top of page
মন-আমি
(মহর্ষি মহামানস-এর অধ্যাত্ম-মনোবিজ্ঞান হতে গৃহীত)

মানব ধর্ম— ‘মহাধর্ম’ এবং মহাধর্মের অনুশীলনীয় পর্ব ‘মহামনন’ —আত্ম- বিকাশ বা মনোবিকাশ কার্যক্রমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, আমাদের ‘মন’ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকা আবশ্যক।

‘মন’ হলো— অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো প্রায় বর্ণনাতীত –সাধারণের পক্ষে প্রায় বোধাতীত এক অতি সুক্ষ্ম অস্তিত্ব। মন-সফটওয়ার ও শরীর (হার্ডওয়ার), —এদের মাঝে একটি প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার আছে। এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার-এর মাধ্যমেই শরীর যন্ত্রের যাবতীয় অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপাদি তথা সহজ-প্রবৃত্তিজাত কার্যাদি সংঘটিত হয়ে থাকে। শরীরকে ভিত্তি করেই এই জৈব সফটওয়ার তৈরী হয়েছে। আর, শরীরসহ এই প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারের ভিত্তিতেই তৈরী হয়েছে— মন-সফটওয়ার।

 

প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার বা ভিত্তিমন সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার, — উভয়েরই স্বতন্ত্র অবয়ব আছে। এই অবয়ব আমাদের বর্তমান চেতন-স্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। উচ্চতর চেতনস্তরের মন এই অবয়ব উপলব্ধি করতে সক্ষম। অন্যান্য সমস্ত অস্তিত্বশীলদের মতই উভয় সফটওয়ারেরই আছে অশরীরী দিব্য অস্তিত্ব (দ্রষ্টব্যঃ Super-existence)। একেই অনেকে আত্মা বলে থাকেন। কিন্তু, সমগ্র মন-অস্তিত্বই হলো— আত্মা। সে দেহযুক্তই হোক আর দেহাতীতই হোক (দ্রষ্টব্যঃ আত্মা)।

প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার এবং মন-সফটওয়ার— উভয়েরই নিজস্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকলেও, কেউই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। একে অপরের উপর, এবং শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপর উভয় জৈব সফটওয়ারই কম-বেশি নির্ভরশীল। আবার, শরীরসহ বহীর্জাগতিক বিষয়-বস্তুর উপরেও এরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। মানসিক কার্যকলাপ এবং শারীরীক কার্যকলাপ (যা প্রাথমিক জৈব সফটওয়ার দ্বারা পরিচালিত অনৈচ্ছিক ক্রিয়াকলাপ)একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার ক’রে পরস্পর সহযোগী হয়ে কাজ ক’রে থাকে। এর পিছনে রয়েছে— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র কার্য-কারণ স্বরূপ অসংখ্য ঘটনার সম্মিলিত ঘটনাপ্রবাহ। শরীর ও মনের ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়া-কান্ডগুলি হলো— জগতব্যাপী পরম্পরাগত অজস্র ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে প্রসুত ফল, এবং সেই সম্মিলিত ঘটনা প্রবাহেরই অংশ, যা আরো অনেক ঘটনার জন্মদাতা (দ্রষ্টব্যঃ ভাগ্য)।

 

ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতই, সমগ্র মন— একের পর এক ক্রমোচ্চ স্তরে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। বিকাশের প্রতিটি চেতন-স্তরে মনের এক এক প্রকার রূপ—গঠণ—কার্যকলাপ। অস্ফূট-চেতন-স্তর থেকে পূর্ণ-চেতন-স্তর অভিমুখে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের মধ্য দিয়ে তুচ্ছ লক্ষ্য থেকে উচ্চ লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা (এ’নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘মহাবাদ’ গ্রন্থে)।

 

তবে, শরীর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অথবা স্বয়ংসম্ভুত হয়ে— মনের সৃষ্টি হয়নি। কম্পিউটার সফটওয়ারের মতো— মন-সফটওয়ারেরও স্রষ্টা আছে। প্রোগ্রামার— ডেভলপার আছে। প্রাথমিক জৈব সফটওয়ারসহ মন-সফটওয়ার এবং শরীরযন্ত্র তৈরী হয়েছে— ঈশ্বর দ্বারা, —ঈশ্বরের মন ও শরীর উপাদান থেকে। এই মহা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডরূপ শরীর আর মহা বিশ্ব-মন নিয়েই হলো— ঈশ্বর অস্তিত্ব।

 

