top of page
শান্তির খোঁজে

‘শান্তি— শান্তি’ বলে, মাতামাতি করলেই শান্তি আসবেনা। অশান্তির কারণটাকে বুঝতে হবে ভালোভাবে, এবং সবাইকে তা’ বোঝাতে হবে। তারপর, তার প্রতিকার করতে পারলে, তবেই শান্তি আসবে। যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব, আর শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতাই অশান্তির মূল কারণ।

শান্তির জন্য— ভিতরের ও বাইরের সুস্থতাসহ অন্তর্জগত ও বহির্জগত সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যার নিজের সম্পর্কে এবং বহীর্জগত সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই, সে অজ্ঞানতার কারণে— মায়ার বশবর্তী হয়ে, অশান্তিকেই ডেকে আনবে। যাতে অশান্তি সৃষ্টি হয়— সেইরূপ কাজই সে করবে।

বিশেষ চাহিদা বিহীন অর্থাৎ স্বল্প চাহিদা সম্পন্ন নির্জীব অথবা দাস মনোভাবাপন্ন অল্পকিছু অন্ধ-ভক্ত মানুষ— ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন ক’রে ব্যক্তিগতভাবে শান্তিলাভে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু তার ফলে বা তার প্রভাবে মানব সমাজে শান্তি আসবেনা।

এখানে উল্লেখনীয়, সাধারণতঃ এরা নিজেকে ও ঈশ্বরকে নিজেদের স্বরূপে না জেনেই, এইরূপ ক’রে থাকে। যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভের পর, নিজেকে ও ঈশ্বরকে সম্যকভাবে জানার পর কেউ সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করলে, তা’ হবে ভিন্ন প্রকৃতির।

অধিকাংশ অশান্তির পিছনে আছে— নানা প্রকারের অনিয়ন্ত্রিত— অবুঝ কামনা-বাসনা —চাহিদা, এবং উগ্র ও বিকৃত চাহিদা। এই সমস্ত চাহিদার পিছনে থাকে— অজ্ঞান বা স্বল্পজ্ঞান সম্পন্ন অসুস্থ মন, এবং অসুস্থ শরীর। থাকে যথেষ্ট চেতনার অভাব।

অনেক অশান্তিকর পরিবেশ-পরিস্থিতির পিছনেও দায়ী মানুষের অজ্ঞান-অসুস্থ মন। তাই সার্বিক মনোবিকাশ না ঘটা পর্যন্ত— এ’সব চলবে— চলতেই থাকবে।

এর সমাধান আছে একমাত্র মানব ধর্ম— মহাধর্মে। বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্টায় মহাধর্ম-ই একমাত্র পথ। মহাধর্ম হলো— প্রকৃত মানব-বিকাশের জন্য বেসিক এডুকেশন।

Google search: MahaDharma

“ঈশ্বর তথা জাগতিক ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে নানাবিধ ক্ষুধা বা চাহিদারূপ অশান্তির বীজ বপন ক’রে দিয়েছে, যাতে আমরা এই সমস্ত ক্ষুধা বা চাহিদার তাড়নায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে— কর্ম ও ভোগের মধ্য দিয়ে— জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি। ক্রমশ লাভ করতে পারি সেই অমূল্য সম্পদ— চেতনা।

যথেষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-চেতনা লাভ না হওয়াবধি, অবুঝের মতো শান্তি চাইতে গিয়ে— অশান্তিই বাড়ে। তাই, শান্তি লাভ করতে চাইলে, আত্ম-বিকাশ-এর পথ অবলম্বন করাই একমাত্র কর্তব্য।

যার জন্য এই অশান্তি— যার অভাবে এত অশান্তি, সেই জ্ঞান ও চেতনা লাভ না হওয়া পর্যন্ত— ঈশ্বরের কাছে শত মাথা কুটলেও শান্তি পাওয়া যাবে না।

তাই, নিজের চাহিদামতো ছোটার সাথে সাথে— ঈশ্বরের চাহিদাটাকেও বোঝার চেষ্টা করো।” —মহামানস

ঈশ্বর প্রসঙ্গে

আমরা সবাই একই চেতন-স্তরে অবস্থান না করার ফলে, ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের ধারণাও সবার ক্ষেত্রে একরূপ নয়। আবার আধ্যাত্মিক (দৃষ্টিকোণ থেকে) ঈশ্বর, আর প্রচলিত ধর্মীও ইশ্বর একরূপ নয়। যখন তুমি নিজেকে নিজের স্বরূপে জানতে পারবে, একমাত্র তখনই তুমি ঈশ্বরকে তার প্রকৃত রূপে বা স্বরূপে জানতে সক্ষম হবে— অনেকাংশে। এই মহাবিশ্বরূপ ঈশ্বরকে— মহাসাগররূপে কল্পনা করলে, তুমি হলে তার একবিন্দু জল বা পাণি স্বরূপ। এই মহাসাগরকে জানতে, সর্বাগ্রে— তার কয়েক বিন্দু জল বা পাণি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে তোমাকে। তুমি নিজেকে এবং নিজের চারিপাশকে সঠিকভাবে যত বেশি জানতে পারবে, ঈশ্বরকেও জানতে পারবে তত বেশি।

আমরা (মহাবাদ ও মহাধর্ম-এর অনুগামীগণ) মনে করি, এই মহাবিশ্ব হলো ঈশ্বরের শরীর, এবং এই শরীরের মধ্যে আছে একটি মন, তা-ই হলো ঈশ্বর-মন। এই মহাবিশ্বরূপ ‘শরীর’ আর এই মহাজাগতিক ‘মন’ মিলে একত্রে ঈশ্বর অস্তিত্ব।

এই মহাবিশ্ব— ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট নয়, সে নিজেই ঈশ্বর। এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর অতিরিক্ত আর কিছুর অস্তিত্ব নেই (একমাত্র সুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন আদিসত্ত্বা ছাড়া)। শুধুমাত্র এর কিছু অংশ— যেমন জীব ও উদ্ভিদ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। যদিও ঈশ্বর এদের সৃষ্টি করেছে তার শরীর উপাদান থেকেই। আমাদের মনও সৃষ্টি হয়েছে— বিশ্ব-মন বা ঈশ্বর-মন থেকে। শুন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হয়নি। আমরা সবাই ঈশ্বরের অর্থাৎ এই মহাবিশ্বেরই অংশ।

এই বিশ্ব-অস্তিত্বই হলো ঈশ্বর। যা সৃষ্ট হয়েছে আদিসত্ত্বা বা পরমাত্মা (সংস্কৃততে ব্রহ্ম) থেকে। এই আদিসত্ত্বা ঈশ্বর নয়, এবং এই জাগতিক কর্মকান্ডে তার বিশেষ ভূমিকা নেই। এই বিশ্ব-লীলায় আদিসত্ত্বা হলো নিরব ও প্রচ্ছন্ন দর্শকের মতো। 
আদিসত্ত্বা— পরমাত্মা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ বা পরিপূর্ণ নয়। পূর্ণতা হলো— পূর্ণ স্থির নিশ্চল— নিষ্ক্রিয় অবস্থা। পূর্ণতা থেকে কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। সেই অবস্থায় চাওয়ার কিছু থাকে না— পাওয়ারও কিছু নেই। সেই কারণে করারও কিছু নেই। সৃষ্টির প্রশ্নই আসেনা সেখানে।

আদিসত্ত্বাও পূর্ণ নয়। তারও আছে কিছু চাহিদা— কিছু অভাব। সে জানেনা, সে— কে, কেনই বা সে, আর কোথা থেকেই বা সে এসেছে বা তার উৎপত্তি হয়েছে। জানেনা তার পরিণতি কী। এই নিজেকে জানার ইচ্ছাই হলো— সৃষ্টির আদি কারণ। অগত্যা, স্ব-ইচ্ছায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পুণরায় তাকে খোঁজা বা আত্মানুসন্ধান করাই হল— সৃষ্টির গোপন রহস্য।

একসময় এই মহাবিশ্ব— অস্তিত্ব সম্পন্ন হয়েছে বা জন্ম নিয়েছে, এবং একসময় এর মৃত্যু বা ধ্বংসও হবে। এই মহাবিশ্ব— মহাসৃষ্টি হলো আদিসত্ত্বার ইচ্ছার ফল। ঈশ্বরের জন্ম হয়েছে ঠিক একটি সদ্যজাত শিশুর মতো— শিশু-বিশ্ব রূপে। প্রায় অজ্ঞান-অচেতন একটি শিশুর জীবনযাত্রা শুরু হয়েছে— পূর্ন বিকাশলাভের উদ্দেশে। প্রায় অজ্ঞান-অচেতন অবস্থা থেকে পূর্ণ চেতনার লক্ষ্যে, কর্মতৎপরতা সহ দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দলাভের মধ্য দিয়ে— জ্ঞান ও চেতনা লাভের জন্য অবিরাম চলাই তার নিয়তি। আর এটাই হলো জীবন।

পিতা-মাতার অপূর্ণ ইচ্ছাকে সন্তানের মধ্য দিয়ে পূর্ণ ক’রে তোলার সাথে— এই মহাসৃষ্টির উদ্দেশ্য-র অনেকটাই সাদৃশ্য আছে। ঈশ্বর বা মহাবিশ্ব-জীবনে অনেকগুলি ক্রমিক ধাপ রয়েছে, যথা— শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি, —অনেকটা আমাদের জীবনের মতোই।

