top of page

মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন


মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন

(মহর্ষি মহামানস-এর ‘মহাবাদ’ গ্রন্থ হতে গৃহীত আত্মধ্যান-লব্ধ মহাতত্ত্ব-জ্ঞান কান্ড— বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।)

পরমশূন্য! আদি-অন্তবিহীন— নিরাকার প্রকৃত শূন্য! আমাদের জানা মহাশূন্য নয়—। মহাবিশ্ব বা ঐশ্বরীয় এলাকা ছাড়িয়ে— আদিসত্তার অঞ্চল (বা ব্রহ্মাঞ্চল) পেরিয়ে বিদ্যমান যে অনন্ত আকাশ— সেই পরম শূন্য। নিস্তব্ধ—নিস্তরঙ্গ—নির্বিকার— অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্ব। শূন্যাস্তিত্ব! অপরিবর্তিত— অবিনাশী—অবিচল সেই শূন্যে— এখানের কোনো সচল বস্তু বা শক্তি প্রবেশ করতে অক্ষম।

সেই পরম শূন্যের মাঝে, একটি নির্দিষ্ট সীমা নিয়ে আদিসত্তা— পরমাত্মার অবস্থান। সে এখন* লীলা অবসানে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সেই আদিসত্তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে মহাসৃষ্টি। বহুসংখ্যক মহাবিশ্ব নিয়ে এই মহাসৃষ্টি। তারমধ্যে একটি হলো আমাদের এই মহাবিশ্ব। আদিসত্তা— পরমাত্মা প্রধানত আদিকণা — পরমকণা — আদিশক্তি দিয়ে গঠিত। এছাড়াও তা' আদি বস্তুকণা, অসংখ্য যুগ্মকণা এবং বিকিরণে পরিপূর্ণ। পরমাত্মার অধিক অংশই পরমা্ণু— অতিপরমাণু, আদি শক্তিকণা ও তার বিপরীত কণা দিয়ে গঠিত অসংখ্য যুগ্মকণা এবং নানা বিকিরণে পূর্ণ। এদের সাথে মিলেমিশে রয়েছে আরও অনেক বস্তু— অবস্তু, অন্যবস্তু। যেমন— পরম-পদার্থ, দিব্য-পদার্থ ও চেতনা। আদি চেতনা— পরম চেতনা।

সৃষ্টিপূর্বে— একাবারে আদিতে, দুই প্রকারের আদিকণা উপস্থিত ছিল। একটি হলো— পজেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ‘1’ প্রোগ্রামীং কোড এবং 1 ডাইমেনশন সম্পন্ন ‘X’ কণা, আর অপরটি হলো— নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ‘0’ (জিরো) প্রোগ্রামীং কোড সম্পন্ন এবং জিরো ডাইমেনশন বা ডাইমেনশন বিহীন ‘Y’ কণা। বিভিন্ন সংখ্যক X ও Y কণার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মৌলিক কণা। একাধিক মৌলিক কণা— বিশেষ বিশেষ সন্নিবেশে মিলিত হয়ে তৈরী হয়েছে বিভিন্নরূপ মৌলিক পদার্থ কণা।

বিভিন্ন মাত্রার ঘুর্ণন— কম্পাঙ্ক এবং চার্জ সম্পন্ন এক একটি মৌলিক কণা— অপরাপর মৌলিক কণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মৌলিক পদার্থ ও শক্তি সৃষ্টি করে থাকে। এই বিভিন্নতার পিছনে নিহিত থাকে ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রামীং কোড— ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক আদিকণার উপস্থিতি।

আদিকণা থেকে মৌলিক কণাসহ সমস্ত পদার্থ কণা ও শক্তি কণা এবং তাদের বিশেষ বিশেষ সন্নিবেশে সৃষ্ট বিভিন্ন জাগতিক অস্তিত্বগুলি— সবকিছুর অন্তরেই নিহিত রয়েছে বিভিন্নরূপ প্রোগ্রামীং কোড। কতকটা আমাদের কম্পিউটার প্রোগ্রামীং কোড-এর মতোই। আদিকণা থেকে পরবর্তীতে সৃষ্ট বিভিন্ন কম্পাঙ্কের বিভিন্ন প্রকার কণাগুলিসহ সমস্ত প্রকার জাগতিক অস্তিত্ব— ভিন্ন ভিন্নরূপ অব্যক্ত প্রোগ্রামীং কোড-এরই ব্যক্ত বা মূর্ত রূপ।

বিভিন্ন প্রকার যোগ-বিয়োগ, আদান-প্রদান, গ্রহণ-বর্জন প্রভৃতি আচরণের ফলে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন বহু প্রকারের কণা ও অস্তিত্ব। যেমন— XY, XYY, XXX, YYY, (XY)+(XYY), (XXY)+(XYY) প্রভৃতি বিভিন্ন ভর বিশিষ্ট এবং ভর বিহীন, চার্জ বিশিষ্ট এবং চার্জ বিহীন, শূন্য ডাইমেনশন থেকে বহু ডাইমেনশনাল অস্তিত্ব।

সৃষ্টি হয়— মহাকাশ, পদার্থ, শক্তি, চেতনা প্রভৃতি। মৌলিক কণার মধ্যে পরবর্তীতে রূপান্তরিত হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাই নিহিত বা সুপ্ত থাকে। এই কণাগুলি রূপান্তরধর্মী এবং কখনো কখনো বৈপরীত্য গুণ সম্পন্ন। মৌলিক কণাগুলির মধ্যে বিভিন্নরূপ যোগ-বিয়োগের ফলে সমবিপরীত এবং আংশিক বিপরীত কণাও সৃষ্টি হয়ে থাকে। মৌলিক কণাগুলি এবং তাদের থেকে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্নরূপ কণাগুলির এক বিশেষ বিন্যাসের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আদি-মন ও আদি-চেতনাসহ আদিসত্তা— পরমাত্মা।

তা-ই বলে, আদিসত্তা পূর্ণ চেতন-সত্তা বা পূর্ণ চেতনা সম্পন্ন নয়। আর, আদিসত্তা —পরমাত্মা সবদিক থেকেও পুর্ণ নয়। পুর্ণতা হলো একেবারে পূর্ণ অচলাবস্থা। পূর্ণ নিষ্ক্রিয়— নির্গুণ অবস্থা, যা অচেতনতার সমার্থক। যে অবস্থা থেকে কোন সৃষ্টি হতে পারে না। পূর্ণ স্থিতাবস্থা।

পূর্ণ চেতন-সত্তার চাওয়ার কিছু থাকে না। পাওয়ারও কিছু নেই। তাই, তার করারও কিছু নেই। স্বয়ং সম্পূর্ণ হলে, সেখানে সৃষ্টি লীলার প্রশ্নই আসেনা। যেখানে লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, চলা নেই— সেখানে সৃষ্টি অসম্ভব।

না, আদিসত্তা— পরমাত্মা পূর্ণ নয়, —তবে প্রায় পূর্ণ। আমাদের নিম্ন চেতনা সাপেক্ষে— আপাতঃ দৃষ্টিতে তাকে পূর্ণ মনে হলেও, প্রকৃত অর্থে তাকে শুধু পরম চৈতন্যময় পরমাত্মা** বলা-ই ঠিক হবে। এখানে একমাত্র পরমাত্মা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

তার অন্তরের গভীরে অতি ক্ষীণ মাত্রায় অপূর্ণতা রয়েছে। রয়েছে অতি ধীর এবং সূক্ষ্ম মাত্রায় সক্রিয়তা। তার বহির্ভাগ প্রায় নিস্তরঙ্গ— নিরুত্তেজিত মনে হলেও, রয়েছে চাপা উত্তেজনা।

বাস্তবে, পূর্ণতঃ বিরাম এবং পূর্ণ সক্রিয়াবস্থা বলে কিছু নেই। সর্বোচ্চ বিরাম বা নিষ্ক্রিয় অবস্থার মধ্যেও অতি সামান্য হলেও থাকে কিছু সক্রিয়তা। বিপরীত ক্ষেত্রেও তা’ই। বিরাম অবস্থা থেকে পুনরায় কর্মারম্ভ হয়, নিদ্রা-জাগরণের মতো।

পরমসত্তা হলো পরমাত্মার দিব্যশরীর সহ দিব্যমন। সামগ্রিকভাবে যা জন্ম-মৃত্যু রহিত— অবিনশ্বর। সাদৃশ্যে মন্ডলাকার। তার কেন্দ্রাভিমুখে ঘনত্ব— তাপ ও চাপ ক্রমশ বেশি।

একসময় পরমাত্মার নিদ্রাকাল শেষ হলো। পরম কালের (মহাকাল নয়) সকাল হলো যেন। নিদ্রাবসানের সাথে সাথে আমাদের যেমন, বিভিন্ন চাহিদা— বিভিন্ন ইচ্ছা জাগ্রত হয়, যেমন— কর্মেচ্ছা, সুখ ও আনন্দ লাভের ইচ্ছা, পূর্ণতা লাভের ইচ্ছা— যা সাধারণ মানুষের অজ্ঞাতে কাজ করে, তার চেতনা সাপেক্ষে— নানা প্রকার হওয়া ও বহু কিছু করা, এবং বহু কিছু পাওয়ার ইচ্ছা রূপে। একাকীত্ব দূর করতে এবং পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে— প্রিয় সঙ্গ লাভের ইচ্ছা জাগে। প্রায় অজ্ঞান মনের অপূর্ণতার চাহিদা মেটাতে এইরূপ ইচ্ছা, —যেন ওকে পেলে বা ঐ বস্তুটা পেলে আমি সুখি হবো— আমি পূর্ণ হবো। আমার একাকীত্ব দূর হবে। এক জীবনে পূর্ণতা লাভ এবং অমরত্ব লাভ সম্ভব নয় বলে, এবং সেইসঙ্গে একাকীত্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্য থেকেই সৃষ্ট হয় সন্তান লাভের ইচ্ছা। জীবন ধারণ এবং রসনার সুখ লাভার্থে আহারের ইচ্ছা বা চাহিদা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে আরেকটু বিকশিত হলে, আত্মজীজ্ঞাসা জাগ্রত হলে, তখন আত্মজ্ঞান লাভের এবং সচেতনভাবে বিকাশলাভের ইচ্ছা প্রভৃতি একে একে জাগ্রত হতে থাকে নিদ্রা অবসানে।

পরমাত্মারও— নিদ্রান্তে প্রায় অনুরূপ কিছু চাহিদা ও ইচ্ছার উদ্রেক হলো। আমাদের ইচ্ছাগুলি যেমন মন ও শরীরের নানা চাহিদারই বহিঃপ্রকাশ বা মনঃপ্রকাশ, তেমনই পরমাত্মার ক্ষেত্রেও। ঐ চাহিদার পিছনে রয়েছে তার মন ও শরীরাভ্যন্তরের ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারূপ নানা ঘটনা।