চেতনা হলো— শরীর ও মনের অনুভব—সংবেদন—বোধ করার ক্ষমতা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা, কোনো কিছু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার, বিচার-বিবেচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, শরীর ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা, কল্পনা—উদ্ভাবন—সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা স্বরূপ।

 

বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডস্বরূপ ঈশ্বর শরীরের সমস্ত কার্যকলাপ— ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতেই ঈশ্বর-মন ও ঈশ্বর-চেতনার প্রকাশ। আর, জীব ‘আমি’ হলো— সেই দিব্য-চেতন-মন-সিন্ধুর এক একটি বিন্দু স্বরূপ। ঈশ্বর-শরীরের অসংখ্য কোষের মধ্যে এক একটি কোষ সম। তবে, অন্যান্য কোষের সাথে এর একটু পার্থক্য আছে। জীব হলো— ঈশ্বর উপাদানে— ঈশ্বর সৃষ্ট জৈব কোষ।

 

এই মানব-চেতন-স্তরে— দুটি সক্রিয় মন নিয়ে আমাদের মনোজগত। একটি হলো— অবচেতন মন, যে অধিক অংশেই বিকশিত ও সক্রিয়। আর অপরটি হলো— সচেতন মন, যে স্বল্পাংশে বিকশিত ও সক্রিয়। এই সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে, তবেই আমরা মানবোত্তর উচ্চ-চেতন-স্তরে উপনিত হবো।

 

অবচেতন মন হলো— যুক্তি বিহীন আবেগপ্রবণ অন্ধ-বিশ্বাসী মন। সারা দিন-রাতের অধিকাংশ চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা ও কর্মের পিছনে আছে এই মন। আর, সচেতন মন হলো— যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষনসহ সত্যপ্রিয় মন। অবচেতন মনের কাজকর্মকে যুক্তি-বিচার-সতর্কতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিচালনা করাই এর কাজ। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এই মনটি খুব সামান্য পরিমানে বিকশিত ও জাগ্রত, এবং অধিকাংশ সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায়, তাদের সচেতন মন যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে অবচেতন মনকে সবসময় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হয়না।

 

যে নিজেকে ‘আমি’ বলছে, সেতো আসলে ‘মন’-ই! তবে, কখনো অবচেতন-মন নিজেকে ‘আমি’ বলছে, আবার কখনো সচেতন-মন (মানব-চেতন-মন) নিজেকে ‘আমি’ বলছে। একে অপরকে দাবিয়ে রাখার আমিত্বের লড়াই চলছে— প্রায় সর্বক্ষণ। বেশিরভাগ সময়ে সবল অবচেতন-মন-ই জিতছে এই লড়াইয়ে। তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বল্প-বিকশিত দুর্বল সচেতন-মন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কখনো কখনো।

 

অদৃশ্য এই মনদুটিকে যদি মূর্তরূপে দেখতে চান, তাহলে প্রচলিত ধর্মীয় ভাবনার বাইরে গিয়ে— মাকালী্র সেই ছবিটাকে মানসপটে অবলোকন করুন, যার পদতলে শিব শায়িত রয়েছে। এখানে, রণোন্মত্ত কালীই হলো অবচেতন মন। আর, তন্দ্রাচ্ছন্ন শায়িত শিব হলো সচেতন মন।

 

প্রত্যেক (চেতন স্তরের) মনের নিজস্ব স্মৃতি ভান্ডার আছে।অবচেতন মনের স্মৃতিচারণের সময় যদি সচেতন মন সজাগ থাকে, এবং আগ্রহী থাকে, তবেই সচেতন মন সেই স্মৃতি গ্রহন করতে এবং তার স্মৃতি-ভান্ডারে সঞ্চয় করতে পারবে। অবচেতন মন প্রায় সব সময়েই সজাগ থাকায়-- সে আগ্রহী হলে, সচেতন মনের স্মৃতি গ্রহন করতে সক্ষম।

 

সচেতন-মনের শাসনাধীনে থাকতে অবচেতন-মনের মোটেই ভালো লাগেনা। তবু নিরুপায় হয়ে থাকতে হয় তাকে। আমাদের নিদ্রাকালে, সচেতন-মন যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিদ্রিত হয়ে পড়ে, তখন বেশকিছু সময়ের জন্য অবচেতন-মন স্বপ্নরূপ কল্পনার পাখা মেলে দিয়ে— সম্পূর্ণতঃ বা অনেকাংশে স্বাধীনতা উপভোগ ক’রে থাকে। আমরা জাগ্রত থাকাকালেও, সচেতন-মনের তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঝিমুনো অবস্থায়, অথবা তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অবচেতন-মন নিজের খেয়াল-খুশিমতো কল্পনার জগতে অথবা বাস্তব জগতে অনেক কান্ডই ঘটিয়ে থাকে।