শুধু ঈশ্বর নয়, আমরা সবাই চলেছি সেই এক লক্ষ্য পানে—। ইশ্বর বা মহাবিশ্বের অংশানুক্রমে আমরা প্রকৃতি—পরিস্থিতি এবং ঘটনা অনুসারে কেউ এগিয়ে আর কেউ পিছিয়ে আছি।

সৃষ্টির ক্রমিক পর্বগুলি নিম্নরূপ—

১) আদিসত্ত্বা বা পরমাত্মা তার নিজ উপাদানে— প্রায় তার অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র সত্ত্বা তৈরী করেছে প্রথমে।

২) আদিসত্ত্বার প্রতিরূপ সত্ত্বাটি— স্ব-অভিভাবন বা আত্ম-সম্মোহন দ্বারা অর্থাৎ যোগনিদ্রা বলে, নিজ জ্ঞান-গুণ-ক্ষমতা বিস্মৃত হয়ে— অস্ফুট চেতন-স্তরে উপনীত হয়।

৩) তারপর সে, প্রথম বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে— দ্বিধা বিভক্ত হয়ে, কিছুটা দুরিত্বে দুটি বিপরীত বিশ্বের বীজে পরিণত হয়।

৪) দুটি বিশ্ব-বীজ থেকে দুটি বিশ্ব-অস্তিত্ব (এই বিশ্ব ছাড়াও আছে আরেকটি বিপরীত বিশ্ব-অস্তিত্ব, একটি হলো ঈশ্বর, আর অপর বিশ্বকে বোঝার সুবিধার জন্য ‘ঈশ্বরী’ বলা যেতে পারে)-এর সৃষ্টি হয়, একই সময়ে দুটি মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। তারপর, বীজ থেকে ক্রমশ মহীরূহের মতো— মহাবিশ্বে পরিণত হতে থাকে (উভয় বিশ্ব-ই) অসংখ্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।

৫) পরবর্তীকালে, ঈশ্বর একসময় উদ্ভিদ ও জীব সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠে...।

এই হলো, অতিসংক্ষেপে মহা জীবন-চলার কথা (বিশদভাবে জানতে হলে, ‘মহাবাদ’ গ্রন্থটি পড়তে হবে)। এই জীবন-চলার মধ্যে বহু পর্ব আছে। আছে বহু কর্মকান্ড। এই বিশ্বরূপ ঈশ্বর সহ আমরা যতই এগিয়ে চলেছি, ততই অজ্ঞানতা— অচেতনতা ও মোহ থেকে মুক্ত হচ্ছি ক্রমশ। প্রকৃতপক্ষে, যথেষ্ট জ্ঞান-চেতনা লাভই এই জীবনের মূল লক্ষ্য।

ঈশ্বর সম্পর্কে সাধারণের ধারণা, ঈশ্বর শুধুই কল্যাণময়— শুভাকাঙ্খী— প্রেমময়, সৎ চিৎ আনন্দময়, জীবের বন্ধু। কিন্তু ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ বা স্বরূপ তা’ নয়। ঈশ্বরের মধ্যে তার বিভিন্ন চেতন-স্তর ও অবস্থা অনুযায়ী শুভ-অশুভ, সৎ-অসৎ উভয় গুণ ও শক্তিই বিদ্যমান। এখানে উল্লেখযোগ্য, ঈশ্বর যদি সত্যই জীবের বন্ধু বা শুভাকাঙ্খী হতো, তাহলে জীবের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক তৈরী করতো না।

ঈশ্বর-মনের মধ্যে শুভাত্মক সৎ মন-অস্তিত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি তার মধ্যে অশুভ— অসৎ মন-অস্তিত্বও রয়েছে। অসৎ বা শয়তান আসলে ঈশ্বরেরই আর এক দিক বা রূপ বা অস্তিত্ব।

ঈশ্বরের সন্তান ও অংশরূপে তার সাথে আমাদের বহু সাদৃশ্য বর্তমান। ক্রমবিকাশমান চেতনার পথে— ঈশ্বর যখন আমাদের অনুরূপ চেতন-স্তরে অবস্থান করেছে, তখন তার মানসিক অবস্থাও অনেকাংশে আমাদের মতই ছিলো। আমাদের মতোই ঈশ্বরের মন ও চেতনাও ক্রমশ বিকাশমান। বিকাশমান মনের কয়েকটি বিশেষ বিশেষ নিম্ন-চেতন-স্তর হলো— কয়েক প্রকারের অসৎ বা ঋণাত্মক মন-স্তর।

ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে এই ঋণাত্মক বা শয়তান মনের বিকাশ ঘটে, নিম্ন-চেতন-স্তরগুলির বিশেষ বিশেষ স্তরে— অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত অবস্থায়। ক্রমশ চেতনা বিকাশের সাথে সাথে, এইসব নিম্ন-চেতন-স্তরের অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত মনগুলি সচেতন বা আরও উচ্চ-চেতন মনের প্রদীপের নীচে— অন্ধকারে আশ্রয় নেয়, অর্থাৎ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে অন্তরালে চলে যায় তারা।

তাই বলে, একেবারে হারিয়ে যায় না কিছুই— সবই থাকে ফাইলের নীচে চাপা পড়া অবস্থায়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, ঈশ্বররূপ এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর অতিরিক্ত কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে ভালো-মন্দ যা কিছু আছে, সবই ইশ্বর বা ঈশ্বরের অংশ। মনের ক্রমবিকাশের স্তরগুলি সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করেছি ('মন-আমি' দ্রষ্টব্য)।

তাইবলে, ঈশ্বরকে ভয় পাবার কিছু নেই। ঈশ্বর সৃষ্ট জীব কখনোই ঈশ্বরের শত্রু হতে পারে না। আবার, ঈশ্বরও কখনোই জীবকে শত্রু ভাবতে পারে না। ঈশ্বরের শত্রু হতে গেলে, যে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তা’ কখনোই জীবের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। জীবোত্তর জীবনে উচ্চতর চেতন-স্তরে— সে যতই উন্নীত হবে, ঈশ্বরের সাথে তার একাত্মতা বৃদ্ধি পাবে ততই।

জীবের প্রতি রুষ্ট বা অসন্তুস্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, জীব যা কিছু করে, —সবই সে জাগতিক ব্যবস্থার দ্বারা চালিত হয়েই ক’রে থাকে। স্বতন্ত্রভাবে তার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। তাই, তার কর্মের জন্য সে দায়ী নয়।

আমাদের ক্ষেত্রে যেমন— আমরাই আমাদের বড় শত্রু। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই নিজের বড় শত্রু (অজ্ঞানতার কারণে)। তেমনি ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও। ঈশ্বরের মধ্যেও (নিম্ন চেতন-স্তরগুলিতে) চলে অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে নিজেই তার নিজের শত্রু। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে, ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে— মহাবিশ্ব জুড়ে। অবশ্য তার কুফল ভুগতে হয় জীবকেও। কিন্তু জীব এখানে অসহায়, তার পক্ষে ঈশ্বরকে শান্ত করা— প্রশমিত করা সম্ভব নয়। পূজা-পাঠ, প্রার্থনা—উপাসনা কোনো কিছুই ঈশ্বরকে টলাতে সক্ষম নয়।

তবে সান্তনা এই যে, ঈশ্বর এখন ক্রমবিকাশের পথ ধরে— অনেক উচ্চ চেতন-স্তরে উপনীত হয়েছে। তার ঋণাত্মক বা শয়তান মন এখন অতীতের অন্ধকারে প্রায় সুপ্ত অবস্থায় চলে গেছে। সে এখন আর সৃষ্টির ব্যপারে— কিশোর-যৌবনের লীলা-খেলার ব্যপারে অনেকটাই উদাসীন।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা যেমন— যা কিছু করছি— ভাবছি, সবই বাধ্য হয়ে করছি। জগতের অংশরূপে পূর্ব-নির্ধারিত জাগতিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে সবাইকে। ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও তেমনি। ঈশ্বর নিজেই এই জগত স্বরূপ। তার মধ্যে যাকিছু ঘটছে, প্রকৃতপক্ষে তার উপর ঈশ্বরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার ভাবনা-চিন্তা-কর্ম সবই পূর্ব-নির্ধারিতভাবে যখন যেটা ঘটার ঘটে চলেছে। এরই নাম ভাগ্য। সে যেটা নিয়ন্ত্রণ করছে সেটাও পূর্ব-নির্ধারিতভাবে করতে বাধ্য হচ্ছে সে। অপ্রিয় সত্যটা হলো— ভাগ্য ঈশ্বরের থেকেও বলবান।

এই পূর্ব-নির্ধারণ ঘটেছে সৃষ্টির শুরুতেই। সৃষ্টির শুরুতেই সমস্ত চিত্রনাট্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। কখন কোথায় কী ঘটবে, সবকিছুই স্থির হয়ে গেছে— সৃষ্টি শুরু হবার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। যেমন একটি বিস্ফোরণ ঘটার সাথে সাথেই স্থির হয়ে যায়— তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কখন— কোথায় কী ঘটবে। সৃষ্টির শুরুও তো আসলে একটা বিস্ফোরণ বা মহা-বিস্ফোরণ!