নিদ্রান্তে এইসব চিন্তা-ভাবনা থেকে— পরমাত্মার শরীরাভ্যন্তর কেন্দ্রে ক্রমশ তাপ-চাপ —উত্তেজনা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেখানকার যুগ্ম আদি-কণাগুলি মিলে মিশে, ভেঙেচুরে সৃষ্টি হতে থাকে নতুন নতুন কণা— নতুন নতুন পদার্থ। ক্রমশ অন্তরের গভীরে চলতে থাকে মহাসৃষ্টিসহ সৃষ্টি-বীজ তৈরীর প্রস্তুতি।

পরমাত্মা নিজের অবস্থা ভেবে ও বুঝে, আর কোনো গতি না দেখে, অগত্যা, অবশেষে নিজের চাহিদা মেটাতে এক সুন্দর উপায় উদ্ভাবন করে। প্রথমে সে (প্রোগ্রামীং কোড-এর মাধ্যমে)— নিজের অনুরূপ একটি ক্ষুদ্র মায়া অস্তিত্ব (ভার্চুয়াল এক্সিস্টেন্স) তৈরী করে — নিজের মধ্যে। তারপর, পরমাত্মার নির্দেশ বা ইচ্ছানুসারে তার দ্বারা সৃষ্ট সেই মায়া-সত্তা— স্ব-অভিভাবন বা আত্ম-সম্মোহনমূলক স্ব-অভিভাবন দ্বারা গভীর যোগনিদ্রার (সম্মোহন-নিদ্রার) মধ্য দিয়ে নিজেকে ঘনীভূত— কেন্দ্রীভূত ক’রে বীজাকার প্রাপ্ত হয়। নিজের রূপ-গুণ-চেতনা, জ্ঞান-শক্তি-ক্ষমতা প্রভৃতি সমস্ত কিছুকে বীজ আকারে পরিণত করে সে। নিজেকে অস্ফূট-জ্ঞান বা অজ্ঞান প্রাক-শিশুচেতন— অর্থাৎ ভ্রুণ চেতন স্তরে পর্যবসিত ক’রে, —নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পুনরায় নিজেকে খোঁজার— আবিষ্কারের খেলায় মেতে উঠবে ব’লে।

“নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে ফেলে, —আবার তাকে খোঁজা-খুঁজির কানামাছি খেলাই হলো সৃষ্টি রহস্যের মূল কথা।” —মহর্ষি মহামানস

===============================================================

*‘এখন’ কিন্তু বর্তমান কাল নয়, সৃষ্টিপূর্ব কোনো এক সময়।

**আদিসত্তার ক্ষেত্রে ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে— বোঝানোর সুবিধার জন্য।

==============================================================

এরপর, পরমাত্মার সেই মায়া-সত্তা (ভার্চুয়াল এক্সিস্টেন্স) নিজেকে ক্রমশ সঙ্কুচিত ক’রে বীজাকারে একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়— পরমাত্মার মধ্যস্থলে। তারপর ক্রমসংকোচনের এক বিশেষ পর্যায়— পরমাত্মার কেন্দ্রস্থলে অকল্পনীয় তাপ—চাপ ও ঘনত্বের ফলে, সেই বহু বিশ্ব-বীজের সমষ্টিরূপ সৃজন-ফলটির মধ্যে ঘটে এক বিস্ফোরণ। আদি বিস্ফোরণ! বিস্ফোরণের মধ্যদিয়ে সেই আদি সৃষ্টি-বীজ ফেটে বহুবিভক্ত হয়ে, সৃষ্টি হয়— বহু বিশ্ব-বীজ।

পরমাত্মার কেন্দ্রস্থল থেকে সেই বিশ্ব-বীজগুলি দশদিকে— কেন্দ্র থেকে সবেগে ছিটকে বেড়িয়ে আসে। বিশ্ব-বীজগুলির মধ্যে রয়েছে, সমসংখ্যক বিশ্ব-বীজ এবং সম-বিপরীত গুণ সম্পন্ন বিশ্ব-বীজ। বিপরীত গুণ সম্পন্ন বীজগুলি একে অপরের সাথে মিলিত হলে, লয় প্রাপ্ত হবে উভয়েই। এরা হলো পরস্পর বিপরীত বিশ্ব-বীজ — অর্থাৎ বিপরীত বিশ্বের বীজ। একসম্‌য়, প্রত্যেকটি বিশ্ব-বীজের মধ্যে ঘটলো মহা বিস্ফোরণ, প্রায় একই সময়ে। — অবিলম্বে অঙ্কুরোদ্গম ঘটিয়ে, কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে— ক্রমে মহীরূহ হয়ে উঠতে, তারা শুরু করলো আত্ম-বিকাশের পালা।

বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সম্প্রসারিত হতে থাকলো প্রত্যেকে— বহু মহাবিশ্ব রূপে! তাদের অভ্যন্তরেও নিরন্তর ঘটে চলেছে অসংখ্য বিস্ফোরণ—। ভাঙা-জোড়া, পরিবর্তন, রূপান্তর, নব নব সৃষ্টি—ধ্বংস, অজস্র বিচিত্র ঘটনা। সৃষ্টি—স্থিতি—গতি—লয়-এর ঘটনাচক্রে এ’সব কিছু ঘটে চলেছে পরমাত্মার শরীরাভ্যন্তরে সৃষ্ট এই মহাবিশ্বগুলির মধ্যে। সদ্যোজাত বিশ্বগুলি বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, এবং প্রত্যেকটি বিশ্ব নিজ নিজ কেন্দ্র থেকে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। ক্রম-প্রসারমান বিশ্বগুলি নিকটবর্তী বিপরীত বিশ্বের সংস্পর্শে এলেই তখন উভয় বিশ্বসহ সমস্ত সৃষ্টি-ই লয় প্রাপ্ত হবে।

আর সে—, সেই আদিসত্তা— পরমাত্মা চুপটি ক’রে উপভোগ করছে— সয়ংক্রিয়ভাবে—পরম্পরাগতভাবে ঘটে চলা— এই সৃষ্টি-লীলা।

এদিকে এরা— বেচারা! — নিঃস্বপ্রায় অজ্ঞান-অচেতন-অসহায় শৈশব অবস্থা থেকে হাঁটি-হাঁটি পা-পা ক’রে এগিয়ে চলেছে পূর্ণবিকাশ লাভের উদ্দেশ্যে। এই ক্রমবিকাশমান বিশ্বগুলির মধ্যে একটি হলো— আমাদের মহাবিশ্ব! তারমধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ হলো আমাদের এই মানব-গ্রহ— পৃথিবী।

এইভাবে চলতে চলতে— অঙ্কুর থেকে কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে একটু একটু ক’রে ক্রমবিকাশের পথ ধরে অবশেষে লাভ করবে তারা পূর্ণ আত্ম-বিকাশ! আদি বীজ-কোষস্থ সফটওয়ারের মাধ্যমে— আদি বীজ-কোষের মধ্যে সাংকেতিক ‘প্রোগ্রাম’ আকারে নথিভূক্ত থাকা ভবিষ্যত কার্যকলাপের পরিকল্পনার ভিত্তিতে— একের পর এক ঘটতে থাকবে বহু বিচিত্র ঘটনাবলী।

তবে, এই প্রোগ্রামের মধ্যে মূল উদ্দেশ্য— আত্মানুসন্ধান— আত্মোপলব্ধি— আত্মবিকাশ প্রভৃতি আদি ইচ্ছাগুলি অন্তর্গ্রথিত থাকলেও, কখন কী ঘটবে—, কবে—কোথায়— কার দ্বারা কীভাবে কী ঘটবে, এ’সমস্ত নির্দেশ বিশদভাবে সেখানে উল্লেখ নেই। তাহলে তো খেলার আনন্দই থাকে না! এ’সবই ঘটছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাগ্যক্রমে (ভাগ্য সম্পর্কে বিশদভাবে ‘ভাগ্য আসলে কী’ প্রবন্ধে আলোচনা করেছি)।

বিকাশের নানা মাত্রায় একের পর এক ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। নানা পরিবর্তন— রূপান্তর, এবং সেই সাথে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনার ক্রমবিকাশ লাভ।

সৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, —চলছে তার ক্রমবিকাশ। এই অবসরে পরমাত্মার মনের অন্দর-মহলে একটু উঁকি দেওয়া যাক—।

পরমাত্মা নিদ্রান্তে— জাগ্রত হয়ে, বিগত সকালগুলির মতোই আবার কর্মজীবন শুরু করেছে। সে জানে, নতুন ক’রে পাওয়ার কিছু নেই —করারও কিছু নেই। সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া— খাড়া বড়ি থোড়’, —একভাবে জীবন চলছে।

চাওয়ার যে কিছু নেই, তা’ নয়। কিন্তু চেয়ে কোনো লাভ নেই—। তাই সে তার সমস্ত চাহিদাকে ‘বুকের মাঝে পাষাণ চাপা দিয়ে’ শুইয়ে রেখেছে। কিন্তু তা’তে কি হবে, সেই চাহিদার কীট— ভিতরে ভিতরে তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আনমনা ক’রে তুলছে কখনো কখনো। কখনওবা অস্থির— উত্তেজিত— অসন্তুষ্ট— হতাশাগ্রস্ত— বিষাদ-বিমর্ষ ক’রে তুলছে তাকে।

তবে এ’ সমস্তই অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতির হৃদয়াবেগ। মাত্রারিক্ত হয়ে ওঠেনি কখনও। তাই বাইরে থেকে আপাতঃ দৃষ্টিতে সে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ এক পূর্ণ চেতনাময় নির্বিকার সত্তা। যেন, আপনাতে আপনি মগ্ন। শান্ত— সমাহিত— প্রসন্ন, সব পাওয়া— সব হওয়া— সব থাকার এক উজ্জ্বল মহিমামন্ডিত পূর্ণ রূপ!

কিন্তু কি সেই অভাব, কী সেই চাহিদা, যা আজও তাকে সক্রিয়—জীবন্ত ক’রে রেখেছে! যার জন্য হতাশা ভুলতে, আনন্দ—উত্তেজনার আগুন পুইয়ে একঘেয়েমীর শীতলতা কাটাতে, আবার কখনও উত্তেজনা দিয়ে উত্তেজনার প্রশমন ঘটাতে, —একা একাই দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে খেলার আয়োজন করতে হয়েছে তাকে বারবার। কেন, কিসের জন্য—?

এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, তার ক্ষমতা— অক্ষমতা, জানা— অজানা, ইচ্ছা— অনিচ্ছার কতটা হদিশ পাওয়া যায়।

সে তার ইচ্ছামতো অনেক কিছু করতে পারে। পারে, —তবে তা’ শুধু তার অঞ্চলের বা শরীরের মধ্যেই—। তার শরীর-মন অনেকটাই তার নিয়ন্ত্রণাধীন। শরীর-মনের মধ্যে যা কিছু ঘটছে— যা কিছু আছে, সে সম্পর্কে সে অবগত। কিন্তু সে পরম শূন্যপথে অন্যত্র কোথাও যেতে অক্ষম। নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে অক্ষম। সে নিজেকে নিয়েও যা খুশি করতে পারে না। পারে না নিজের আয়তনকে সঙ্কুচিত বা প্রসারিত করতে, অথবা নিজেকে দ্বিগুণ বা তার বেশি সত্তায় পরিণত করতে। আর পারে না বলেই, সে নিজের উপাদানে এক ক্ষুদ্র মায়া প্রতিরূপ সৃষ্টি ক’রে, তার মধ্য দিয়েই নিজের ইচ্ছাপূর্তি ঘটিয়েছে বারবার।

তার এই সমস্ত ইচ্ছা কিন্তু অনেকাংশে তার শরীর ও মন নির্ভর। সে শরীর অন্যরূপ— অন্যবস্তু বা অন্য পদার্থে তৈরী হলেও তা’ শরীর-ই। আমাদের মতোই তার ইচ্ছাগুলিও উৎপন্ন হয় কার্য-কারণের উপর ভিত্তি করে। তার ইচ্ছাও যথেচ্ছভাবে সৃষ্টি হয় না। সে-ও উৎপন্ন হয় তার শারীরিক-মানসিক গঠন-উপাদান, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও কাল সাপেক্ষে, এবং নেপথ্যে থাকা ঐচ্ছিক-অনৈচ্ছিক অজানা শক্তির প্রভাবে।

সে তার শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। সে জানে, সে কোথাও যেতে অক্ষম। জানে, তার ক্ষয় নেই, বৃদ্ধিও নেই। কিন্তু সে জানে না, তার জন্ম রহস্য! তার শুরু ও শেষ, জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। যেন, তার শুরু নেই— শেষ নেই, —এভাবেই চলছে—চলবে। প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কী এই পরমশূন্য থেকেই হয়েছে তার সৃষ্টি?! পরম শূন্যের মধ্যেই কী লুকিয়ে আছে আদিসত্তার সৃষ্টিরহস্য?!

মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে, কে— সে, কোথা থেকে— কিভাবে এসেছে বা উৎপত্তি হয়েছে, কি উদ্দেশ্যে তার জীবন! কি তার পরিণতি। কোথায় শুরু— কোথায় শেষ এই পরম শূন্যের! কে তার স্রষ্টা! কোথাও তার দোসর আছে— কী নেই, এইসব প্রশ্ন জাগে মনে।

পরমশূন্যের মধ্যে অন্যত্র কোথায় কি আছে, কোথায় কি ঘটছে, সে জানে না। সে এটুকু জানে, পরম শূন্যের মধ্য দিয়ে কোনো আলোক, তরঙ্গ, শক্তি, বিকিরণ বা তার জানা কোন কিছুই যেতে বা চলতে সক্ষম নয়। সেখানে দৃষ্টি প্রসারিত হয় না— নিঃসীম অন্ধকার।

সে জানে, কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার নেই, —দেওয়ারও নেই কাউকে কিছু। —এত কিছু সত্বেও তার আলস্য নেই, কারণ তার মধ্যে রয়েছে প্রবলতম জীবনীশক্তি— পরম প্রানশক্তি। আছে তীব্র কর্মেচ্ছা— প্রচন্ড উদ্দীপনা। যার জন্য সে চিরকাল এত সক্রিয়— জীবন্ত!

আপাততঃ অতীত ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, অজানা নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে— ঘটমান বর্তমানের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পরমানন্দে সে উপভোগ ক’রে চলেছে তার জীবন। সদানন্দ শিশুর মতোই খেলা নিয়ে মেতে আছে সে। প্রতিবারের মতো, খেলা শেষ হলে, দামাল শিশুর মতোই পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রার কোলে নিজেকে সঁপে দেবে সে— আদিসত্তা—পরমাত্মা।

আর বিশ্বাত্মা** — বিশ্বাত্মা বা ইশ্বর বলতে এখানে, আমাদের বিশ্ব-অস্তিত্বকেই বোঝানো হয়েছে। এই বিশ্ব-অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে একটি মন— বিশ্ব-মন। এখানে ‘ঈশ্বর’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে সবার বোঝার সুবিধার্থে। আমরা তাকে ‘বিশ্বাত্মা’-ই বলে থাকি।

আমাদের বিশ্বের নিকটবর্তী বিপরীত বিশ্বের মধ্যেও রয়েছে একটি বিশ্ব-মন। আমাদের বিশ্ব —যে বিশ্বে অবস্থান ক’রে— আমি বলছি, তুমি শুনছো। অথবা আমি লিখছি, তুমি পড়ছো। অপর বিশ্বেও তুমি আছো— আমি আছি। এখানে যা কিছু আছে, যা কিছু ঘটছে— সব কিছু সেখানেও আছে, সেখানেও ঘটছে। সে বিশ্বের সাথে এ’ বিশ্বের প্রত্যক্ষ কোনো যোগ না থাকলেও, আছে এক অদৃশ্য আন্তরীক টান।

বিপরীত কণা দিয়ে গঠিত হলেও, সে বিশ্বের সব কিছু এই বিশ্বের মতোই। সেখানকার ‘তুমি’ —‘আমি’ এখানকার তুলনায় বিপরীত গুণ ও চরিত্র বিশিষ্ট নয়। এদের বিপরীত গুণ তখনই বোঝা যাবে, যখন এখানের ‘আমি’ আর ওখানের ‘আমি’ অথবা উভয় বিশ্ব পরস্পর প্রত্যক্ষভাবে মিলিত হবে। মিলিত হবার সাথে সাথেই উভয় ‘আমি’ সহ উভয় বিশ্বই লয় প্রাপ্ত হবে তখুনি। আবার, এরা বিপরীত ধর্মী হলেও, পরস্পরের প্রতি পরস্পর তীব্র আকর্ষণ বোধ করে থাকে।

এবার আমাদের বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক—। মহা বিশ্বরূপ শরীর, বিশ্বমন, বিশ্বশক্তি স্বরূপ মহাপ্রাণ-শক্তিসহ সমগ্র বিশ্বসত্তাই— ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা)। তার দেহ আছে, মন আছে, আছে নানারূপ কামনা-বাসনা, নানা কর্মকান্ড। সে অধিকাংশ গুণ, শক্তি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কামনা-বাসনা, জ্ঞান-চেতনা প্রভৃতি লাভ করেছে আদিসত্তা—পরমাত্মা থেকে —জন্মসূত্রে। কিন্তু সে সবই সুপ্তাবস্থায় রয়েছে— রয়েছে বিকাশের অপেক্ষায়।

বিশ্ব-শরীর বলতে এই পৃথিবীই নয়, পৃথিবীর মতো ছোট-বড় অনেক গ্রহ-উপগ্রহ আর অসংখ্য গ্রহাণু এবং এক বা একাধিক নক্ষত্র নিয়ে গঠিত সৌরজগতের মতো এক একটি নক্ষত্র-জগত। এমনই কোটি কোটি নক্ষত্র-জগত নিয়ে এক একটি নক্ষত্রপুঞ্জ। আর ঐরূপ লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রপুঞ্জ নিয়ে এই বিশাল বিশ্বরূপ ঈশ্বর শরীর। এই শরীরের মধ্যে রয়েছে— অদ্ভূত অদ্ভূত কত কী! আদিকণা— পরামানু—অতিপরমানু থেকে আরম্ভ ক’রে ধূমকেতু, নোভা, সুপার-নোভা, ব্ল্যাক-হোল, ডার্ক-ম্যাটার, ডার্ক-এনার্জী প্রভৃতি কতো কী। আছে বহু বিচিত্র জীব, চেতন-সত্তা— উদ্ভীদ আর বিচিত্র বিষয়-বস্তু।

মহাকাশ: সমগ্র বিশ্বজুড়ে--- একটি বুদবুদ (Bubble)-এর মতো বহুমাত্রিক (Multidimensional), আপাতদৃষ্টিতে অবাধ অথবা প্রায় অবাধ শূন্যস্থান অস্তিত্বকে মহাকাশ বলা হয়ে থাকে।

মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের এই মহাকাশ (Space) অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এবং মহাবিশ্বের সাথে সাথে ক্রমশই এই মহাকাশ প্রসারিত হয়ে চলেছে। এই মহাকাশ আসলে একপ্রকার অদৃশ্য অননুভূত— বিশেষ কম্পাঙ্কের কণা দিয়ে গঠিত এক বিশেষ অস্তিত্ব। কোষবিভাজন প্রক্রিয়ার মতো এই কণাগুলি প্রয়োজনে চক্রবৃদ্ধিহারে নিজেদের বৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বিজ্ঞান এখনো তাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি।

সাধারণভাবে, এই মহাকাশ আমাদের কাছে অদৃশ্য অননুভব‍্য এক অস্তিত্ব। তাই একে মহাশূন্য বলা হয়ে থাকে। তাইবলে, এই মহাকাশ পরমশূন্য নয়। পরমশূন্য রয়েছে মহাবিশ্বের বাইরে যে বহু মহাবিশ্বের সম্মিলিতরূপ মহাসৃষ্টি অবস্থান করছে, তার বাইরে— আদিসত্তারও বাইরে।

আমাদের এই মহাকাশ মোটেও শূন্য নয়। সে তার নিজস্ব অস্তিত্ব ছাড়াও, নানারূপ মহাজাগতিক রশ্মি—শক্তি, কণা এবং বিকিরণে ভরে আছে। সেইসব শক্তি ও কণাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আকর্ষণ-বিকর্ষণ সহ বিভিন্নরূপ কার্যকলাপে সাধারণত সে অংশগ্রহণ করে না। সে নিরপেক্ষ— নিষ্ক্রিয় নির্বিকার।