একটি শিশুকে আগ্রহের সাথে বারবার নানাবিধ প্রশ্ন করতে দেখে, আমরা সাধারণতঃ তাকে উন্নতিশীল বা প্রগতিশীল শিশু বলে চিহ্নিত ক’রে থাকি। তার এইসব প্রশ্ন যদি নিছক কৌতুহল না হয়ে জানার আগ্রহ হয়, আর সে যদি তার স্বল্প জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সম্বল ক’রেই যুক্তি-বিচার সম্ভাবনা-অনুমান-এর সাহায্যে সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, এবং সেই পথে সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তখন তাকে আমরা উৎকৃষ্ট শ্রেণীর শিশু বলে থাকি।

 

শুধু শিশুই নয়, বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও এ’কথা প্রযোজ্য। যে সচেতন মনটির মালিক হওয়ার সুবাদে— আমরা মানুষ বলে গণ্য হই, সেই সচেতন বা মানব-চেতন মনটি এখনো আমাদের অধিকাংশের মধ্যে শৈশব অবস্থাতেই রয়েছে। তার যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে— তবেই ঘটবে মনোবিকাশ —ঘটবে মানব-বিকাশ।

 

সঠিক বিকাশের জন্য— জানার আগ্রহের সাথে থাকতে হবে সুস্থতা। ক্রোধ-উত্তেজনা-অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, অলসতা-উদাসীনতা প্রভৃতি অসুস্থতা জ্ঞাপক দোষসহ অন্ধ-বিশ্বাস, অন্ধবৎ অনুসরণ, নির্বোধের মতো সব মেনে নেওয়া, যুক্তি-বিচারের অক্ষমতা, এবং স্রোতে ভেসে চলার প্রবণতা প্রভৃতি দোষগুলি আমাদের বিকাশের পরিপন্থি। কষ্ট করতে রাজি নয়, এমন একজনের বক্তব্যঃ ‘বিশ্বাস করতে তো আর কষ্ট করতে হয়না, জ্ঞান অর্জনের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়!’ অথচ, জ্ঞানাভাবের কারণে তাকে আরো অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে!  

 

মানব-জীবন লাভ ক’রে— মানব অস্তিত্ব সম্পন্ন উন্নত জীব হয়েও যদি কারো মধ্যে— নিজের সম্পর্কে—জীবন সম্পর্কে জোরালো প্রশ্ন না জাগে, আত্ম-জিজ্ঞাসা— জীবন-জিজ্ঞাসা —বিকাশাকাঙ্খা না জাগ্রত হয়, এবং যদি সে তার উত্তর সন্ধানে— সত্য সন্ধানে যুক্তিপথে অগ্রসর না হয়, সেক্ষেত্রে, তার সচেতন মনের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।

 

সচেতন বা মানব-চেতন মনের ধর্মই হলো— যুক্তি-বিচার-সতর্কতার সাথে বাস্তবপ্রিয়তা ও সত্যপ্রিয়তা প্রভৃতি। আর, অবচেতন বা প্রাক-মানব-চেতন মনের ধর্ম হলো— অন্ধ-আবেগ— অন্ধ-বিশ্বাস, অলীক কল্পনা প্রিয়তা প্রভৃতি। মনে রাখতে হবে, আত্ম-জিজ্ঞাসাই ঊর্ধগামী আত্ম-বিকাশ-পথের প্রথম সোপান। এবং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে— তা’ যেন নিম্নগামী অন্ধবিশ্বাসের আপাত সুখকর পথে নেমে গিয়ে— পথভ্রষ্ট না হয়, —বিপথগামী না হয়।

 

আমাদের সচেতন-মন যত বেশি বিকশিত হবে, আমরা ততই অন্ধ-বিশ্বাস মুক্ত হয়ে— যুক্তি ও জ্ঞানপথে অগ্রসর হতে পারবো। আমরা যুক্তি ও জ্ঞানের পথ ধরে যত চলবো— সেইমতো সচেতন-মনের বিকাশও ঘটতে থাকবে ততই।

 