ঈশ্বর প্রসঙ্গে –খুব স্বাভাবিকভাবেই দেব-দেবীদের কথা এসে যায়। বহু মানুষই ঈশ্বর ও দেব-দেবী সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে, বিভিন্ন দেব-দেবীকেই ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা—উপাসনা করে থাকে। ‘মহাবাদ’-এ উক্ত দেব-চেতন-স্তরের বাসিন্দারাই প্রকৃত অর্থে দেবতা। এখানে দেব-দেবী বলে কিছু নেই। কারণ, এই উচ্চ চেতন-স্তরে কোনো লিঙ্গ ভেদ নেই। নেই বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা।

সারা পৃথিবীতে প্রচলিত বা কাল্পনিক দেব-দেবী বা দেবতাগণ আর মহাবাদোক্ত দেবতাগণ এক নয়। এরা অনেক বেশি উচ্চ চেতন-স্তরের সত্ত্বা। পৃথিবীতে অবতরণ ক’রে মানুষের সাথে নানারূপ লীলা-খেলায় অংশ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সংস্কৃতভাষায় দেবতার অর্থ জ্ঞানী-বিদ্বজন, যাঁরা তৎকালীন সাধারণ মানুষ থেকে বেশ কিছুটা উচ্চশ্রেণীর মানুষ।* ভগবান বলতেও সংস্কৃতভাষায় শুধু ঈশ্বরকেই বোঝায় না। দেবতুল্য ব্যক্তি, শৌর্য-বীর্যবান, ঐশ্বর্যশালি, জ্ঞানী, যশবান ও সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকেও ভগবান বলা হয়। আর, এর ফলেই, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ঈশ্বর ও দেবতা সম্পর্কে গুলিয়ে ফেলে।

আর, একটা গুহ্য কথা, পরোলোকের কিছু কিছু নিম্ন-চেতন-স্তরের বিদেহী আত্মা (বা দুরাত্মা)-দেরকে অনেক সময়েই বিভিন্ন পূজিত দেব-দেবীর ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। বিশেষতঃ যে সব মন্দির ও তীর্থস্থানে অনাচার—কদাচার—দুরাচারে পূর্ণ, সেইসব স্থানেই ভূত-প্রেত-পিশাচাদি নিম্ন-চেতন-স্তরের প্রেত-আত্মাদের ভীড়। এদের মধ্যে কিছু কিছু চতুর প্রতারক মনের প্রেত-আত্মা অনেক সময়েই অজ্ঞান-অন্ধ-অসহায় মানুষ বা দেব-ভক্তদের প্রতারণা ক’রে আনন্দ পায়, এবং তাদের পূজা-অর্ঘাদি আত্মসাৎ ক’রে তৃপ্ত হয়।

এদের কেরামতিতেই অনেক দেবস্থান এবং অনেক দেব-দেবী হয়ে ওঠে জাগ্রত। দেবতা সম্পর্কে সঠীক ধারণা না থাকায়, অনেক মানুষই প্রতারিত হয়ে আসছে এইভাবে। অনেকেই ঈশ্বর আর দেবতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে মায়ার গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছে।

*বিদ্বাংসোদেবা (সূত্রঃ তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২/৩ সুক্ত)

কর্ম ও কর্মফল

আমার কর্ম— এই মহাজাগতিক কর্মকান্ডেরই একটা অংশ। আমার কর্ম হতে উৎপন্ন হয় যে ফল, অর্থাৎ আমার কর্মফল— তা’ শুধু আমার নয়, তা’ এই জগতেরই—, এবং জগৎ জুড়েই তা’ প্রভাব বিস্তার করে। আর, সমস্ত জগতই সেই ফল ভোগ ক’রে থাকে। 


জগতের কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছুর সাথেই সবার যোগ রয়েছে। জাগতিক কর্মকান্ড এবং তা’ থেকে উৎপন্ন ফলের অধিকাংশই আমাদের পক্ষে অনুভব যোগ্য নয়। আমরা তার খুব সামান্য অংশই উপলব্ধি করে থাকি।

এই মহাজাগতিক কর্মকান্ড থেকে উৎপন্ন অসংখ্য প্রকারের— অসংখ্য ফলের মধ্যে আমিও একটি ফল। আমি যা কিছু করছি, তা’ এই জগতব্যাপী ঐচ্ছিক—অনৈচ্ছিক অসংখ্য কর্মকান্ডের মিলিত ফলেরই একটা অংশ।

আমার দ্বারা কৃত সমস্ত কর্ম— আমার ইচ্ছা মতোই সংঘটিত হয়না। এর পিছনে রয়েছে— বহু ইচ্ছা—অনিচ্ছা, স্বয়ংক্রিয় ঘটনা, স্থান-কাল-পাত্র, অবস্থা প্রভৃতি। আর, এ সবই পুর্বনির্ধারিতভাবে যখন যেটা ঘটার— ঘটে চলেছে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, —আমার-তোমার —সবার এবং সবকিছুর ক্ষেত্রেই। 


সামাজিক দৃষ্টিতে কেউ খারাপ কাজ করলেই যে তাকে খারাপ ফল ভোগ করতে হবে— তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার কেউ ভালো কাজ করলেই যে সে ভালো ফল পাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পেতেও পারে, আবার নাও পেতে পারে। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।

কোনো কর্মই শুধু ভালো কর্ম অথবা শুধুই মন্দ কর্ম— এমন হয়না। প্রতিটি কর্মই কম-বেশি ভালো-মন্দ হয়ে থাকে। কোনো কর্ম কারো দৃষ্টিকোণ থেকে বা কারো পক্ষে ভালো, তো অপর কারো পক্ষে মন্দ হতে পারে।


আবার, ভালো—মন্দের নুন্যাধিক্য গুণ বিচার ক’রে কেউ কেউ কোনো কর্মকে ভালো, আর কোনো কর্মকে মন্দ বলে, মনে করতে পারে।

কর্ম হ’তে উৎপন্ন কর্মফলের মধ্যেও ভালো ও মন্দ উভয় ফলই বিদ্যমান থাকে। কেউ শুধু ভালোটা দেখতে পায়, মন্দটা তার দৃষ্টিগোচর হয়না। আবার কেউ শুধু মন্দটাই দেখতে পায়, ভালো দিকটা সে উপলব্ধি করতে পারেনা।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় দিকই সঠিকভাবে দেখতে পায়— এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। 


সাধারণত, কর্মের জন্য— কর্মফলের জন্য— একজন অপরজনকে দায়ি ক’রে থাকে। আবার, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দেখে, এদের মধ্যে কেউই দায়ি নয়, —পূর্ব-নির্দিষ্টভাবে যা ঘটার তা-ই ঘটে চলেছে। কোনো কর্মেই কারো হাত নেই। আর, তাই কোন কর্মের জন্যই কেউ দায়ি নয়।

‘কর্মফল’-কে বুঝতে হলে, সর্বাগ্রে আমাদেরকে পূর্বনির্ধারিত ‘ভাগ্য’-কে বুঝতে হবে। ‘ভাগ্য’ আসলে কী— তা’ না বোঝা পর্যন্ত নানা সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঢেউয়ের দোলায় ও ধাক্কায় বিপর্যস্ত হতে হবে আমাদেরকে।

রাজ পূজা— ঈশ্বর পূজা

রাজা-বাদশাদের কৃপালাভের জন্য মানুষ যেমন নতমস্তকে স্তব-স্তুতি, পূজা (রাজ পূজা)—প্রার্থনা, উপঢৌকন প্রভৃতির দ্বারা তাদের সন্তুষ্টি বিধানের চেষ্টা করে এসেছে, ঈশ্বরের কৃপালাভের আশাতেও স্বল্পচেতন মানুষ তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে— সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে—।

মানুষী ধারণায় ঈশ্বর যেন রাজা-বাদশাদের মতই মানব-মন ও মানব-চেতনা সম্পন্ন কোনো পরাক্রমশালী ব্যক্তি, যে ঐগুলি পেয়ে খুব খুশি হয়ে— তার প্রার্থনা মঞ্জুর করবে!

শুধুকি তা’ই, রাজ-পূজা, দেব-পূজা*, ঈশ্বর-পূজার সাথে জড়িয়ে আছে— পূজা পেতে চাওয়া—পূজা দিতে চাওয়ার** মতো মানুষী মনস্তত্ব, যা ক্রমে সংক্রামিত হয়েছে বহু মানুষের মধ্যে।

মানুষ ক্রমশ বিকশিত হয়ে— যেদিন ঈশ্বরকে তার প্রকৃত রূপে (স্বরূপে) জানতে পারবে, সেদিন সে আর ঈশ্বরের প্রতি এ’রূপ আচরণ করবে না।

*’দেব’ অর্থে জ্ঞানী—বিদ্বান ব্যক্তি

**কতকটা ‘খেতে ভালবাসা— খাওয়াতে ভালবাসা’-র মতো

জীবনে সাফল্য লাভ প্রসঙ্গে

জীবনে সফল হওয়া বলতে, সাধারণত- মানব সমাজে প্রচলিত ‘মূল্যায়নের মাপকাঠি’ অনুযায়ী, একজনের জীবনে- তার চাহিদা মতো এবং/অথবা অপরাপরের চাহিদা অনুসারে- কোন কিছু বা বিশেষ কিছু হয়ে ওঠা, পেরে ওঠা, লাভবান হওয়া, বড় হওয়া অথবা উচ্চস্থান লাভ করা- কোন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করাকেই বুঝে থাকি আমরা।

আমরা অনেকেই জীবনের মূল সত্য- মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারণেই ঐ রূপ ভেবে থাকি, এবং ঐ রূপ কিছু একটা হতে পারলে অথবা লাভ করতে পারলেই নিজেদেরকে জীবনে সফল বলে মনে করি।

আবার, যারা সেই হয়ে ওঠা- পেরে ওঠায় অসফল হয়, তারা মনে করে- তাদের জীবনটাই বুঝি বিফল হয়ে গেল! দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা –হতাশায় কেউ কেউ জীবনের মূল স্রোত থেকেই সরে যায়।

আবার দেখা যায়, সফলতা লাভের পরেও, অন্তরের গভীরে একটা অতৃপ্তি থেকেই যায়। ‘কি যেন চেয়েছি –কি যেন পাইনি-!’ অনেক খুঁজেও সেই অতৃপ্তির কারণটাকে সবাই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনা।


মানব সমাজে সফলতার সার্টিফিকেট পেয়েও, সংবেদনশীল মন মাত্রেই ভিতরে ভিতরে একটা অপরিতৃপ্তি-অসন্তোষ অনুভব করে থাকে।

কেন এমন হয়?