মহাকাশের মধ্যেই যে বিশ্বের সমস্ত কিছু অবস্থান করছে, শুধু তাই নয়, সমস্ত কিছুর মধ্যে বা ভিতরেও মহাকাশ রয়েছে বা বিরাজ করছে। মহাকাশ কোন কিছুকে ধারণ করে না— বর্জনও করে না।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই— মহাকাশ ছাড়াও আরো দুটি অব‍্যক্ত অননুভবনীয় স্বতন্ত্র ভার্চুয়াল অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছে। তা হলো 'সময়' আর 'ভাগ্য' (সময় বা Time ও ভাগ্য বা Destiny সম্পর্কে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। কেউ কেউ মহাকাশ আর সময়-কে মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু সময় ও মহাকাশ দুটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। সময় আর মহাকাশের মধ্যে বড় সম্পর্ক হলো— তারা একইসঙ্গে একই ঘটনা থেকে জন্ম নিয়েছে।

জলাশয়ের জলের ভিতরে মাছ যেমন, অনেকটা তেমনই এই মহাকাশের মধ্যে আমাদের অবস্থান। আমাদের সবদিকে— ভেতরে ও বাইরে রয়েছে মহাকাশ। এই অরূপ মহাকাশকে কেউ কেউ তাদের ধারণা বা কল্পনা মতো বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেগুলির কোনটিই এই রহস্যময় মহাকাশের প্রকৃত রূপ বা অবয়ব নয়। মহাকাশ এখনও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে।

মহাকাশকে বুঝতে হলে, একেবারে মূল থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। পরম শূন্যের মধ্যে আদিসত্তার অবস্থান। আর তার মধ্যেই বহু মহাবিশ্বরূপ মহাসৃষ্টি সহ বহু মহাকাশ জন্ম নিয়েছে। মহাবিশ্বগুলির অন্তরবর্তী শূণ্যস্থানকে বলাহয়— অতিমহাকাশ। সৃষ্টিতত্ত্বের শুরুতেই পরমশূন‍্য সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। সেই পরমশূন‍্যের মধ্যে আদিসত্তার অবস্থান। আর সেই আদিসত্তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে মহাসৃষ্টি। বহুসংখ্যক মহাবিশ্ব নিয়ে এই মহাসৃষ্টি। তারমধ্যে একটি হলো আমাদের এই মহাবিশ্ব।

আদি বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু মহাবিশ্ব-বীজ দিয়ে গঠিত ফল রূপ--- প্রাক মহাসৃষ্টি। আর, একসময় এই ফলটির মধ্যে থাকা বিশ্ববীজগুলির মধ্যে সংঘটিত হয় মহাবিস্ফোরণ। যা থেকে ক্রমশ অঙ্কুরিত হয়ে— অসংখ্য মহীরুহের মতো বিকশিত হয়ে চলছে মহাবিশ্বগুলি।

বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) জন্ম একটু আগেই পর্যবেক্ষণ করেছি—। এখন দেখছি, আমাদের মতো তারও আছে শৈশব, কৈশোর, যৌবন প্রভৃতি। আছে পরিণতির দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া। বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর মনও ক্রমবিকাশমান। অস্ফূট জ্ঞান ও চেতনা থেকে পূর্ণ জ্ঞান ও চেতনার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান চেতনালাভের মধ্য দিয়ে তার জীবন-চলা।

অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে শিশুর মতো হাঁটী হাঁটি পা-পা ক’রে তার যাত্রা শূরু। যত চলছে— ততই তার অজ্ঞানতা— মোহ-মায়া-অন্ধত্ব থেকে মুক্তি ঘটছে। ক্রমশ নব নব চেতনার আলোয় আলোকীত হয়ে উঠছে তার জীবন। তার মোহ-মায়া সম্পন্ন, স্বল্প-জ্ঞান ও অন্ধ আবেগ সম্পন্ন অবচেতন অংশ-মনই হলো— মহামায়া (‘মন’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

অতি-শৈশব কেটেছে ঘোর অজ্ঞানতার মধ্য দিয়ে, দুর্বার—দুরন্ত গতিতে বেড়ে ওঠা—। শৈশবও কেটেছে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ছোটাছুটি— খেলেধুলায় খেয়াল-খুশি মতো কাজ করে, অসচেতনভাবে— ভিতরের তাড়নায়। কৈশোরে কিছুটা সচেতনতা এলেও, মোহ-মায়া, অজ্ঞান-অন্ধত্ব, অন্ধ-আবেগের বশে— খামখেয়ালীপনার সাথে কাম-পীড়িত হয়ে পেরিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। একই সময়ে দুটি ভিন্ন চেতন-স্তরের ভিন্নধর্মী দুটি সক্রিয় মনের (‘মন’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) উপস্থিতির কারণে, মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে যেমন বৈপরীত্য দেখা যায়, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের মধ্যেও ঠিক তেমনই ঘটে।

এইভাবে ক্রমশ এগিয়ে চলতে চলতে— চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে সে একটু একটু ক’রে বুঝতে থাকে নিজেকে। তার শক্তি, ক্ষমতা, কর্ম, লক্ষ্য— উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ। এতদিন অজ্ঞাতসারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে* খেলা চলেছে। এবার আস্তে আস্তে শুরু হয় সজ্ঞানে সচেতনভাবে চলার পালা। বিভিন্ন সময় চেতনার ক্রমবর্ধিত মাত্রা অনুসারে, তখনকার পরিবির্তিত মনোভাব— কামনা-বাসনা অনুযায়ী নানা উদ্দেশ্যে খেলতে থাকে সে। নিজেকে নিয়ে খেলা— সৃষ্টিলীলা।

=========================================================

* আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্যবিহীন মনে হলেও, সে কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই প্রাক সংস্কার বা প্রি-প্রোগ্রামিং মতো লক্ষ্যপানেই এগিয়ে চলেছে।

** বোঝানোর সুবিধার্থে— ‘ঈশ্বর’ বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রচলিত ‘ঈশ্বর’ ধারণার সাথে ‘বিশ্বাত্মা’-র অনেক অমিল আছে।

==============================================================

যথেষ্ট চেতনা লাভের সাথেসাথে জাগে আত্ম-জিজ্ঞাসা। —ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার উত্তর সন্ধানে। খেলাধুলা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসে—। শুরু হয়ে যায় তার মহৎ লক্ষ্য পানে— আত্মানুসন্ধানের* লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। ক্রমশ দ্রুত বিকাশের লক্ষ্যে— পূর্ণতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলার নতুন খেলা।

ক্রমশ আরো চেতনা বৃদ্ধি পেলে, একটু একটু ক’রে আত্মজ্ঞান লাভ করতে থাকে সে। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসে অনেক কিছু—। পরিণত হয়ে ওঠে সে ক্রমশ।

আমি কে—, কেন্—, কোথা থেকে এসেছি—, কোথায় যাব—, কি উদ্দেশ্যে আমি সৃষ্ট হয়েছি—(?) —এ’ প্রশ্ন আজ নতুন নয়। এ’ প্রশ্ন আমার— তোমার সকলের অন্তরে জ্ঞাতে—অজ্ঞাতে অনুক্ষণ অনুরণিত হয়ে চলেছে— সৃষ্টির আদি কাল হতে। এই প্রশ্নই সৃষ্টিলীলার মূল কারণ।

আমি যেমন নিজেকে প্রশ্ন করছি, ‘আমি কে—কেন—কোথা থেকে—কোথায়’, বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বরও) তেমনি নিজেকে এই একই প্রশ্ন করছে। আবার, আদিসত্তা— পরমাত্মাও এই একই প্রশ্নবাণে জর্জরিত ক’রে তুলছে নিজেকে!

আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে শিকড়ের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়াই হলো— এই মহাজীবন-চলা। একেই অনেকে ‘সৃষ্টিলীলা’ বলে থাকেন। আসলে, এই সৃষ্টি— পরমাত্মার কল্পনা-বিলাস বৈ আর কিছু নয়। এ’সমস্তই তার মানস-সৃজন। সেই হিসাবে, ঈশ্বরকে তার মানস-সন্তান-ও বলা যেতে পারে।

পরমাত্মা নিজের জীবনে যে সমস্ত ইচ্ছা পূরণে অক্ষম হয়েছে, কল্পনার মধ্য দিয়ে— সেই সমস্ত ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যেই তার এই লীলা-খেলা বা সৃষ্টিলীলা।

বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর)— শুধু আত্মানুসন্ধানেই নয়, সেই সাথে তার স্রষ্টার খোঁজেই শুধু নয়, এছাড়াও আরও একটি খোঁজ চলতে থাকে তার (বিশ্বাত্মার বা ঈশ্বরের) মধ্যে জ্ঞাতে—অজ্ঞাতে, তা’ হলো তার দোসরের খোঁজ। একাকীত্বের পীড়ায় পীড়িত হয়ে, কামনা-বাসনায় জর্জরিত হয়ে, অতঃপর বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর) মনে মনে স্থির করে, ‘হ্যাঁ, আমার প্রধান লক্ষ্য হলো নিজেকে জানা। তবে তার সাথে এ-ও দেখতে হবে, এখানে আমি একা— না আমার কোনো দোসর আছে।’#

কিন্তু কি ক’রে তা’ সম্ভব! সে শুধুমাত্র নিজেকে সম্প্রসারিত— বিস্ফোরিত করতে সক্ষম। বহু বিশ্ব নিয়ে গঠিত— মহাসৃষ্টির সম্প্রসারণের ফলে নির্ধারিত পথে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া, পরমাত্মার শরীরের (বা ব্রহ্মাঞ্চলের) অন্য কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা— নতুন উদ্যোমে জলন্ত গ্যাসীও অগ্নিপিন্ডের মতো কোটি কোটি অংশে বিভক্ত হয়ে, দুরন্ত গতিতে দশদিকে প্রসারিত হয়ে— দিগবিজয়ে বেড়িয়ে পড়ে সে।** যেন রাজ্য জয়ের মহোৎসবে— মহাশূন্য জুড়ে আতসবাজীর খেলা। কখনো একটা খণ্ড ভেঙে অনেক ছোট ছোট টুকরো হচ্ছে, আবার কখনো অনেক টুকরো মিলিত হয়ে একটা বড় খণ্ড অথবা গ্রহ— নক্ষত্র তৈরী হচ্ছে।

দুর্দম—দুরন্ত গতিতে নিজেকে প্রসারিত ক’রে এগিয়ে চলা—। পিছনে তাকানোর মতো একটুও সময় নেই হাতে। একের পর এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়, চক্রবৃদ্ধিহারে কোষ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে— অবিরাম চলা।