স্বল্প-বিকশিত সচেতন-মনের মানুষ অন্ধ-বিশ্বাসের পথ ধরে চলতে গিয়ে— বারবার ঘাত-প্রতিঘাতে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত হতে থাকবে, এবং এরফলেই তিলে তিলে তাদের মধ্যে বাস্তব বোধ— যুক্তি বোধসম্পন্ন সচেতন-মনের বিকাশ ঘটতে থাকবে। এইভাবে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রনাদায়ক বিচিত্র ঘটনার মধ্যদিয়ে একসময় তাদের সচেতন-মনের বিকাশ ঘটবে।

     

এরই মধ্যবর্তী কোনো কোনো সূক্ষ চেতনস্তরে, অন্ধ-বিশ্বাসকে অপযুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দেখা যাবে। আবার, অন্ধ-যুক্তিবাদী ও অন্ধ-বিজ্ঞান-সমর্থক মানুষের দেখাও পাওয়া যাবে কিছু কিছু, যারা আসলে একশ্রেণীর অন্ধ-বিশ্বাসী।

 

অন্ধ-বিশ্বাস-প্রবন স্বল্প-চেতন মানুষ— ভন্ড-প্রতারকদেরকেই বেশি পছন্দ ক’রে থাকে। যাদের দ্বারা সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তেমন ব্যক্তিদের প্রতিই সে বেশি আকর্ষন বোধ ক’রে থাকে। জ্ঞানী ব্যক্তি— যে প্রকৃতই তার মঙ্গল চায়, তাঁকে এবং তাঁর কথা তার ভালো লাগেনা। ফলে, বারবার প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে সে, যতদিন না তার চেতনা যথেষ্ট জাগ্রত হয়। আবার, কারো কারো চেতনার জড়তা এত বেশি, যে বারবার ঠেকে ও ঠকেও তাদের চেতনা হয়না।    

 

আরো পড়ুনঃ আত্মা-মন-পুণর্জন্ম (এই লিঙ্কং অনুসরণ করুন) https://www.facebook.com/notes/sume...

*মন সম্পর্কে আরো জানতে, নিজের সম্পর্কে জানতে— ‘মহাবাদ’ পড়ুন।

আত্মা—মন—পুণর্জন্ম

সমগ্র মন-ই হলো— আত্মা। আত্মা ব’লে আলাদা কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। অহম বোধ সম্পন্ন এবং মনন ক্ষমতা সম্পন্ন চেতন সত্তাটি আসলে মন-ই। সে পার্থিব দেহ সম্পন্ন মনই হোক আর অপার্থিব দেহ সম্পন্ন মনই হোক, জীব-মনই হোক আর ঈশ্বর-মনই হোক, আসলে সে— মন।

 

আমাদের বর্তমান মনোজগতে কতকটা স্বামী-স্ত্রীর মতই— সক্রিয় মনদুটির একটি হলো— ‘প্রাক মানব-চেতন-মন’ বা অবচেতন মন, আর অপরটি হলো— ‘মানব-চেতন-মন’ বা সচেতন মন। এরা হলো সমগ্র মনের (ক্রমবিকাশমান মনোপদ্মের ) অংশমাত্র। সমগ্র মন হলো— ক্রমবিকাশমান পদ্মের মতো। অস্ফুট চেতন-স্তর থেকে একটু একটু ক’রে ক্রমশ বিকশিত হতে হতে এক সময় পূর্ণচেতন স্তরে পৌঁছে— পূর্ণ বিকাশলাভ করবে সে।

এক একটি চেতন-স্তরের এক একটি নাম, এক এক রূপ, এবং এক এক প্রকারের কার্যকলাপ। সংক্ষেপে চেতনস্তরগুলি হলো- কীট-চেতন স্তর, সরীসৃপ-চেতন স্তর, পশু-চেতন স্তর, আদিম-মানব চেতন স্তর, মানব-চেতন স্তর, মহামানব চেতন স্তর, দেব-চেতন স্তর, মহাদেব-চেতন স্তর, এবং ঈশ্বর-চেতন স্তর। সমস্ত চেতন স্তরগুলি পৃথিবীতে লভ্য নয়। মানব-চেতন স্তরের পরবর্তী স্তরগুলি অপরাপর বিভিন্ন লোকে ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকে। তবে, মানব-চেতন ও মহামানব-চেতন স্তরের মধ্যবর্তী সন্ধি স্তরের ২।৪ জন মানুষকে কখনো কখনো পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে স্বল্প বিকশিত এই মানব-চেতন-মন বা সচেতন মনের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলে তবেই পরবর্তী উচ্চ-চেতন (স্তরের) মনের মালিক হতে পারবো আমরা। তারপরেও আরো অনেক পথ পেরতে হবে এই বিকাশপথ ধরে...।