আমি কে- জীবন কি ও কেন, জীবনের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি, -তা’ সঠিকভাবে জানা না থাকার কারণে, এবং মূল উদ্দেশের ক্ষেত্রে সফলতা লাভ না হওয়ার কারণেই এমনটা হয়ে থাকে।

অনেকেই বলে থাকে, জীবনের মূল উদ্দেশ্য নাকি ঈশ্বরলাভ! –ঈশ্বরলাভ না হওয়ার কারণেই ঐরূপ অতৃপ্তি –শূণ্যতা অনুভূত হয়ে থাকে।

কিন্তু ঈশ্বর লাভ বলতে, তারা ঠিক কি বলতে চায়, তা’ তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এই জীবনেই ঈশ্বর লাভ আদৌ সম্ভব কিনা, ঈশ্বরলাভই মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি না, -সে সম্পর্কে তাদের কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। শুধু পড়া ও শোনা কথা- জাহির করেই তারা আত্ম-সন্তুষ্টি লাভ ক’রে থাকে।

যার নিজের সম্পর্কে- জগৎ-সংসার সম্পর্কে, এবং ঈশ্বর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই, সে কি ক’রে বলতে পারে – ঈশ্বরলাভই জীবনের মূল লক্ষ্য!

আমাদের মধ্যে, পরিশ্রম ক’রে কিছু লাভ করা- যুক্তি-বুদ্ধি খরচ ক’রে, প্রভাব মুক্ত হয়ে- বিচার-বিবেচনা-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তলিয়ে দেখা ও বোঝার চেষ্টা খুব কম। শুধু পরস্পর শুনে- বিশ্বাস করা, আর ঘুষ দিয়ে- পূজো দিয়ে, স্তব-স্তুতি-স্তাবকতা ক’রে অনায়াসে বা স্বল্পায়াসে লাভ করার দিকেই আমাদের বেশী আগ্রহ। তার জন্য নিজেকে ঠকাতেও আমরা প্রস্তুত।
আমাদেরকে জীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করতে, এবং সেই লক্ষ্যপানে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছে- আত্মবিকাশ তথা মানববিকাশ মূলক ধর্ম- মহাধর্ম। মানব ধর্মই হলো- মহাধর্ম।

সত্যই যদি জীবনে সফল হতে চাও, -তাহলে মহাধর্ম পথে অগ্রসর হও। মহাধর্ম-ই হোক তোমার আপন ধর্ম।


মহাধর্ম সম্পর্কে আরো জানতে, গুগল সার্চ = মহাধর্ম MahaDharma, MahaManan

জীবনের মূল লক্ষ্য হলো 

চেতনার ক্রমবিকাশ।

আমাদের নানান চাহিদা। --- আমরা সর্বদা সেইসব
চাহিদার তাড়নায়, সেগুলো লাভ করার জন্য ছুটে মরছি।
এই চাহিদা গুলোর নির্দেশ বা প্রোগ্রাম আমাদের মন-সফ্টওয়ার-এর মধ্যে লোড করে দিয়েছে ঈশ্বর প্রোগ্রামার। যাতে করে আমরা বিভিন্ন চাহিদা নিয়ে ছুটে মরি, আর জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ করি। যত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ হবে--- ততই চেতনা বৃদ্ধি পাবে।

জীবনের লক্ষ্য ঈশ্বর লাভ নয়, ঈশ্বরের কৃপা লাভ নয়, স্বর্গ লাভ নয়, সম্পূর্ণ ঈশ্বর হয়ে ওঠাই জীবনের মূল লক্ষ্য। শিশু-ঈশ্বর থেকে পূর্ণ ঈশ্বর হয়ে ওঠা। বাঘের বাচ্চা তো কালক্রমে বাঘই হবে না কী!

সদগুরু— মহর্ষি মহামানস

এ যুগের প্রজ্ঞাবান ঋষি— মহান শিক্ষাবিদ এবং মানোবন্নয়নে আত্ম উৎসর্গীকৃত বহুদর্শী চিন্তাবিদ...

অতি সংক্ষিপ্ত জীবনালেক্ষ্য

মহামানস-এর জ্ঞানযোগী ভক্ত—শিষ্য—অনুগামীদের নিকট তিনি এ’কালের মহাপ্রজ্ঞ মানবপ্রেমিক মহর্ষি মহামানস। আর তাঁর ভক্তিযোগী ভক্ত—শিষ্য—অনুগামীদের নিকট তিনি মহা-শিবাবতার পরম প্রেমময় জগতবন্ধু— মহাআনন্দ-মহামানস।

তাঁর অনুগামী ভক্তগণ বলেন, অসাধারণ শুভ-আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন হওয়া সত্তেও, তিনি তা’ সযত্নে গোপন রাখেন। তাঁর অনেক ভক্তগণই তাঁকে স্মরণ ক’রে, তাঁর শরণ নিয়েই বহু বিপদ-আপদ ও সমস্যা থেকে রক্ষা পেয়ে থাকেন।

আমরা জানি, তাঁর প্রদর্শিত ও নির্দেশিত পথে— তাঁর দেওয়া পদ্ধতি অনুসরণ ক’রে চললে, আমাদের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটবে। জীবনটাই বদলে যাবে— সুখ-শান্তি-আনন্দ ও সুস্থতা, জ্ঞান ও চেতনায় সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে আমাদের জীবন। আমরা যারা তাঁর পথ অনুসরণ ক’রে— অনায়াসে তার কিছুটা লাভ করতে পেরেছি, তারাই জানি এর সত্যতা।  

তাঁর কথা, “আমাকে নিয়ে মাতামাতি কোরো না। আমাকে দেখা ও পাওয়ার জন্যে শ্রম ও সময় ব্যয় না ক’রে, এমনকি আমার জীবনধারা অনুসরণ না ক’রে, আমার প্রদর্শিত মত—পথ—শিক্ষা অনুসরণ ক’রে, তার মধ্য দিয়েই আমাকে খুঁজে পাবে।” শিবের মতোই অসাধারণ বর্ণময় জীবন তাঁর।

অন্যান্য ধর্মগুরু বা অবতার পুরুষের সাথে তঁর তুলনা চলে না। তাঁর প্রদর্শিত পথ— ‘মহাআত্মবিকাশ পথ’ (‘মহামনন’ নামে পরিচিত) এবং তাঁর দর্শন ও মহা মতবাদ— ‘মহাবাদ’ সেইসব মুক্তমনা-যুক্তিবাদী-প্রগতিশীল মানুষদের জন্য, যাদের জ্ঞান-পিপাসা— আত্ম-জিজ্ঞাসা প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে তেমন মানুষের সংখ্যা আজ আর কম নয়। মানুষের বয়েস হয়েছে— এখন চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত হারে।

একবিংশ শতাব্দি যে হবে মহা-আত্ম-বিকাশ এবং ‘মহাবাদ’-উক্ত প্রকৃত জ্ঞান যোগের কাল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আসুন, আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে মহা-আত্ম-বিকাশ পথের পথিক হই।

তি একালে একজন মহান মানবহিতৈষী ঋষি-বিজ্ঞানী-দার্শনিক। সারা জীবন ধরে তিনি মানুষের প্রকৃত বিকাশ এবং জীবন ও মহাজীবনের পরম সত্য অন্বেষণ তথা উন্মোচনের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে, মানব মনের সঠিক বিকাশ ঘটাতে, তিনি সুদীর্ঘকালের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মানুষ-গড়ার এক অত্যুৎকৃষ্ট শিক্ষা-পদ্ধতি আমাদের দিয়েছেন, যার নাম— ‘মহামনন’ আত্ম-বিকাশ যোগ শিক্ষাক্রম।

তিনি একজন বহুমুখী সৃজন-ক্ষমতা সম্পন্ন —বহুব্যপক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিল্পী-গবেষক, মনোবিদ ও শিক্ষাবিদ। একজন জ্ঞান-পথের ও বিকাশ-পথের পথিক। পৃথিবীর মুক্ত-পাঠশালায় তিনি আজও অবিরাম শিক্ষা গ্রহন ক’রে চলেছেন।