ক্রমবিকাশমান চেতনার বিভিন্ন স্তরে, কল্পনার রঙে-রূপে-রসে —নিজেরই উপাদানে নিজেকে গড়ছে—ভাঙছে বারবার। যাত্রাপথের একঘেয়েমী দূর করতে, নিজেকে রসে-বশে আনন্দময় রাখতে, বিভিন্ন উপায়ে বা পথে কাম-তাড়নার প্রশমন ঘটাতে— সদা সক্রিয় সৃজনশীল শিল্পী-মন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

#মহাসৃষ্টিতে আরও অনেক বিশ্ব (দোসর) থাকলেও, প্রথমদিকে বিশ্বাত্মা তাদের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ক্রমবিকাশের পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে এসে, পরবর্তীকালে সে তার দোসরের সন্ধান পায়।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------

আদি ইচ্ছাকে সফল ক’রে তুলতে, আনন্দ পেতে— আবিরাম চিন্তা-যজ্ঞ চলছে। দ্রুত সিদ্ধিলাভ চাই, আবার একঘেয়েমী থেকে মুক্তি পেতে চাই বৈচিত্র, চাই সুখস্বাদ। শিল্পীমন মেতে আছে নবনব সৃষ্টির তাড়নায়। প্রকারান্তরে— পূর্ণতা লাভের আকাঙ্খায়।

নিরন্তর গবেষণায় নিত্য-নব রূপে— বহুভাবে নিজেকে করছে আবিষ্কার। স্রষ্টা সে— সৃষ্টিও সে-ই। সৃষ্টির আনন্দে মশগুল শিল্পী-গবেষক বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর— অনেক পথ পেরিয়ে এসে, এখন সে অনেকটাই পরিণত।

মহা সৃষ্টির আনন্দে মত্তপ্রায়— অপরিসীম সুখাবিষ্ট মোহাচ্ছন্ন বিশ্বাত্মা (ঈশ্বর)— নতুন আর কী সৃষ্টি করবে, যা কিছু সবই ছিলো বীজ রূপে। জ্ঞান-চেতনা— সমস্ত কিছু। চলতে চলতে সময়ের সাথে সাথে, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে— বিকাশ ঘটছে ধাপে ধাপে। পূর্ব নির্ধারিতভাবে ঘটে চলেছে— যখন যা ঘটার।

এরই নাম ভাগ্য! না, প্রত্যক্ষভাবে এর পিছনে সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি বা চেতন সত্তা নেই। কারো অঙ্গুলী হেলনে বা কারো খেয়াল-খুশিমতো এ’সব কিছু ঘটছে না। ঘটছে— মহাজাগতিক ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক দুটি ভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে। ঐচ্ছিক শক্তি কাজ করছে— আদি বীজ-কোষ এবং সমস্ত বিশ্ব-কোষের মধ্যে অন্তর্গ্রথিত নির্দেশ বা ‘প্রোগ্রাম’ বা ‘প্রি-প্রোগ্রাম’ অনুসারে। আর, অনৈচ্ছিক শক্তি কাজ করছে— ঘটনা প্রবাহের কার্য-কারণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ম মেনে, প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

একটা উদাহরণ দিলেই সমস্ত ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। একটা পটকা অথবা খুব ছো্ট একটা বোমার চারিদিকে কতগুলি মারবেল বা পাথরের টুকরো রেখে,— কাগজ দিয়ে মুড়ে নাও, যেন পটকাটির পলতেটা বাইরে বেড়িয়ে থাকে। এবার একটা পরিস্কার ফাঁকা উঠানে নিয়ে গিয়ে— পটকাটি ফাটিয়ে দাও। বিস্ফোরণের পরমূহুর্তে মারবেল বা পাথরের টুকরোগুলি চতুর্দিকে বিভিন্ন গতিতে— বিভিন্ন ঢঙে— ছিটকে বেড়িয়ে পড়েছে—। লক্ষ্য কর, এক একটা টুকরো এক এক পরিবেশে, এক এক ভাবে পাক খেয়ে অথবা গড়িয়ে চলেছে।

কেউ হয়তো আর একটিকে আঘাত ক’রে ভেঙে দুই বা ততোধিক টুকরো হয়েছে। আবার কোনো টুকরো হয়তো আরেকটিকে আঘাত ক’রে তার আচরণে পরিবর্তন এনেছে। আর, কোনো একটা টুকরো হয়তো এক জায়গায় লাট্টুর মতো পাক খেয়ে চলেছে। এইরকম বহু ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে একই সময়ে। কারো আচরণের সাথে কারো পুরোপুরি মিল নেই।

ওখানে এমন একজন দিব্যজ্ঞানী যদি থাকতেন, —পটকাটি, মারবেল বা পাথরের টুকরোগুলির আকার—আয়তন—ওজন, উপাদানাদি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ-আবহাওয়া প্রভৃতি সমস্তকিছু সম্পর্কে যাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টি— প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে, তিনি বলে দিতে পারতেন— কখন কোন টুকরোটির কি দশা হবে, কার কি গতি বা কি পরিণতি ঘটবে। কারণ, ওদের সবার ভাগ্যই নির্ধারিত হয়ে গেছে পটকাটি ফাটার মূহুর্তেই।

আরো সহজ ক’রে বোঝাতে, ঘুরণ-চরকী লটারী খেলার সাদামাটা যন্ত্রটার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চক্রটি ঘুরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ঠিক হয়ে যায়— তার কাঁটাটি কোন ঘরে বা কত নম্বরে— কখন গিয়ে থামবে।

ঠিক তেমনিভাবে, এখানে যা কিছু ঘটছে, ঘটেছে এবং ঘটবে— সমস্ত কিছুর মূল কারণ নিহিত রয়েছে সেই মহাবিস্ফোরণের মূহুর্তে। একেই বলা হয়— ভাগ্য। ঈশ্বর নিজেও এই ভাগ্যের বাঁধনে বাঁধা। আমরাতো তার অংশমাত্র (‘ভাগ্য আসলে কী’ স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)।

বিশ্বাত্মার (ঈশ্বরের) ইচ্ছা—অনিচ্ছা এবং আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলি সবই, যখন যেটা জাগ্রত হওয়ার— হয়। আমাদের ইচ্ছাও আমাদের নিজস্ব নয়। সে-ও পূর্বনির্ধারিত সময় মতোই জাগ্রত হয়, আবার সময় মতোই তিরোহিত হয়। যখন যেমনটি হবার তেমনটিই হয়।

এই ‘প্রি-প্রোগ্রামড’ ঐচ্ছিক শক্তি আর মহাবিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট ‘ভাগ্য’ রূপ— অনৈচ্ছিক শক্তি, উভয়ে মিলেমিশে কাজ ক’রে চলেছে সর্বক্ষণ।

প্রধাণত অনৈচ্ছিক শক্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে— ভাগ্য! আর, ঐচ্ছিক শক্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছে— বিশ্ব-মন বা ঈশ্বর-মন এবং আমাদের মন। এই মন ও তার ইচ্ছা— চিন্তা-ভাবনা, এও সেই অনৈচ্ছিক শক্তির অধিন। ভাগ্যের তালে তাল মিলিয়ে এই মনের বিকাশ ঘটে চলেছে— একটু একটু ক’রে। ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ইচ্ছুক মন— ঈশ্বর মন-এর জন্ম দিয়ে, আদি ঐচ্ছিক শক্তি— আপাতত নিস্ক্রিয় শক্তিরূপে অন্তরাল থেকে কাজ করে চলেছে সঙ্গোপনে।

মহাজগত বিভিন্ন সময়ে— কখন কী রূপ ধারণ করবে, এবং সেই সঙ্গে জীব এবং অন্যান্য চেতন-সত্তার অস্তিত্ব আর তাদের বিভিন্ন দশার যাবতীয় পরিকল্পনা বীজাকারে— ‘প্রোগ্রাম’ আকারে আদিসত্তার মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। সেই আদিসত্তা থেকে জন্ম নেওয়া সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু—কণাসহ আমাদের তথা জীবের প্রতিটি (দেহ ও মস্তিষ্ক) কোষের মধ্যে সেই ‘প্রোগ্রাম’ বিদ্যমান রয়েছে।

সেই ঐচ্ছিক ক্রিয়া আর ভাগ্যরূপ অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার ঐক্য-বাদনে মহাজাগতিক সুর রচিত হয়ে চলেছে।

==========================================================

* এ’এক অদ্ভূত অন্বেষণ। এই খোঁজার প্রথমদিকে একটা বড় অংশ পর্যন্ত—, কে খোঁজে, কিম্বা কাকে খোঁজে, কেন খোঁজে, কোথায় খোঁজে— এ’ সবই থাকে অজানা। তবু নিজের অজ্ঞাতেই খোঁজ চলতে থাকে— অনবরত, চলতেই থাকে।

** এতদিন ধরে এই চলা— এই ছড়িয়ে পড়া ছিলো অনৈচ্ছিকভাবে— অজ্ঞানে। এখন সেই চলাই— সেই ছড়িয়ে পড়াই সতেজ হলো—, নতুন উদ্যোমে— ইচ্ছাকৃতভাবে— সচেতনভাবে।

==========================================================

পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের বুকে মানুষ এবং বিভিন্নরূপ চেতন-সত্তার চেতনার এই যে ক্রমবিকাশ, এর পিছনেও কাজ করছে সেই আদি উদ্দেশ্য। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের অংশানুক্রমে কোটি কোটি অনুবৎ আমরাও জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে চলেছি ছুটে সেই আত্মজিজ্ঞাসা— সেই আদি প্রশ্ন নিয়ে।

সৃষ্টির শুরুতে— বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের স্বল্প-চেতন-স্তরে, আজকের এই উন্নত জীব— মানুষ এবং অন্যান্য উচ্চ চেতন-সত্তার কল্পনাও তখন অসাধ্য ছিলো তার কাছে। চলতে চলতে নিত্য নতুন চাওয়া-পাওয়া, ভাঙা-গড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নব নব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে— ক্রমশ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি এবং চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই মানুষ এবং অন্যান্য চেতন-সত্তা।

আমাদের জীবনযাত্রার সাথে প্রজাপতির জীবন-চক্রের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায়। প্রথমে ডিম, —আমাদের অতীতের সুপ্ত চেতনাবস্থা। তারপর শুককীট, —ক্রোধ, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা-স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা এবং আত্মরক্ষার অজস্র শুঁয়ো নিয়ে শুঁয়োপোকার মতো আমরা ইহলোকে এবং পরলোকে ভোগ সম্পন্ন ক’রে চলেছি। এই ভোগ শেষে— জ্ঞানযোগ সম্পূর্ণ হলে, সমস্ত কিছু পরিত্যাগ ক’রে দিব্যলোকে— পরলোকোত্তর পরবর্তী জীবনে গভীর ধ্যানমগ্ন বা সমাধিস্থ হওয়া পূর্ণ বিকাশ লাভের উদ্দেশে। —সেই হলো মূককীট অবস্থা। অবশেষে পূর্ণ আত্মবিকাশ— প্রজাপতির মতো।