আত্মার পুণর্জন্ম নিয়ে প্রচলিত মতবাদ, অর্থাৎ পরলোকগত আত্মা— পরলোক হতে পৃথিবীতে পুণরায় জন্মগ্রহন করে— এই মতবাদ অনুসারে প্রত্যেক নবজাত মানবশিশুই কোন একসময় পরলোকগত হওয়া কোনো মনুষ্য আত্মার— পরলোক হতে ইহলোকে পুণরাগমন ক’রে— মনুষ্য রূপে পুণর্জন্মলাভ করা এক মানব-অস্তিত্ব!

তাই যদি হয়, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারেনা। আর, মনুষ্যেতর অন্য কোনো জীবের আত্মার পক্ষেও মানুষরূপে জন্মগ্রহন করা সম্ভব নয়। কারণ, সচেতন বা মানব-চেতন মনের সামান্য উপস্থিতি বা বিকাশ না ঘটে থাকলে, তার পক্ষে মানব-অস্তিত্ব সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়।

 

পৃথিবীতে স্বল্প মানব-চেতন বা সচেতন মন সম্পন্ন অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে, পৃথিবীতে আদিম মানুষের সংখ্যাও নগন্য। একমাত্র, বিকশিত আদিম মানুষের— যথেষ্ট বিকশিত আত্মার পক্ষেই– আজকের এই মানুষ রূপে পুণর্জন্ম লাভ সম্ভব হতে পারে। অন্য কোনো জীবের পক্ষে তা’ মোটেই সম্ভব নয়।

তাই, যুক্তিসম্মত আধ্যাত্মিক মতবাদ ’মহাবাদ’ —উপরে উল্লেখিত পুণর্জন্মের ধারণাকে সমর্থন করেনা।

পুনশ্চঃ

পুনর্জন্মের প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই পুর্বজন্মের ‘কর্মফল’ কথাটা চলে আসে। ‘কর্মফল’ নিয়ে আমার একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ আছে। এখানে সংক্ষেপে দু’-একটা কথা বলি, ঈশ্বরের রাজ্যে— জাগতিক ব্যবস্থায় আমরা যাকিছু করি— তার জন্য আমরা দায়ী নই। পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যক্রমে (ভাগ্য সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) এখানে সবকিছু ঘটে চলেছে। আমরা যাকিছু করি— তা’ আমরা করতে বাধ্য হই, অর্থাৎ প্রায় ক্রিড়নকের মতোই বাধ্য হয়ে করি। তাই, তার ফলাফলের জন্য আমরা কোনভাবেই দায়ী নই। এখানে আমরা মায় সমস্ত কিছুই পরম্পরাগত ঘটনাস্রোতের ফসল। তবে, ঘটনাক্রমে— বহুকিছু সাপেক্ষে কোন কোন কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতে হয়, আবার কোন কোন কর্মের ফল আমরা ভোগ করিনা। সবকিছুর পিছনেই কার্য-কারণ থাকে।

 

আর যেহেতু, সাধারণভাবে পৃথিবীতে পুণর্জন্ম হয়না, তাই পূর্বজন্মের কর্মফল পরজন্মে ভোগ করার প্রশ্নই আসেনা। আমরা জীবমাত্রই, পিতা-মাতার নিকট হতে বংশানুক্রমে দেহ-মন লাভ করে থাকি। জীব-অস্তিত্বশীল হওয়ার জন্য পরোলোকগত কোন আত্মার অনুপ্রবেশের প্রয়োজনই নেই এখানে। তবে, বর্তমানের মানুষ সংকর জাতির জীব হওয়ার ফলে, আমরা এক একজন এক এক প্রকারের— বিচিত্ররূপী দেহ-মন সম্পন্ন মানুষ। ভাগ্যক্রমে আমরা এক একজন এক এক পরিবেশ— পরিস্থিতিতে, এক এক প্রকার ভাগ্য অনুসারে কর্ম করে চলেছি।

আপনার কাছে যদি পুণর্জন্ম-এর পক্ষে ভালো যুক্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে জানান। আপনাকে স্বাগত জানাই।

আরো পড়ুনঃ কর্ম ও কর্মফলঃ (এই লিঙ্কং অনুসরণ করুন) https://www.facebook.com/notes/sumeru-ray/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%AB%E0%A6%B2/10154794968786673/

A Worldwide Human Development Peace Program 

Blog Posts >

bottom of page