তিনি কোনো সাধু-সন্ত বা গুরু-বাবা নন। তিনি একজন দেবতাসদৃশ মানুষ। মহামানস একজন সত্যদ্রষ্টা দার্শনিক ঋষি। তাঁর সারা জীবনের বড় অবদান হলো— ‘মহাবাদ’ নামে এক অসাধারণ গ্রন্থ (যা মহাধর্ম-এর ধর্মগ্রন্থ)। যুক্তিসম্মত আধ্যাত্মিক দর্শনসহ আধাত্মিক-মনোবিজ্ঞান এবং আত্ম-বিকাশ শিক্ষায় সমৃদ্ধ এই গ্রন্থ আমাদেরকে আমাদের প্রকৃত স্বরূপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিভিন্ন শিল্প-কলা, সঙ্গীত-সাহিত্য, ধ্যান-যোগসহ চিকিৎসা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও তাঁর সহজাত ব্যুৎপত্তি ও সমান আগ্রহ দেখা যায়। তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে, গুগল সার্চের সাহায্য নিন।    

Embodiment Our of Conscious Mind 

with Lotus Mudra 

ব্লগ পোষ্ট দেখুন>

অথ ধর্ম কথা

হাজার হাজার বছর ধরে অজ্ঞান—অসহায় মানুষ অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক (আরোপিত)ধর্মের অধিনস্ত হয়ে আসছে। এই সুদীর্ঘকালের ধর্ম-শিক্ষায় মানুষের ওপরটাতে মেকী সভ্যতার চাকচিক্য— ধর্মীয় ভেক বা ভন্ডামোর ছাপ পড়েছে শুধুমাত্র, অন্তরের অন্ধকার ঘোঁচেনি এতটুকুও। মানুষ যে তিমির সেই তিমিরেই রয়ে গেছে আজও। প্রচলিত ধর্ম মানুষের সচেতন মনের বিকাশ ঘটাতে চায়নি কোনদিনই।

প্রচলিত ধর্ম ও রাজতন্ত্র (বর্তমানে রাজনীতি) উভয় উভয়ের স্বার্থে —একে অপরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেস্ট। মেকী মানবসভ্যতার অন্যতম ভিত্তি স্বরূপ শক্তিশালী তিনটি স্তম্ভ হলো— ধর্ম, রাজতন্ত্র আর বৈশ্যতন্ত্র। এরা পারতপক্ষে (কম-বেশি) প্রত্যেকেই মানুষকে অজ্ঞান-অন্ধ ক’রে রাখতে— তাদের খুশিমতো মানুষকে ব্যবহার করতে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর। মানব মনের যথেষ্ট বিকাশ —এদের কাম্য নয়।

এককালে, আদিম মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, তাদেরকে সমাজবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ক’রে তুলতে, প্রচলিত ধর্মের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কালের সাথেসাথে তা’ সময়োপযোগী না হয়ে ওঠায়, এখন তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে অনেকাংশে। অন্ধ-বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্ম মানুষকে কখনোই প্রকৃত জ্ঞানের পথে— সত্যের অভিমুখে অগ্রসর হতে সাহায্য করেনা। আজ চারিদিকে যে ভীষন অসুস্থতা— অরাজকতা, বিকার-বিকৃতি, যে তমসাচ্ছন্ন ঘোর সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা’ অনেকাংশেই এই ধর্মের গর্ভে সৃষ্ট। ধর্ম নিজেই যদি অজ্ঞান-অন্ধ —দুষিত —অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত হয়, তার গর্ভজাত সন্তান ভাল হয় কীকরে! দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষকে নিয়ে আহ্লাদিত হলে হবেনা!

সারাবিশ্বে যত গন্ডগোল— যত সমস্যা— সঙ্কট, তার অধিকাংশের জন্যই দায়ী হলো— অন্ধ-বিশ্বাস। যে ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে আমার সম্যক জ্ঞান নেই, সেই ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণাকে ‘সত্য’ বলে— নিশ্চিতভাবে মনে স্থান দেওয়াই হলো— বিশ্বাস বা অন্ধ-বিশ্বাস। এযে কত বিপদজনক —কী মারাত্মক, তা’ একটু সজাগ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালেই বোঝা যাবে। বোঝা না গেলে, —সে-ও হবে ঐ অন্ধ-বিশ্বাসের কারণেই। জ্ঞানী মানুষ মাত্রই তাদের ধারণা—বিশ্বাস—জ্ঞানকে আপাতসত্য জ্ঞান ক’রে থাকেন।

পুরস্কারের লোভ আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে পশুকে এবং পশুতুল্য নিম্নচেতনস্তরের মানুষকে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। একটু জ্ঞান-চক্ষু ফুটলে— সচেতন মনের একটু বিকাশ ঘটলেই— সে মানুষ তখন আর ওসবের দ্বারা কারো নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। তাই, ধর্মও চায়না মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটুক। স্বর্গলাভ—পূণ্যলাভ প্রভৃতি পুরস্কারের লোভ আর নরকাদি শাস্তির ভয় দেখিয়ে, দিব্য-চেতনার নামে আজগুবি দার্শনিক তত্ত্বে ভুলিয়ে— মানুষকে অচেতন করে রাখতেই সে বেশি আগ্রহী।

আজকের এই করুণ পরিস্থিতিতে মানবজাতিকে রক্ষা করতে, চাই— ‘মানবধর্ম’। যে ধর্ম মানুষকে মিথ্যার পিছনে না ছুটিয়ে— ছোটাবে ‘পূর্ণ বিকশিত মানুষ’ হওয়ার লক্ষ্যে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে সে-ও একটু একটু করে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে! এখন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে আমাদের নিজেরদের স্বার্থেই। গুগল বা ফেসবুকে গিয়ে— ‘মহাধর্ম’ (MahaDharma) সার্চ করলেই তার দেখা পাওয়া যাবে। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

যুগ যুগ ধরে মানুষ প্রচলিত ধর্মীয় শাসন ও শিক্ষার অধিনে থেকেও, তার যথেষ্ট মনোবিকাশ ঘটেনি এখনো। যে তিমির সেই তিমিরেই পড়ে আছে।

এর চাইতে, মানুষ যদি প্রচলিত ধর্ম হতে মুক্ত থেকে, স্বাভাবিক মানব ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর মুক্ত পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে অনেক অনেক বেশি বিকাশলাভ করতে পারতো।

ধর্ম-টা ব‍্যক্তিগত ব‍্যপার, ব‍্যক্তি স্বার্থের ব‍্যপার হলে বিশেষ সমস‍্যা থাকেনা। কিন্তু, সেটা যখন গোষ্ঠিগত ব‍্যপার, গোষ্ঠীগত স্বার্থের ব‍্যপার হয়, এবং সেই গোষ্ঠি যদি গোড়া মৌলবাদী গোষ্ঠি হয়, তখন সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অথচ স্বাধীনচেতা বা মুক্তমনের মানুষের পক্ষে তা' সঙ্কটের কারণ হয়ে ওঠে। 

কেউ কেউ প্রচলিত ধর্মের মধ্যে থেকে, তার সেই ধর্মকে সংশোধন ---পরিবর্তন করতে চায়। খুব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব‍্যক্তি হলে, কিছুটা পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলেও হতে পারে। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা' সম্ভব হবেনা। উল্টে প্রাণটাই যাবে।

জীবন সম্পর্কে আমার সাধারণ কথাগুলো অনেকের কাছেই ভারি দুর্বোধ্য লাগছে। এ' হলো প্রচলিত ধর্মের ফসল। যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুর্খ বানিয়ে রাখার ফলে এমনটা হচ্ছে।

তবে, কারও মধ‍্যে জানার বোঝার আগ্রহ ---ব‍্যাকুলতা থাকলে, সে কিছু দেরিতে হলেও বুঝতে পারবে। তারপর, সেই আবার অন‍্যদের বোঝাতে পারবে।

তবে, ভুল বোঝার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। আর, এটার সম্ভাবনাই বেশি। সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধর্ম যেভাবে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে, তার ফলে মানুষ ভুল পথে চলতেই বেশি অভ‍্যস্ত।

অনেকেই আমার কথায় রুষ্ট হয়ে আমাকে গালাগালি দেবে, দিক। তাতেও যদি সঠিকটা বুঝতে পারে তাহলেই হবে।

         দিব্যজ্ঞান লাভ করতে চাও?            আগে কান্ডজ্ঞান লাভ করো!