এখানে আমাদের বিকাশ ঘটছে তিনটি স্তরে। প্রথমটি হলো— বংশানুক্রমে। দ্বিতীয় স্তরের বিকাশ ঘটছে দুই ভাগে, প্রথম পর্ব— ইহলোকে, এই জীবনে। আর দ্বিতীয় পর্বের বিকাশ ঘটছে— পরলোকে। তৃতীয় স্তরের বিকাশ ঘটছে, মহামানব স্তরে— দিব্যলোকে। পরলোকের মধ্যেও রয়েছে ক্রমোচ্চ কয়েকটি ছোট ছোট ক্রমোচ্চ স্তর। পরলোকের সর্বোচ্চ স্তর পার হয়ে পৌঁছাতে হয় মহামানব স্তরে। তার পরেও রয়েছে আরও কয়েকটি ক্রমোচ্চ চেতন স্তর। দেব-চেতন স্তর, মহাদেব-চেতন স্তর, এবং সব শেষে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-চেতন স্তরে উন্নীত হয়ে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বরের সাথে একাত্ম বোধে বিলীন হয়ে যাওয়া (এ’নিয়ে অন্যত্র বিশদভাবে আলোচনা করেছি)।

বংশানুক্রমে যে বিকাশ ঘটছে, তাকেই ডিম্ব অধ্যায় বলা যায়। কারণ, অগণিত পূর্বজদের শরীর-কোষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে জীব সত্তাটি। পূর্বজদের অর্জিত জ্ঞান-চেতনা— যা সংক্রামিত হয় তাদের শরীর-মস্তিষ্ক কোষে, মন সফটওয়ারে এবং তাদের শুক্রকীটে বা ডিম্বকোষে। পূর্বজদের কোষের মধ্যে সুপ্ত থাকা অবস্থাতেই বংশ-পরাম্পরায় ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে ভবিষ্যতের হবু জীবসত্তা।

আমরা সবাই চলেছি সেই এক লক্ষ্য পানে—, কেউ জ্ঞানে, কেউ অজ্ঞানে। তাই কেউ জানে, কেউ জানেনা— আসলে একই পথের পথিক আমরা। জড়বৎ অস্ফূট চেতনা হ’তে পূর্ণ চেতনার পথে, কর্ম আর ভোগের মধ্য দিয়ে অবিরাম চলা—। এখানে কেউ থেমে নেই— থেমে থাকে যায়ও না। পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আরও অনেক কারণে গতির বিভিন্নতা। কেউ আছে এগিয়ে, আর কেউ পিছিয়ে।

আজ এখানে এসে পৌঁছানোর পিছনে রয়েছে লক্ষ-লক্ষ বছরের অজস্র দুঃখ-কষ্টে ভরা দুঃসহ যন্ত্রনাময় ইতিহাস। যতই এগিয়েছি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতা-যন্ত্রনা রূপান্তরিত হয়ে পেয়েছি চেতনা।

আপাতভাবে আমরা এ’ সমস্ত ভুলে গেলেও, সৃষ্টির আদিকাল থেকে— সমস্ত স্মৃতিই সঞ্চিত রয়েছে আমাদের অন্তরের গভীর স্মৃতি-ভান্ডারে। অন্তরের গভীরে ডুবতে পারলেই সব জানা যাবে।

অতীতকে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, কীভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে তিলে তিলে দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা, শোক-সমস্যা-হতাশা, ...নিদারুণ যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে প্রায় জড়বৎ মনে একটু একটু ক’রে চেতনার বিকাশ ঘটে চলেছে। পূর্ণ লক্ষ্যে না পৌঁছানো অবধি এর থেকে রেহাই বা মুক্তি নেই।

যত বেশি উচ্চাকাঙ্খা, যত বেশি বহির্মুখিতা, যত বেশি উত্তেজনা— অস্থিরিতা, বুঝবে, মুক্তি ততই সন্নিকট। এই মুক্তি— অজ্ঞানতা—অন্ধত্ব—বন্ধন, —পরাধীনতা থেকে মুক্তি। মায়া-মোহপাশ থেকে মুক্তি। অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন মোহ, এবং তার থেকে উৎপন্ন বহু জাগতিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি।

আকরিক লৌহ-পিন্ডকে যেমন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-পিটিয়ে, নানাবিধ শোধনের পর, ঘষে-মেজে জাগানো হয় তার ঔজ্বল্য— তার শাশ্বত রূপ, চেতনার বিকাশ-প্রক্রিয়াও তেমনি এক সুসম্বদ্ধ ব্যবস্থা। ভয় পেয়ে, শান্তি বা মুক্তির খোঁজে পালিয়ে গেলেই রেহাই পাবে, তা’ ভেবনা। ভোগ তোমায় সম্পূর্ণ করতেই হবে।

তবে দ্রুত হবে কী বিলম্বিত হবে, এবং কিভাবে হবে— সবই পূর্ব নির্ধারিত। আমরা অসহায়। ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক সম। আমাদের নিজস্ব কিছু করার নেই। যা ভাবছি—, যা করছি্‌—, তা’ না ক’রে উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়ে করছি। যা কিছু করছি, তা’ করতে বাধ্য হচ্ছি বলেই করছি। অজ্ঞানতাবশতঃ মনে হচ্ছে— ‘আমি করছি, আমি বলছি, আমার ইচ্ছায় হচ্ছে বা ঘটছে।’

আমরা! —কেন এই স্বাতন্ত্র বোধ— এই বহুত্ব?! —শুধু বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর সৃষ্ট জীব-জগতেই নয়, এই বহুত্ব মহাবিশ্বের সর্বত্র। একী তবে বিশ্বাত্মার একাকীত্বের দুঃসহ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবার প্রয়াস?!

আসলে, এ-ও তার অদৃষ্ট বা ভাগ্য। মহাবিস্ফোরণের পরক্ষণ থেকে দশদিকে ছিটকে—ছড়িয়ে পড়া ছোট বড় জমাট বাঁধা প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কণা, প্রতিটি অনু-পরমানু সেই চরম আঘাতের ফলে আত্মবিস্মৃত হয়েছে। একত্ব ভুলে স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে ছুটে চলেছে, কর্ম করে চলেছে যে যার অদৃষ্ট মতো। এর পিছনে— সৃষ্টিপূর্বে, আত্মসম্মোহন দ্বারা আত্মবিস্মৃতি সহ অজ্ঞানাবস্থা লাভ-ও এর অন্যতম কারণ।

এ’যেন আমাদের শরীরের মতো। বিভিন্ন ধরণের কোটি কোটি কোষ দিয়ে গঠিত এই শরীর। যেন, প্রতিটি কোষ নিজেকে বোধ করছে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে। কর্ম ক’রে যাচ্ছে যে যার মতো। প্রত্যেকেই যেন এক একটা ‘আমি’। আর এই অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘আমি’ নিয়ে আমি— ‘মহা-আমি’। আজকের এই ‘আমি’ মহাজগতের এক আবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ‘আমি’-কে বাদ দিয়ে— এই মহাজগত-অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নয়, সম্ভবও নয়।

'আমি'! এই জগতটাই আমি ময়। এই চেতন জগতে 'আমি' থেকে মুক্তি নেই। পরম-আমি থেকে ঈশ্বর-আমি, তারপর, অহম-আমি, অহংকারে মত্ত আমি। অস্ফুট আমি থেকে বিকশিত আমি। অবচেতন-মন সেও নিজেকে বলছে, 'আমি'। মোহাচ্ছন্ন অজ্ঞান আমি। আবার —সচেতন-মন সেও নিজেকে বলছে, 'আমি'। সচেতন আমি। আমি হলো চেতন জগতের প্রথম আত্মোপলব্ধীর প্রকাশ! —আমি নেই তো কিছুই নেই!

এই ‘আমি’ যা ভাবছে— যা করছে, তার পিছনে রয়েছে অসংখ্য ঘটনা। কোটি কোটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয়— আরো কোটি কোটি ঘটনা। আবার, সেই সব ঘটনার ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্টি হয় আরো অজস্র ঘটনা।

এইরূপে, ঘটনা-পরম্পরাগতভাবে— বর্তমানে জন্ম নেওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি হলো— এই ‘আমি’-র চিন্তা—ইচ্ছা। আর একটি হলো— এই ‘আমি’-র কর্ম। এদের থেকে আবার জন্ম নেবে অজস্র ঘটনা। এইভাবেই বয়ে চলেছে পরম্পরাগত ঘটনা-প্রবাহ।

‘আমি’-র চিন্তা এবং ‘আমি’-র কর্ম হলো— অতীত ও বর্তমানের অসংখ্য ঘটনার সাথে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত অসংখ্য ঘটনার মধ্যে অজস্র ক্রিয়া-বিক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফল। ‘আমি’-র অস্তিত্ব, ‘আমি’-র কর্ম— সব কিছুই এই জাগতিক ব্যবস্থার ফসল।

তবে, যা-ই ঘটুক, আদি লক্ষ্য— আত্মান্বেষণ ও পূর্ণতালাভের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি কেউই। তা’ ঠিক গাঁথা আছে প্রত্যেকের অন্তরে। আমাদের সার্বিক বিকাশে— হবে তার পূর্ণতা লাভ। পুণরায় আপাতঃ ‘বহু’ থেকে ‘এক’-এ বিলীন হবার স্বপ্নে, প্রত্যেকে চলেছি এক অজ্ঞাত আকর্ষণে।

বিভিন্ন শক্তি—পদার্থ—বস্তু যে উৎস থেকে উৎপন্ন বা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের মনও সৃষ্টি হয়েছে সেই উৎস থেকেই। পরম-চেতনা এবং মহাচেতনা থেকেই আমরা আমাদের চেতনা লাভ করেছি। মহাপ্রাণ থেকেই পেয়েছি আমরা প্রাণশক্তি। মহাবিশ্ব-শরীর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই জীব-শরীর। পরিণতিতে— সমস্ত বস্তু—মন-চেতনা সেই উৎসে গিয়ে মিশে যাবে বা বিলীন হয়ে যাবে একসময়।

আদি শক্তি ও শক্তি-ক্ষেত্র থেকেই বিভিন্নরূপ শক্তি এবং বিভিন্ন ধরণের শক্তিক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি শক্তিক্ষেত্রের মধ্যেই আদি শক্তিক্ষেত্রের ছাপ বা সংকেত অন্তর্নিহিত রয়েছে।

এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু সৃষ্টির মূলে রয়েছে মানসক্রিয়া— চিন্তা। চিন্তা থেকেই ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছাক্রমেই সমস্ত সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এই চিন্তারূপ কর্মটির কর্তা হলো— মন। পরমাত্মার চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে বিশ্বরূপ বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়। আর, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-মনের চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হয়েছে— এই উদ্ভিদ ও জীব জগত।

তারপর, পৃথিবীর চিন্তাশীল জীব মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে আরও কতকিছু। চিন্তা—কল্পনাকে রূপায়ীত ক’রে তোলার ইচ্ছাতেই শুরু হয় কর্ম। আর, কর্ম থেকেই হয় সৃষ্টি। সৃষ্টিকে কেন্দ্র ক’রে সৃজনশীল মনে আবার একের পর এক চিন্তা—কল্পনা চলতে থাকে। তার থেকে জন্ম নেয় আরও নব নব সৃষ্টি।

তবে, অনেকসময়ে, যা কল্পনাতেও ছিলো না, —তা’ও সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে— ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার যৌথ কারবারে। অনেকসময়, চিন্তা ও ইচ্ছানুরূপ কাজ না হওয়া, সৃষ্টি না হওয়া— সফল না হওয়ার জন্য দায়ী হলো এই অনৈচ্ছিক ক্রিয়া— ভাগ্য! অনেকসময়েই, চিন্তাকে প্রভাবিত ক’রে থাকে— পরিচালিত ক’রে থাকে এই ভাগ্য।

অজ্ঞানতা জনিত মোহ-মায়াবশতঃ যতই বহুত্ব বোধ করুক সবাই, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর কিন্তু বহু হয়নি কখনোই। ‘এক’-ই রয়েছে সে। একটু ভালো ক’রে নিরীক্ষণ করলেই বুঝতে পারবে, —ঈশ্বর এখন পর্যন্ত পমাত্মার শরীরের বা ব্রহ্মাঞ্চলের যতটা অংশে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, তার মধ্যে এতটুকুও শূন্য নেই। সমস্ত স্থান জুড়ে হয় বস্তু— না হয় কোনো না কোনো শক্তি—কণা, আদিকণা অথবা আমাদের অজানা অন্য বস্তু— অন্য শক্তিতে ভরপুর হয়ে রয়েছে। আর তারই মধ্যে সূক্ষ্মভাবে ছড়িয়ে রয়েছে— দিব্য পদার্থ— পরম পদার্থ (বা ব্রহ্মপদার্থ) ও দিব্য চেতনা প্রভৃতি। স্বাতন্ত্র ও বহুত্ববোধ শুধু মনে। সৃষ্টির আদি থেকে মহাজগৎ ক্রমশ প্রসারিত হয়েই চলেছে, —‘বহু’ হয়নি কখনও।

কতকটা যেন, এক গামলা জলের মধ্যে— অনেকগুলি ছোট—বড় বরফের টুকরো। প্রতিটি টুকরো— প্রতিটি জলকণা মোহ-অজ্ঞানতা বশতঃ নিজেদেরকে এক একটি স্বতন্ত্র সত্তা ভাবছে। এইভাবেই মায়াত্মক বহুত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের মহাকাশকে মহাশূন্য বলা হলেও, তা’ কিন্তু মোটেই শূন্য বা খালি নয়। মহাবিশ্ব অখন্ড। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই এই মহাকাশও সৃষ্টি হয়েছে, এবং সে-ও মহাবিশ্বের মতোই ক্রমশ প্রসারমান।

এই প্রসঙ্গে বলি, মহাজাগতিক সময়েরও সৃষ্টি হয়েছে— মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই। মহাজাগতিক সময়— আর পরমাত্মার পারমাত্মিক সময় এক নয়। যেমন এক নয়— আমাদের পার্থিব সময়। মহাজগতের জন্মের পূর্বে, মহাজাগতিক সময় সৃষ্টির পূর্বে— ছিলো শুধু পারমাত্মিক বা পরম সময়। ‘সময়’ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছি অপর একটি অধ্যায়ে।

আমরা যেন এক মহা মায়ানদীর স্রোতের টানে ছুটে চলা বিন্দু বিন্দু জলকণারাশি। এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই কারো। ঘটনাচক্রে— বিকাশের মাত্রা অনুসারে, কেউ আছে নীচে, কেউ মাঝে আর কেউ উপরের স্রোতে। যে যেখানে— সেই মতো তার দর্শন। যে আছে একেবারে সবার ওপর তলে, একমাত্র সে-ই দেখতে পারছে— আকাশ, দেখতে পারছে— বাইরের দৃশ্যপট। বুঝতে পারছে তার প্রকৃত অবস্থাটা। বিচার করতে পারছে আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই, এই স্রোতকে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই তারও।

আনন্দ পেতে চেয়ে কর্ম-যজ্ঞে নেমে, না চেয়েও জ্ঞান লাভ হয়। তবু যদি আনন্দ না পেতে চায় কেউ, দুঃখ পেতে হবে জেনে, —কেউ যদি এগিয়ে না যায়, তাই— জ্বালাময়ী দুটি ক্ষুধা সর্বদা জ্বলছে এই দেহে। সেই সাথে আর আছে— রোগ-যন্ত্রনা, আত্মরক্ষার তাগিদ, —এদের মেটাতে গিয়ে ছুটতেই হবে। জ্বালা নেভাতে গিয়ে আরো জ্বালা বাড়ে, না চেয়েও জ্ঞান ও চেতনা বেড়ে ওঠে নিজেরই অজ্ঞাতে।

ওদের তাড়নায় এইভাবে চলতে চলতে— একটা সময় আসে, যখন জ্ঞান লাভেই আনন্দ অনুভূত হয়। ক্রমশ আত্মজ্ঞান— আত্মচেতনা, অন্তর্নিহিত সুপ্ত আত্মশক্তি বিকশিত হতে থাকে। অতঃপর একসময় যখন দিব্যসত্তাটি বিকশিত হয়ে ‘ঈশ্বর-আমি’-তে পর্যবসিত হয়, তখন পূর্ণতা লাভের** সাথে সাথে আসে অচলাবস্থা। এক আকার ধারণ করতেই, বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব হয় না আর। একাত্মবোধ— অবিলম্বে একীভূত—একাকার হওয়ার ডাক আসে।

অবশেষে, বিশ্বাত্মা বা ঈশ্বর-মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটার সাথে সাথেই তড়িৎ গতিতে— তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত অংশের— এমনকি অজ্ঞান-অন্ধকার অংশেরও পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তার সমস্ত অংশের অজ্ঞানতা-অন্ধত্ব-অন্ধকার দূর হয়ে— আলোকময় হয়ে ওঠে এক নিমেষে।

এদিকেও তখন দেখাযায়, নিকটবর্তী দুটি বিপরিত বিশ্ব— ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে একে অপরের অতি নিকটে চলে এসেছে মিলনের আকাঙ্খায়। শুধু আমদের বিশ্ব-ই নয়, অপরাপর বিশ্বগুলির ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা।

হঠাৎ এক সুতীব্র আলোর ঝলকানির সাথে সাথে ভোজবাজীর মতো সব নিমেষে উধাও! বিপরীত বিশ্বগুলির মিলনের মধ্য দিয়ে— ঘটে সৃষ্টিলীলার অবসান। এ ঘটনা শুধু আমাদের বিশ্ব এবং তার বিপরীত বিশ্বের ক্ষেত্রেই নয়, একই সময়ে, এই একই ঘটনা ঘটে অন্যান্য সমস্ত বিশ্ব এবং তাদের বিপরিত বিশ্বের ক্ষেত্রেও।

অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এক কল্প-নাটক দেখা শেষ ক’রে, পরিশ্রান্ত পরমাত্মা (বা পরমব্রহ্ম) নিজেকে সঁপে দেয় গভীর নিদ্রার কোলে।

‘মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন’ অধ্যায় এখানেই শেষ হলো। যাকে জানা দুষ্কর, জানলেও, ব্যক্ত করা কঠিন—, সেই অব্যক্ত পরমাত্মা বা ব্রহ্মের অতি কিঞ্চিৎ মাত্র ব্যক্ত করা সম্ভব হলো— শুধুমাত্র তার ইচ্ছাতেই। এ’টুকু নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে এখন।

===============================================================

।। সৃষ্টিতত্ত্বের গোপন রহস্য উন্মোচন ।।

বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর বা স্রষ্টা) এবং তদকর্তৃক সৃষ্ট এই জীবজগত সহ সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হলো এক ভার্চুয়াল অস্তিত্ব বা মায়া অস্তিত্ব। এ' হলো কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতোই অতি উন্নত মানের প্রোগ্রামীং কোড দ্বারা সৃষ্ট ও চালিত এক বিশাল ভিডিও গেমের মতো।

আমাদের বুদ্ধিমত্তা, যাকে আমরা প্রাকৃতিক বলে জানি, সেও আসলে আমাদের স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

আমরা যেমন নিজেরা ভার্চুয়াল অস্তিত্ব হয়েও, কম্পিউটার গেমের মধ্যে অনেক ভার্চুয়াল চরিত্র সহ ভার্চুয়াল জগত সৃষ্টি করছি, তেমনি বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর) নিজে এক মায়া অস্তিত্ব হয়েও, এই জীবজগত সহ আমাদের অনুভব যোগ্য তথাকথিত বাস্তব জগত সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বাত্মা (বা ঈশ্বর) সৃষ্ট উন্নত জীব মানুষ কর্তৃক এবং অন্যান্য গ্রহের এবং অন্যান্য বিশ্বের অতি উন্নত জীব (এলিয়েন ) অথবা এনিমেটেড ক‍্যারেকটারদের দ্বারাও আমাদের মতোই অনেক জায়গায় ভার্চুয়াল জগত সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে।

=======================================================

মহাজীবন চলার পথে বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর ও আমরা:

ঠিক আমাদের মতোই, সৃজন কালে— বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর মনের মধ্যেও ছিলো দুটি মন, দুটি অংশ-মন। একটি হলো— সচেতন মন বা কিশোর মন, আর অপরটি হলো— অবচেতন মন বা শিশুচেতন মন। তার এই অন্ধ-আবেগ সর্বস্ব— যুক্তি-বিচার-কান্ডজ্ঞান বিহিন, মোহ-মায়াময় মনটিই হলো— মহামায়া ! আর তৎকালে আংশিক বিকশিত— আংশিক জাগ্রত সচেতন মনটিই হলো— মহামন বা মহামানস। একেই অনেকে মহাদেব নামে অভিহিত ক’রে থাকে।

আমাদের মধ্যে— যাদের মনরাজ্যে প্রধানতঃ অবচেতন মনের রাজত্ব বা প্রভুত্ব চলছে, সচেতন মন তেমন জাগ্রত না হওয়ায়— সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা, তারা ঈশ্বরের অবচেতন বা শিশুমন— মহামায়ার ভক্ত ও উপাসক।

আর যাদের সচেতন মন অনেকাংশে বিকশিত— অনেকটাই সক্রিয় এবং অবচেতন মনের উপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম, —তারা ঈশ্বরের সচেতন বা কিশোর মনের ভক্ত এবং যুক্তি-বিচার ও জ্ঞান-পথের পথিক। মনের মিল হলে তবেই না তাকে ভালোলাগে !

