুর নিকট তাঁর স্বধর্মে দীক্ষিত হন। তিনিও হিমালয়ের একজন গুহাবাসী যোগী তপস্বী। দীক্ষাদান কালে গুরুদেবের প্রতি তাঁর বক্তব্য ছিল, “তুমি স্বশিক্ষিত—স্বদীক্ষিত, উচ্চকোটির চেতনা প্রাপ্ত মহামানব। তোমাকে দেবার মতো আমার কাছে বিশেষ কিছু নেই। তুমি যে মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলেছ, তোমাকে সেই মন্ত্রেই দীক্ষা দিলাম। শুধু প্রচলিত ধারণায় প্রত্যেক সাধকের একজন গুরু থাকা আবশ্যক, সেজন্য তোমাকে আমি তোমার প্রকৃত বিকাশযোগেই দীক্ষা দিলাম। তুমি অবশ্যই জয়ী হবে।” গুরুজীর এই গুরুর নাম— স্বামী পরমানন্দ। ‘মহামানস’ নামটি তাঁরই দেওয়া নাম।

এই ভারত ভূমিতে বিভিন্ন সময়ে বহু ঋষি— মনীষি— তপস্বী তাঁদের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন। তবে সবার চাহিদা সমান নয়। গুরুদেবের চাহিদা ছিল, ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে— মুক্ত আবহাওয়ায়, স্বাধীনভাবে প্রকৃত অধ্যাত্ম-জ্ঞান এবং প্রকৃত আত্মবিকাশ লাভ। সেই সঙ্গে মানুষের সমস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনায় সমব্যথী হয়ে তিনি চেয়েছিলেন, মানুষের সার্বিক চেতনার বিকাশ।

মানুষের সার্বিক বিকাশ যে এখন দ্রুতগতিতে ঘটে চলেছে, তা’ আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করছি। মহামানসের মতবাদ— ‘মহাবাদ’-এর মহামন্ত্র উপলব্ধি করার সামর্থ ক্রমশই বাড়ছে আমাদের। এখন শুধু দিকে দিকে— ‘মানব ধর্মই মহাধর্ম’ এই মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

bottom of page