(ভক্ত ও অনুগামীদের প্রতি মহামানসের উক্তি)

যদি দিব্যজ্ঞান লাভ করতে চাও, তাহলে— আগে কান্ডজ্ঞান লাভ করো। মোহ-মায়া —অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত হতে পারলে, —তবেই মুক্তিলাভ সম্ভব হবে।

পূর্ণ বিকাশলাভই এই জীবনের অন্তিম লক্ষ্য। তার জন্য পায়ে পায়ে— সমস্ত পথ অতিক্রম করতে হবে। চেতনার পথে যত এগিয়ে যাবে, —ততই বন্ধন মুক্ত হবে, —ততই স্বাধীন হয়ে উঠবে। তবে, ফাঁকি দিয়ে— ফাঁক রেখে, কাউকে ঘুষ দিয়ে— কোনো জাদু-মন্ত্র বলে এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ডিঙিয়ে যাওয়ার অলীক চিন্তা কোরো না। 


যে যতই প্রলোভন দেখাক না কেন, বর্তমান মানব-চেতন স্তরে কোনো ভাবেই মুক্তিলাভ— মোক্ষলাভ— দিব্যজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তাই, যথাসম্ভব মুক্তমনা হয়ে, যথাসাধ্য সজাগ— সচেতন থেকে, আত্মজ্ঞান— আত্মবিকাশ লাভে সচেষ্ট হও।

কেউ অত্যল্প অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েই— নিজেকে একজন কেউকেটা ভাবছে। আবার কেউ কেউ মানুষ ঠকানোর মতো কিছু ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা, —কিছু প্রতারণা মূলক কৌশল অথবা প্রেতশক্তির সাহায্য নিয়ে— নিজেদেরকে ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের প্রতিনিধি রূপে উপস্থাপিত করছে।

কান্ডজ্ঞান বিহিন— লোভী মানুষই প্রধানত এদের শিকার হয়। এদের মতো লোভে পড়ে, বিকাশের পথ ছেড়ে— বিপথগামী হয়োনা।

আগের কাজ আগে করো। পূর্ণ বিকশিত মানুষ হওয়ার আপাত লক্ষ্যে এগিয়ে যাও। তার পরের ধাপে— ‘মহামানব’ হও। তারপর আস্তে আস্তে দেবচেতন স্তরে উন্নীত হবে। তারওপরে ‘মহাদেব’ চেতনা সম্পন্ন হয়ে উঠবে, এবং ক্রমে পূর্ণ বিকাশলাভ করবে। এই উচ্চতর থেকে উচ্চতম চেতনস্তর গুলির বিকাশ ঘটবে— ভিন্ন ভিন্ন লোকে, —এই পৃথিবীতে নয়।

মনেরেখ, ঈশ্বরের এই বিধান— এই জাগতিক ব্যবস্থাকে লঙ্ঘন করার সাধ্য— ঈশ্বরেরও নেই। সে তুমি যতই তার পূজা— উপাসনা ও প্রার্থনা করো না কেন!

ঈশ্বর আছে কি নেই, থাকলে তার স্বরূপ কি —তা’ যুক্তি-বিচার দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। অজ্ঞান-অন্ধের মতো কেন চোখ বুঁজে তা’ বিশ্বাস করবে!?

মনে রেখ, যুক্তি—কারণ ছাড়া এখানে কোন কিছুই ঘটে না। ঈশ্বরকে যুক্তি-বিচারের সাহায্যে বোঝা যায় না, —একথা ঠিক নয়। তোমার যেটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে— সে টুকুই বোঝ। কল্পনার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার চাইতে তা’ অনেক গুণে ভালো। কল্পনার ঈশ্বরকে নিয়ে তৃপ্ত থাকা— মুর্খের স্বর্গে বাস করার সমান।

ঈশ্বরকে তার স্বরূপে জানা—বোঝার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলে, ‘মহাধর্ম’ পুস্তকটি তোমার কাজে লাগতে পারে। মানব ধর্ম হলো মানুষের মূলগত ধর্ম। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

ঈশ্বর আছে কি নেই, থাকলে তার স্বরূপ কি —তা’ যুক্তি-বিচার দিয়ে বোঝার চেষ্টা কর। অজ্ঞান-অন্ধের মতো কেন চোখ বুঁজে তা’ বিশ্বাস করবে!?

মনে রেখ, যুক্তি—কারণ ছাড়া এখানে কোন কিছুই ঘটে না। ঈশ্বরকে যুক্তি-বিচারের সাহায্যে বোঝা যায় না, —একথা ঠিক নয়। তোমার যেটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে— সে টুকুই বোঝ। কল্পনার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার চাইতে তা’ অনেক গুণে ভালো। কল্পনার ঈশ্বরকে নিয়ে তৃপ্ত থাকা— মুর্খের স্বর্গে বাস করার সমান।

ঈশ্বরকে তার স্বরূপে জানা—বোঝার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলে, ‘মহাধর্ম’ পুস্তকটি তোমার কাজে লাগতে পারে। মানব ধর্ম হলো মানুষের মূলগত ধর্ম। মানব ধর্মই মহাধর্ম।

মহাজীবন চলার পথে ঈশ্বর ও আমরা

ঠিক আমাদের মতোই, সৃজন কালে— ঈশ্বর মনের মধ্যেও ছিলো দুটি মন, দুটি অংশ-মন। একটি হলো— সচেতন মন বা কিশোর মন, আর অপরটি হলো— অবচেতন মন বা শিশুচেতন মন। তার এই অন্ধ-আবেগ সর্বস্ব— যুক্তি-বিচার-কান্ডজ্ঞান বিহিন, মোহ-মায়াময় মনটিই হলো— মহামায়া ! আর তৎকালে আংশিক বিকশিত— আংশিক জাগ্রত সচেতন মনটিই হলো— মহামন বা মহামানস। একেই অনেকে মহাদেব নামে অভিহিত ক’রে থাকে।

আমাদের মধ্যে— যাদের মনরাজ্যে প্রধানতঃ অবচেতন মনের রাজত্ব বা প্রভুত্ব চলছে, সচেতন মন তেমন জাগ্রত না হওয়ায়— সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা, তারা ঈশ্বরের অবচেতন বা শিশুমন— মহামায়ার ভক্ত ও উপাসক।

আর যাদের সচেতন মন অনেকাংশে বিকশিত— অনেকটাই সক্রিয় এবং অবচেতন মনের উপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম, —তারা ঈশ্বরের সচেতন বা কিশোর মনের ভক্ত এবং যুক্তি-বিচার ও জ্ঞান-পথের পথিক। মনের মিল হলে তবেই না তাকে ভালোলাগে !

ঠিক আমাদের মতোই— ঈশ্বরও চেতনার ক্রমবিকাশের পথ ধরে সর্বদা এগিয়ে চলেছে। ঈশ্বর এখন আর পূর্বের সেই চেতনস্তরে নেই, এখন সে অনেক উচ্চ চেতন স্তরে অবস্থান করছে (মহাবাদ গ্রন্থে—সৃষ্টি কান্ড দ্রষ্টব্য)।

আমরা তার দ্বারা— তার অংশ হতে সৃষ্ট জীবগণ বর্তমানে মানব চেতন (ঈশ্বরের ক্ষেত্রে কিশোর চেতন) স্তরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সূক্ষ্ম চেতনস্তরে অবস্থান করছি, এবং ক্রমশ পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে (জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে) এগিয়ে চলেছি, ঠিক ঈশ্বরের মতোই !

আমরা ঈশ্বরের অংশ হলেও, —স্বতন্ত্র চেতন সত্তা হওয়ার কারণে এবং আমাদেরকে প্রথম সৃজন কালে, ঈশ্বর আমাদের তৎকালীন চেতনস্তর থেকে অনেকটাই উচ্চ চেতনস্তরে অবস্থান করার ফলে, পৃথিবী থেকে বহুপূর্বে বিদায় নেওয়া আমাদের অগ্রজ বহু মানুষ— বহু উচ্চ চেতনস্তরে উন্নীত হয়ে— ক্রমে ঈশ্বরের নিকটবর্তী চেতন স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে আমরা কিন্তু ঈশ্বরের দ্বারা সরাসরি সৃজিত নই। ঈশ্বর কৃত স্বয়ংক্রিয় সৃজন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে—পরম্পরাগত ভাবে আমাদের জন্ম হচ্ছে এখন। একসময় আমরাও ক্রমবিকাশের পথ ধরে ঈশ্বর চেতনস্তরে উপনীত হব। এটাই মহা জীবনচলা।

বিশ্বাসের চশমাটাকে খুলে রেখে– দেখো

মহাধর্ম ও মহাবাদ-এর মধ্যে তুমি তোমার বিশ্বাসের ঈশ্বরকে খুঁজতে যেওনা। –পাবেনা। তথাকথিত স্বর্গলাভ– ঈশ্বরলাভ অথবা ব্রহ্মলাভের কোন পথ বা পদ্ধতির সন্ধান নেই এখানে।

বিশ্বাসের চশমাটাকে খুলে রেখে, যথাসম্ভব প্রভাবমুক্ত হয়ে– খোলা মন নিয়ে, সত্যানুসন্ধিত্সু হয়ে– এর গভীরে প্রবেশ করলে, তবেই বিস্ময়কর সত্য তোমার কাছে প্রকাশলাভ করবে।

মহাধর্ম ও মহাবাদ হলো– যথাক্রমে এক স্বতন্ত্র ধর্ম এবং স্বতন্ত্র মতবাদ। বিভিন্ন শাস্ত্র –বিভিন্ন মতবাদ অথবা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সাথে এর তুলনামূলক বিচার করতে গেলে– ধন্দে পড়ে যাবে। দেখবে, কোথাও হয়তো মিলছে– কোথাও মিলছে না। তারফলে, তোমরা অনেকেই মানসিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে– হতবুদ্ধি হয়ে যেতে পার। তাই, মহাধর্ম ও মহাবাদ-এর দ্বারা লাভবান হতে চাইলে, একে এর দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যুক্তিবাদী সচেতন মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

ঠিকমতো উপলব্ধি হলে, তখন বুঝতে পারবে, কোনটা লভ্য –কোনটা লাভ করা সম্ভব, আর কোনটা আকাশ-কুসুম কল্পনা! বুঝতে পারবে, এতদিন কিভাবে মরিচিকার পিছনে ছুটে ছুটে মরেছো তুমি। বুঝতে পারবে মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য কী।