ঠিক আমাদের মতোই— ঈশ্বরও চেতনার ক্রমবিকাশের পথ ধরে সর্বদা এগিয়ে চলেছে। ঈশ্বর এখন আর পূর্বের সেই চেতনস্তরে নেই, এখন সে অনেক উচ্চ চেতন স্তরে অবস্থান করছে।

আমরা তার দ্বারা— তার অংশ হতে সৃষ্ট জীবগণ বর্তমানে মানব-চেতন (বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের ক্ষেত্রে কিশোর চেতন) স্তরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সূক্ষ্ম চেতনস্তরে অবস্থান করছি, এবং ক্রমশ পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে (জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে) এগিয়ে চলেছি, ঠিক ঈশ্বরের মতোই!

আমরা বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের অংশ হলেও, —স্বতন্ত্র চেতন সত্তা হওয়ার কারণে এবং আমাদেরকে প্রথম সৃজন কালে, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের তৎকালীন চেতনস্তর থেকে অনেকটাই উচ্চ চেতনস্তরে অবস্থান করার ফলে, পৃথিবী থেকে বহুপূর্বে বিদায় নেওয়া আমাদের অগ্রজ বহু মানুষ— বহু উচ্চ চেতনস্তরে উন্নীত হয়ে— ক্রমে ঈশ্বরের নিকটবর্তী চেতন স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।

ঈশ্বরের (বিশ্বাত্মার) আয়ুষ্কাল অনেক বেশি হওয়ায়, ঈশ্বর-চেতনার বিকাশ ঘটে খুব ধীর গতিতে (দ্রষ্টব্যঃ ‘সময় ও বয়স’ প্রবন্ধ)। এক-একটি চেতন-স্তর অতিক্রম করতে— তার লক্ষ লক্ষ বছর (পৃথিবীর সময়ে) লেগে যায়। সে তুলনায় মানুষ বা মানুষের মতো চেতন-সত্তার ক্ষেত্রে এক-একটি চেতন-স্তর অতিক্রম করতে (পৃথিবীর সময়ে) সময় লাগে হাজার হাজার বছর। এই কারণেই, ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) মানুষের চাইতে চেতনায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও, মানুষের পক্ষে ঈশ্বর (বিশ্বাত্মা) চেতন-স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এছাড়া, ঈশ্বর ও মানুষ বা মনুষ্যতুল্য জীব বা সত্তা— উভয়ের ক্ষেত্রেই চেতনা যত বৃদ্ধি পাবে, চেতনা বিকাশের গতিও বৃদ্ধি পাবে ততই।

বর্তমানে আমরা কিন্তু ঈশ্বরের দ্বারা সরাসরি সৃজিত নই। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর কৃত স্বয়ংক্রিয় সৃজন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে—পরম্পরাগত ভাবে আমাদের জন্ম হচ্ছে এখন। একসময় আমরাও ক্রমবিকাশের পথ ধরে বিশ্বাত্মার (ঈশ্বর) চেতনস্তরে উপনীত হব। এটাই মহা জীবনচলা।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর ও আমরা : কয়েকটি সূত্র:

● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর কাউকে আলাদা ভাবে কৃপা করে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের কাছ থেকে পূজা ও তোষামোদ কামনা করে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর আমাদের কাউকেই শত্রু বা মিত্র কোনো দৃষ্টিতেই দেখে না। ● বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর যা দেওয়ার, যা করার প্রথম সৃজন কালেই করেছে, নতুন করে আর কিছু করার নেই তার। ● আমাদের উপর তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কোনোটাই হয় না সে। ● বিশ্বাত্মা/ঈশ্বর আমাদের ভাগ্য নিয়ন্তা নয়।

★ এখন আমাদের ভালো-মন্দ যাকিছু হচ্ছে বা ঘটছে, সে সবই হচ্ছে ভাগ্য ক্রমে বা জাগতিক ব‍্যবস্থাক্রমে। ★ ভাগ্য হলো জাগতিক ব‍্যবস্থার অন্তর্গত ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার মিলিত ফল।

◆ যা পরম্পরাগত অসংখ্য ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে আপনা থেকেই উদ্ভূত বিভিন্ন ঘটনা ফসল বা ফল। ◆ যা সৃষ্টি শুরু হওয়ার মূহুর্তেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে— কখন কোথায় কি ঘটবে। ◆ ভাগ্য ঈশ্বরের থেকেও বলবান। ঈশ্বরও ভাগ্যের অধীন।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মন :

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মন নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। যারা নিজের মনটাকেই এখনো ঠিকমতো বুঝতে বা জানতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বর-মনকে বোঝা বা জানা, তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা সত্যিই দুষ্কর।

মনকে বুঝতে হয় মন দিয়েই। আর তার জন্য প্রয়োজন হয়--- সজাগ-সচেতন-সত‍্যপ্রিয়, যথেষ্ট বিকশিত মুক্ত-মন।

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর-মনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করার পক্ষে এই নিদর্শনটি অনেকটা সহায়ক হবে আশাকরি---

মরণশীল জীবের বংশবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে--- তাদের অস্তিত্ব, বংশধারা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর যে কৌশল রচনা করেছে, তাতেই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। আর, বুদ্ধিমত্তাই হলো 'মন'-এর উপস্থিতির নিদর্শন। অর্থাৎ যেখানে বুদ্ধি আছে, সেখানে অবশ্যই মন আছে।

যেমন, কোথাও ধোঁয়া থাকলে--- আমরা সেখানে আগুনের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি সহজেই অনুমান করতে পারি।

এবার বলি, সেই কৌশলের কথা--- যৌন সুখের ব্যবস্থা করা এবং যৌনসুখের প্রতি জীবকে প্রলুব্ধ ক'রে তুলে, ---তার মধ্যে যৌন মিলনের তাড়নারূপ প্রোগ্রাম-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, জীবকে যৌনমিলনে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য ক'রে তোলার কৌশলটি অবশ্যই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।

খুঁজলে, এইরকম আরো অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে। আর একটু সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, দেখা যাবে--- আমাদেরকে স্বল্পচেতন মানব থেকে ক্রমশ উচ্চ--- আরও উচ্চ চেতনা ও জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ক'রে তোলার উদ্দেশ্যে , সে নানা প্রকার কৌশল তৈরী করেছে।

এছাড়াও, আরো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, সুদীর্ঘকাল ধরে ঈশ্বর-মনও ক্রমশ একটু একটু ক'রে বিকশিত হয়ে চলছে। মনোবিকাশের সাথে সাথে তার সৃজন ক্ষমতারও যে উন্নতি হয়েছে, তা তার ক্রমোন্নত (কীট থেকে আরম্ভ করে উন্নত মানুষ) সৃষ্টির দিকে তাকালেই তা' স্পষ্ট বোঝা যাবে।

আমাদের কাছে বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর অস্তিত্বের প্রমান--

বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হলে, আমাদের প্রমাণ করতে হবে--- ঈশ্বর-মনের অস্তিত্ব। আমাদের 'মহাবাদ' দর্শন অনুসারে --- আমরা মনে করি, সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডই হলো ঈশ্বর-শরীর বা ঈশ্বর।

এক্ষেত্রে, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের শরীর-অস্তিত্বের প্রমাণ দাখিল করার প্রয়োজন নেই। শুধু প্রমাণ করতে হবে, এই শরীরের মধ্যে একটি 'মহামন' আছে।

আমরা মনে করি, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেনি। সে নিজেই এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড। অর্থাৎ তার পিছনে এক সৃষ্টিকর্তা অথবা সৃষ্টিরহস্য আছে। এ'নিয়ে পূর্বেই আমাদের 'মহাবিশ্ব সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন' নামক সৃষ্টিতত্ত্বে যথাসম্ভব বর্ণনা করা হয়েছে।

এই দর্শনে আমরা দেখেছি, বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বর শুধু উদ্ভিদ ও জীব সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে এই জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ আবার সৃষ্টি করেছে অনেক কিছু।

বস্তুতঃ এই জীব সৃষ্টির কর্তা হলো ঈশ্বরের মন। আমাদের ক্ষেত্রেও, আমরা যাকিছু সৃষ্টি করছি--- তার প্রকৃত স্রষ্টা হলো আমাদের মন।

এখন, এই মনকে বুঝতে হয় মন দিয়ে। মনের অস্তিত্বকে সরাসরি দেখা বা অনুভব করা--- আমাদের অধিকাংশ স্বল্প চেতন মনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। মনের অস্তিত্বকে আমরা অনুভব করি--- মনের কার্যকলাপের মাধ্যমে।

মন হলো অনেকাংশে কম্পিউটার সফটওয়্যার-এর মতো একটি অতি উচ্চমানের সফটওয়্যার বিশেষ। এই সফটওয়ারের পিছনেও থাকে ডেভলপার---প্রোগ্রামার। এমনি এমনি কিছুই সৃষ্টি হয়ে যায় না।

মন সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে, ‘মন-আমি’ এবং ‘নিজের মনকে জানো’ পড়ুন।

=========================================================

**এই পূর্ণতা লাভ হলো— স্বতন্ত্র সত্তার পূর্ণ বিকাশ লাভ। ইশ্বরের পক্ষে পূর্ণতা লাভ বা পূর্ণ বিকাশলাভ সম্ভব। কিন্তু তা-ই ব’লে, পরমব্রহ্ম— পরমাত্মার পক্ষে তা’ সম্ভব নয়। বিশ্বাত্মা/ ঈশ্বরের পূর্ণ বিকাশ লাভ হলো— পুনরায় সৃষ্টিপূর্বের অবস্থায়, পরমাত্মার অবস্থানে ফিরে আসা।


Featured Posts
Recent Posts
Archive
Search By Tags
No tags yet.
Follow Us
  • Facebook Basic Square
  • Twitter Basic Square
  • Google+ Basic Square
bottom of page