তুমি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে, তোমার জীবনের অধিকাংশ অসাফল্য– পরাজয়– হানি, অধিকাংশ দুঃখ– কষ্ট– যন্ত্রনার পিছনে প্রধানত দায়ী– তোমার অজ্ঞানতা –তোমার অন্ধ-বিশ্বাস। সঠিকভাবে নিজেকে না জানার ফলে, তোমার সামনের মানুষকে ঠিকমতো চিনতে না পারার ফলে, তুমি বহুবার ঠকেছ– প্রতারিত হয়েছো। এর পুণরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে, যতদিন না তুমি আলস্যতা কাটিয়ে সজাগ–সচেতন থেকে– সত্য– মিথ্যা, বাস্তব– অবাস্তব-কে চেনার ক্ষমতা লাভ করছো।

নিজেকে সজাগ–সচেতন রেখে— প্রভাবমুক্ত হয়ে, যুক্তি-বিচার প্রয়োগ করে– সত্যানুসন্ধান করতে, –গভীরভাবে চিন্তা করতে, অনেকটাই মানসিক পরশ্রম করতে হয়। তার চাইতে বিশ্বাস করা অনেক সহজ কাজ। বিশ্বাস করতে তেমন পরিশ্রমের দরকার হয় না। তাই, মানসিক শ্রমবিমুখ মানুষ –বিশ্বাসের পথটাই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু তার ফলে যে কী ক্ষতি হয়, –তা’ বোঝার জন্যেও মানসিক পরিশ্রম করতে সে নারাজ বা অপারক।

বিশ্বাসের পথে আত্মোপলব্ধি –সত্যোপলব্ধি –ঈশ্বরলাভ অথবা ঈশ্বরত্ব লাভ কিছুই সম্ভব হয় না। তবু, মানুষ বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধ’রে ছুটে–ছুটে মরে। তাই, মানুষকে সজাগ-সচেতন –যুক্তিবাদী –সত্যানুসন্ধিত্সু ক’রে তুলতে, মানুষের জীবনে একের পর এক দুর্ভাগ্য নেমে আসে। মানুষ যথেষ্ট সজাগ-সচেতন না হওয়াবধি বারবার আঘাত আসতে থাকে, এবং আসতেই থাকে।

বিশ্বাসের দ্বারা পৃথিবীতে যতটুকু ভালো হয়েছে, মন্দ হয়েছে তার চাইতে অনেক গুণ বেশি। সারা পৃথিবী জুড়ে যত অমানবিক কর্ম সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে, তার অধিক অংশের মূলেই আছে বিশ্বাস। অন্ধ বিশ্বাস।

আর, যদি মনে কর, তোমার বিশ্বাসের পথই শ্রেষ্ঠ পথ, ওটাই শেষ কথা, তাহলে বুঝতে হবে, মহাধর্ম ও মহাবাদ তোমার জন্য নয়।

মহাধর্ম ও মহাবাদ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে, গুগল সার্চ করুন> MahaDharma / MahaVad / MahaManan / MahaManas 

একমাত্র স্বল্প-চেতন স্তরের মানুষই চায়, সবাই তার পূজা করুক। ঈশ্বরের চেতনার কী এতই দৈন‍্য‍দশা যে মানুষের পূজার জন্য সে লালাইত হবে!

মহাধর্ম-এ দেব, ঈশ্বর, গুরু পূজার অবকাশ নেই। আত্ম-বিকাশ লাভ এবং সুস্থতা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মই আমাদের ধর্ম, আমাদের পূজা।

মনোবিকাশ বা চেতনার বিকাশ কিভাবে সম্ভব

আলোচনার প্রয়োজন হয়— কোনো বিষয়কে ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য। কিন্তু যারা ঘন্টার পর ঘন্টা— দিনের পর দিন ধরে কোনো সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা ক’রেই চলে, বুঝতে হবে তাদের চেতনা বা বোধশক্তি খুবই কম।

চেতনা কম হওয়ার অনেকগুলি কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো—

১। মস্তিষ্কের জড়তা, যা কোনো অর্জিত বা বংশগত রোগ-ব্যাধির ফল। রোগব্যাধির প্রধান কারণ হলো— শরীরে কোনো দীর্ঘক্রিয় ও গভীর ক্রিয়াশীল অনিষ্টকর বিষ বা রোগ-বিষ। যেমন, পারদ, সিফিলিস জীবানুজ বিষ প্রভৃতি।

২। মন বা মস্তিষ্ক-র যথেষ্ট কাজ করার পরিবেশ—পরিস্থিতি না থাকা। জীবনে অনেক বিচিত্র সমস্যার সম্মুখীন না হওয়া। যত বিচিত্র জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভ হবে, ততই চেতনা বৃদ্ধি পাবে। দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনার মধ্য দিয়েই চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে।

চেতন-অস্তিত্ব লাভ করার বা প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই যন্ত্রনার পালা শুরু হয়ে যায়। তবে, নিম্ন-চেতন-স্তরগুলিতে বোধ-শক্তি কম হওয়ায়— যন্ত্রনাও কম বোধ হয়। চেতনা যত বর্ধিত হয়, যন্ত্রনাও তত বর্ধিত হতে থাকে।

আবার, উচ্চ-চেতনা লাভের পর থেকে যন্ত্রনা ধীরে ধীরে কম অনুভূত হতে থাকে। অনেকটা উচ্চ বা উচ্চতর চেতন-অবস্থায় আর তেমন যন্ত্রনা থাকে না।

পার্থিব দেহ-অস্তিত্ব সম্পন্ন চেতন-সত্তার যন্ত্রনা কিছু বেশি হলেও, দেহাতীত বা দেহ-বিহীন চেতন সত্তাকেও অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। তা’ হলো মানসিক যন্ত্রনা।

দেহ-অস্তিত্ব সম্পন্ন সচেতন মানুষ শারীরিক যন্ত্রনা থেকে মানসিক যন্ত্রনাই বেশি ভোগ করে থাকে। যন্ত্রনার মধ্যদিয়েই মনোবিকাশ তথা চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে।

যে একবার চেতন-অস্তিত্ব লাভ করেছে, তার যন্ত্রনা থেকে রেহাই নেই। একমাত্র, দ্রুত উচ্চ চেতন-স্তরে উপনীত হতে পারলে, তবেই যন্ত্রনা থেকে অনেকাংশে মুক্তি ঘটবে।

তাই, যন্ত্রনা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অথবা যন্ত্রনাকে ভুলে থাকার চেষ্টা না করে, দ্রুত আত্ম-বিকাশ লাভের চেষ্টা করো। আত্ম বিকাশই আমাদের অন্তিম লক্ষ্য।

জাগতিক-ব্যবস্থা মতো— আমাদের জীবন-চলা ঐ পরম লক্ষ্যপানেই এগিয়ে চলেছে। কেউ দ্রুত গতিতে— কেউ ধীর গতিতে, কেউ এগিয়ে, আর কেউ পিছিয়ে। আমরা সবাই এই একই পথের পথিক— বিকাশমান চেতনার পথে।

অত্যন্ত মূল্যবান এই মানব জীবনকে মোটেই হালকাভাবে দেখো না। জীবনটা শুধুই হাসি-মজা-হৈচৈ ক’রে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। জীবনের লক্ষ্য কি তা’ জানো। জীবনকে ভালোভাবে বোঝার পরে, তখন হালকাচালে চলতে পারা-ই হলো— জীবন-কলা।

আমরা এখানে এসেছি— এক শিক্ষামূলক ভ্রমনে। ক্রমশ উচ্চ থেকে আরো উচ্চ চেতনা লাভই— এই মানব জীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এখানে আমরা জ্ঞান—অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে যত বেশি চেতনা-সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারবো, —তত বেশি লাভবান হবো। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে— এখান থেকে চলে যাবার সময় কিছুই আমাদের সঙ্গে যাবে না, —একমাত্র চেতনা ব্যতিত।

চেতনার অনেকটা বিকাশ ঘটলে, তবেই একজন ব্যক্তি মানুষ চেনার ক্ষমতা লাভ ক’রে থাকে। মানুষ চিনতে না পারার কারনে— একজন ব্যক্তিকে সারা জীবন বহু দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। সাধুবেশী ভন্ড-প্রতারক—উন্মাদ-শয়তানের কবলে পড়েও, অনেকের চেতনা জাগ্রত হয়না। একই ভুল সে বারবার করতেই থাকে। যদি চেতনার বিকাশ ঘটাতে চাও, মানব ধর্ম— মহাধর্ম-এর শরণ নাও।

তবে, একটু-আধটু চিনতে সক্ষম হলেই যেন তা’ প্রকাশ কোরোনা, তাহলেই বিপদে পড়বে। কিছুকিছু জ্ঞান প্রকাশযোগ্য নয়।

আমাদের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো— অধিকাংশ মানুষই মুক্তমনে— যুক্তি-বিচারের সাথে গভীরভাবে তলিয়ে ভাবতে পারেনা, এবং অনেক সাধারণ বিষয়ও বুঝতে পারেনা। তারা গতানুগতিক বাঁধা ছকের মধ্যে— ওপরে ওপরে— ভাসা ভাসা চিন্তা করতে অভ্যস্ত। মানবজাতির প্রধান সমস্যা গুলির মধ্যে এটা হলো অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। এর সাথে নিকট সম্পর্কযুক্ত আরেকটি সমস্যা হলো— অন্ধ-বিশ্বাস।

দু-একটি ব্যতীক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, স্কুল-কলেজ প্রভৃতির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, এবং ধর্মীয় শিক্ষা, —এদের কেউই আমাদেরকে যুক্তি-সম্মতভাবে— বিষয়ের গভীরে গিয়ে— পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চিন্তা করতে শেখায় না, বুঝতে শেখায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই— এরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে শেখায়। এদের অধিক অংশই আমাদেরকে তাদের অধীনস্ত— আজ্ঞাবহ—বাধ্য ক’রে রাখতে, আমাদেরকে মূর্খ বানিয়ে রাখতে সদা তৎপর।

এখানে এমন কোনো চালু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যে সরাসরি আমাদের চেতনার বিকাশ (সচেতন মনের বিকাশ) ঘটাতে সাহায্য করে। আমাদের জীবনের পক্ষে অপরিহার্য এই বিষয়ের উপরেই কাজ ক’রে চলেছে— মানব-বিকাশ-মূলক ধর্ম— মহাধর্ম। মহাধর্ম বলে, জেগে ওঠো— আত্ম-বিকাশলাভ করো।

আমরা জানি, মোহাচ্ছন্ন মানুষ— এই ‘জেগে ওঠা’ এবং ‘প্রকৃত বিকাশলাভ’-এ মোটেই আগ্রহী নয়। তাদের কথা— ‘এই মধুর স্বপ্ন দেখা থেকে জাগিও না— আমাদের জাগিও না।’ ‘হোক সে মিথ্যা বা কল্পনা, তবু সেই মিথ্যা নিয়েই বাঁচতে চাই আমরা।’

এমনও দেখা যাবে, একজন ব্যক্তি কোনো ক্ষেত্রে বা কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমঝদার, এবং যুক্তি অবলম্বন করে চলেছেন। আবার, সেই একই ব্যক্তি, অপর কোনো একটি ক্ষেত্রে পুরোপুরি অন্ধ-বিশ্বাস যুক্ত।

একজন, কোনো একটি বিষয়ে ভালো সমঝদার, কিন্তু অপর কোনো একটি সাধারণ বিষয় তার মাথাতেই ঢোকেনা। এখানে আগ্রহ—অনাগ্রহের ব্যাপার থাকতে পারে। আবার আগ্রহ থাকা সত্বেও, কোনো ক্ষেত্রে সে (মানসিক দিক থেকে) দুর্বল বা অক্ষম, —কোনো ক্ষেত্রে সে (মানসিক দিক থেকে) সবল— সক্ষম হতে পারে।

এছাড়া, লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, আমরা অনেক সময় কোনো বিষয় ভালোভাবে না বুঝে অথবা কিছু না বুঝেই কথা বলি— কাজ করি। আবার, কখনো কখনো সব বোঝার ভান করে থাকি। —এ’ হলো আমাদের মানসিক দোষ বা ত্রুটি।

যুগযুগ ধরে বহু মনীষীই আমাদেরকে বলেছেন— ‘মানুষ হও...’ ‘মানুষের মতো মানুষ হও’ ...কিন্তু, কী উপায়ে যে যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা যাবে, —তার কোনো হদিস নেই কোথাও। 


যে সব পথ অনেকে দেখিয়ে গেছেন, সে সব পথে যথেষ্ট বিকশিত মানুষ হয়ে ওঠা যাবেনা কোনো দিনও। তা’ যদি হতো— তাহলে দেশের তথা পৃথিবীর চেহারাটাই বদলে যেতো।

এখানে উল্লেখযোগ্য, মানুষ হওয়ার মানে শুধু মানব-দরদী হওয়াই নয়, মানুষ হওয়ার অর্থ হলো— মানব-মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটা। বিকশিত মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবেই মানব-দরদী হয়ে থাকে। তাদের উপর মানবতার পাঠ বা কর্তব্য আরোপ করার কোনো প্রয়োজনই হয়না।

(আজ, মানুষ গড়ার প্রকৃত দিশা দেখিয়েছেন, সদগুরু— মহর্ষি মহামানস তাঁর আত্ম-বিকাশ শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে। এ-ই হলো প্রকৃত আত্ম-বিকাশ লাভের পথ।)

চেতনা বিকাশের কয়েকটি সহজ উপায় (প্রতিটি পদ্ধতিই অভ্যাস করতে হবে)

১। সর্বপ্রথম যা দরকার তা’ হলো— ইচ্ছা। আত্ম বিকাশলাভের ইচ্ছা।

২। সর্বদা হাবজাবি চিন্তায় মনকে ব্যস্ত না রেখে, কিছু কিছু সৃজনমূলক গঠনমূলক চিন্তা করো। এছাড়া, গোয়েন্দা বা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো প্রয়োজনীয় অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে মন দাও। কোনো কিছু আবিষ্কারেও মন দিতে পারো। কোনো কিছু সৃষ্টি করা— আবিষ্কার করা, সত্য উদ্ঘাটন করার মধ্যে যে কতো আনন্দ— তা’ ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।

৩। মাঝেমাঝেই নিজের মনের প্রতি— মনের কার্যকলাপের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখো। এর উপর মৎকৃত একটি অডিও প্রোগ্রাম আছে। এই মন-আমি-যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে মন তথা চেতনার বিকাশ ঘটে থাকে।

৪। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যা অর্জন ও যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করা। শুধু তোমার চাহিদা হলেই হবেনা, বাজারে তার চাহিদা থাকতে হবে। তার জন্য মার্কেট-স্টাডি করতে হবে তোমাকে।

৫। সর্বদা সমশ্রেণীর মানুষদের সাথে মেলামেশা না ক’রে, মাঝেমাঝে বিভিন্ন শ্রেণীর এবং সম্ভব হলে, কিছু উচ্চশ্রেণীর মানুষের সাথে মেলামেশা করবে। এবং এই মেলামেশার সময় নিজেকে সজাগ রেখে, তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু বিষয় শেখার ও জানার চেষ্টা করবে।

৬। সুস্থতা লাভ ও তা’ বজায় রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন করতে হবে। অসুস্থতা ও তার কারণ এবং শরীর-মন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এবং সুষম আহার

করতে হবে। আজেবাজে আহার (জাঙ্ক ফুড) একেবারে চলবে না।

৭। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দক্ষ কর্মীর কাজ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে। একজন দক্ষ কর্মী কিভাবে— কি কৌশলে সেই কাজটি সম্পন্ন করছে, শেখার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে যেন তুমিও সেই কাজটি করতে পারো। অর্থাৎ কর্মদক্ষ হয়ে উঠতে হবে।

৮। অবসর সময়ে, অথবা ট্রেনে বা বাসে যাত্রাকালে মনোযোগ দিয়ে সামনের মানুষকে বোঝার বা পড়ার (রিড করার) চেষ্টা করবে। তার চেহারা, মুখাবয়ব, তার পোষাক, অভিব্যক্তি, কথাবার্তা, বাচনভঙ্গী— সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করবে (তবে সেই ব্যক্তি যেন বুঝতে না পারে)। এবং মনেমনে এক এক ক’রে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আপাত সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে। এরপর, সুযোগ পেলে তোমার সিদ্ধান্ত মিলিয়ে নেবে। ভুল হলে, কেন ভুল হয়েছে দেখবে, এবং ভুল সংশোধন করে নেবে।

তবে, সাবধান, তোমার এই সিদ্ধান্ত বা প্রেডিকশন মিলে গেলে খুশি হতে পার, কিন্তু অহঙ্কার বোধ কোরো না। তাহলেই তোমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। এইভাবে অভ্যাস করতে করতে তোমার মন-বিকাশ ঘটতে থাকবে।

৯। নিজের দিকে দৃষ্টি দাও, —নিজেকে চেনো। নিরপেক্ষভাবে নিজের শরীর ও মনকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করো। ক্রমশ চেতনা বৃদ্ধি পাবে।

১০। নিয়মিতভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে— যোগ-নিদ্রা বা সুষুপ্তাবস্থায় ডুবে যাও। এতে মনের বিকাশ ঘটবে। যোগনিদ্রা ভালোভাবে অভ্যাস হয়ে গেলে, তখন গভীর ধ্যানের মধ্যে ডুবে যাওয়া খুব সহজ হবে।

এর উপর মৎকৃত যোগ-নিদ্রার অডিও প্রোগ্রাম আছে। যার মাধ্যমে খুব সহজেই যোগ-নিদ্রার গভীরে ডুবে যাওয়া যায়।

১১। মৎকৃত কিছু বিশেষ ধ্যান-প্রক্রিয়া— যেমন, মহামনস-যোগ, আত্ম-ধ্যান-যোগ প্রভৃতি মনোবিকাশ তথা চেতনার বিকাশের উৎকৃষ্ট উপায়।

১২। মাঝেমাঝে মৎকৃত ‘মহাবাদ’ দর্শন অধ্যয়ন এবং নিয়মিতভাবে নিষ্ঠার সাথে ‘মহামনন’ আত্ম-বিকাশ-যোগ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চেতনার বিকাশ ঘটে। ‘মহামনন’-এর মধ্যেই রয়েছে মৎকর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্লভ যোগ পদ্ধতি যা আত্ম-বিকাশ বা মনোবিকাশ ঘটাতে সাহায্য করবে।

এগুলি অভ্যাসের মধ্যদিয়ে আত্মবিকাশ লাভের পথে এগিয়ে যাওয়াই হলো— মহাধর্ম (পালন)।

bottom of page